বাঘের সাথে বসবাস

প্রকাশ | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আতা সরকার
জ্ঞান ফিরল। সারা শরীর ব্যথায় টাটাচ্ছে। চোখ দুটোও ভারী। খুলতে ইচ্ছে করছে না। নাকে এসে ধাক্কা লাগল বোটকা গন্ধ। জায়গা খুব দুগর্ন্ধময়। আস্তে আস্তে চোখ খুললেন সফিক। খুলতেই সারা গা শিউরে উঠল। চারপাশে চারটি বাঘ। ভয়ে ধপ করে চোখ বন্ধ করলেন। শরীরের ব্যথা-বেদনার চাইতেও এখন বেশি আতঙ্ক, এই বুঝি বাঘগুলো ঝঁাপিয়ে পড়ে তার ওপর। ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তার পুরো দেহ। প্রায় মৃতের মতো নিঃসাড় শুয়ে থেকে বাঘের হামলার অপেক্ষা করতে থাকলেন। খঁাচাবন্দি এ বাঘগুলোর কথা জনশ্রæতিতে শুনেছিলেন তিনি। নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে বাঘের খঁাচায় ফেলা হয়। এমনকি ধরা পড়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও। তাদের মৃত্যু হয় বাঘের কবলে পড়েই। ছিন্নভিন্ন দেহ নিয়ে ভাগ্যগুণে কেউ যদি বেঁচে যায়, তাদের নিমর্মভাবে হত্যা করে পাকবাহিনীর সেনারা। বাঘের থাবার কোনো স্পশর্ পেলেন না সফিক। সাহস করে একটু একটু চোখ খুললেন। বাঘ চারটিকে দেখতে পেলেন। তাকে ঘিরে বসে আছে। তার নড়াচড়া দেখে সজাগ হয়ে উঠে পড়ল। সফিক আলগোছে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নিলেন। একটা লোহার খঁাচা। মাঝখানে পাটির্শন। এক পাটির্শন থেকে অন্য পাটির্শনে যেতে দরজা আছে। সে দরজা খঁাচার বাইরে থেকে বন্ধ করেও দেয়া যায়। বাঘের জন্যই খঁাচাটি বানানো। ঠাকুরগঁায়ের ইপিআর ক্যাম্প দখল করে নিয়ে সেখানেই আস্তানা গেড়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেটাকেই বানিয়েছে ক্যানন্টনমেন্ট। বাঘসহ খঁাচাটি সেখানে আগে থেকেই ছিল বাঙালি ইপিআর কমান্ডারের পশুপ্রীতির শৌখিনতায়। সেটাই এখন হানাদার বাহিনীর নিমর্ম জল্লাদখানা। সফিককে চোখ খুলতে দেখে বাঘগুলো তাকে রেখে অন্য পাটির্শনে চলে গেল। কৌত‚হলে খঁাচার দিকে নজর রাখছিল কয়েকজন পাকসেনা। সফিককে কিছু না করে বাঘগুলোকে অন্যত্র সরে যেতে দেখে তারা অবাক হলো। বাঘ সরে গেলেও সফিক ভয়ে ভয়ে তাদের দিকে তাকালেন। মনে মনে ভাবলেন, আবার যখন ওরা ফিরে আসবে তখন নিশ্চয়ই তাকে ছাড়বে না। ঠিক এ সময়ই তার সামনে এসে পড়ল একটা পোড়া রুটি। বাঘের পেশাবে জবজবে জায়গাটা। তার উপরেই পড়ল রুটিটা। চারপাশে বাঘের গায়ের বোটকা গন্ধ তো আছেই, তার ওপর তাদের মলমূত্রের মাখামাখি। খুব ক্ষুধাতর্ সফিক। এ পযর্ন্ত পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি। চারপাশের পরিবেশ তিনি ভুলে গেলেন। পোড়া রুটিটাই খাবলে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে লাগলেন। কিন্তু ওইটুকু রুটিতে কী হয়! ক্ষুধা যেন আরও বেড়েই গেল। যে লোকটা রুটি ছুড়ে