শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই

এস ডি সুব্রত
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

স্বল্প জীবনে অল্প লিখে যারা বেশি সুনাম কুড়িয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাদের মধ্যে একজন।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মাত্র চুয়ান্ন বছর বেঁচেছিলেন। স্বল্প জীবনে লিখেছেন অল্প কিন্তু নিজেকে বাংলা সাহিত্যের আকাশে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন অনায়াসে। লিখেছেন দুটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধ আর কয়েকটি ছোটগল্প।

তার সাড়া জাগানো উপন্যাস বহুল আলোচিত গ্রন্থ-

'চিলেকোঠার সেপাই' ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত। এটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। চিলেকোঠায় বাস করেও স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বৃহত্তর আন্দোলনের জোয়ারে একজন সাধারণ মানুষের যোগ দিতে সক্ষম হওয়ার এক গল্প চিলেকোঠার সেপাই- এ আমরা দেখতে পাই।

রাজনীতির নানা ঘটনা পরম্পরা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। সেখানে চিত্রিত হয়েছে, একদল কীভাবে দিনের পর দিন ধরে বিনির্মাণ করে চলেছেন ঊনসত্তর। আবার তারাই হারিয়ে যাচ্ছেন; এর বিপরীতে উঠে আসে আরেক শক্তি। তারাই প্রবল বেগে প্রভাব বিস্তার করছেন সেই বিনির্মিত ঊনসত্তরের ঘটনাপ্রবাহের ওপর। এর মাঝেও ফুটে উঠেছে মানুষের নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য, চরিত্রের নানা দিক। গল্পে গল্পে এগিয়ে গেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম। শত কুসংস্কার নিয়েও আন্দোলনে তুখোড় ভূমিকা নিচ্ছেন এক 'প্রান্তিকজন', আবার 'আধুনিক শিক্ষা' নিয়েও সেই ভূমিকা থেকে একটু দূরবর্তী অবস্থান নিচ্ছেন, কেবল তার শ্রেণি চরিত্রের কারণে। '৬৯-এর মিছিল বর্ণনায় লেখকের যে ভাবাবেগ বইটিতে আমরা দেখতে পাই তা বাস্তবতাবোধেরই সম্প্রসারণ। তাই তো মিছিলের উত্তাপ, অস্তিত্ব-বিচ্ছিন্ন ওসমান চরিত্রটিকেও আলোকিত করতে পেরেছিল। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহ একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে এই উপন্যাসে। নগরকেন্দ্রিক মুসলিম লীগপন্থি নব্য সুবিধাভোগী শ্রেণির সঙ্গে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন্ন শ্রেণির দ্বন্দ্ব ও গ্রামকেন্দ্রিক আইয়ুব গণতন্ত্রীদের দৌরাত্ম্য ও শোষণ এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয় হিসেবে চিত্রিত হয়েছে লেখকের অনবদ্য কলমের ছোঁয়ায়। অন্যদিক থেকে ভাবলে এর প্রধান চরিত্র বলা যায় হাড্ডি খিজিরকে, যে কিনা ওসমানের বাড়িওয়ালার ভাগনের গ্যারেজ দেখাশোনা করে।

'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসটি ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে 'রোববার' নামের সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৮৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ওসমান গণি ওরফে রঞ্জু দেশভাগের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসে। ওসমানের বাবা থেকে যান ভারতে, বাবা বেঁচে আছে কি না তা-ও জানে না সে। সবকিছু থেকে সে এতটাই বিচ্ছিন্ন আর ছিন্নমূল যে ঢাকার ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এক বাড়ির চিলেকোঠায় বাস করাই তার জন্য যথাযথ হয়।

পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে ১৯৬৯-এর গণঅভু্যত্থানে শহর, নগর, বন্দর, গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠছে। প্রতিদিন মিটিং, মিছিল, গণআদালত, কারফিউ ভাঙা এবং ক্ষোভ ও বিদ্রোহে সব স্থানের মানুষ তখন মুক্তির লক্ষ্যে উন্মত্ত। ওসমান গণি সবকিছু দেখে, শোনে, মিছিল-মিটিংয়েও যায়। কিন্তু কোনো কিছুতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। চিলেকোঠার চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে তার দিন কাটে। তারই সহনামী প্রতিবেশী কিশোর রঞ্জুর প্রতি তার ভালোবাসা কাজ করে। কিন্তু রঞ্জুর তরুণী বোন রানুকে ওসমান অবচেতন মনে ভালোবেসে ফেলে। এছাড়া এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন, ভোটের রাইট প্রার্থী আলতাফ, রাজনীতি বিশ্লেষক বামপন্থি আনোয়ার, রিকশাওয়ালা হাড্ডি খিজিরসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষ তার চারপাশ ঘিরে থাকে। একটি বিশেষ সময়ের সবধরনের মানুষকে লেখক এই উপন্যাসে এক ফ্রেমে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। শহরের আধুনিক উচ্চবিত্ত বুদ্ধিজীবীর পাশাপাশি বস্তির খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের চোখে একটি গণআন্দোলনের প্রকৃত চেহারা লেখকের অসামান্য বর্ণনা-নৈপুণ্যে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।

ওসমানের বন্ধু আনোয়ার বামপন্থি রাজনীতির সক্রিয় সদস্য। যমুনার দুর্গম চর এলাকায় গ্রামে গিয়ে মহাজন জোতদারসহ শোষক শ্রেণির ভয়াবহ রূপ দেখে নিজ শ্রেণির উপরে তার ঘৃণা জন্মায়। আরেক চরিত্র হাড্ডি খিজির একটু আলাদা ধরনের রুক্ষ্ণ মানুষ। এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন মিয়ার রিকশার গ্যারেজ থেকে রাজপথের মানুষের সঙ্গে মিছিল করে স্স্নোগান দিতে তার ভালো লাগে। সময় আর সুযোগ পেলেই তাই চলে যায় মিটিং-মিছিলে। এক ভরা জনসভায় ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রসঙ্গ উঠলে হাড্ডি খিজির নির্ভয়ে মহাজনের বিরুদ্ধে কথা বলে। গণঅভু্যত্থানে ভীত শাসকদের আরোপ করা সামরিক শাসন এবং নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে চারপাশের মানুষের মধ্যে এক বিহ্বলভাব লক্ষ্য করা যায় যা ওসমানের মনকে আলোড়িত করে। ঊনসত্তর যে স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেয় এবং এই ঊনসত্তরই যে হাজার বছরের বাংলার শোষণ মুক্তির হাতিয়ার তা লেখক ওসমানের চিন্তায় এবং চোখে দেখিয়েছেন। অবশেষে ওসমানকে বিচ্ছিন্ন ঘর থেকে তাকে বেরিয়ে পড়তে প্ররোচনা দেয় গণঅভু্যত্থানের সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কারফিউ চাপা রাস্তায় মিলিটারির হাতে প্রাণদন্ডে দন্ডিত হাড্ডি খিজির। সমাজের তথাকথিত নিম্ন্নস্তরের সামান্য একজন শ্রমিকই ওসমানের মুক্তি আকাঙ্ক্ষী সত্তাকে জাগিয়ে তোলে প্রবলভাবে। ওসমানকে আটকে রাখার জন্য বন্ধুদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সে ঘরের তালা ভেঙে সবার অগোচরে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। চিলেকোঠার বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে ওসমানের সামনে অজস্র পথ খুলে যায়। মূলত, চিলেকোঠার চার দেয়ালের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা ও আত্মপ্রেমের বন্ধন থেকেও তার মুক্তি ঘটে। বৃহত্তর গণআন্দোলনের জোয়ারে অবশেষে ওসমান একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মিশে যেতে সক্ষম হয়। লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জাতীয় রাজনীতির অন্তঃস্বরূপকেও প্রত্যক্ষ করেছেন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। ঊনসত্তরের প্রবল গণআন্দোলনের টানে জাতীয় মুক্তির সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হলেও সাধারণ মানুষের জীবনধারণের গুণগত পরিবর্তন দুঃস্বপ্নই থেকে যায়। ওসমানের আত্ম-রূপান্তরে এ কারণেই সম্ভবত তার শ্রেণিসত্তার বিলুপ্তি নির্দেশ করেন ঔপন্যাসিক। বাঙালির মুক্তি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও সংগ্রামে পরিণত হয়। শহরের বস্তি থেকে শুরু করে যমুনার দুর্গম চর এলাকা পর্যন্ত উপন্যাসটি বিস্তৃত হয়েছে। লেখকের অতি সূক্ষ্ণ এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ শক্তিতে উপন্যাসে একটি আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে। লেখকের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখায় ঘটনার সঙ্গে চরিত্রের বাস্তবতা, কল্পনা, চেতনা অন্তঃচেতনার মিশ্রণে বইটিতে পাঠক নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। ইতিবাচক রাজনীতির উপস্থাপনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বরূপটি উপস্থাপনে 'চিলেকোঠার সেপাই' একটি অসাধারণ উপন্যাস নিঃসন্দেহে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে