দহন

প্রকাশ | ০৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

শারমিন সুলতানা রীনা
আমারে চিনবার পারছ? এতক্ষণ মাথা নিচু করে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিল গায়েন। আচমকা ধ্যান ভাঙে। কেমন আছোস সখী? বাপ-মায় বড় বাড়ি, বড় বংশ টাকা-পয়সা দেইখা বিয়া দিছে। মহারানী বানাইতে। আমি খারাপ থাকি ক্যামনে? তুমি কেমন আছো? শ্রোতে ভাসা শ্যাওলা যেমন থাকে তেমন কইরা বঁাইআ আছি আইজ এইখানে কাইল সেইখানে। এইতো গায়েনের জীবন। এইডা তোর শ্বশুরবাড়ি জানলে আইতাম না। সেই রাইতে চোরের মতো পলাইয়া গেছিলা ক্যা? একবারও কি তোমার সখীর কথা মনে পড়লো না? একবারও কি মুখখান ভাসে নাই তুমার চোখে? তোমারে ছাড়া সখী ক্যামনে বঁাচবো? ঃ ভাবছি বইলাই সাত পুরুষের ভিটা-মাটি থুইয়া রাইতের আন্ধারে ঘর ছাড়ছি। তুইও কি বুজস নাই বাউন্ডেলে বাউলের হাতে তোর মা বাপ কোনোদিন তোরে তুইলা দিব না? ঃ জানতাম, কিন্তু এইডাও জানতাম যে ভালোবাসে সে কিছু মানে না। সখীও জানে এ কথা, তবু সব জেনে বুঝে গায়েনকে সে ভালোবেসেছিল। গায়েনের কণ্ঠ বঁাশির সুর তাকে পাগল করে তুলেছিল। কত রাত এই সুর তাকে ঘরছাড়া করেছে। এ নিয়ে সখীর বাড়িতে কত অশান্তি হয়েছে তবু সখী কারও কাছে নত হয়নি। চুপ থেকেছে। গায়েনকে নিয়ে ঘর বঁাধার স্বপ্নে বিমোহিত থেকেছে। এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় যা ভাবে ভাবুক সমাজ গায়েনের সাথে পালিয়ে যাবে সে। গায়েন কে খুলে বলে তার মনের কথা। কাল ভোর হবার আগেই গায়েনকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। কলংকে সে ভয় পায় না। গায়েন নিশ্চুপ। কোনো কথা নেই তার মুখে। বাকরুদ্ধ। কি জবাব দেবে তার? নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ ভেবে রাত জেগে সখী নিজেকে গুছায়। ভোর হবার আগেই ঘর ছেড়ে গায়েনের বাড়ির দিকে ছোটে। এসে দেখে গায়েনের ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। তার স্বপ্ন ভেঙে খান-খান হয়ে যায়। দুঃখ অভিমানে আবার সে বাড়ি ফিরে আসে। কাউকে বলতে পারে না এই করুণ পরিণতির কথা। একদিন বাবা-মার পছন্দ করা ছেলের সাথে সখীর বিয়ে হয়। কিন্তু তার হৃতপিÐ জুড়ে থাকে গায়েন। একটা ক্ষোভ তাকে কুরে কুরে খায়, যদি কোনোদিন দেখা হয় একবার জানতে চাইবে কেন সে এমন করেছে? বাড়িতে আজ গানের আসর। সন্ধ্যার পর শুরু হবে অনুষ্ঠান। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসবে গান শুনতে। বাইরে তাদের জন্য রাতের খাবারের আয়োজন চলছে। ছেলেমেয়েরা সেখানে আনন্দে মেতে আছে। বাড়ির কতার্ কাজে। গায়েনের কাছে তার অনেক অভিযোগ। আজ সুযোগ এসেছে বলার। কিন্তু কি বলবে গলা দিয়ে তার কোনো কথা বের হচ্ছে না। গায়েনও নীরব। একটা দীঘর্শ্বাস অলক্ষ্যে দুজনের কণ্ঠই রোধ করে রাখে। ভর দুপুর, প্রচÐ রোদ। সূযর্টা ঠিক যেন মাথার ওপর। দর দর করে ঘামছে গায়েন। সে দিকে তার খেয়াল নেই। মুখে সে কিছু বলতে পারে না তার অনুভ‚তির প্রকাশ ঘটে গান আর বঁাশিতে। সখী একটা গামছা এগিয়ে দেয়। ঃ শরীর খান মুছো। সামনের ঘাট থেইকা গোসল কইরা কাচারি ঘরে গিয়া বিশ্রাম নেও। তোমার খাওনের ব্যবস্থা হইতেছে মাগরিব শেষ হবার পর পুরো বাড়ি লোকে লোকারণ্য। গায়েন প্রস্তুতি নিচ্ছে গানের। উঠোনের মাঝখানে স্টেজ ও সামিয়ানা টানানো হয়েছে। গায়েন গিয়ে বসে সেখানে। মেয়েদের বসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা। কয়েকজন জোর করে সখীকে এনে বসায়। সখীর বুকের ভিতরে একটা শূন্য নদীর বসবাস ছিল এতকাল। সেই শূন্যতায় ঢেউ বয়ে গেছে নীরবে। আজ সে নীরবতাকে আর আটকে রাখতে পারছে না। বঁাধ ভাঙা কান্না গ্রাস করে নিচ্ছে সে নীরবতা। গায়েন তার জীবনে কোনো মোহ ছিল না। হৃদয় পোড়ানো মমর্দাহ প্রেম। যার গান আর বঁাশির সুর ঘুচিয়ে দিত সবার শাসনের গøানি ও অপমান। দগ্ধতায়ও এত সুখ নিসিদ্ধ দহনে না পুড়লে কে তা বুঝতে পারে? আজও মেহেদি পাতার মতো পুষে রেখেছে সে দহন। যার উপরে সবুজ ভিতরটা রক্তে রঞ্জিত। এতটা বছর নিভৃতে ছিল যে নদী আজ সে নদীর বুকে প্রজ্বলিত চিতা। অনন্ত তৃষ্ণায় পুড়ে যাচ্ছে বুক। এ কী হলো সখীর? করতলে রক্তের কালিতে লেখা ছিল, গোপনে এঁকে গেছে সান্ত¡নার নিবিড় সংসার। যেখানে সুজন আর সখী ছাড়া কেউ নেই। চঁাদের জোছনাও তার একচ্ছত্র অধিকারে। নীরব কল্পনায় ছিল দুঃস্বপ্নের নিঃশব্দ চিৎকার। ডানা ভাঙা পাখির আতর্নাদ। এতগুলান বছর পর ক্যান দেখা দিলা গায়েন? যারে ভুলবার চাইছিলাম তারে আবার জ্বালাইয়া দিতে দেখা দিলা? জ্বলন্ত আগুন হইয়া পুড়াইতে আইছো এই ঝলসানো মানুষটারে? কেন উন্মাতাল করতে ফিরা আইলা ক্ষণিকের লাইগা? বঁাশিতে সুর বাজে, গেয়ে ওঠে গায়েন। ‘সোনা বন্ধুরে আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি’ সখী নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারে না। ঘরে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দেয়। তার এতদিনের বঁাধ ভাঙা কান্না জোয়ারের মতো প্রবাহিত হতে থাকে\