শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মন খারাপের দিনে

মুহাম্মাদ রাহাতুল ইসলাম
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে বসলাম। আজকে কেন জানি মনটা ছটফট করছে। কিছুই ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম নাহ এখানে আর ভালো লাগছে না। বসায় চলে যাব। নিজের ব্যবসার এ একটা সুবিধা। যখন-তখন যা ইচ্ছে করা যায়। তাছাড়া আমার কর্মচারীরা যখন শুনবে আজকে মাগরিবের পরপরই যাবতীয় কর্যক্রম বন্ধ, তখন তারা অবাক আর আনন্দিত না হয়ে পারবে না। প্রায়ই আমি ওদের চমকে দেই। এটা করতে আমার ভালো লাগে। আজকেও তাই করব। যেই ভাবা সেই কাজ।

মন খরাপ করে রাস্তায় হাঁটছি। হঠাৎই একটা পিচ্চি এসে বলল, ভাই দুইডা ফুল নেন, টেহা দিয়া কিছু কিন্না খামু। কথা শুনে মন খারাপটা বাড়ল না কমল বোঝা গেল না। চুপচাপ দুইটা ফুল কিনে নিলাম। এদিকটায় ফুলটুল খুব একটা দেখা যায় না। কাল কোনো বিশেষ দিন হবে বোধহয়, তাই চারদিকে ফুলের ছড়াছড়ি। আজকাল রাস্তার এসব ছেলেপুলেরাও বিশেষ দিনগুলোর হিসাব রাখে। বাহ্‌ বিষয়টা ভেবে ভালোই লাগল।

\হদরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঠকঠক আওয়াজ করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল। বোঝাই যায় ভিতরের মানুষটা এই পরিচিত আওয়াজটার অপেক্ষায়ই থাকে। সিটকিনি খোলার পর কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। কারণ বিপরীত পাশের মানুষটা হুইল চেয়ারে বসা। সে আমার প্রিয়তম স্ত্রী।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে মানুষটা আমার সঙ্গে বসবাস করে। সুতরাং আমি এখন বুঝি কখন কি করতে হয়। আর কোন কাজ করলে তার জন্য সুবিধা হয়। আর কোন কাজ করলে অসুবিধা হয়।

সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সেই ছোট হতেই সে হুইল চেয়ার ব্যবহার করে। তার বাবা একজন সিএনজি ড্রাইভার। এই একটি মাত্র সন্তান তার। জীবনের সবটুকু দিয়ে সে তার সন্তানের প্রত্যেকটা চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে চেয়েছে। সাধ্যমতো তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করে গেছে। আর এখন আমি তার বাবার মতো করে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

হালকা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। তার দিকে তাকিয়েই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আজকেও সে সাদা শাড়িটা পরেছে। প্রচন্ড রকম ধমক দিয়ে বললাম; এক দিন নিষেধ করছি না? আবারও এই শাড়িটা পরলা কেন?

ধমক খেয়েও সে হেসে দিল। মেজাজটা এবার আগের থেকে বেশি গরম হলো। নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। দিগুণ রাগ নিয়ে বললাম, আমার কথা গায়ে লাগে না তাই না? বের হও! এখনই বের হও আমার ঘর থেকে। আর একটা মুহূর্তও যেন চোখের সামনে না দেখি। বেয়াদব মেয়ে একটা।

সে অট্টহাসিতে মেতে উঠল। মনে হয় এখানে সিনেমার শুটিং চলছে। অথবা আমি রাগ করতেই জানি না। কি করব ভেবে পেলাম না। অবশেষে ফুল দুটো এক পাশে ছুড়ে মেরে নিজের ঘরে চলে এলাম।

\হএবার কিছুটা হলেও বিচলিত হয়ে উঠল। চেহারাটা মলিন হয়ে গেল। নিজেই হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে আমার পেছন পেছন রুমে আসে, তারপর আলনা থেকে আরেকটা কাপড় নিয়ে আবার বের হয়ে যায়। আমি পা ঝুুলিয়ে খাটের ওপর বসে এটা-ওটা ভাবছি।

আচমকাই কিছু একটা ভাঙার আওয়াজ হলো। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রান্না ঘরের দিকে উঁকি মারলাম। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, না সেখানে কিছুই হয়নি। তাহলে? ধুক করে বুকটা কেঁপে উঠল। এবার উঠে বাথরুমের দিকে যেতেই হালকা কেমন যেন আওয়াজ কানে আসল। দ্রম্নত পা ফেলে দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি পাগলিটা বাম হাত দিয়ে ডান হাতটা চেপে রেখেছে। কোলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সাদা শাড়িটা রক্তে লাল হয়ে আছে। আর নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কাচের টুকরো।

আলনা থেকে গামছা নিয়ে কোনোরকম হাতটা বেঁধেই দ্রম্নত বের হয়ে গেলাম। ফার্মেসির সঙ্গে একটু-আদটু পরিচিত থাকায় দ্রম্নতই ডাক্তার চলে এলো। কয়টা সেলাই লাগল সেদিকে তাকালাম না। বাথরুমে পরে থাকা কাচের টুকরো উঠিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করলাম। এদিক-ওদিক ঘাড়টাও ঘুরালাম। এই কাজটা সাধারণত আমাকেই করতে হয়। মানুষটা হুইল চেয়ার ঠেলে আর কত করবে।

ডাক্তার চলে গেলে তাকে উঠিয়ে খাটে বসালাম। বরাবরের মতোই সে কিছু খেতে নারাজ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেও খানিকটা। ওষুধ খাওয়ার জন্য কিছু তো খেতেই হবে। নিরুপায় হয়ে আবারও বাহিরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। সামনের মোড়েই একটা বিরিয়ানির দোকান। নিয়মিত যাওয়া-আসা করায় বেশ সক্ষতা গড়ে উঠেছে। দোকানির নাম লতিফ মিয়া। সবাই লতিফ ভাই বলে ডাকে। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বলে উঠল; আরে ভাই, মন খারাপ না-কি?

(একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে); না ভাই এমনিতেই।

আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ এক প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে চলে আসলাম।

খাবার ও যাবতীয় ওষুধ খেয়ে সে এখন শুয়ে আছে। নিজেও একটু-আধটু খেলাম। ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকে মনে হলো সব কিছুই অক্ষত আছে। তাহলে ভাঙলটা কী? ভাঙা কাচের টুকরোগুলোও ফেলে দিয়েছি। সুতরাং জিজ্ঞেস করা ব্যতীত প্রকৃত সত্যটা জনার উপায় নেই।

বাথরুম থেকে বের হয়ে তার পাশে বসলাম। কিছু বলতে যাব অমনি সে বলে উঠল; এই দূরে যাও বলছি। আমার কাছে কিছু বলতে আসবা না। আচমকাই এহেন কথায় ভয় পেয়ে গেলাম। অসহায় হয়ে কিছুটা তোতলাতে তোতলাতে বললাম, কেন আমি করছি?

প্রচন্ড অভিমানের সুরে বাকপটুদের মতো করে বলে উঠল; ন্যাকামো সব ন্যাকামো। কি করছে জানে না সে। এত রাগ না দেখাইলে কী এত কিছু হতো? সাহস ফিরে পেলাম। এবার স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলাম; তারপর কী করলে? এবার সে-ও অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল; রাগের কথা আমি সইতে পারি না। তাই হাতের কাছে কাচের গস্নাসটা পেলাম। তারপর মুঠ করে বাথরুমের দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি মারলাম।

কথাটা শুনেই হাসি পেল। শব্দ করে হেসে উঠলাম। হাসতেই ছিলাম বেশ কিছু সময়। হাসি দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে সে। একটা সময় আমি অনুভব করলাম, না এখন আর নেই। সন্ধ্যার সেই মন খারাপটা এখন আর নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে