তেপান্তরের বাঁশি

প্রকাশ | ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

আতা সরকার
১. রাজপুত্র আর উজিরপুত্র। বেজায় ভাব। গলায় গলায়। একসাথে ঘোরে। একসাথে খায়। সারা দিনমান একসাথে চলাফেরা। শিকারে যাওয়া। এক বিকালে তেপান্তর মাঠে ঝাঁকড়া ডালপালার গাছতলায় বসে আধ-ডোবা সূর্য-রোদের খেলা দেখছে। দুজন পাশাপাশি। দেখতে দেখতেই গুজগুজ। ফুসফুস। দিনভর রাতভর এতো কথা বলে! তাও তাদের কথা আর ফুরোয় না। তেপান্তরের ওই প্রান্তে এক রাখাল ছেলে। সেও বসে আরেক গাছতলায়। বসে বসে বাঁশিতে সুর তুলে মায়াখেলা করছে। রাজপুত্র আর উজিরপুত্রের চোখ পড়ল রাখালের ওপর। উজিরপুত্র তন্ময় হয়ে ওদিকে তাকিয়েই রইল। রাখাল ছেলের সঙ্গে উজিরপুত্রের চোখাচোখি। উজিরপুত্র ডাকল হাতের ইশারায়। ওখান থেকে এতোটুকু নড়ার ইচ্ছে নেই রাখাল ছেলের। নেহায়েত দায়। নইলে বুঝি গর্দান যায়। এসে দাঁড়াল দুই বন্ধুর সামনে। উজিরপুত্র মুগ্ধ। কথায় সেই আমেজ রেখে বলল : বাহ! বেশ সুন্দর তো! মোহন সুর! আমাদের সামনে বাঁশিটা আবার বাজাও তো। রাখাল ছেলে তীর্যক তাকায় রাজপুত্র উজিরপুত্রের দিকে। তারপর চোখ চক্কর খায় তেপান্তর প্রান্তরের চারপাশটায়। কেউ কোত্থাও নেই। এরপর সে উজিরপুত্রের সামনেই মাঠের ঘাসে থুথু ফেলে। তার চোখে ঘেন্না। দাঁত কিড়মিড় করে বলে : জাউরা! এ কোন্‌ ভাষা! কেমন ভাষা! এমন ভাষা এমন শব্দের সাথে পরিচয় নেই রাজপুত্র উজিরপুত্রের। তবে রাখাল ছেলের ভাব-গতিক মুখভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছে: কথাটা ভালো নয়। রাজপুত্র অবাক হয়ে জানতে চাইল: এ কথাটার মানে কী? রাখাল ছেলে মুখ ফিরিয়ে বলল : প্রাসাদে ফিরে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করোগে। উজিরপুত্র বলল : আচ্ছা তাই করব। কিন্তু এখন বাঁশিতে একটু সুর বাজাও। রাখাল ছেলের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। কথায় জোর দিয়ে বলল : না। বাজাব না। রাজপুত্র উজিরপুত্র অবাক। ওদের কথা মান্য করে না, এমন বুকের পাটা এ তলস্নাটে কোন লোকের নাই। উজিরপুত্র জিজ্ঞেস করল: কেন? রাখাল ছেলে বলল : অসতী মায়ের ছেলের সামনে আমার বাঁশি বাজবে না। এবারের কথাটা রাজপুত্র উজিরপুত্র দুজনই বুঝল। তাদের মাথায় এবার রাগ চড়ে গেল। বলল : এমন অন্যায় কথা তুমি বলতে পার না। রাখাল ছেলে : প্রাসাদে গিয়ে তোমার মাকে পরখ করোগে, তার সতীপর্দা ঠিক আছে কিনা! রাজপুত্র উজিরপুত্রের কান গরম হয়ে উঠল : কী অশ্লীল কথা! রাগও হলো তেমন। রাখাল ছেলেকে তাও কিছু বলল না। ফিরে চলল প্রাসাদের দিকে। রাগে উত্তেজনায় টগবগ ফুটছে রাজপুত্র উজিরপুত্র। তেপান্তর মাঠ পেরিয়ে এসে হাজির হলো উজিরের বাসভবনে। নিজ মহলেই ছিল উজিরপত্নী। সামনে পেয়ে উজিরপুত্র লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে প্রশ্ন করল : মা, এ কথা আমার জিজ্ঞেস করা উচিত নয়, আমার জিজ্ঞেস করার কোনো ইচ্ছা বা রুচি কোনোটাই নেই, কিন্তু পাজি বদমাশ একজন আমাদের মাথায় এই সন্দেহের পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে, তাই আজ আপনার কাছে জানতে চাইছি মা, আপনার কি সতীপর্দা অক্ষুণ্ন আছে? এ কী প্রশ্ন! তাও আবার ছেলের মুখ থেকে! উজিরপত্নী লাল হয়ে উঠল। মুখ ফিরিয়ে অন্য ঘরে চলে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু পথ আগলে দাঁড়িয়েছে ছেলেরা। শুধু উজিরপুত্র নয়, রাজপুত্রও। চাপাচাপি। আর চাপাচাপি। একই প্রশ্ন বারবার। বারে বারে লজ্জাকর একই প্রশ্ন। শুনতেও কান গরম হয়ে উঠছে। ছেলে আবার শেষ পর্যন্ত গোস্বা করে সংসার-বিবাগী হয়ে চলে যায় কিনা, এই আশঙ্কায় উজিরপত্নী শেষে মুখ খুলল : বাপধন, যা ফাটার, সময় হলে তা ফাটেই। তা না হলে তোর জন্ম হতো কী করে? রাজপুত্র এবার উজিরপত্নীর চোখের ওপর তার তীক্ষ্ন চোখ রাখল। মায়াহীন কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করল : তার মানে কি আপনি অসতী? উজিরপত্নীর মাথাটা এবার কেন জানি নিচু হয়ে গেল। চোখ দুটোও মনে হলো ছলছল। মৃদুকণ্ঠে বলল : সে কথা তোমার পিতা মহামান্য মহারাজের কাছে গিয়ে করো। এই রাজ্যের তিনিই সর্বাধিপতি। তাকে এ কথাও জিজ্ঞেস করতে ভুলো না, তিনি নিজেও কুমার আছেন কিনা? তিনি সব জানেন। তার কথা থেকেই সব বুঝতে পারবে। রাজপুত্র উজিরপুত্র পঙ্খীরাজ ঘোড়ার চাইতেও দ্রম্নত এক উড়ালে চলে এলো রাজপ্রাসাদে। অন্দরমহলে গট গট করে ঢুকে পড়ল রাজার আরামখানায়। রাজা তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। চারপাশের সুন্দরী রূপসী দাসীরা তার খেদমতে ব্যস্ত। দুই জোড় মানিক বন্ধুকে হনহন করে ঢুকতে দেখে দাসীরা সরে পড়ল। রাজার হাতের ইশারায় তারা সব আরামখানা থেকে বেরিয়ে গেল। রাজার মুখে মাপা রাজকীয় হাসি। দুই পুত্র দুই বন্ধুকে হাত ধরে এনে বসালেন তার পাশে। মোলায়েম কণ্ঠে বললেন : এমন অসময়ে তোমরা আমার কাছে কেন? রাজপুত্রের গলায় টগবগে উত্তেজনা। কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল : আব্বা হুজুর, আপনি কি এখনো কুমার? রাজাপুত্রদের উত্তেজনা দেখলেন। অবাক হলেন। তবে এ নিয়ে কিছু বললেন না। একটুখানি হাসলেন। ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখলেন এক চিলতে মৃদুহাসি। তারপর গম্ভীর। রাজার মতো। বললেন : রাজধর্ম পালন করতে হলে কুমারত্ব ত্যাগ করতে হয়। রাজাকে করতে হয় অনেক ভূমিকা পালন। করতে হয় প্রজা রঞ্জন। রমণী রঞ্জনও। এরপর রাজা পুত্রদের দিকে তাকালেন তীর্যক দৃষ্টিপাতে। চাপা, কিন্তু তীক্ষ্ন কণ্ঠে বললেন: কুমারই যদি থাকতাম আমি, তবে তোমরা জন্মগ্রহণ করতে কীভাবে? তোমাদের মায়েরাই বা রাজকীয় আনন্দ উপভোগ করতেন কিসে? উজিরপুত্রের মুখমন্ডলে সন্দেহের দানা জমতে থাকে। গলাটা হয়ে আসে ভার-ভারিক্কি। খুঁতখুঁতে মন নিয়েই প্রশ্ন করে, প্রশ্নটা যেন নিজেই নিজেকে করা: আমার মা কি তবে অসতী? রাজা রাজপুত্র উজিরপুত্র দুজনের মাথাতেই তার দুটি হাত ছড়িয়ে দিলেন। ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন : এইসব কোনো বড় কথা নয়। বড় ঘটনা হলো, তোমরা দুজন এসেছ এই সুন্দর পৃথিবীতে। এই রাজপ্রাসাদেই তোমরা বেড়ে উঠেছ একসাথে একইভাবে। এক চোখেই দেখছি তোমাদের দুজনকেই। কখনোই কোনো তফাত করি নাই। তোমরা দুজন- একজন হলে রাজপুত্র, আরেকজন উজিরপুত্র- ভাই ভাই সম্পর্ক থাকলেই বা অসুবিধা কোথায়? রাজপুত্র উজিরপুত্রের চোখ গলে আপনা আপনি পানি পড়ছে ঝরঝরিয়ে। ২. রাজপুত্র উজিরপুত্র ঘোড়া ছোটায়। ছুটতে ছুটতে তেরো নদী পেরিয়ে যায়। তুরকী তেজি তাজা ঘোড়া দুটো এখন ঘেমে-নেয়ে একাকার। দুটি ঘোড়ার আটটি পাই এখন যেন আর দৌড়াতে অনিচ্ছা জানায়। পায়ের ক্ষুর ঘষটে রাজপথ ঠুকছে। রাজপুত্র উজিরপুত্র ঘোড়া দুটোকে ছেড়ে দেয়: যা ঘোড়া, যেথায় ইচ্ছা চলে যা, পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে নদী-সাগর ছাড়িয়ে আঘাট-অঘাট মাড়িয়ে মন-পবনের সাথে পালস্না দিয়ে তোদের মতো হারিয়ে যা। রাজপুত্র উজিরপুত্র সম্বল করে যার যার নিজ নিজ পদযুগলকেই। হাজার রাজ্যের ধুলো মাখিয়ে ওরা দুজন যখনই পা রেখেছে তেপান্তর মাঠের সবুজ ঘাসে, তখনই বেজে ওঠে সুর মাতাল বাঁশি। এই বাঁশি কি সেই রাখাল ছেলের বাঁশি? তাই বা হবে কী করে? ওরা তো তাদের রাজ্য থেকে দূরে বহু দূরে! তেপান্তর ছাড়িয়ে আরেক তেপান্তরে! মাঠজুড়ে তারা হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতেও সবুজ ঘাসের মাঠ আর ফুরোয় না। ধপাস করে তারা বসে পড়ে মাঠের সবুজ ঘাসে। বাঁশির সুর যেন আরও মিঠে হয়ে ওঠে। ওরা দুজনই কেমন জানি বিভোর হয়ে যায়। চোখ বুঝি বুঁজে আসে! দুজনই চোখ ঠিকঠাক মতো খুলতেই দেখতে পায় রাজপ্রাসাদের পাশে সেই তেপান্তর মাঠ। ওরা যেখানে বসে আছে তার পাশেই গাছটা। সেই গাছের গুঁড়িতেই হেলান দিয়ে রাখাল ছেলেটা আপনমনে বাঁশির সুর ছড়িয়ে যাচ্ছে মায়ার বাঁধন জড়িয়ে। কোনোদিকে তার নজর নাই। নাই এতটুকু খেয়ালও। রাজপুত্র উজিরপুত্রও গাছে হেলান দিয়ে বিভোর হয়। জন্ম-জন্মান্তরের নাম-ঠিকানা পরিচয় বুঝি বা ভুলেই যায়।