শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন

বোরহানউদ্দীন ইউসুফ
  ০৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা সাংঘর্ষিক কি না বা উত্তর আধুনিকতা চিন্তার যৌক্তিকতা নিয়ে গত ২-৩ দশক ধরে আলোচনা জমজমাট। একটি কবিতা উত্তর আধুনিক ফর্মে হতে হলে যেসব মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে হয়- তা নিয়ে তর্ক আছে। কেউ বলছেন- অঙ্কের হিসাব কষে বা বৈজ্ঞানিক উপাত্ত ধরে নির্ধারিত ছকে একজন কবি কবিতা লিখেন না। ঠিক বিপরীত কথা বলছেন কেউ কেউ। এসব তথাকথিত ছক থেকে কবিতাকে মুক্ত করে সাবলিলভাবে বেড়ে উঠতে দেয়াই উত্তর আধুনিকতা। এতে অন্যের প্রভাব চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থাকে না। এতে শেকড়ের টান ও নিজস্বতার প্রভাবকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি উত্তর আধুনিকতা বিষয়ক একটি বই ও প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ঢাকার কাঁটাবনে মনোজ্ঞ আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। সে সূত্রে আয়োজনে আমার সূচনাকথন নিয়ে এ লেখা। যার প্রতিপাদ্য নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ আজিজ মার্কেট কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন।

কবিতা বা সৃজনশীল সাহিত্য চর্চার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও স্থান-কালের একটা অবশ্যম্ভাবী প্রভাব থাকে। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশে দশকওয়ারী বিবেচনায় সত্তর-আশির দশকের কবিতার একটা বড় অংশে সমসাময়িক বাস্তবতার প্রকাশ ঘটে। নব্বই পরবর্তী বা আমরা যেটাকে নব্বই দশক বলি, এ সময়ে শিল্প সাহিত্যে চিন্তার বৈচিত্র্য ও ব্যাপক স্ফূরণ ঘটে। বৈশ্বিক সাহিত্য, এপার-ওপার বাংলার সাহিত্য নানামুখী স্র্রোতের মোহনায় কেউ আলোকিত হয়, কেউ স্রেফ আলোচিত হয়।

নব্বই দশকের ছাত্র-তরুণদের মধ্যে আলোচনা, সাহিত্য আড্ডা, লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনায় কিছু ব্যক্তি, স্থান কেন্দ্রিক বলয় গড়ে উঠতেও দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক কবিতা উৎসব ও সাহিত্য চত্ব্বর নজরে আসে। শাহবাগ আজিজ মার্কেটের পূর্ব-উত্তর কোনায় আলোচিত টরেন্ট চত্বরে বৃহস্পতিবারের আড্ডা উত্তর আধুনিক সাহিত্য বৈঠকের উলেস্নখযোগ্য কেন্দ্র হয়ে উঠে। লেটার প্রেসের পর অফসেট মুদ্রণ পরিচ্ছন্ন প্রকাশনার পাশাপাশি অলঙ্করণেও ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বসন্তকালীন কবিতা উৎসবের দু'-একটি স্স্নোগানের দিকে লক্ষ্য করি-

কবিতা হৃদয়ের, কবিতা নান্দনিকতার।

কবিতা দেশ-কাল ঐতিহ্যের; কবিতা উত্তর আধুনিকতার।

১৯৯৫ সালে ৪র্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বসন্তকালীন কবিতা উৎসবে ৪টি পর্বের সকাল বেলা ছিল আমতলায় উন্মুক্ত উৎসবপর্ব, দুপুরে সেমিনারপর্ব, বিকালে নির্ধারিত কবিদের কবিতা পাঠ এবং সন্ধ্যায় উত্তর আধুনিকতা বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ সাহিত্যপ্রেমীদের উজ্জীবিত করে।

এ উৎসবে সংশ্লিষ্ট তরুণ লেখকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে ধারাবাহিকভাবে 'মুক্তমন চত্বরে' সাহিত্য আড্ডায় মিলিত হন। সে সময়ের অনেক কবি, লেখক বাংলা একাডেমি কর্তৃক তরুণ লেখক প্রকল্পে যুক্ত হন। যা তাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি ১টি প্রকাশনার সুযোগ তৈরি করে। যদিও অনেকে ট্রেনিং দিয়ে লেখক তৈরি বা সৃজনশীলতা নিয়ে সমালোচনা করে। বাস্তবে দেখা গেল, মূলধারার সাহিত্যে এদের অংশগ্রহণ ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

মুক্তমনের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি শিক্ষক লাউঞ্জে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের সফঙ্গ চমৎকার সাহিত্য আড্ডা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এখনকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক সেদিনের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন। আজিজ মার্কেটে কলকাতার প্রকাশনাগুলো সহজলভ্য হওয়ায় শিবনারায়ণ রায়ের 'জিজ্ঞাসা' পত্রিকাটি অনেকের আগ্রহ তৈরি করে।

প্রেক্ষাপট বুঝতে সংশ্লিষ্ট একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। কথাশিল্পী শওকত ওসমানের লেখা আমাদের পাঠ্য বইতেও ছিল। তিনিও থাকবেন শুনে আমার বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়। অভিভূত হই- কিছুটা হোঁচট খাই, তিনি এসে নিচে বসে কদমবুচি করে শিবনারায়ণ রায়কে যে সম্মান দেখালেন এবং পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে থাকা আমার কাছে বিস্ময়কর ছিল। শিবনারায়ণ রায় তার কথার আভিজাত্যে উপস্থিত শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখেন। তিনি ওপার বাংলা থেকেই টের পান আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে বিভক্তির বিষয়টি। স্বীকৃতি না দিলে যে ইতিহাসের বিকৃতি হয়, সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া হবে তার আশঙ্কা করেন। তিনি একজন আলোচিত কবিকে ইঙ্গিত করে বলেন- তার লেখায় আমি অভিভূত। তিনি যে, কত বড় মাপের কবি এখানের অনেকেই তা স্বীকার করেন না।

আজিজ মার্কেটের করিডোর ও সিঁড়িজুড়ে তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের টুকরো টুকরো আড্ডা নব্বই দশকের নান্দনিক প্রতিচ্ছবি। একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের কাছে সে সময়ের একজন উদীয়মান কবি একটি কবিতা পাঠান; কবিতাটি ছিল এমন-

'গির্জার টুংটাং শব্দে আমার ঘুম ভেঙে দেখি

ফুটন্ত টিউলিফে ভোরের শিশির!'

সম্পাদক আক্ষেপ করেন, মসজিদের শহর ঢাকায় আজানের শব্দে ঘুম না ভেঙে টুংটাংওয়ালারা স্থান-কাল বিচ্ছিন্ন। এরা বাস্তবতা বিবর্জিত।

আমরা কবি ইশারফ হোসেনের সকাল প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে দেখেছি নব্বই দশকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লিটলম্যাগ তরুণদের যুক্ত রাখে। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের একবিংশসহ অনেক পত্রিকার নাম আসতে পারে। এখানে সে আলোচনায় যাচ্ছি না। নব্বই দশকে উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন চরিত্রে আলোচনায় আসে ও চর্চা হয়। সে সময় প্রকাশিত 'উত্তর আধুনিকতা' নামক বুলেটিনে কবি ইশারফ হোসেন লেখেন- 'নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনধারা ও অস্তিত্ব সংলগ্ন বাস্তবতাকে শিল্প সাহিত্য চর্চা করার বিবেচনাগত দাবি ও প্রত্যাশার অঙ্গীকারই উত্তর আধুনিকতা।'

উত্তর আধুনিকতার দেশজ ও আন্তর্জাতিক টার্ম নিয়ে রোমাঞ্চকর আলোচনা নব্বই দশকের অন্যতম সৌন্দর্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে