বাংলা কবিতা ও কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতীর্

আমরা যেমন কমল কুমার মজুমদারের গদ্য পড়তে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, একইভাবে বিষ্ণুদের কবিতাও আমাদের কাছে জটিল ও দুবোর্ধ্য ঠেকে। এমনকি ইদানীং যারা কবিতা লিখছেন তাদের বেশিরভাগের কবিতাই দুবোর্ধ্য ভাব-ব্যঞ্জনাহীন অলঙ্কারবিহীন, শিল্পের অনুপস্থিতিও চোখে পড়ে। কবিতার মধ্যে প্রাণ নেই, নেই গতিশীলতা আনন্দ-বিনোদন। মনে হয় কিছু জটিল শব্দ সাজিয়ে রাখা হয়েছে, ব্যতিক্রমও রয়েছে। কারও কারও কবিতায় শব্দচয়ন আধুনিক ও অনবদ্য। উপমা চিত্রকল্প ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পূবর্সূরিদের চেয়ে তারা এগিয়ে। কবিতায় বঁাক বদলের ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এরাই বাংলা কবিতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রকাশ | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
কবিতা লেখার ঝেঁাক বা প্রবণতা বাঙালির মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করে। বাঙালি আবেগ ও কল্পনাপ্রবণ এই কারণও প্রাধান্য পেতে পারে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লিখে পাতাভতির্ করা কবির এ দেশে অভাব নেই। এখনো এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। তার প্রমাণ আমি প্রায়ই পেয়ে থাকি। সুদূর মফস্বল থেকে আমার কাছে যারা আসেন তারা ব্যাগভতির্ নিজের লেখা কবিতা নিয়ে আসেন, শত শত কবিতা। তারা এও বণর্না করেন যে এই সব কবিতা রাত জেগে বছরের পর বছর ধরে লিখেছেন, অনেক কষ্ট করে। তাদের কাব্য-সাধনার কথা শুনলে অবাক লাগে। কবিতার প্রতি তাদের এত নিষ্ঠা-শ্রম দরদ এত ত্যাগ। বলা হয়ে থাকে গান যে ভালোবাসেন না তিনি মানুষ খুন করতে পারেন। কবিতার ক্ষেত্রেও প্রায়ই একই কথা প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের অনেক কবিতাই তো গীত হয়েছে। এক তরুণ শিল্পী তো বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন কবির কবিতা গানের মযার্দা দিয়ে সিডি বের করেছেন, আমাকে উপহারও দিয়েছিলেন, চমৎকার তার গায়কী ঢং কণ্ঠমাধুযর্। ছোটবেলা থেকে আমরা যারা কবিতাচচার্ করে আসছি তারাও এক সময়ে লিখে পাতা ভরাতাম, কবিতা হোক বা না হোক। একবার তো আমি নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নজরুলের অভিশাপ কবিতার (৯৯ পঙ্ক্তি) আদলে ১২০ পঙ্ক্তি লিখে ফেললাম, যেন রাজ্য জয় করলাম। পাথর্ক্য এই যে, তিনি লিখলেন বুঝবে সেদিন বুঝবে আর আমি লিখলাম কঁাদবে সেদিন কঁাদবে। দুজনের কবিতাই প্রেমাশ্রয়ী প্রেয়সীর উদ্দেশে, বিরহকাতরতা ও প্রতিশোধপরায়ণতা যেখানে উজ্জ্বল। এর পর ঢাকা কলেজে যখন ভতির্ হলাম তখন বাংলা বিভাগের শিক্ষক সুলতানা শরিফা আক্তারকে কবিতাগুলো দেখালাম, তিনি কবিতা পড়ে আনন্দে আত্মহারা হলেন। আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন বিভাগীয় প্রধান হুসনা বেগমের কাছে। তিনি আমার কবিতা খুব পছন্দ করলেন। এই ঘটনায় আমি বাকরহিত হলাম। এরপর কবিতা নিয়ে গেলাম আহসান হাবীবের কাছে, দৈনিক বাংলা অফিসে। তিনি বললেন কবিতায় ছন্দ নেই। বললেন কী তিনি। এবার ছন্দ সমস্যায় পড়লাম। স্কুলজীবনে ভাবতাম কবিতার অন্তমিল মানেই ছন্দ, এখনো অনেকেই মনে করেন। একজন সিনিয়র কবিকে কবিতা দেখালাম, তিনি বললেন, কবিতা লেখার আগে ছন্দবিষয়ক অন্তত তিনটি বই পাঠ করতে হবে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতীর্র কবিতার ক্লাস, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের বাংলা কবিতার ছন্দ এবং শঙ্খ ঘোষের ছন্দের বারান্দা। কবিতার নিজস্ব ব্যাকরণ রয়েছে, তা ভালো করে জেনে ও মেনে কবিতা লিখতে হবে। ছন্দের বই পড়ার সূত্র ধরেই আমি প্রথম কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতীর্র নাম জানতে পারি। এর পর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন দুই বাংলার ছোট কাগজ সম্মেলনে কলকাতায় যাই। কলকাতার মৌলালীর রাজ্য-যুব কেন্দ্রে ওই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওখানে পরিচয় হয় কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতীর্র সঙ্গে। ওই সম্মেলন আরও উপস্থিত ছিলেন, অন্নদাশঙ্কর রায়, শুদ্ধস্বত্ত¡ বসু ও পবিত্র সরকার। তার সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে তার কবিতার বিশেষ অনুরাগী গেয়ে উঠি। চযার্পদের কবি কিংবা মধ্যযুগের কবিদের কথা বাদ দিয়ে বিহারী লাল চক্রবতীর্ থেকে কবিতার ধারাক্রম যদি বিচার-বিশ্লেষণ করি, তবে তার কবিতায় স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর উজ্জ্বলভাবে ধরা পড়ে। তিনি দুই বাংলার কবি ও কবিতা পাঠকদের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। তিনি জীবনের প্রায় শেষ মুহূতর্ পযর্ন্ত সৃষ্টিশীল থেকে গেছেন। তার কবিতা দুবোর্ধ্য নয় সহজ ভাষায় কবিতা লিখতেন তিনি বাস্তবতার নিরিখে , যার গভীরতা অনেক। গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ‘কলকাতার যিশু’, ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’, ‘উলঙ্গ রাজা’র মতো অমর জনপ্রিয় কবিতার স্রষ্টা। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি বাধর্ক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তিনি শুধু কবিতাই লেখেননি। তিনি গদ্যসাহিত্যেও যথেষ্ট স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। ‘ডিটেকটিভ ভাদুড়ীমশাই’ বাংলা কিশোর সাহিত্যে তার এক অনবদ্য সৃষ্টি। একাধারে তিনি ছিলেন কবি ও ছড়াকার, অন্যদিকে প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকারও। বানান-বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় বিশেষ বানানরীতি চালু করেছিলেন। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক লেখক। ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশের ফরিদপুরে তার জন্ম। প্রাথমিক লেখাপড়া সেখানকার পাঠশালায়। পরে ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় চলে যান। তিনি ১৯৫১ সালে যোগ দিয়েছিলেন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায়। দীঘর্ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই ‘নীল নিজর্ন’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। এরপর প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’সহ অসংখ্য কবিতার বই। সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বঙ্গবিভ‚ষণ সম্মান দিয়ে সম্মানিত করেছিল। পরিণত বয়সে তার মৃত্যু হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের এক স্বণর্যুগের কবি চলে গেলেন। তার শৈশবের পুরোটাই কেটেছে পূবর্বঙ্গে তথা বাংলা দেশে, ঠাকুরদা আর ঠাকুমার কাছে। তার শৈশবের জীবন ছিল অত্যন্ত বণার্ঢ্য। এ বিষয়ে তিনি বহুবার স্মৃতিচারণ করেছেন, লিখেছেনও। কবিতার প্রতি তিনি নিবিষ্ট ছিলেন এবং কবিতাই তার মাতৃভাষা ছিল। তবে, সংবাদপত্রে কাজ করার সুবাদে নানা রকমের গদ্যও লিখেছেন নীরেন্দ্রনাথ। তিনি নিজে মনে করতেন, ‘কবিতাকে ফঁাকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে নিয়ে আমি গদ্যকে দিচ্ছি।’ তিনি আরও বলতেন, ‘কবিতা লেখায় আমার কল্পনার েেজার তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় এ শহরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা। একেবারে চোখের সামনে যা ঘটতে দেখলুম, তার ভিত্তিতে তক্ষুনি লেখা।’ তার বিখ্যাত কবিতা- আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম/ কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল/ অমলাকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি/ সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল (অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল) । সাধারণের ভেতর কী অসাধারণ কথা। কবিতা কি কেবলই ভাবপ্রকাশের মাধ্যম? শব্দের পর শব্দ বসালেই কি কবিতা হয়ে যায়? কবিতায় শিল্প কোথায়? কোথায় বিনোদন? কবিতায় উপমা উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্প অনুপ্রাস রূপক এসবের কি সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে? ইদানিং কি অলংকারবিহীন কবিতা লেখা হচ্ছে? একশ্রেণির কবি তো গদ্য কবিতার নামে কবিতার ছন্দকে অস্বীকার করে আসছেন অনেক আগে থেকেই। আবার অনেক কবি ছন্দকে নিজের মতো করে ভেঙেছেন। শামসুর রাহমান ছন্দকে এড়িয়ে গিয়ে বলতেন, ‘কবিতাটা পড়তে ভালো লাগে কিনা। কোনো শব্দ বাক্য কানে বাজে কিনা। অথার্ৎ কবিতায় গতিশীলতা বা প্রবহমানতা কতটুকু, তা পাঠককে আকৃষ্ট করে কিনা।’ কাক কালো কোকিল কালো কালো কন্যার কেশ এমন আদ্যানুপ্রাসের ব্যবহার চোখে পড়ে কিনা। কিংবা জলদস্যুর মতো বন্যা এসে যাদের ঘরে অকস্মাৎ হানা দিচ্ছে, এমন উপমা, অথবা তোমার শুশ্রƒষা পেয়ে বিশুষ্ক অক্ষরগুলো হয়ে ওঠে বষার্র নদী, এমন চিত্রকল্প। কবিতাকেন্দ্রিক এসব অসংখ্য প্রশ্ন আজ সামনে চলে আসছে। আমরা যেমন কমল কুমার মজুমদারের গদ্য পড়তে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, একইভাবে বিষ্ণু দের কবিতাও আমাদের কাছে জটিল ও দুবোর্ধ্য ঠেকে। এমনকি ইদানিং যারা কবিতা লিখছেন তাদের বেশিরভাগের কবিতাই দুবোর্ধ্য ভাব-ব্যঞ্জনাহীন অলঙ্কারবিহীন, শিল্পের অনুপস্থিতিও চোখে পড়ে। কবিতার মধ্যে প্রাণ নেই, নেই গতিশীলতা আনন্দ-বিনোদন। মনে হয় কিছু জটিল শব্দ সাজিয়ে রাখা হয়েছে, ব্যতিক্রমও রয়েছে। কারও কারও কবিতায় শব্দচয়ন আধুনিক ও অনবদ্য। উপমা চিত্রকল্প ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পূবর্সূরিদের চেয়ে তারা এগিয়ে। কবিতায় বঁাক বদলের ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এরাই বাংলা কবিতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি মনে করি পশ্চিমবঙ্গের তরুণ কবিদের চেয়ে এই সব দিক থেকে বাংলাদেশের তরুণ কবিরা অনেক এগিয়ে। তবে ফেসবুকে যেসব কবিতা অহরহ প্রকাশ পাচ্ছে তার বেশির ভাগের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অবশ্য এর একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। বাংলাদেশে কবিতাচচার্ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সব তরুণ কবির মধ্য থেকে হয়তো বা একজন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়ম শামসুল হক, রফিক আজাদ, সিকদার আমিনুল হক বেরিয়ে আসবে।