দিয়েছিল তার কাছেই তিনি পানি চাইলেন। ক্রুর হাসি ফুটে উঠল লোকটার মুখে। পাঞ্জাবিদের দিলে রহম নাই পঁচিশে মাচর্ রাতেই তারা তা বুঝিয়ে দিয়েছিল। এ লোকটাও পাঞ্জাবি। সে একটা মগে পানিতে বাঘের পেশাব মিশিয়ে এগিয়ে দিল। তৃষ্ণাতর্ সফিক অতি কষ্টে তাই পান করলেন। এরপর প্রায় অচেতনের মতো পড়ে রইলেন বাঘের খঁাচাতেই। কতক্ষণ এভাবে ছিলেন জানা নেই। খঁাচার বাইরে আবার মানুষের সাড়া। আরও একটা পোড়া রুটি একই কায়দায় এসে পড়ল খঁাচার ভেতর। চোখ মেললেন সফিক। হামাগুড়ি দিয়ে এসে কুড়িয়ে নিলেন রুটি। গোগ্রাসে পেটে চালান করে দিলেন। সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। বুঝতে পারলেন এটা নৈশভোজ। তাকিয়ে দেখেন, খঁাচার ওপাশের পাটির্শনের দরজা খোলা। বাঘেরা চুপচাপ। ওদের এখন আর ভয় লাগে না। সফিক মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকেন। এ সময় একটা বাঘের বাচ্চা চলে আসে এদিকে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় সফিকের দিকে। তার দুই পায়ের ফটকে মাথা রেখে বাঘের বাচ্চাটিও শুয়ে পড়ে। ২. সফিক। সফিকুল আলম চৌধুরী। বাম ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আর বসে থাকেননি। নিজেকেও যুক্ত করেন এর সঙ্গে। পাকিস্তানি বাহিনী সফিককে ধরিয়ে দেয়ার জন্য মোটা টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে তার অপরাধ বহুতর। গ্রামে গ্রামে তিনি ট্রেনিং ক্যাম্পের ব্যবস্থা করেছিলেন মুক্তিকামী তরুণ যুবাদের জন্য। বিশেষ করে পঁাচপীর, সাকোয়া, মাড়েয়া, শানডাঙ্গা, পামুনীতে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে কাজ করেছিলেন। বোদা থানা থেকে রাইফেল নিয়ে আনসারদের সহযোগিতায় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পুরোদমে শুরু হলে সফিক দেশের ভেতর আত্মগোপনে থেকেই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু একসময় তিনি ধরা পড়ে যান। প্রথমে তাকে নয়াদীঘি ক্যাম্পে নেয়া হয়। সেখান থেকে তার হাত-চোখ বেঁধে বোদা থানায় নিয়ে আসা হয়। যাওয়ার পথে অবশ্য তার অনুরোধে চোখের বঁাধন খুলে দেয়া হয়। থানায় এসে দারোগা তাকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে। একজন বিহারি পুলিশ সেখানে ছিল। সফিকের চেয়ারে বসা তার সহ্য হলো না। সে চিৎকার করে উঠল অশ্লীল ভাষায় খিস্তি করে। লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল চেয়ার। সফিক ছিটকে পড়লেন মেঝের ওপর। সফিক উঠে দঁাড়িয়ে দারোগাকে বললেন : আমি তো বসতে চাই নাই। দারোগা কিছু বলল না। সফিকের নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে নিল। সফিকের চোখ আবার বঁাধা হলো। হাতে পরানো হলো হ্যান্ডকাপ। তাকে নিয়ে আসা হলো বোদা স্কুলের মাঠে। চোখের বঁাধন খুলে দেয়া হলে তিনি দেখতে পেলেন মাঠে একজন পাকিস্তানি আমির্ অফিসারকে ঘিরে বসে আছে কয়েকজন মিলিটারি ও বাঙালি চাটুকার। সফিক গম্ভীর কণ্ঠে সালাম জানালেন কোনো জবাবের প্রত্যাশা না করেই। পাঞ্জাবি অফিসার খেঁকিয়ে উঠলো : কি? তুমি হিন্দু নাকি? সফিক বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অফিসারের দিকে। তার চোখ আবার বঁাধা হলো। তাকে দু’হাত ধরে চ্যাং দোলা করে তোলা হলো আমির্ জিপে। সফিক নেতিয়ে পড়েছেন। দুদিন ধরে একদানা খাবারও পড়েনি পেটে। তারপর অবমাননাকর এই ঘোরাঘুরি। চোখ বঁাধা, মানসিক অত্যাচার। এরপর ঠাকুরগঁাও ক্যান্টনমেন্ট। তাকে জিপ থেকে নামিয়ে দঁাড় করিয়ে রাখা হলো। একজন লোক তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সম্ভবত হাতে কাপ পিরিচ। আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। লোকটা তার পাশে দঁাড়ালো। সফিকের পাহারাদার দুই মিলিটারিকে জিজ্ঞেস করল : এ ব্যাটা কে? একজন জবাব দিল : এ তো মুক্তিদের কনের্ল। লোকটা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কষে লাথি বসাল সফিকের পেট বরাবর। অভুক্ত দুবর্ল সফিক সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। তার জ্ঞান ফেরে বাঘের খঁাচায়। ৩. সারারাত আর ঘুম হয় না সফিকের। দুই পায়ের ফঁাকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় বাঘের বাচ্চা। এই বাঘগুলো দেখা যাচ্ছে পাকবাহিনীর মতো ববর্র নয়। কী এক রহস্যময় কারণে তাকে ছুঁয়েও দেখেনি। কিন্তু পাঞ্জাবি মিলিটারিরা কি তাকে ছেড়ে দেবে? বাঘ দিয়ে যখন মারতে পারেনি তখন নিশ্চয়ই গুলি করে হত্যা করা হবে তাকে। এই ভাবনাতেই কেটে যায় সারাটা রাত। মাথার কাছে যখন পোড়া রুটি এসে পড়ল ঠিক আগের কায়দায় তখন বুঝতে পারলো সকালের ব্রেকফাস্ট এসে গেছে। ভোর হয়েছে। চোখ খুললেন সফিক। রুটি খাওয়া শেষ হয়েছে কি হয়নি, তাকে বাঘের খঁাচা থেকে বের করে আনা হলো। চোখ ও হাত আবার বঁাধা হলো। এবার তাকে নিয়ে আসা হলো এক পাঞ্জাবি মেজরের কাছে। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। : তুমি কোন পাটির্ কর। সফিক একটুখানি ভাবলেন। বাঙালি নেতার নাম না বলে একটু কায়দা করে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতার নাম জড়িয়ে তার রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিলেন আমি ওয়ালী খান ন্যাপ করি। খিস্তি পাক আমির্র রক্তে মিশে আছে। অশ্লীল খিস্তি করে সে বলল : তুমি গাদ্দার। ওয়ালী খানও গাদ্দার। এর পরপরই তার জেরা : ভিতরে কতজন মুক্তি রয়েছে? সফিকের নিবির্কার জবাব : আমি জানি না। তিড়িং করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল মেজর। হাতে তার মোটা রুলার। তাই বসিয়ে দিতে লাগল সফিকের মাথায়। পর পর। বারবার। সাত ঘায়ের পরেই লুটিয়ে পড়লেন সফিক। জ্ঞান হারালেন। অচৈতন্য অবস্থাতেই তাকে এনে আবার ফেলা হলো বাঘের খঁাচায়। জ্ঞান ফিরতেই সফিক টের পায় তার সারা মুখ ভেজা চটচটে। প্রবল দুগর্ন্ধ নাকে ঝাপটা দিচ্ছে। মুখে হাত বুলিয়ে টের পায়, তার সারা মুখে মলমূত্রে মাখামাখি পানি চিটমিট করছে। বাঘের মলমূত্র পরিষ্কার করার বেলচা দিয়ে পানির ঝাপটা দেয়া হয়েছে মুখমÐলে। তিনি বাঘ চারটিকে দেখতে পেলেন। দুটি পূণর্বয়স্ক। দুটি বাচ্চা। তার চারপাশ ঘিরে হঁাটাচলা করছে। তাকে ঘিরে মৃত্যুই যেন টহল দিচ্ছে। বুকের ভিতর মৃত্যুভয় আবার দলা পাকিয়ে উঠতে লাগল। চোখ বন্ধ করলেন সফিক। বাঘগুলো চলে গেল পাটির্শনের ওপারে। সেই বাঘের বাচ্চাটি খানিক পরেই ফিরে এলো। তার দুই পায়ের ফঁাকে জায়গা করে নিয়ে একটা পায়ের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ৪. এভাবেই চলতে লাগল। জেরার নাম করে পাঞ্জাবি অফিসার মেজর রানা সফিককে তলব করে আনে। কথা আদায়ের জন্য চলে নিমর্ম নিযার্তন। তারপর তাকে ফেলে রাখা হয় বাঘের খঁাচায়। আবার মৃত্যুভয়। পরেরদিন আবার জেরা : এধারে কতগুলো গাদ্দার আদমি রয়েছে? : জানি না। : শালা, তোমাকে গুলি করে মারব। সফিকের নিবির্কার জবাব : আপনার যা মজির্। মেজরের নিদেের্শ দু’জন পাঞ্জাবি সৈন্য সফিককে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে আসে। শুইয়ে দেয় মাটিতে। তাদের সঙ্গে আরও দু’জন পাঞ্জাবি সৈন্য যোগ দেয়। দু’জন তার হাত-পা চেপে ধরে। বাকি দু’জন উঠে দঁাড়ায় তার দেহের ওপর। ভারী বুটের জুতায় তার সারা শরীর নিদর্য়ভাবে মাড়াতে থাকে। আতর্নাদ করে ওঠেন সফিক। কে শোনে তার মরণ-চিৎকার! জ্ঞান হারান সফিক। বোধ ফিরে পেলে নিজেকে বাঘের খঁাচায় আবার দেখতে পান। পরের দিন আবার মেজর রানার মুখোমুখি। : তুমি তো ইন্ডিয়া থেকে এসেছো। সেখানে কি কি দেখেছো? : আমি তো কখনো ইন্ডিয়ায় যায়নি। আপনাকে তাহলে কি কি কেমন করে জানাব? সফিকের জবাব শুনেই ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল মেজর। লাফিয়ে দঁাড়াল। চরম আক্রোশে মুঠো করে ধরল সফিকের চুল। হ্যঁাচকা টান দিল। আরেক হাতে কষে থাপ্পড় বসালো গালে। পরপর দুই থাপ্পড়। আবার প্রশ্ন : তোমার কাছে যে স্টেনগান রাইফেল ছিল এখন সেগুলো কার কাছে আছে? সফিক শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন : যেসব ইপিআর লোক ইন্ডিয়ায় যাচ্ছিল, আমি সেগুলো তাদের দিয়ে দিয়েছি। মেজর চোখ পাকিয়ে বলল : গাদ্দার শূয়োরের বাচ্চা, এখন পযর্ন্ত ঝুট বাত বলছো! পাঞ্জাবি সৈন্য দু’জনের কাছে আবার তাকে সোপদর্ করা হলো। ওরা তাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলো। তাকে ঠেসে ধরে নাকের ওপর একখানা কাপড় দিয়ে পানি ঢালতে শুরু করে। দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে সফিকের। সে ছটফট করতে থাকে। এবার মৃত্যু বুঝি ঘনিয়েই আসছে। মনে মনে কালেমা পড়েন তিনি। সে অবস্থাতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আবার বাঘের খঁাচায় ফিরে আসা। বাঘের সঙ্গে বসবাস। পরের দিন আবার মেজর রানার মুখোমুখি। এবার সফিক মানসিকভাবে প্রস্তুত। সত্য কথা বলার জন্য এমন ধারার নিযার্তন কাহাতক সহ্য করা যায়! রাতেই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন, মেজর আবার ডাকাডাকি করলে এবার মিছেমিছি সব স্বীকার করে নেবেনÑ মেজরের মনমতো। মেজরের জিজ্ঞাসা : তুমি যখন ইন্ডিয়া থেকে ফিরেছো, তখন সেখানে কি কি দেখেছো তা ঠিকঠাক মতো বলো। সফিক তার ভাবনা মতো জবাব দিলেন : আমি যখন ইন্ডিয়া থেকে ফিরি তার কথা আপনাকে আর কী বলবো। বডাের্রর ওপারে কমসে কম দু’মাইলজুড়ে ট্যাংক আর বহু বহু ইন্ডিয়ান আমির্ দেখেছি। : মুক্তি কোনদিকে? : মুক্তি তো বডাের্র রয়েছে। : ইস্ট পাকিস্তানের ভিতরে কি কোনো মুক্তি রয়েছে? : জি না। ওরা বডাের্রই। এদিকে এসে অপারেশন চালায়। মাথা নাড়ল মেজর রানা। বলল : হ্যঁা, হ্যঁা, ঠিক কথাই বলেছো তুমি। পাশের সৈন্যদের অডার্র করলো : যাও একে নিয়ে যাও। সফিকের আশ্রয় জুটলো আবার বাঘের খঁাচায়। এবার পাটির্শনের দরজা আর খোলা হলো না। বাঘগুলো রইলো খঁাচার ওপাশে। সেদিন বিকেলে সফিক ১৫ জন সাথী পেলেন। তাদের খঁাচায় ঢুকিয়েই পাটির্শনের দরজা খুলে দেয়া হলো। চারটি বাঘই তেড়ে মেরে ছুটে এলো। ঝঁাপিয়ে পড়ল নবাগত লোকগুলোর ওপর। ১০ থেকে ১২ জনের মুখে থাবা মেরে মাংস উড়িয়ে দিল। মানুষের আতর্নাদে কেঁপে উঠল বাঘের খঁাচা। সন্ধ্যায় লোকগুলোকে বাঘের খঁাচা থেকে বের করে আনা হলো। পাশেই সার বেঁধে দঁাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হলো তাদের। বাঘগুলো এখন শান্ত। তারা ফিরে গিয়েছে আগের অভ্যাসে। বাঘের বাচ্চাটি যথারীতি শুতে এসেছে সফিকের পায়ের ফঁাকে। ৫. পরদিন সকালে বাঘের খঁাচা থেকে বের করে আনা হলো সফিককে। খঁাচায় তার আর ফিরে যাওয়া নয়। ক’দিন তার কাটল ভিন্ন বন্দিজীবন। সফিককে পাঠানো হলো ঠাকুরগঁাও জেলে। দু’দিন পর এসডিওর কোটের্। জেরার পর তাকে আবার পাঠানো হলো জেলে। পরের দিন ফের এসডিওর কোটের্ হাজিরা। দু’বছর কারাদÐের রায় নিয়ে আবার জেলখানায়। জজকোটের্ আপিল। মিলে গেল জামিন। জামিনের কাগজ জেলখানায় পেঁৗছলে বেরিয়ে এলেন সফিক। কিন্তু তার নিস্তার নেই। মিলিটারির গাড়ি এসে তাকে জেলগেট থেকে নিয়ে গেল ঠাকুরগঁাও ক্যান্টনমেন্টে। মেজর রানার মুখোমুখি হতেই সে চোখ পাকিয়ে বলল : শালা, তুমি ভেগে যাওয়ার কোশেশ করছো! সফিক বললেন : জি না। জজ সাহেব আমাকে জামিন দিয়েছেন। কে জজ সাহেব? কিসের জামিন? মেজর এসব কিছুই মানতে রাজি নয়। সে তার হাতের বেত দিয়ে সফিককে এলোপাথাড়ি পিটাতে শুরু করল। এটা চলল সে পযর্ন্ত যখন না সফিক জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান ফিরলেই সফিক নিজেকে আবিষ্কার করলেন তার পুরনো জায়গায়। সেই বাঘের খঁাচায়। যেন স্বজন ফিরে আসায় কত আনন্দ এমন ভঙ্গিমায় চারটি বাঘ তার চারপাশে হঁাটাচলা করছে। একটা সময় তারা যথারীতি পাটির্শনের ওপারে চলে গেল। আর বাঘের বাচ্চাটি ফিরে এলো তার অতি পরিচিত লোকটির চেনা জায়গায় শুয়ে পড়তে। বাঘের খঁাচায় বাঘের সঙ্গে মিতালি ও বসবাসের গল্পটি চাউর হলো চারপাশে। বিশেষ করে পাক আমির্ আর তার দোসরদের মধ্যে। আর এ কারণেই সফিক ও বাঘের খঁাচা ক্রমেই দশর্নীয় বস্তুতে পরিণত হলো। একদিন বালিয়াডাঙ্গি থেকে এক মেজর এলো। সফিকের গল্প ও বাঘের কাÐ দেখে সে সফিককে জিজ্ঞেস করল : তুমি কে? সফিক জবাব দিলেন: আমি মানুষ। মেজর বলল : বাঘের গায়ে হাত দাও তো? সফিক বাঘকে স্পশর্ করতেই বাঘ সরে গেল। আরেকদিন পঞ্চগড় থেকে আরেক মেজর এলো। সফিককে বলল : তোমার মাথা বাঘের কাছে নিয়ে যাও। সফিক বাঘগুলোর কাছে গিয়ে মাথা পাতল। বাঘ চারটিই তার কাছ থেকে সরে গেল। খঁাচার এক কোণায় চুপচাপ বসে রইল তারা। কাÐ দেখে তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল : এ তো বহুত শরিফ লেড়কা। কোনো বাঘই একে খাচ্ছে না। কেউ একে ছেড়ে দিও না। সেদিন বিকেলে এক কনের্ল এলো। সফিকের সঙ্গে দেখা করে মিষ্টি স্বরে বলল : তোমার কোনো তখলিফ হচ্ছে না তো! খানাপিনা পাচ্ছো তো? তোমাকে আমি মুসলমান বানিয়ে দেব। এসব রাজনীতি ছেড়ে দাও। কতদূর পযর্ন্ত লেখাপড়া করেছ? সফিক কনেের্লর চোখে চোখ রেখে বললেন : দেখুন কনের্ল সাহেব, আমি তো মুসলমানই। আপনি তো মুসলমান হয়েও বাঘের পেশাব আর পায়খানার মধ্যে আমাকে রুটি খাইয়েছেন। এটা একজন মুসলমানের কেমন ব্যবহার? এতদিন পযর্ন্ত আপনারা আমাকে এখানে রেখেছেন এক বেলায় মাত্র একটা করে রুটি খাইয়ে। আপনাদের কি কোনো মনুষ্যত্বও নেই। এর চেয়ে বরং আপনারা আমাকে গুলি চালিয়ে মেরে দিন। কনের্ল কি বিব্রতবোধ করে? সে শান্ত কণ্ঠে বলল : ঠিক আছে। আমি তোমাকে মারব না। তোমাকে ছেড়ে দেব। আজ তোমার আচ্ছা আচ্ছা খানা মিলবে। কনের্ল চলে গেল। সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যার সঙ্গে ঝড় বাদল বৃষ্টি। খঁাচা খোলা জায়গায়। মুষল বৃষ্টি ও বাতাসে ভিজতে থাকেন সফিক। সারারাত। আজ সফিক জেগে। বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে তাকিয়ে থাকেন সামনে। তিনি নিশ্চিত জানেন, মুক্তি আসছে। কনেের্লর কাছ থেকে নয়। মুক্তির পতাকা নিয়ে এগিয়ে আসছে বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধারা। বৃষ্টি ও বাতাসের আওয়াজে তিনি তাদের জয়ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন।