শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ এক বিস্ময়

শাহরিয়ার সোহেল
  ০৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।/ কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।/ (মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না। অন্ধ করে রাখে, তোমারে দেখিতে দেয় না।) / ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে / ওহে 'হারাই হারাই' সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে। / ( আশা না মিটিতে হারাইয়া/ পলক না পড়িতে হারাইয়া / হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে।) / কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে/ ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে। / (আমার সাধ্য কিবা তোমারে দয়া না করিলে কে পারে-/ তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে।)/ আর-কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ-/ ওহে তুমি যদি বলো এখনি করিব বিষয়- বাসনা বিসর্জন।/ ( দিব শীচরণে বিষয়- দিব অকাতরে বিষয়-/ দিব তোমার লাগি বিষয় -বাসনা বিসর্জন।'

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক সত্তা, যিনি স্রষ্টাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন আপন শক্তিতে, আপন মমতায়। তাইতো তিনি গাইতে পেরেছিলেন নির্ভুল প্রেম সংগীত। স্রষ্টা যাকে দেন অপার মহিমা, সে ছাড়া কারো সাধ্য নেই, তাকে বুঝতে পারা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন একজন মনীষী যিনি খুব সঙ্গোপনে স্রষ্টার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, তাইতো তিনি মর্মচোখে তাকে দেখেছেন, অনুভব করেছেন শিরায় শিরায়, অস্তিত্বের পরতে পরতে।

স্রষ্টার সান্নিধ্য মাঝে মাঝে পেয়েছেন, মাঝে মাঝে স্রষ্টা আপন আলোয় ধরা দিয়েছেন কবি প্রাণে। কিন্তু স্থায়ী হননি। চিরকালের জন্য থেকে যাননি। কবির আফসোস, কেন চিরদিন তিনি স্রষ্টার একান্ত সান্নিধ্য পান না। হৃদয় সর্বদা স্বচ্ছ থাকে না। হৃদয় আকাশে মেঘ আসে আর আসে কাল নাগিনীর মতো মোহ মেঘ। সে মেঘের তীব্রতায় আলোকচ্ছটা আটকে যায়, কবি প্রাণে এসে ঠিক মতো পৌঁছায় না, কবির এজন্য অনেক দুঃখ, অনেক বেদনা। মোহ মেঘ চোখকে অন্ধ করে রাখে, স্রষ্টাকে আড়াল করে। ক্ষণিকের জন্য স্রষ্টার সান্নিধ্য কবি যখন পান, তখনো তার মনে ভয় জাগে। কারণ চোখের পলকে তিনি আবারও হারিয়ে যান। মনের আশা মেটে না, অতৃপ্ত হৃদয় করে আহাজারি। প্রাণের তৃষ্ণা মেটে না কিছুতেই। ক্ষণিক দেখা দিয়েই মহাপ্রভু আবার কোথাও হারিয়ে যান।

কবি স্রষ্টার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছেন। তিনি নিজের কাছে প্রশ্ন করেছেন, বিধাতার কাছে প্রশ্ন করেছেন, কী করলে মহাপ্রভু আঁখিতে স্থান নেবেন, সর্বদা মর্মে পুঞ্জিভূত হবেন। তিনি আরও বলেছেন, এত প্রেম তিনি কোথায় পাবেন মহাপ্রভুকে ধারণ করতে! কবি যে তুচ্ছ, সামান্য, অতি সামান্য। কেমন প্রেমের বাঁধনে তিনি স্রষ্টাকে আটকাবেন বুঝতে পারেন না। কিন্তু প্রাণে বড় সাধ তাকে ধরে রাখার। প্রভুর সান্নিধ্যের প্রতি বিপুল তৃষ্ণা কবিকে আন্দোলিত করে, সর্বদা চিত্তকে চঞ্চল করে রাখে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, এত ছোট প্রেম দিয়ে অত বড় প্রেম ধরে রাখার সাধ্য তার নাই। তাইতো তিনি আরও বলেছেন, যদি তিনি নিজে এসে ধরা না দেন কারো সাধ্য নেই তাকে উপলব্ধি করার। বিশ্ব জগৎ সম্পর্কে কেউ কিছুই বুঝতে পারে না, যদি তিনি নিজ থেকে সাহায্য না করেন।

কবি সত্যকে উপলব্ধি করেছেন, তিনি সত্যের স্পর্শে আন্দোলিত হয়েছেন, পুলকিত হয়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন পৃথিবীতে যা কিছু অর্জন, সবই তুচ্ছ, মোহ মায়া। সত্য যখন স্পর্শ করে, ক্ষণিক পৃথিবীর সবকিছু বড় বেশি ম্স্নান হয়ে যায়। তাইতো কবি, স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে চেয়েছেন। সর্ব প্রকার বিষয় বাসনা ত্যাগ করতে চেয়েছেন, তিনি শুধুই চেয়েছেন, মহা শক্তির একান্ত সান্নিধ্য। কারণ তিনি সত্যের স্পর্শে পরশ পাথর হয়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন, সমর্পণেই সর্ব সুখ। অনন্ত আত্মার সুখ সমর্পণেই ন্যস্ত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে