কবিতায় পরাবাস্তবতা

প্রকাশ | ০৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

আবু আফজাল মোহা. সালেহ
পরাবাস্তবতা হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্তবতা যে বাস্তবতার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কিছু মিল থাকতেও পারে অবশ্য। ইংরেজিতে সুররিয়েলিজম (ংঁৎৎবধষরংস) বলা হয়। বস্তুত চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্তি¡ক ধারণা মেলানো যায় এখানে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের ভাবনাÑ মানুষ অবচেতন মনে অনেক কিছুই করে বা ভাবে। তিনি বলেনÑ এ ভাবনা চেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনেরই বেশি। পরাবাস্তবতা হচ্ছে মানুষের চেতনটা যখন শিথিল হয় তখন মানব মনে অবচেতন প্রভাব প্রভাব ফেলে। এটি হচ্ছে কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পগুলোর মধ্যে যোগসূত্র। মূলত সুইজারল্যান্ড থেকে উঠে আসা ‘ডাডাইজম’ এর পরবতীর্ আন্দোলন হচ্ছে ‘সুররিয়েলিজম’ বা ‘পরাবাস্ততা’। এখন আবার যা জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে। মাকর্ আনেের্স্টর সংজ্ঞা আমরা তুলে ধরতে পারি। সুররিয়েলিজমকে তিনি বলেছেনÑ সুর রিয়ালিস্টের লক্ষ্য হচ্ছে অবচেতনার বাস্তব চিত্র অঁাকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকাও সৃষ্টি করাও নয়। এর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সঙ্গে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেয়া। (ৃ ঃড় পৎবধঃব ধ ংঁঢ়বৎ-ৎবধষরঃু রহ যিরপয ৎবধষ ধহফ ঁহৎবধষ সবফরঃধঃরড়হ ধহফ ধপঃরড়হ, সববঃ ধহফ সরহমষব ধহফ ফড়সরহধঃব ঃযব যিড়ষব ষরভব.) ইতালিতে জন্মগ্রহণ করা ফ্রেঞ্চ আপোলিনিয়ার (১৮৮০-১৯১৮) ‘সুররিয়ালিজম’ শব্দটি উল্লেখ করেন। তার লেখা কবিতায় আদি-সুররিয়ালিজম কাব্যের নিদশর্ন রয়েছে। ‘টাইরেসিয়ামের স্তন’ নাটকে প্রথম সুররিয়ালিজম প্রয়োগ করেন তিনি। পরে তা ইংরেজি ও জামার্ সাহিত্যেও এ ধারা সম্প্রসারণ হয়। ‘চঁাদের আলো’ কবিতায় তিনি পরাবাস্তবতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন এভাবেÑ ‘ক্রোধীর ঠেঁাটে শ্রবণসুখকর চঁাদ আর রাতের লোভাতর্ নগর ও উদ্যান মৌমাছির মতো নক্ষত্রদের ভ্রম হয় এই আলোকময় মধুতে আঙুরবাগান আহত আকাশ থেকে ঝরছে মধুর মধু চঁাদের রশ্মি যেন মধুর ঝিকিমিকি ...হাওয়ায় গোলাপে মিশছে মধুর চন্দ্রিমা।’ এল দুয়ার, সালভার দালি, চিত্রশিল্পী পল ক্লে, নেরুদাসহ অনেকে সুররিয়েলিজম কবিতা লিখেছেন বা সাহিত্য রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে অনেকে পরাবাস্তবতার প্রয়োগ বেশ কিছু কবি প্রয়োগ করেছেন। বতর্মানকালের প্রায় সব কবিই পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল কবিতা/গানে সামান্য পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, সেই পাহাড়ের ঝণার্ আমি...।’ বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবতীর্, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবিতায় পরাবাস্তবতা এনেছেন মাঝে মধ্যে। আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি বিষ্ণু দে তার ‘ঊবর্শী ও আটেির্মস’ কাব্যগ্রন্থে প্রথম সাথর্ক সুররিয়েলিজম বা পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেন। তবে পরাবাস্তবতার উপাদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তার ‘ঝরাপালক’, ‘বনলতা সেন’, ‘ধূসর পাÐুলিপি’ কাব্যগ্রন্থে পরাবাস্তবতার ব্যবহার অনেক বেশি। তাকে ‘পরাবাস্তবতার কবি’ বলা হয়ে থাকে। পরাবাস্তবতার সাথর্ক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন এ বিষয়ে। কয়েকটি উদাহরণ দিই। ‘জানতাম তোমার চোখে একদা জারুলের বন ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ’- ( কোন এক পরিচিতাকে, শামসুর রাহমান) ‘অনেক আকাশ’ কবিতায় সৈয়দ আলী আহসান ধরা দিয়েছেন এভাবে- ‘... সোনার ঘাসের পাতা ঘুমের মতো অজস্র পাতার ফঁাকে হৃদয়ের নদী হয় চঁাদ নেমে ঘাসে’- (সংক্ষেপিত) আল মাহমুদ বেশ কয়েক জায়গায় পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। ‘নদীর ভিতরে নদী’ কবিতায় পরাবাস্তবতার একটু প্রয়োগ দেখি- ‘নদীর ভিতরে যেন উচ্চ এক নদী ¯œান করে। তিতাসের স্বচ্ছ জলে প্রক্ষালনে নেমেছে তিতাসই। নিজের শাপলা লয়ে নেমে নদী নদীর ভিতরে ঠাট্টা বা বিদ্রæপ নেই, শ্যেনচক্ষু, নেই চারণের বালি।’ মান্নান সৈয়দ বলতেনÑ সুর রিয়ালিজমই হলো প্রকৃত বাস্তবতা। তিনিও কবিতায় সাথর্ক পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ (১৯৬৭)। এখানে সুররিয়ালিজমের সাথর্ক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি জীবননান্দ দাশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা লিখেছেন এবং গবেষণা করেছেন। আর এ কারণে জীবননান্দ প্রভাব বিস্তার করেছে কবির মনে। কয়েকটি কবিতায় পরাবাস্তবতার উদাহরণÑ ১) ‘দেখেছি ঘাসের মেঝে ছিন্ন লাল মুÐু নিয়ে খেলে বিনা অপব্যয়ে সূযর্ টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি।’ (কবিতা, রাত্রপাত) ২) ‘জ্যোৎস্না হয় জল্লাদের ডিমের মতো জলহীন মুÐু জোড়া-জোড়া চোখ সাতটি আঙুলের ও একমুষ্টি হাত রক্তকরবীর অন্ধকার এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার’- ( জ্যোৎস্না কবিতায়) ৩) ‘একেকটি দিন একেকটি সবুজভুক সিংহ’ কবিতায়- ‘পরিবতের্নর ছাদ বিড়ালের মতো অন্যমনস্ক হবার সুযোগে পা টিপে-টিপে এগুলো বরফের মানুষ নাজেহাল ছোট-ছোট নুড়ির আওয়াজ যখন দজির্ কাপড় হয়ে গেল মাংসভুক চেষ্টায়’। পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি কবিতার কিছু চরণ তুলে ধরি। তিনি পাঞ্জাবির পকেটে চঁাদের উঁকি দেওয়া দেখতে পান- ‘দেখি তার চুলে রাত্রি থেমে আছে চোখে সবুজ প্রিজমের ভিতর থেকে লাফিয়ে পড়ে ফড়িং ... বেরিয়ে আসছে সান্ধ্যবেলার সবগুলো তারা দেখি তার পাঞ্জাবির ঢোল পকেটে উঁকি দিচ্ছে চঁাদ।’ ‘বনলতা সেন’ কবিতাগ্রন্থের ‘তুমি’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন- ‘নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ; বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস; কঁাচপোকা ঘুমিয়েছেÑ গঙ্গাফড়িং সে-অ ঘুমে; আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি। মাটির অনেক নিচে চলে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে তুমি আজ? কোন কথা ভাবছ অঁাধারে?’ তার অনেক কবিতায় পরাবাস্তবতার গন্ধ পাওয়া যায়। বতর্মানের অনেক কবিই পরাবাস্তবতা বা জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ করছেন সুনিপুণভাবে। আসলে আধুনিক কবিতাকে গতিশীলতা আনতে পরাবাস্তবতার কাছে যেতেই হবে। আর উত্তরাধুনিক কবিতায় এর চাহিদা আরও বেশি।