অনাকাক্সিক্ষত এক ভয়

প্রকাশ | ২১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

স্বপ্না রেজা
ঘরে ফেরা হলো দিনের সব আলো বিদায় দিয়ে। কিছুদিন আগেও দিনের আলো থাকত ঘরে ফেরা পযর্ন্ত। এখন দিনের তড়িঘড়ি। তাড়াতাড়ি ফিরে রাতকে পাঠিয়ে দেয়া। রাত আর দিনের চুক্তি। শীতকালের এমন আচরণ মন্দ লাগে না রমলার। কলিংবেলে আঙুল স্পশর্ করা মাত্রই দরজা খুলে যায়। চল্লিশোধর্ সখিনা বেগম দরজা খুলে দেয়। এলোমেলো চুল। পানের রসে ঠেঁাট লাল টসটসে। হাসিও আছে গুটিসুটি হয়ে। রমলার ঘরবাড়ি সামলাবার দায়িত্ব পেয়েছে মাত্র এক দিন হলো। অথচ ভাবটা এক বছরের। কিছু মানুষ এমন আচরণ করতে অভ্যস্ত। আপন করে নেয়ার সহজাত ভাব বজায় রেখে চলে। সম্পকর্ গড়ে। খারাপ লাগেনি। বরং ভালো লেগেছিল প্রথম সাক্ষাতে। ভালোলাগার কথা প্রকাশও করেছিল। নীরব সে কথা শুনে নীরবে হেসেছে। তবে আস্তে করে জানতে চেয়েছে, এ জগতে কোন মানুষটাকে তোমার ভালো লাগেনি, বলতে পারবে। উত্তর করার তাড়া বোধ করেনি রমলা। মন বলেছে, নীরব তাকে অবমূল্যায়ন করতে পছন্দ করে। হয়তো এই প্রশ্নটা তারই অংশ। বেশ ব্যস্ততা সখিনা বেগমের। খুব প্রিয় এক কাপ চা এমন সময়ে হাতে পাওয়া। আগের বুয়া বুঝিয়ে, শুনিয়ে গেছে। আহা কী মায়া, যে গেল তার। থেকে গেল তাও এক বছর। যাবার আগে কত টান বুঝিয়ে গেল। মুখ ফুটে বলেও ফেলে রমলা, না হয় ফিরে এসো আবার। আমি অপেক্ষা করি তোমার জন্য। মৃদু হেসে বলেছে বুয়া, ‘ঢাকা শহরে কাম করতে আইলে তুমার কাছেই আইতাম। কথা দিলাম।’ শেষে আবার না আসার কথা শুনিয়েছে। স্বামীর শরীর খারাপ, সেই অস্থিরতায় কাজ ছেড়ে যাওয়া। প্রতিমাসে বেতনের টাকা স্বামীর কাছে বিকাশ করে পাঠিয়েছে। একদিন দেরি হলে গলা ভার করে বলেছে, ‘স্বামীর অসুখ গো আপা। টাকাটা বিকাশ কইরেন।’ সখিনা বেগম হাতে তুলে দেয়, ধোয়া ওড়া এক কাপ গরম চা। সারা দিনের অফিসিয়াল ক্লান্তি যেন ধুয়ে যায় এই ধেঁায়ায়। আজকাল মানুষ আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার চেয়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিংমলে ঘুরতে ভালোবাসে। সমাজের ভেতর আত্মকেন্দ্রিকতার বসবাস বেশ। আথর্-সামাজিক অবস্থা যেন বিচ্ছিন্নতা বোধ বপন করেছে মানুষের চিন্তার ভেতর। একা থাকার চলটা সেখান থেকে। রমলার বাসায় আগে অনেকেই আসতো। এখন আসে না। যতদিন শ্বশুর, শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন, ততদিন লাইন দিয়ে তাদের মানুষজন আসতেন। তারা গেছেন, সাথে এসব মানুষজনও গেছেন। এই বাসার কোনো স্মৃতিও তাদের কাছে গচ্ছিত নেই। জমজমাট ঘর শূন্য হয়ে যায় প্রয়োজন শব্দটার অভাবে। সখিনা বেগম কাছে এসে দঁাড়ায়। মাথা নিচু করে আছে। কিছু বলবে? রমলার প্রশ্ন ওর মাথাকে সোজা হতে সাহায্য করল। আমার স্বামী গত ঈদের পরের দিন মারা গেছে। সখিনা বেগমের গলা ভিজে স্যঁাতসেঁতে। শব্দ তাই অস্পষ্ট শোনায়। আহা! কী হয়েছিল তার? আপা! সব কপাল আমার! সুস্থ মানুষটা হঠাৎ করে চলে গেল! বুকে ব্যথা শুরু হলো। হাসপাতালে নিলাম। বঁাচলো না। সখিনা বেগমের দু’গাল বেয়ে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে। আহা! মায়া হলো রমলার। কাছে নিয়ে মাথায় হাত রাখে। অভয়ের ছেঁায়া। আশ্রয়ের আভাস। ওতে সখিনা বেগম গুমরে ওঠে। দুলে ওঠে। বিশাল ঢেউয়ের ওপর ভেসে থাকা নৌকার মতন। সান্ত¡না যতটা দিলে সখিনা বেগমের মনটা স্থির হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, ততটা দিতে থাকে রমলা। কান্নার গতি কমে আসে। কান্না দুবর্ল হয়ে পড়ে। আপা, মানুষটা মরে যাওয়ার পর আমি ঘরে শুয়ে, বসেই কাটিয়েছি। অসুখে ধরেছে। ছেলেমেয়ে আমাকে খাইয়েছে। কাজকাম করতে দেয়নি। এই শহরে আমি এই প্রথম কাজে আসলাম। কপাল ভালো সখিনা বেগমের। স্বামী মরলে ছেলেমেয়ে দেখভাল করে, অনেক শিক্ষিত, সচ্ছল পরিবারেও তেমন আজকাল দেখা যায় না। দরিদ্র পরিবারে এমন গল্প ভালো লাগে। আর যাই হোক বোধে সচ্ছল এসব পরিবার, অথের্ না হোক। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে সখিনা বেগম। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বলে বোধ হয়। রমলা সান্ত¡না দেয়। সাথে অভয়। আমি তো আছি শহরে। আহা! আপা! কী মিষ্টি কথা আপনার। আপনে ভাববেন না। সব আমি সামলাবো। শুধু ভরসা রেখেন। কোনো দিন অবিশ্বাসের কাজ করব না। সখিনা বেগমের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। দৌড়ে যায় সেদিকে। যেন গাছ থেকে টসটসে পঁাকা আম পড়ল। দৌড়ে তা নিজের করে নিতে হবে। নতুবা হাতছাড়া হবে। রমলা সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে ফেলতে বাথরুমে যায়। অনেকক্ষণ শাওয়ারের নিচে ভিজতে ভালো লাগে। বেশ অনেকদিন ঘরের সবদিক সামলে অফিস ছুটে যেতে হয়েছে। না খেয়ে দৌড় যাকে বলে। আজ অনেক শান্তি। সখিনা বেগম শান্তি দিয়েছে। গেল বাথের্ডতে রিয়া রমলাকে ছোট গল্পের সংকলন আনন্দসঙ্গী উপহার দিয়েছিল। শুরু থেকে আনন্দবাজার পত্রিকায় যত গল্প প্রকাশিত হয়েছে, তারই সংকলন। রিয়া তার প্রাণের বন্ধু। সরকারি চাকরে। ছুটিছাটা বেশ কাটাতে পারে। রমলার বাথের্ড ঠিক মনে রেখে দেয়, মনে তার আর কিছু জায়গা পাক, আর নাই পাক। ছুটি কাটায়। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে রিয়া। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়া, একসাথে লাঞ্চ করা, এসব করে রিয়া। গাড়ি করে নামিয়ে দেয়ার সময় একটা গিফট প্যাক রমলার হাতে ধরিয়ে দেয়। ‘আমি যখন বেশ দূরে সরে যাব, তখন খুলবি।’ রমলা নিদের্শ মানে। আবেগ আপ্লুত হয়ে যায়। রমলার প্রিয় সব কিছু বেশ বোঝে রিয়া। বইটা পড়া হয়নি। অফিস, বাসার ঝামেলা শেষ করতেই দিন শেষ হয়ে যায়। গোসল করতে করতে স্থির করে ফেলে, আজ আনন্দসঙ্গী বইটা পড়তে শুরু করবে। তার আগে রিয়াকে ফোন দেবে এই খবর দিতে। রমলার গোসল শেষ হয়। কিন্তু সখিনা বেগমের কথা শেষ হয় না। বারান্দার এক কোণে ব্যস্ত সে। আজকাল গৃহকমীের্দর ফোনে কথা বলতে দিতে হয়। কিছুদিন আগে স্টার জলসা দেখার সুযোগ আছে কিনা বাসায়, এমন খবর নিয়ে সেই বাসায় কাজ করার মনস্থির করত গৃহকমীর্রা। এখন ওয়াইফাই আছে কিনা। অনলাইনে কথা বলা, ফেসবুকিং চালানো সম্ভব কিনা, এসব খবর নিয়ে কাজে আসতে চায়। মোবাইল ফোনে সে কথা বলবে, যতক্ষণ তার প্রয়োজন হয়, ততক্ষণ। কার কী বলার আছে, নেই। রিয়ার মোবাইল ব্যস্ত। দশ মিনিট ধরে ব্যস্ততা। রমলার কল ওয়েটিং-এ। মোবাইল ফোন কোম্পানির সৌজন্যতাবোধও বেশ। কখন কী অবস্থায় তার গ্রাহক, কলদাতাকে তা জানাতে কাল বিলম্ব করে না। যোগাযোগে জনপ্রিয়তা বাড়াতে সব দিকে খেয়াল রাখার ব্যবস্থা তেমনই করে রাখা হয়েছে। জীবনযাপন সহজ করে দিয়েছে যন্ত্র। রিয়ার কাছ থেকে কোনো ফোন ব্যাক কল আসলো না। আনন্দসঙ্গী নিয়ে বসে যায় রমলা। প্রথম গল্পটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রোববার’। কত আধুনিক লেখা। মনে হয় আজই তিনি লিখে উঠেছেন। মন গল্পের প্রতিটি শব্দ ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোচ্ছে, বিভোর হচ্ছে পরিবেশ। আচমকা বিকট শব্দ। মনে হলো খুব কাছে কিছু একটা ভেঙে পড়েছে। দৌড়ে আসতে দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সখিনা বেগম। বাচ্চাদের মতন কেঁদে বলছে, আমার শরীর ভালো না! কেমন কেমন লাগে! আমি কাজ করতে পারব না! আমাকে কাল বাসস্ট্যান্ডে তুলে দিয়েন! সখিনা বেগমের আচরণ রমলাকে হতভম্ব করে দেয়। আচমকা কোনো গতের্ পা ফেলে আটকে যাবার মতন। কিছুতেই সামনে এগুনো যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগের সময়ের সাথে এখন সময়ের বিরাট ফারাক। কী সমস্যা তোমার! কী হলো হঠাৎ করে? জবাবে সখিনা বেগম কামিজের সামনের অংশ পেট পযর্ন্ত উঠালো। এই দেখেন অপারেশনের দাগ! অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হয়েছে। কিডনির পাথর বাইর করছে। দুইটা অপারেশন! হঠাৎ করে তোমার শরীর খারাপ হয়ে গেল! চলো তাহলে ডাক্তারের কাছে! না না না। আমারে যাইতে দেন। বাড়িতে ডাক্তার আমাকে দেখে। কেউ আমারে ভালো করতে পারবে না! আমাকে কাল সকালে বাসে তুলে দেন! রমলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। একজন মানুষ দ্রæত এতটা বদলে যেতে পারে, জানা ছিল না। অনেক খেঁাজাখুঁজির পর, অনেক প্রতীক্ষার পর পাওয়া মানুষটা এমন আকস্মিক নোটিশে হারাতে হবে, কষ্টটা অনেক কষ্টের। টাকা-পয়সা হারানোর কষ্টের চেয়েও বেশি কষ্ট যেন। কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে থাকা রমলার। কৌশল বদলাতে হবে মূল কারণ জানার জন্য। ফোনে কথা বলছিল সখিনা বেগম অনেকক্ষণ ধরে। তারপর এই আচরণ সখিনা বেগমের। গলায় মায়া দরদ নিয়ে রমলা তাকে কাছে বসায়। কাছে টানার ভেতর জাদু থাকে বোধহয়। যাকে কাছে টানা হয়, সে শত্রæ হোক বা মিত্র হোক। হোক অপরিচিত কেউ, খুব অনায়াসে সে আপন হয়ে ওঠে। সখিনা বেগম তেমন বোধ করে। কিছুক্ষণ নীরবতা। আমার মন কী বলে জানো? রমলার প্রশ্নের উত্তর সখিনা বেগম তার কাছেই জানতে উৎসুক হয়। তুমি হয়তো কাজ করতে চাইছ না আর। শরীর খারাপ নিয়ে মানুষ কীভাবে কাজ করে! আমি এখন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে আপনে কী করবেন! ঝামেলায় পড়বেন তো! এত কথার দরকার নেই সখিনা বেগম। সিদ্ধান্ত পাকা, তুমি চলে যাবে। দুটো দিন থাকো। আমি আরেকজন মানুষ পেয়ে নিই। রমলার কথার ভেতর শান্তি খুঁজে পেয়ে সখিনা বেগম শান্ত হলো। ঠিক হলো সপ্তাহ খানেক সখিনা বেগম রমলার সংসারে কাজ করবে। আনন্দসঙ্গী আর পড়া হলো না রমলার। রিয়ার সাথে কথা বলার দারুণ ইচ্ছেটাও কোথায় মুখ লুকালো। বছরের শেষ সময়। সারা বছর জমে যাওয়া কাজ শেষ করার প্রবল চাপ। একদম ফুরসত নেই রমলার অন্য কোন দিকে মন দেয়ার। অন্তত যেটুকু সময় অফিসে অবস্থান করা হয়। সখিনা বেগম ঘুরছে ভেঁা ভেঁা করে মাথার ভেতর। সখিনা বেগমদের কত চাহিদা রমলার মতন মানুষের জীবনে। ওরা ছাড়া জীবন ভার। বয়ে চলা কষ্ট। নীরব রমলার কাছে সখিনা বেগমের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা শুনে নীরবই থেকেছে। সংসারে অধিকাংশ পুরুষ, পুরুষ হয়ে থাকতে চান, মানুষ হন না। যেন এ বিষয়ে ভাববার তার কিছুই নেই। নারী ভাবুক। যে তাকে সময়মতো খেতে দেবে, পরিপাটি হতে সহায়তা করবে। তিনি বাবু হয়ে অফিস যাবেন। আর একজন নারী বুয়া হয়ে অফিস যাবেন। প্রতিদিন জীবনের কত বৈষম্যের কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। বিশেষত যারা যুদ্ধ করে দিন পার করেন, তাদের মধ্যে নিজেকেও একজন যোদ্ধা মনে হয় রমলার। যে যুদ্ধের জয় কিংবা পরাজয় নিজের যুদ্ধ করার শক্তি, সামথের্্যর ওপর নিভর্র করে। সামান্য হাল ছাড়লেই পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। ছোট-বড় জয়-পরাজয় নিয়ে চলছে জীবন। সখিনা বেগম প্রসঙ্গ বোধহয় পরাজয়ের তালিকা কিঞ্চিত বড় করে দেয়। হার মানতে চায়না রমলা। মানুষ বলে রমলার সম্মোহনী শক্তি আছে। প্রয়োগ করে দেখা যায়, কী হয়। খালি হাতে ফেরে না রমলা ঘরে। একটা শাড়ির প্যাকেট হাতে ধরা। সখিনা বেগমের জন্য। আজ বেশ ক’বার কলিংবেলের ওপর আঙুলের চাপ দিতে হয়েছে। দেরি করে খোলার কারণ বলে, কাজে ব্যস্ত ছিল সে। ঘর বলে না কেউ পরিষ্কার করেছে। চুলা বলে না কেউ রান্না করেছে। ওলটপালট, অগোছালো সব। হাতে করে আনা শাড়ি জায়গা পেল বিছানার ওপর। অফিস থেকে বের হওয়ার পূবের্র সিদ্ধান্তে মরচে ধরে গেল যেন। চাপা অভিমান, ক্ষোভ রমলার সখিনা বেগমের ওপর। বুঝতে দিল না। পরনের কাপড় চেঞ্জ না করে সোজা রান্না ঘরে ঢোকে রমলা। রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে ওঠা রমলার চোখ ঘুরেফিরে সখিনা বেগমের দিকে। বেসিনে জমে থাকা সকালের বাসনকোসন পরিষ্কার করছে সে। বিড়বিড় করছে। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না। কান সেদিকে পেতে শোনার চেষ্টা করছে রমলা। সেই চেষ্টা অবশ্য বেশিদূর করতে হলো না। নিজ থেকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিল সখিনা বেগম, আপা। আমার বাবার শরীর ভালো না। অনেক অসুখ। পরশুদিন আমাকে যেতে হবে বাড়ি। বাবা বঁাচবে না। দ্বিতীয় দফার ধাক্কা লাগে রমলার মনে। সখিনা বেগমের দিকে দৃষ্টি সরাসরি দেয়া ছাড়া আর উপায় নেই। কী হয়েছে তোমার বাবার? অনেক অসুখ। এর বেশি কিছু বলল না সে। যা বোঝার রমলাকে বুঝে নিতে হবে। সৌজন্যতা বশে রমলা জানতে চায়, ডাক্তার দেখিয়েছে? আমি বাড়ি গেলে নেবে। সে কী! বাড়িতে কেউ নেই, তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার? জবাব দিতে বাধ্য নয় সখিনা বেগম। বাবা তার, এত প্রশ্ন কেন রমলার, ভাবটা এমন। রমলার মনে জিদ উঁকি দেয়, কেন সখিনা বেগম যা চাইবে, তাই করতে হবে। সখিনা, তুমি যাবে। তবে আরও দুদিন পর। আমি একটা মানুষ খুঁজে নিই। কী বললেন! আমার বাবা মরে গেলে আপনি এনে দিতে পারবেন? চেঁচিয়ে উঠল সখিনা বেগম। কঠিন শোনালো তার এই চিৎকার। অমানবিক শোনালো কিনা কথাটা ভেবে দেখে রমলা। তবে সখিনা বেগমকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে, তুমি তো আর কাজই করবে না। সুতরাং একবারে চলে যাও। আপনার চেয়ে আমার কাছে আমার বাবা বড়। আপনি যদি আমাকে আটকায়ে রাখেন, যদি পরশুদিন যেতে না দেন, তাহলে আমি ছাদ থেকে পড়ে মরব! কী করবেন তখন? কী সবর্নাশের কথা। রমলা জীবনে এমন হুমকি শোনেনি। কথাটা হাতুড়ি দিয়ে মাথা পেটানোর মতন লাগলো। হাত থেকে খুন্তি পড়ে গেল। রান্নাঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায় রমলা। ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে বসে পড়ে ঠিক তার নিচে। এমন অস্বাভাবিক কথা সে জীবনেও শোনেনি। এমন কথার কোনো উৎস নেই। সূত্র নেই। সখিনা বেগম স্বাভাবিক। রমলার ফেলে যাওয়া কাজ শেষ করে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখে। এর মধ্যে দু’তিনবার মোবাইল বেজে ওঠে। কথাও বলে সখিনা বেগম। খেয়ে নেন। খাবার দেয়া হয়েছে। দরজার কাছে দঁাড়িয়ে সখিনা বেগম। রমলার মনে হলো, মানুষ নয়, অন্যকিছু দঁাড়িয়ে। ধুক করে শব্দ হলো বুকে। শংকা আর আতংকের দ্বৈত সংগীত যেন। মারাত্মক কিছু ঘটার সম্ভাবনা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে। সখিনা বেগমের চেহারায় নতুন রূপ। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ো। সন্ধ্যারাতে কেউ ঘুমায় নাকি! আজ তো আমার ঘুম হবে না। কেন? আপনি তো বললেন না, আমি পরশু বাড়িতে যাব কিনা। রাত গভীর হয়নি। নিজর্নতা চারপাশ দখল করেছে এরই মধ্যে। তুমি কালই বাড়ি যাবে। সখিনা বেগম অবাক এমন উত্তরে। বেশিক্ষণ নয়। ঠেঁাটের কোণে রহস্যের হাসি। পানের লাল ওতে মিশে লকলক করছে। রাত আরও গভীর হয়। পুরো বাড়িতে রমলা, সখিনা বেগম আর এক অজানা আশংকা পায়চারী করে। নীরব অফিসের কাজে বাইরে চলে গেছে। মাঝেসাঝে এমনই করে। ফোনে ওকে ব্যাপারটা জানাতে ইচ্ছে হয়নি। লাভ হতো না। রিয়াকে ফোন করে রমলা। কী রে রমলা, কথা বলতে ইচ্ছে হলো তোর এতদিন পর! একটা বিপদে পড়েছি । কী! রিয়া ভয় পায়। কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা। ভালো আছিস তো রমলা? কোথায় এখন তুই? প্লিজ বল! বিপদের কথা না শুনেই রাজ্যের প্রশ্ন। যেন প্রশ্ন দিয়ে রমলাকে রক্ষা করবে রিয়া। সখিনা বেগমের ঘটনা শুনে অঁাতকে ওঠে রিয়া। সবর্নাশ! মানসিক রোগী নয় তো? কোথায় পেলি এটারে? এক্ষুনি পাঠিয়ে দে! ভুলে গেছে রিয়া এখন অনেক রাত। পুলিশকে জানিয়ে রাখব? আরে ওরা তো কতকিছু জানতে চাইবে। ওলটপালট করে দেবে। দরকার নেই। বাড়ি পাঠিয়ে দে। রাতে যদি কোনো অঘটন ঘটে। পাহারা দে। মেইন দরজায় তালা মেরে দেয়া হলো। অন্ধকারকে পাহারা দেয়া যেন। একটু শব্দ হলে ধড়াস করে ওঠে বুক। এঘর, সেঘর করে বেড়ায় রমলা সারারাত। নিজের ছায়া দেখে চমকে ওঠে, অঁাতকে ওঠে। সখিনা বেগম ভয় পাইয়ে দিয়েছে। এত সাহসে ভরা বুকটা ওজনহীন রমলার। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। সামান্য একজন সখিনা বেগম আজ অনেককিছু পেরে উঠেছে। আতংকের ক্লান্তি রাতের শেষে চোখে ভর করে। চোখ বুঁজে আসলেও ইন্দ্রিয় সজাগ ছিল। ফলে রমলা ভোর হওয়ার আগেই চোখ মেলে। সখিনা বেগম রেডি। পরনে কুচকুচে কালো বোরকা। মুখ ঢেকে ফেলেছে ওড়নায়। চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। আমাকে একটু সায়েদাবাদে পৌঁছে দেন। আমি শহর চিনি না। সখিনা বেগমের আব্দার। ভয় থেকে মুক্তির যত পথ, সবটাতে পা ফেলতে আপত্তি নেই রমলার। সায়েদাবাদে নেমে যায় সখিনা বেগম। কিছুক্ষণ বাদে রমলার ফোনে সখিনা বেগমের কল। আপা, আপনি আমাকে ছাদ থেকে পড়ে মরতে দেন নাই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি মরি নাই।