শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পথে পথে ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্য

দিলীপ রায়
  ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

(গত সংখ্যার পর)

আমরা যখন ফেউয়া লেকে পৌঁছালাম তখন বিকাল ৪টা বেজে গেছে। তারপর হঠাৎ বৃষ্টি! সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টিটা চলল। যার জন্য আমরা সন্ধ্যার সময় ঝুঁকি নিলাম না। লেকে বোটিং করার আগে টিকেট সংগ্রহ করা জরুরি। টিকেট কাউন্টারে টিকেট কাটতে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তবুও বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। তাই পরের দিন নৌকা ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী পরের দিন ভোরবেলায় শরণকোটের টাউয়ার থেকে পর্বতের ভিউ ও সূর্য ওঠা দেখে লেকে বোটিংয়ের জন্য ছুটলাম। দুইজনের জন্য ছোট নৌকা। নৌকার মাঝি স্থানীয়। তার মুখে গল্প শুনছিলাম। লেকে অনেক ধরনের মাছ। মাছ ধরার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ রয়েছেন। তারা ছাড়া কেউ মাছ ধরতে গেলে পারমিশন লাগে। তা ছাড়া পাহাড় থেকে অনেক ধরনের হিংস্র জন্তু জানোয়ার জল খেতে লেকের ধারে চলে আসে। এমনকি চিতা বাঘও দেখা যায়। অন্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মাঝি তাদের কর্ম জীবনের কাহিনী শোনাল। তারা শুধু নৌকার বাহক। নৌকার লাইন থাকে। কপাল ভালো থাকলে সারাদিনে তিনটি ট্রিপ পায়। নতুবা দুটিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। নূ্যনতম মজুরি যেটা খুব কম। সেই মজুরিতে তাদের সংসার চালানো খুব কঠিন। উপরন্তু গত দুবছর অতি মহামারির কারণে তাদের কাজ বন্ধ ছিল। এবছর নাকি কেবলমাত্র কিছুদিন আগে থেকে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। পোখরা ভ্রমণের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ফেউয়া লেক।

সামান্য মৃদুমন্দ বাতাসে, খোলা আকাশের নিচে নৌকা ভ্রমণ আমাদের চিত্ত ভরিয়ে দিল। ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টা নৌকা ভ্রমণ। তবে লেকের মাঝখানের মন্দিরে অবশ্যই নিয়ে যাবে। অনেকে মন্দিরে নেমে পুজা দেন। সব ব্যবস্থা সেখানে রয়েছে। পরিষ্কার আকাশ থাকার জন্য আমাদের নৌকা ভ্রমণ ভীষণ আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। নৌকা ভ্রমণ শেষে হোটেলে ছুটলাম।

ভোর ৫টায় ড্রাইভারের ডাক। সময় কম। শিগ্‌গির চলুন। শরণকোট (ঝধৎধহমশড়ঃ)। শরণকোট নেপালের কাস্কি জেলায় পোখরার কাছে অবস্থিত। পোখরার পশ্চিমদিকে ৫ কিমি দূরে ও ১৫৯২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। পোখরার শরণকোট পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে পর্বতমালার অপূর্ব দৃশ্য দর্শন করা যায়। এমনকি শরণকোটের উপর থেকে ফেউয়া লেক পরিষ্কার দেখা যায়। পর্যটকরা এখানে আসে সূর্য ওঠা দেখতে। টাউয়ার থেকে সূর্য ওঠা দেখা পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। পর্বতশৃঙ্গের সূর্যের অন্যদিকে অন্নপূর্ণা ও ফিসটেল। অভূতপূর্ব দৃশ্য। টাউয়ার থেকে পর্বতগুলো ছবির মতো দেখতে। গুরুত্বপূর্ণ দুটি পর্বতের মধ্যে ফিসটেলের উচ্চতা ৬৯৯৭ মিটার এবং অন্নপূর্ণা ৭৫৫৫ মিটার উচ্চতা। অথচ শরণকোট ভিউ পয়েন্টের উচ্চতা অনেক বেশি, ১৫৯২ মিটার। একটা জায়গার পর গাড়ি আর উপরে উঠতে পারে না। তারপর হেঁটে ওঠা। খাড়া সিঁড়ি। হেঁটে ওঠা পরিশ্রম সাপেক্ষ। জিরিয়ে জিরিয়ে আমাদের উঠতে হয়েছিল। সিঁড়ি গুলো প্রচন্ড খাড়াই। কয়েকটি সিঁড়ি উঠলে ছেলে-বুড়ো সবাইকে হাঁপিয়ে যেতে হয়। নামার সময় আমরা গণনা করে দেখলাম, মোট ৩৫০টি সিঁড়ির ধাপ। কিন্তু ভিউ পয়েন্টে ওঠার পর অফুরন্ত আনন্দ। আনন্দের ঘনঘটা বোঝানো দুঃসাধ্য। চারিদিকে পাহাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য। পূর্বদিকে তখন সূর্যের রক্তিম আভা। পরিষ্কার আকশে ধীরে ধীরে সূর্যের আগমন। মনোরম দৃশ্য আমাদের মন ভরিয়ে দিল। শরণকোট ভিউ পয়েন্টের টাউয়ারে একজন মাসি লিকার চা বিক্রিতে ব্যস্ত। ওই সকাল বেলায় অতটা উচ্চতায় বসে ঠান্ডার মধ্যে এক কাপ লিকার চা ও দুটি বিস্কুট পাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেল। একদিকে সূর্য ওঠা এবং অন্যদিকে অন্নপূর্ণা ও ফিসটেলের অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়ায় নেপাল ভ্রমণের সার্থকতা সঠিক অর্থে খুঁজে পাওয়া গেল। তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামা। তারপর সোজা ফেউয়া লেক। উদ্দেশ্য বোটিং।

শরণকোট ভিউ পয়েন্ট ও ফেউয়া লেকের বোটিং শেষে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে আবার বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য শান্তি স্তুপা। আনন্দু (অহধহফঁ ঐরষষ) পর্বতের উপর তৈরি করা খুব সুন্দর একটি প্যাগোডা। বুদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য। শান্তি স্তুপা তৈরি হয়েছিল শান্তির প্রতীক হিসেবে। সারা বিশ্বে যে কটা শান্তি স্তুপা, তার মধ্যে দুটি নেপালে। একটি পোখরায় এবং অন্যটি লুম্বিনীতে। পোখরার শান্তি স্তুপা নেপালে বিশ্বের প্রথম শান্তি স্তুপা। এখানে মেডিটেশনের জন্য বহু মানুষ আসেন। পাহাড়ের উপর এই প্যাগোডা থেকে ফেউয়া লেক বা পোখরা শহর সুন্দর দেখা যায়। শান্তি স্তুপার পাশ দিয়ে নানান ধরনের দ্রব্যের বাজার। বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মানুষের প্রার্থনার সমস্ত রকম উপকরণ পাওয়া যায়। আমরা যখন পুরো এলাকাটা ঘুরলাম, সেই সময় মূল গেটটা তখনও খোলেনি। তবে উল্টোদিকের বিল্ডিংয়ের বারান্দা থেকে সমস্তটাই আমরা উপভোগ করতে পারলাম।

শান্তি স্তুপা থেকে বের হয়ে আমরা ঢুকলাম ডেভিস ফলসে (উবার'ং ঋধষষং)। টিকেট সিস্টেম রয়েছে। কাস্কি জেলায় পোখরার মধ্যে এই ডেভিস ফলস। মূলত ফেউয়া লেকের জল এই ঝর্ণার উৎস। টানেল দিয়ে ঝর্ণার জল নেমে আসছে। টানেলটি মোটামুটি ৫০০ ফুট লম্বা। ডেভিস ফলসে একটি ঘটনা ঘটার পর ফলসটির নাম রাখা হয় ডেভিস ফলস। ১৯৬১ সালের ৩১ জুলাই এক সু্যইস দম্পতি ফলস দেখতে আসে। তখন ফলসের জলের প্রচন্ড উচ্ছ্বাস। ফলসের জলে অতর্কিতে 'ডাভি' নামে ওই সু্যইস মহিলা পড়ে যান এবং জলে ডুবে মারা যান। তার নামে ফলসটির নাম রাখা হয় ডেভিস ফলস। যাই হোক আমরা এপ্রিল মাসের শেষদিকে যাওয়ার দরুন নাকি ফলসে তেমন জলের উচ্ছ্বাস নেই। তারপর ফলস থেকে উপরে উঠে এলাম। লাগোয়া বাগান। বাগানের মধ্যে একটি বুদ্ধের মুর্তি। সামনে লেখা রয়েছে 'খড়ৎফ ইঁফফযধ। একটা জায়গায় বাউন্ডারি ওয়ালে লেখা আছে 'ঠরংরঃ ঘবঢ়ধষ'। বাগান পার হলে অনেক দোকান। রকমারী জিনিসপত্র সাজিয়ে বসে রয়েছেন। বাঙালি টুরিস্টদের সঙ্গে কথা বলার জন্য দোকানদাররা অল্প বিস্তর বাংলাও জানেন। সব মিলিয়ে জায়গাটা ভীষণ উপভোগ করলাম।

ডেভিস ফলসের অদূরে এবং উল্টোদিকে গুপ্তেশ্বর মহাদেব গুহা (এঁঢ়ঃবংযড়িৎ গধযধফবা ঈধাব, চড়শযধৎধ, ঘবঢ়ধষ)। তবে এটা একটা গুহা মন্দির। গুহা মন্দিরটি মহাপ্রভু মহাদেবের প্রতি উৎসর্গীকৃত। গুহায় ঢুকতে গেলে প্রবেশ ফি রয়েছে। টিকেট কেটে গুহার প্রবেশ পথে পৌঁছে দেখলাম, হিন্দুদের অনেক ধরনের ঠাকুর দেবতাদের নিপুণ হাতে ছবি আঁকা রয়েছে। বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে নামার রাস্তা। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই গুহাকে 'শিবা লিঙ্গামের' পুরানো ঘর মনে করা হয়। গুহাটি দুটো ভাগে বিভাজিত। প্রথমটি নিচের দিকে ৪০ মিটার সিঁড়ি বেয়ে হাঁটলেই দেখা যাবে শিব লিঙ্গ। সেখানে মহাদেবের পুজা হচ্ছে। শিব লিঙ্গের ফটো তোলা নিষেধ। তারপর আনুমানিক ১০০ মিটার বা তারও বেশি নিচের দিকে সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে নামলে দেখা যাবে ডেভিস ফলসের কিছু অংশ। নিচে ফলসের জল গড়িয়ে পড়ছে। পুরো সিঁড়িটা পাহাড় কেটে তৈরি। অন্ধকারের মধ্যে কিছু বিজলী বাতি থাকার জন্য রক্ষে। পাহাড় থেকে চুঁইয়ে পড়া জলে ভেজা সিঁড়ি বেয়ে হাঁটাটা ঝুঁকিবহুল। তবুও দেখলাম বিদেশিরা ঝটাপট হেঁটে গুহার অন্দরমহলে ঢুকে যাচ্ছে। একটা জায়গায় পাহাড় কেটে সিঁড়ি তৈরি সম্ভব না হওয়ায় সেখানে লোহার সিঁড়ি লাগানো। অন্ধকারাচ্ছন্ন ভিজে স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে আমাদের একটু ভয় ভয় লাগছিল। তবে শারীরিক স্থিতি ও মনের জোর সাংঘাতিক। তার জন্য বুকে অদম্য সাহস রেখে নেমে গেলাম। পাহাড় চুঁইয়ে জল গড়াচ্ছে। সেই জল মাথায় পড়তে বাধ্য। টুপি থাকায় বেঁচেগেছি। মাথা ভেজেনি। গুহার ভেতরের জলপ্রপাত দেখে পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেও খুব ঝকমারি। একটু অসাবধানতায় বিপদ অনিবার্য। তাই শঙ্কা মেশানো ভয়ার্ত এক নতুন অভিজ্ঞতা!

\হ( ৩)

লুম্বিনী। খুব সকালে হোটেল থেকে বের হলাম। ড্রাইভার যদিও জানিয়েছিল রাস্তাঘাটের অবস্থা তেমন ভালো না। আমরা ততটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু বাস্তবে ড্রাইভারের কথাই ঠিক। পোখরা থেকে অনেকটা দূরের পথ লুম্বিনী। পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তাঘাটের অবস্থা তথৈবচ। পৌঁছাতে অনেক সময় নিল। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানোটাও ভীষণ ঝুঁকির। ভাঙাচোরা রাস্তার জন্য গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমরা ক্লান্ত। তবুও লুম্বিনীতে ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান দেখার আনন্দে আমরা বিহ্বল। আমরা জানি, সিদ্ধার্থের বুদ্ধ লাভের মধ্যে দিয়েই জগতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তিত হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে বুদ্ধই ভগবান। বৌদ্ধমতে, সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি অর্জন, মূল উদ্দেশ্য। লুম্বিনীর মায়াদেবী মন্দিরের কাছে হোটেল। হোটেল থেকে হাঁটা পথে ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান। জায়গাটা ভারী সুন্দর। দ্রম্নত গতিতে এলাকার উন্নয়ন হচ্ছে, সেটা কাজ কর্মের গতিধারা দেখলে সহজেই অনুমেয়। আগামীদিনে এলাকাটা পর্যটকদের মনোরঞ্জন করতে যে সমর্থ হবে, সরকারি কাজ কর্ম দেখে সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।

লুম্বিনী একটা বৌদ্ধধর্মীয় তীর্থস্থান যা কিনা নেপালের রূপাদি জেলায় অবস্থিত। এই স্থানেই রাণি মায়াদেবী 'সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ'কে জন্ম দান করেন। সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ থেকে ৫৪৩ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধ নামে ধর্ম প্রচার করেন। তার জীবনের সঙ্গে জড়িত চারটি স্থান- লুম্বিনী, কুশীনগর, বুদ্ধ গয়া এবং সারনাথ। স্থানগুলো এখন মহাতীর্থ নামে খ্যাত।

লুম্বিনীতে গৌতম বুদ্ধ ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। এখানে মায়াদেবী মন্দিরসহ আরও অনেক মন্দির রয়েছে। লুম্বিনী ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশ-বিদেশের মনাস্টারি রয়েছে। এখানেই পবিত্র পুষ্করিণী যেখানে মাতা মায়াদেবী গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে প্রথাগত স্থান করেছিলেন। আমরা জানি, ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো লুম্বিনীকে ওয়ার্ল্ড হেরিটাজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত করে। শোনা যায়, সম্রাট অশোক তার রাজ্য অভিষেকের বিশ বছরে দ্বিতীয়বার লুম্বিনী আগমন করেন। সম্রাট অশোক খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৯-এ ভগবান বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীতে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মস্থান চিরস্মরণীয় করে রাখতে স্তম্ভ নির্মাণ করেন, যেটা 'অশোক-স্তম্ভ' নামে বিশ্বখ্যাত। উলেস্নখ থাকে যে, সম্প্রতি আমাদের দেশের (ভারতের) প্রধানমন্ত্রী ১৬ মে, ২০২২ ওই অশোক স্তম্ভে প্রদীপ প্রজ্বালন করে শ্রদ্ধা জানান। নেপালের প্রধানমন্ত্রী তার সফরসঙ্গী ছিলেন। আজও সন্ধ্যাবেলায় সেখানে প্রদীপ প্রজ্বালনের রেওয়াজ অবিরত। (ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন প্রদীপ প্রজ্বালনের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে!)

মায়াদেবী মন্দিরের ঠিক লাগোয়া যে পুষ্করিণী, সেটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভগবান বুদ্ধের জন্ম কাহিনী। পুষ্করিণীর পাশেই লুম্বিনী গার্ডেন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম বৈশাখী পূর্ণিমার দিন লুম্বিনী গার্ডেনে গাছের নিচে। শোনা যায়, গৌতম বুদ্ধের মা গর্ভাবস্থায় সাদা হাতি ও পদ্ম ফুলের স্বপ্ন দেখেন। আরও শোনা যায়, গৌতম বুদ্ধের মা গর্ভাবস্থায় বাবার বাড়ি যাওয়ার পথে লুম্বিনী বাগানে থামেন। জলাশয়ের পাশেই সেই বোধিবৃক্ষগুলো। আগেকার বাড়ি ঘরের নির্মাণের অনেক ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান।

বর্তমানে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানের জন্য বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে 'লুম্বিনী' পবিত্র তীর্থক্ষেত্র হিসেবে অন্যতম। যদিও পূর্বে উলেস্নখ করেছি তবুও জানাই যে, বৌদ্ধদের কাছে চারটি মহাতীর্থ- যেমন লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ ও কুশীনগর। মহাতীর্থ হিসেবে লুম্বিনী অন্যতম। বৈশাখী পূর্ণিমার দিন দেশ-বিদেশ থেকে আগত প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। মায়াদেবী মন্দিরের চারিদিকে অনেক বোধিবৃক্ষ। আমরা জানি, যে অশ্বত্থ গাছের নিচে তপস্যা করতে করতে গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন সেই গাছের নাম বোধিবৃক্ষ। সূর্যাস্তের সময় সূর্যের রক্তিম আভায় জায়গাটার মাধুর্য অন্যমাত্রা পেল। মনটাকে শান্ত-স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিল। তারপর সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলে ওঠে। আমরাও প্রদীপ জ্বালালাম। প্রজ্বালিত প্রদীপের মধ্যেও একটা সুন্দর অনুভূতি। যেগুলো লিখে বোঝানো কঠিন। দূর থেকে ভেসে আসছে, 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি'। বৌদ্ধস্তুতি শুনে মনটা বুদ্ধ ভক্তিতে ভরে উঠল।

দূরে বৌদ্ধ স্তুপাকে কেন্দ্র করে রয়েছে চির শান্তির শিখা। শান্তির শিখা থেকে বৌদ্ধ স্তুপা বা মঠ পর্যন্ত সোজা জলাশয়। বৌদ্ধ স্তুপাকে অনেকে বৌদ্ধ মঠও বলে। জলাশয়ের দুপাশে ইট দিয়ে বাঁধানো এবং তার পাশ দিয়ে প্রচুর গাছ। শান্তি শিখা থেকে তাকালে অনেক দূরে দেখা যায় বৌদ্ধ-মন্দির বা বৌদ্ধ-মঠ। শান্তির শিখার প্রজ্বালনের কাছে যেসব সিকিউরিটি তাদের কাছে জানতে পারলাম, ওই শান্তির শিখার প্রজ্বালন নাকি কখনই নেভে না। এমনকি ভারী বর্ষায়ও নেভে না। যদিও তার সত্যতা যাচাই হয়নি। শান্তির শিখার প্রজ্বালনের উল্টোদিকে অর্থাৎ বৌদ্ধমন্দিরের সোজা বরাবর লুম্বিনীর মায়া মন্দির। লুম্বিনীর গার্ডেন। ঠাকুর বৌদ্ধের জন্মস্থান। সুতরাং লুম্বিনীর গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান মায়াদেবীর মন্দির থেকে তাকালে বৌদ্ধ-মঠ দেখা যায়। ভারী সুন্দর একটা অনুভূতির পবিত্র স্থান! ইদানীং পুরো লুম্বিনী এলাকাটায় সংস্কারের কাজ চলছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লুম্বিনী এলাকার উন্নয়ন সারা বিশ্বের নজরে পড়বে, আমাদের ধারণা।

বৌদ্ধ-মঠ ঘুরে দেখলাম। অনেক বড় এলাকা। বেশ কয়েকজন বুদ্ধভক্ত পর্যটক আবার ধ্যানে মগ্ন। খোলামেলা জায়গা। বুদ্ধদেবের মূর্তি যেটা রয়েছে সেটা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। বৌদ্ধ মঠের সামনে ছোট একটি জলাশয়। জলাশয়টি পদ্ম গাছে ভর্তি। সুন্দর মনোরম দৃশ্য। সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেল। কেননা, পরের দিন চিতোয়ানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু।

লুম্বিনী ছেড়ে রওনা দিলাম চিতোয়ানের উদ্দেশে।

পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখলাম। অপূর্ব নিদর্শন। সারস্বত ধামে মহাদেবের মন্দির বিশেষ আকর্ষণ। ১০৮টি শিব লিঙ্গ। খোলা আকাশের নিচে প্রতিষ্ঠিত। বুদ্ধের মূর্তি দেখলে মনটা ভক্তিতে ভরে যায়। ভারী সুন্দর মনোমুগ্ধকর পবিত্র জায়গা। জিরিয়ে এক কাপ কফির তেষ্টা পেলে তার খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে সুন্দর একটি রেস্টুরেন্ট। সেখানে চা-স্নাক্স পাওয়া যায়। আমরা যখন পৌছাঁলাম তখন প্রখর রৌদ্র। সেটা নাকি নেপাল দেশে সবচেয়ে বড় প্রখর রৌদ্রের তাপ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এত রৌদ্র অথচ কপালে ঘাম নেই। সুতরাং সূর্যের তাপের তাপমাত্রা সহজেই অনুমেয়। কয়েক একর জমি নিয়ে মন্দির। ভক্তদের থাকার সুন্দর ব্যবস্থাপনা। ভেতরে সিনেমা দেখার ছোট একটা হল (ঈরহবসধ ঐধষষ)। সেখানে ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানো হয়। সম্পূর্ণ বিনা খরচে। ওই ফিল্মের মাধ্যমে অনেক কিছু জানা যায়। এছাড়া রয়েছে মিউজিয়াম। অনেক সংগৃহীত ছবি। গোটা এলাকাটা ঘুরে আধ্যাত্মিক একটা উপলব্ধি অনুভব করলাম।

রত্ননগর, বদ্রেনী, চিতোয়ানের শেষ সীমানা। চিতোয়ানের শেষ মাথায় পৌঁছে দেখলাম নদী পার হওয়ার ঝুলন্ত ব্রীজ। নদী না বলে বলা ভালো জলাশয়। জলাশয় পার হলেই গভীর বন। বন থেকে হরদম হিংস্র জন্তু জানোয়ার জলাশয়ের কিনারে আসে জল খেতে। তবে চারিদিকে কড়া পাহাড়াদার। ঝুলন্ত ব্রিজ পার হলে পোষা হাতির দল দেখা যায়। কৌতুহলবশত আমরাও ব্রীজ পার হওয়ার উদ্দেশে ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ চিৎকার! 'কেউ ব্রিজ পার হবেন না।' সিকিউরিটি সবাইকে ব্রিজের উপর থাকতে নির্দেশ দিল। ব্রিজ থেকে তাকিয়ে দেখলাম, একদল বুনো হাতি জল খেতে জলাশয়ে নামল। জল খাওয়ার পর তারা চলে যেতেই প্রকান্ড একটা গন্ডারের আবির্ভাব। সে বেচারা জলে নেমে খানিকক্ষণ জলকেলি করে হেলতে-দুলতে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। ব্রিজের উপরের সমস্ত পর্যটক তখন হাতি ও গন্ডার দেখতে পেয়ে বিস্ময়ে হতবাক!

তারপর নিচে নেমে ছোট ছোট কটেজে চা খেতে ঢুকলাম। বদ্রেনীর রত্ননগরের চায়ের দোকানগুলো অদ্ভুত ধরনের। চা ছাড়াও কোল্ড ড্রিঙ্ক, ডিমের ওমলেট বা অন্যান্য স্নাক্স চাইলেই পাওয়া যায়। চায়ের সঙ্গে আমরা টা অর্থাৎ বিস্কুট চাইলাম। কিন্তু সেখানে প্যাকেট খোলা সিঙ্গল বিস্কুট পাওয়া কঠিন। বিস্কুটের প্যাকেট কেনার সিস্টেম। কফি খাওয়ার পর আমরা ছুটলাম, থারু ড্যান্স দেখতে। টিকেট কেটে থিয়েটার হলের সামনে অপেক্ষা। তারপর ঠিক সন্ধ্যা ৮টায় অনুষ্ঠান শুরু। তাদের নিজস্ব ড্রেস। জানা গেল পার্ফমেন্সে যোগদানকারী সবাই অল্প বয়সের। তা ছাড়া থারু ড্যান্সে তারা অনেক বেশি পরিপক্ক।

দর্শকে হল ঘর ভর্তি। বেশির ভাগ দর্শক বিদেশি পর্যটক। হাতে গোনা কয়েকজন ভারতীয় পর্যটক। থারু ড্যান্স চলাকালীন সব দর্শক চুপচাপ। ঢুলির সঙ্গে অন্য বাজনার পরিবেশনও মনোমুগ্ধকর। পুরো অনুষ্ঠানটি ভালো লাগল। রিসোর্টে এসে ডিনার সেরে রুমে ঢুকে পড়লাম। থারু সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন দেখে আমরা ভীষণ খুশি।

পরের দিন সকালে ভোর ৬টায় ব্রেকফার্স্ট রেডি। তারপর ছুটলাম চিতোয়ান ন্যাশনাল পার্কে জঙ্গল সাফারির উদ্দেশে। জিপ সাফারি মোট চার ঘণ্টার বেশি সময়ের। নদী এপার-ওপার হওয়া, উদ্যানের মধ্যখানে ক্রোকোডাইল ফ্রিডিং সেন্টারে কিছুক্ষণ ঘোরা, ইত্যাদি নিয়ে মোট পাঁচ ঘণ্টার হ্যাপা। ইতোমধ্যে ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশের জন্য সরকারি টিকেট হাতে এসে পৌঁছাল। টিকেট নিয়ে নদী পার হওয়ার জন্য ঘাটে এসে পৌঁছালাম। উলেস্নখ থাকে যে, চিতোয়ান জঙ্গল সাফারিতে পৌঁছানোর শুরুতে একটা দীর্ঘদিনের নদী। সেটা পার হতে হয়। যখন ঘাটে পৌঁছালাম, পূর্বদিকে তখন সূর্য প্রজ্জ্বলিত। ঘড়িতে তখন সকাল ৭টা বেজে গেছে। চারিদিকে প্রচুর সিকিউরিটি।

\হশোনা যায়, চিতোয়ান জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৭০০ প্রজাতির অধিক বন্যপ্রাণ ও গাছপালা দিয়ে বিস্তৃত। যদিও প্রজাপতি মথ, মথ এবং পোকা প্রজাতির সংখ্যা জানা যায়নি। এছাড়া শঙ্খচূড়া এবং শিলা পাইথনসহ সাপের অন্যান্য ১৭টি প্রজাতি, তারকা কচ্ছপ এবং গুই সাপ রয়েছে। ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে, নারায়ণী নদীতে ২৩৫টি ঘড়িয়াল ছিল। সংখ্যাটা এখন অনেক কমে গেছে। প্রতি বছর ওই নদী থেকে ঘড়িয়ালের ডিম সংগ্রহ করে, ঘড়িয়াল সংরক্ষণ প্রকল্পে ছানাগুলো বড় করা হয়। তবে আরও জানা যায়, ওই জাতীয় ছানা শেষ পর্যন্ত বাঁচে কম। এছাড়া রয়েছে হিংস্র জন্তু জানোয়ার। যেমন বাঘ এমনকি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, গন্ডার (একটা শিং-যুক্ত গন্ডারের সংখ্যা বেশি), হাতি, ইত্যাদি। রয়েছে হরিণ, ময়ূর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার।

নদী পার হওয়ার আগেই সরকারি-স্বীকৃত গাইড এসে হাজির। তিনি ঘনশ্যাম লামা। তবে লামা নামেই বেশি পরিচিত। দাঁত বের করে হেসে বলল, 'জঙ্গল সাফারির গাইড।' হিংস্র জন্তু জানোয়ার থেকে লামা হচ্ছে আমাদের রক্ষাকর্তা। আমাদের কাছ থেকে টিকেট নিয়ে নদীর পারে অপেক্ষা করতে বলল। নদী পার হওয়ার ক্ষেত্রে নাকি নেপালি মিলিটারিদের অনুমতি লাগে। লামা পারমিশন আনতে যাওয়ার ফাঁকে নদীটা ভালো করে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছিলাম। অনেক কুমীর নদীর কিনারে শুয়ে আছে। নদীর জলেও বড় বড় মাছ। ঔৎসুক্যদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। লামাই বুঝিয়ে দিল, ওই কুমীরগুলো নাকি কোনো ক্ষতি করে না। নদীর জলে তাদের আনাগোনা। মাছগুলো রয়েছে কুমীরের খাদ্য হিসেবে। তাই নদীতে মাছ ধরা নিষেধ।

পার হওয়াটাতেও অভিনবত্ব। নামে ডিঙি নৌকা। কিন্তু তার আকৃতি বা গঠন অন্যরকম। কিছুটা তালের ডোঙার মতো। জানা যায়, একটা গাছের গুঁড়ি মাঝখান থেকে কেটে নৌকা তৈরি। নৌকায় উঠলে শরীরের ভারসাম্য রাখাটা খুব ঝুঁকির। তবে নৌকার মাঝি ভীষণ সতর্ক। ডিঙির মধ্যখানে ছোট ছোট জল-চৌকি রাখা আছে। জল-চৌকিতে লাইন দিয়ে বসলে একটা ডিঙি নৌকায় মোটামুটি ৭-৮ জন পার হতে পারে। ডিঙি নৌকায় উঠে বসলাম। জলে স্রোত আছে। তবে নদীর জলের গভীরতা খুব কম। একেবারেই ঢেউ ছিল না। নদীর প্রশস্ততা খুব স্বল্প। যার জন্য পার হতে কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

\হনদী পার হওয়ার পর বালি মাটিতে কিছুটা হাঁটার পথ! তারপর জঙ্গল সাফারি করার জিপ দাঁড়িয়ে। গাইডম্যান লামা সব সময় পেছনে পেছনে। তার হাতে একটা দূরবীন। সে আমাদের নিয়ে জিপে বসালো। ছইবিহীন খোলা জিপ। তবে বসার সুন্দর চেয়ার। শক্তপোক্ত গাড়ি। ছইওয়ালা জিপের চেয়েও মজবুত। জঙ্গল সাফারি শুরু হলো ঠিক সকাল ৮টায়। সকালে সুন্দর মিষ্টি-মধুর আবহাওয়া। প্রথমেই রাস্তার উপরে ময়ূর দর্শন। পেখম তুলে দন্ডায়মান। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, জঙ্গলের রাস্তা খুব ছোট। তবে অতটা জল কাঁদা নেই। রাস্তার দুপাশে নানান প্রজাতির গাছগাছালিতে ভর্তি। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। পুরোটাই অসমতল। জিপ চালাচ্ছে, তবে ভীষণ ধীর গতিতে। ধীর গতি রাখার আরও একটি কারণ, জোরে চালালে গাড়ির শব্দে জন্তু জানোয়াররা ভয়ে পালাবে। তাহলে জিপ সাফারির মজাটাই পাওয়া যাবে না। জিপ এগোচ্ছে। হঠাৎ জিপ দাঁড়িয়ে গেল। অদূরে একটি-শিংওয়ালা গন্ডার দাঁড়িয়ে। একেবারে কাছে না থাকায় ফটো তুলে আরাম পাওয়া গেল না। তারপর গন্ডারটি জলাশয়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

চিতোয়ানে ফিরছি। জিপ থেকে আমরা নদীর কিনারে নামলাম। আবার নদী পার হওয়ার পালা। নদীর পারে গাড়ি দাঁড়িয়ে। কাঠমান্ডু ফেরার পালা। তাই রিসোর্টে ফিরে দুপুরের লাঞ্চ সারলাম। তারপর আমরা কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা দিলাম।

কাঠমান্ডু শহরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের নিজস্ব খাবার জেনে নিয়ে সেই খাবার খেয়ে তৃপ্তি পেলাম। সারাদিন এলোপাতাড়ি ঘুরেফিরে সময় কাটালাম। বলা চলে উদ্দেশ্যহীনভাবে। নেপালী ভাষা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলাম। ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্রে হিন্দি-বাংলার মিশ্রণ উপলব্ধি করলাম। তবে নেপালীদের অমায়িক ব্যবহার আমাকে মন ভরিয়ে দিয়েছে। তাদের মিষ্টি-মধুর ব্যবহারে আমরা বিহ্বল। নেপালীদের জন্য আমাদের অনেক অনেক শুভকামনা। (শেষ)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে