বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ

বিমল ভৌমিক
  ০৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

রবীন্দ্র প্রতিভা যুগান্তরে মানব মনে বিশ্বব্যাপী অব্যাহত প্রভাব সত্যিই এক বিস্ময়কর সৃষ্টিশীলতার উজ্জ্বলতম স্বাক্ষর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বকবি অভিধায় সমগ্র বিশ্বব্যাপী তার প্রতিভা ভাস্বরিত সত্য, তেমনি সত্য তিনি আমাদের কবি, আমার কবি। সমগ্র বাঙালি জাতির সঙ্গে তার কবি-প্রতিভা অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্কিত। তাই তিনি বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কবি হয়ে বিশ্বভুবনে সব মানুষের কবি পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। তিনি সংকীর্ণ জাতীয় বোধে বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই সব মানুষের কথা এবং সামগ্রিক সাম্য চেতনার বাণী প্রচারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। যা তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশে একান্ত অনুভূতিময় রূপ-রঙে দৃশ্যমান হয়েছে। সেই পটভূমিকায় আমরা বাঙালিরা চিন্তাক্ষেত্র বিচরণের সম্প্রসারিত বিশ্বময় পদচিহ্ন অন্বেষণ করতে পেরেছি এবং বাঙালি জাতির আত্মচেতনার পথরেখা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য অঙ্গনে ঊনবিংশ শতকের অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত অবাধ বিচরণে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠায় প্রায় ষাট বছর ধরে নিরলস শ্রমলব্ধতায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

এই প্রতিভাধর মানুষটি ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির ও প্রায় এক দশক আগেই মহা প্রস্থানে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাই তিনি ভারতবর্ষের মানুষ হিসেবেই সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে স্বপ্রতিভায় ভাস্বরিত। ভারতবর্ষসহ পৃথিবীব্যাপী এ সময় ঘটেছিল অনেক পরিবর্তন। যে কারণে রবীন্দ্র মানসাকাশেও প্রতিফলিত হয়েছিল কালের কুটিল গতিচক্রের প্রতিবিম্ব। চিত্রিত হয়েছিল নতুন পট বিবর্তনের নতুন ইতিবৃত্ত। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে নয়, সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েই। তিনি তার জীবনাচক্রের অভিধায় বাংলাদেশ তথা ভারতীয় সামাজিক অবক্ষয়ে তখন বর্ণাশ্রমের সংঘাত প্রকটিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার মানসাকাশে প্রভূত পরিবর্তন ঘটলেও সমগ্র বিশ্ব পরিবর্তনে নিজ মনোবিক্ষণে সারাবিশ্বের রূপান্তর পরিক্রমার ছবির প্রতিফলনে তার মানসমুকুর ব্যথিত চিত্রে চিত্রিত হয়। এ সময়ের চিন্তা-চেতনায় ও সাহিত্য সংবিধিবদ্ধতায় এ বিরাট পরিবর্তন চিত্র, লেখা ও ভাষায় রেখাঙ্কিত হয়েছে।

পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন শাসক রবীন্দ্র সাহিত্যকে সর্বক্ষেত্রে বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। তৎসত্ত্বেও এ রবীন্দ্র বিদ্বেষকালে বাংলাদেশের প্রগতিশীল সংস্কৃতি মানস লালিত ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্র সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখেন। রবীন্দ্রনাথকে তারা অসাম্প্রদায়িক চরিত্র চিত্রণে বিশেষভাবে সচেষ্ট হন। রক্ষণশীল সাম্প্রদায়িক শাসক তৎকালীন ধর্ম বিদ্বেষে রবীন্দ্রনাথকেই শুধু নয়, নজরুল সাহিত্যকেও অস্বীকৃতি দিতে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ধর্মীয় চেতনায় সে সময় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাত্রাতিরিক্তভাবে বরীন্দ্রবিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রপ্রেমী অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ব্যক্তিরা ততধিক রবীন্দ্র সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা গ্রহণ করেন ১৯৬১ সাল। রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের সংস্কৃতি সচেতন জনগোষ্ঠী মধ্যবৃত্ত থেকে সাধারণ মানুষের শিক্ষা-দীক্ষায় বিশেষ প্রিয়তায় রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতিফলন ঘটে এবং কবি মানসে উদার বাঙালি চেতনার সাংস্কৃতিক জগৎ উন্মোচিত হয়।

রেনেসাঁস পেরিয়ে এ সময় পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা চরমভাবে বিকশিত হয়। সচেতন জনগোষ্ঠীর জীবন বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যে ভরে ওঠে। দেখা দেয় সময়াভাব ও অসীম জটিল প্রভা। বিপর্যস্ত বেদনার আলোক বিচ্ছুরিত প্রভায় আশা নিয়ে আসে ইউরোপীয় সাহিত্যে 'ছোটগল্প'। ফলে মানব চৈতন্যে ঊনবিংশ শতকের প্রারম্ভিককালে এ ছোটগল্পের আত্ম প্রকাশে শামিল হন রবীন্দ্রনাথও। কারণ তিনি বুঝেছিলেন- সীমাবদ্ধ সময়ের অনুশাসনে এখন যান্ত্রিকতা মানবমনে প্রভাবিত হলে সাহিত্য পলায়নপর মানসিকতায় পর্যবসিত হবে। তাই তিনি ছোটগল্পের প্রতি মনোনিবেশ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে আরও প্রিয়তম ব্যক্তিত্বের নিজস্বতা অর্জনে ব্যাপৃত হন। যান্ত্রিকতার নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে এ সাহিত্য তখন হয়ে ওঠে আরও ঋদ্ধতাসম্পন্ন। পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তের বিপরীতে ছোটগল্প হয়ে উঠল অত্যন্ত জনপ্রিয়। সে সময় ইউরোপীয় সামাজিক সাহিত্যে রূপকথা, উপকথা, লোকগাঁথা এবং প্রেমকাহিনী মনোরঞ্জনের অন্যতম বিশেষ মাধ্যম হয়ে ওঠে। তৎকালে ছোটগল্প ইতালীয় রেনেসাঁস উত্তরলগ্নে নবচেতনার জন্ম দেয়। এ সাহিত্যের নব-প্রতিনব চেতনালোকে রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প সাহিত্য-প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। তখন ছিল ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। যা বাংলায় সংগঠিত হয় সীমাবদ্ধতার প্রেরণায় নবজাগরণে। এ সময় শিল্প-সাহিত্য-ধর্মচর্চায় ঘটে ব্যাপক পরিবর্তন। শিল্পিত চেতনার নব-অঙ্গনে বাংলা সাহিত্যেরও প্রবেশ ঘটে পূর্ণতার লক্ষ্যে। অনেক দেরি হলেও এ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত ছোটগল্পের বলয় বৃত্তে অনুপ্রবেশে বাংলা সাহিত্যেরও সমৃদ্ধি ঘটে। এ যাত্রাপথের প্রথম পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 'আধুনিক বাংলা ছোটগল্প' বাংলা সাহিত্য-ভুবনে প্রাণ-প্রতিষ্ঠায় তিনিই একমাত্র উজ্জ্বল প্রতিভার-স্বাক্ষরিত অনবদ্য মুক্তির আলোকবর্তিকা। ছোটগল্পের আঙ্গিক সৌষ্ঠব চিত্রাঙ্কনে তিনি বাংলা সাহিত্যের পরিমন্ডলে এক নতুন রূপকল্পের কথাচিত্র প্রস্ফুটিত করেছেন। যার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন বাঙালির বাস্তব জীবনের স্বাদ-সৌরভ, আশা-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা, প্রেম-বিরহ এবং প্রণয়-পরিণয়ের শব্দ-প্রতিমায় এক অতু্যজ্জ্বল অনবদ্য সৃষ্টিশীলতা। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে বাংলার পলস্নী-প্রান্তর যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সেখানে প্রতিভাত হয়ে ওঠে বুর্জোয়া মানবতাবাদের প্রভাবিত বাংলার এক নতুন জীবনবোধ। এ দ্বৈত চিন্তা-চেতনার নবতর সংযোজনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বস্তুত প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবিত করে এ ছোট গল্পের মহা কথা-কাব্য রচনার উজ্জ্বলতম আঙিনা পরিভ্রমণে সৃষ্টিশীল পদচারণায়। মাত্র ষোলো বছরের কিশোর তার ছোট গল্পের ভুবনে আবির্ভাব ঘটে তৎকালীন 'ভারতী' পত্রিকায় 'ভিখারিনী' গল্পের প্রকাশনার মাধ্যমে। ১৯৭৭ সাল সমাজ ও সময়ের সমন্বয়ে সযত্ন পরিচর্যায় বর্ণিল এ শিল্পকল্প বাংলা সাহিত্য-সমুদ্রে তার উজ্জ্বলতম স্বাক্ষর। বাংলা ছোট গল্পের এ শিল্পিত বহুবর্ণ শোভিত বিষয়-বৈচিত্র্যময় অঙ্গ-সংগঠনে সমুদ্রগামী মানস প্রতিভায় তার হাতেই শীর্ষতার মুকুর অর্জিত হয়েছে।

মনোজগতে বেঁচে থাকা, বাস্তব জগতে জীবিত থাকা একই অর্থবহ নয়, জীবিত থাকা এক প্রকার স্থল জৈবিকতা। কারণ জীবজগতের একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল আছে। এ স্থূল ও মূর্ত জৈবিকতাকে অতিক্রম করে সূক্ষ্ণ ও বিমূর্ত মানবিকতাকে প্রতিষ্ঠা করে বাঁচা। অতীত পিছুটান মুক্ত হয়ে 'না' অর্থকে বর্জনে অতীতের সদর্থ ঐতিহ্য নতুন করে বিস্তৃত সত্যের প্রতিষ্ঠায় জীবন্ত ও মূর্ততার প্রতীক চিহ্নস্বরূপ। সন্ধ্যা সংগীতে কিশোর বৃদ্ধের মধ্যে প্রকাশিত হবে কি? না এটা অত্যন্ত দুষ্কর চিন্তা। যা রবীন্দ্র মানসে গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠাকল্পে পুরনোকে নিষ্করুণ ত্যাগে নতুনকে অকুণ্ঠ অভিনন্দনে সমকালীনত্ব স্থাপনায় ব্যাপৃত ছিলেন জীবনব্যাপী অগ্রজ পথিকদের সঙ্গে অনাগত ভবিষ্যৎ পথচারীদের সাযুজ্য রক্ষা রবীন্দ্র দর্শনের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। এ মানস ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিতেই বরীন্দ্রনাথ চিরকাল আমাদের মনোজগতে অধিষ্ঠিত থাকবেন। তিনি দৈহিক মৃতু্যর পরও আমাদের মানোভূমিতে বিচরণের যে স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন বহন করছেন, তা সংস্কৃতি ও জীবনের এক মহামন্ত্র সাধনা। সংস্কৃতি সাধনায়ও তিনি যুগান্তরে চমৎকৃত করেছেন তার অভিব্যক্তিত্ব। সংস্কৃতি চর্চায় সুন্দরের পূজারি হয়ে বৈচিত্র্যতার মহত্বমে প্রাকৃত-প্রকৃতির মনোজগতে অসংখ্য অনুভূতিময় রস্বাদনে বেঁচে থাকার কঠিন বাস্তবতা একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভাব্য চেতনার উন্মেষ ঘটায়। তার সাহিত্য চিন্তনে-দর্শনে স্রোতস্বিনী নদীর কথা, ফুল ফোটানোর কাব্য গাঁথা, কবিতাকাশে চাঁদের অনিন্দ্যসুন্দর প্রিয়ার ছবি, আকাশের নীলিমায় গল্পের অভূতপূর্ব চিত্র, তৃণগুল্মতায় শ্যামলিমার ছন্দ, বিরহী প্রেমিক-প্রেমিকার অশ্রম্নসিক্ত কাহিনী, নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখের জীবনালেখ্য, বিশ্বভ্রমণের প্রকৃত রসময়তা, বিচিত্র দেশ ও জাতির আন্তরিক সখ্যতাময় কথামালা, ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনে মানব-সভ্যতার উন্মেষ, জীবনের গল্প সমৃদ্ধ দুঃখ-ব্যথা নিবারণের অঙ্গীকারময় ইতিবৃত্ত, বিশ্ব সাহিত্যাকাশে প্রাচুর্যের গভীরতায় প্রকাশিত দার্শনিক তত্ত্ব আশঙ্কাজনক সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তার মানসিক গঠন, সামাজিক সচেতনতা, শিল্পীসত্তার নির্ভরশীল স্ফুরণ বিমূর্ত হয়ে উঠেছে।

রবীন্দ্র চৈতন্যের দর্শনে সামাজিক অস্থিরতার জটিল রাজনীতি, বিংশ শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের হতাশা ও বিছিন্নতার অবসাদগ্রস্ততায় তিনি চিত্রশিল্পের প্রতি আকর্ষণ অনুতব করেন। তার এ দ্বৈত সত্তায় বৈপরীত্যও দৃশ্যমান হয়ে প্রকাশিত হয়। ১৯২৬-২৭ খ্রি. থেকে তার ছবিগুলোর আত্মপ্রকাশ। খাপ ছাড়া, উদ্ভট, অমূর্ত, অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য চেতনার বহিঃপ্রকাশ-এ তৎকালীন বিশ্বের বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্য সামাজিক অবস্থায় পরিস্ফুটন ঘটে। এ সময় থেকেই তিনি তার পৃথিবীর ও জীবনকে যেন নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেন। এ প্রসঙ্গেই হয়তো তার চিত্রগুলো যুক্তিহীন উদ্ভট অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য, জন্তু-জানোয়ার, মানুষের অদ্ভুত ছবি, গুহাবাসীর সমাধিক্ষেত্র থেকে অতীতের নিষ্ঠুরতম ভয়ংকর প্রেতাত্মার কান্নার প্রকাশ ঘটেছে। তবুও তিনি জীবন-সায়াহ্নের সাহিত্যকর্মে যুক্তিবাদী, আশাবাদী, বাস্তবধর্মী সুপরিকল্পিত সংজ্ঞায়িত চিত্রের অবতারণা করেছেন।

গুংঃৎু না থাকলে কবিতার সার্থকতা ফুটে ওঠে না। সেজন্য কবিতা সম্পূর্ণ আত্মজৈবনিক হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের মৃতু্য চেতনার সায়াহ্নকালের কবিতায়ও কৈশোর যৌবন ও তারুণ্যের বিপন্ন বিস্ময়াভূতের প্রকাশ ঘটেছিল। অন্ধকার মৃতু্য তার সব সত্তাকে গ্রাস করেছে। তখনো তার কবিতায় অন্তরের গূঢ়তত্ত্বময় মন্ত্র দৃঢ় বিশ্বাসে আবর্তিত হয়েছে। মৃতু্য সম্পর্কে তিনি বলেন- 'আধুনিককালে আমরা জীবনের সঙ্গে মৃতু্যর একটা বিরোধ অনুভব করি। মৃতু্য যে জীবনের পরিণাম তাহা নহে, মৃতু্য যেন জীবনের শত্রম্ন। জীবনের পর্বে পর্বে আমরা অক্ষমভাবে মৃতু্যর সঙ্গে ঝগড়া করিয়া চলিতে থাকি। যৌবন চলিয়া গেলেও আমরা যৌবনকে টানাটানি করিয়া রাখিতে চাই। ইন্দ্রিয়শক্তি হ্রাস হইয়া আসিলেও আমরা প্রাণপণে কাজ করিতে চেষ্টা করি। মুষ্টি যখন স্বভাবতই শিথিল হইয়া আসে, তখনো আমরা কোনোমতেই কোনো কিছুর দখল ছাড়িতে চাই না। প্রভাত ও মধ্যাহ্ন ছাড়া আমাদের জীবনের আর কোনো অংশকে আমরা কিছুতেই স্বীকার করিতে ইচ্ছা করি না। অবশেষ যখন আমাদের চেয়ে প্রবলতর শক্তি কানে ধরিয়া স্বীকার করিতে বাধ্য করায়, তখন হয় বিদ্রোহ নয় বিষাদ উপস্থিত হয়- তখন আমাদের সেই পরাভব কেবল রণে-ভঙ্গ রূপেই পরিণত হয়, তাহাকে কোনো কাজে লাগাইতে পারি না।' অথবা 'সত্যকে অস্বীকার করি বলিয়া পদে পদে সত্যের নিকটে পরাস্ত হইতে থাকি' তার জন্মক্ষণ ২৫ শে বৈশাখের ধারাবাহিকতায় মৃতু্যদিনের দিকে ধাবিত ছোট ছোট জন্মমৃতু্যর কথামৃত এগিয়ে চলে কালপ্রবাহে। রস্বাদন শেষে হারিয়ে যায় তমসাঘনান্ধকারে। শিল্প, সাহিত্যিক, কবি ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্টি এবং আবিষ্কারের সূত্রের মাধ্যম্যেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন। জন্ম-জন্মান্তরের কল্পনাপ্রসূত চিন্তাধারা, বিশ্বপ্রকৃতিজগতে আত্মহারা এবং সাহিত্য দর্শনে সৃষ্ট দশনতত্ত্বের সমন্বয়ে তিনি আমাদের প্রজন্মান্তরে চির ভাস্বরিত থাকবেন। কবিতা ও গানে মৃতু্যর অভিধায় বিশ্ব-প্রাকৃতে পমম ব্রক্ষের প্রতি লীন হতে ইচ্ছা প্রকাশই তার বেঁচে থাকা প্রজন্মান্তরে প্রভাবিত করেছে। বাইরের আহ্বান উপেক্ষা করে অন্তরের গভীরতায় চলমান দর্শনের আনন্দধারা জ্যোতির্ময় মৃতু্যকে জয় করার এক অলৌকিক প্রয়াস।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে