আল মাহমুদের কবিতায় প্রেম ও নারী

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

বাসার তাসাউফ
কবিতায় আবেগ ও আতিশয্য থাকা প্রয়োজন আছে। কিন্তু আবেগ ও আতিশয্য অবদমিত হলে অনেকাংশে কাব্যরস হ্রাস পায়। আবার আবেগের বাহুল্য কবিতাকে মেদবহুল করে তোলে। উইলিয়াম ওয়াডর্সওয়াথর্ বলেছেন, ‘ঢ়ড়বঃৎু রং বসড়ঃরড়হ ৎবপড়ষষবপঃবফ রহ ঃৎধহয়ঁরষরঃু. বাংলা কবিতায় আজকাল বেশ আবেগ থাকতে দেখা গেলেও ঞৎধহয়ঁরষরঃু দেখা যায় না। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান মৌলিক কবি। বতর্মান জীবিত থাকা কবিদের মধ্যে তার নাম পয়লা নম্বরেই উচ্চারিত হয়ে থাকে কাব্য-বোদ্ধামহলে। একটা সময় দেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আল মাহমুদের প্রতিযোগিতা হতো, সেটা পাঠক মহলে। কারো মতে, আল মাহমুদ প্রধান কবি, কারও মতে, আবার শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর এখন আর কারও দ্বিমত নেই, দ্বিমত থাকার কথাও নয়। আল মাহমুদই বতর্মানে বাংলদেশের জীবিত কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি। তার ‘লোক লোকান্তর’ ‘সোনালি কাবিন’ ‘কালের কলস’ ‘মায়াবী পদার্ দুলে ওঠো’ তাকে সেই আসন দিয়েছে। এসব কাব্যে তিনি লোকজ, গ্রামীণ পটভভূমি এবং ভাবাত্মক রূপাত্মক শব্দ প্রয়োগ ও কল্পনিক বিষয়বস্তুতে যে উপমা প্রয়োগ করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ। তার কবিতায় আবেগ যেমন আছে, তেমনি ঞৎধহয়ঁরষরঃু আছে। তার এই বহুমাত্রিক কাব্য নিমার্ণকৌশল শুধু কাব্যই সৃষ্টি করে নাÑ তিনি আমাদের এক ধরনের গন্ধ ও অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রাখেন। আমরা রসনা ও স্বাদ পেয়ে যাই কবিতাগুলো পড়ে। অনেকে আজকাল আধুনিকতার দোহাই দিয়ে দুবোর্ধ্য কাব্য রচনা করে নিজেকে মস্ত বড় কবি হিসেবে জাহির করতে চায়। দেখা যায় সেই কবির কবিতার ভেতরে পাঠকের প্রবেশের রাস্তা একেবারে রুদ্ধ। তাই পাঠকও সেই সব কবিতায় প্রবেশের রাস্তা না পেয়ে ফিরে যায় অন্য কোনো সহজবোধ্য কাব্য-দরোজায়। ফলে সেই কবিগণ হারিয়ে যান আড়ালে-আবডালে। আল মাহমুদ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাহলে কি তিনি সহজ সরল ভাষার কবি? এ প্রশ্নের জবাবে অবলীলায় বলে দেওয়া যায় না। তার কবিতার মূলে রয়েছে ফুল, পাখি, নদী চঁাদ, ঝণার্ ও প্রকৃতির সৌন্দযর্ এবং রমণীর রূপলাবণ্যমÐিত শরীর, বক্ষ, কেশ, অঁাখি, মুখবয়ব। তার ভাবুক মনকে নাড়া দিয়ে কবিতা লিখিয়েছে অনেক রমণী। নারীকে, নারীর অঙ্গসৌষ্ঠবকে তিনি গহরফলক, উষ্ণ কালসাপ, নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ, চরের মাটির মতো শরীরের ভঁাজ, ত্রিকোণ কদর্ম, গূঢ় রাত, ত্রিকোণ মৃন্ময়ী ইত্যাদি উপমায় সুশোভিত করেছেন । আল মাহমুদ অকপটে স্বীকার করেন, তার কাছে সবচেয়ে আকষর্ণীয় বিষয় হলো প্রেম ও নারী। তবে নারী ও সৌন্দযের্ক তিনি আলাদা করে দেখতে চান। এক নারী একজনের কাছে সুন্দর, অন্যের কাছে তা না-ও হতে পারে। তাই আল মাহমুদ নারীকে সৌন্দযর্ না বলে আকষর্ণীয় বলতে চান। তার মানে নারী আকষর্ণ করে, তার মধ্যে আকষর্ণ করার শক্তি আছে। সেই আকষের্ণর কেন্দ্রবিন্দু বলেই নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় এত ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাক্সক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেনেÑ ‘বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না তুমি যদি খাও তবে আমাকে দিও সেই ফল জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোহে পরস্পর হবো চিরচেনা পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা দারুণ আহত বটে আতর্ আজ শিরা-উপশিরা।’ আবার তিনি লিখেছেনÑ ‘আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লানৎ ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।’ এ ব্যাপারে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেছেন, ‘তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী। কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদাম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তার টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানকৌড়ি পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে সে কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন।’ (একজন খাটি কবি, উপমা, পৃ. ২৫)। আল মাহমুদ মানব মনের একটি অদৃশ্য ও আদিমতম কামনার জোয়ারকে বিন্দুমাত্র বাধা না দিয়ে তার প্রবাহমানতাকে আরো স্বচ্ছন্দ দিয়েছেন। কাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপূবর্ভাবে চিত্রায়ন করে আদি ও অন্ত পযর্ন্ত চিরন্তন রোমান্টিক ধারাকে বণর্না করেছেন: ‘তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ।’ (সনেট ১০ ) তিনি আরও লিখেছেন, ‘সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি আত্মবিক্রয়ের স্বণর্র্ কোনকালে সঞ্চয় করিনি আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি; ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।’ তার ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যের এসব সনেটে উপমা আর রূপকে নারীর প্রতি পুরুষর আকাক্সক্ষা ও কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে। কবিতা কী? কথিত আছে, ‘বাল্মীকির ক্রোঞ্চমিথুন বিয়োগজনিত শোকই ‘শ্লোক’ রূপে উৎসারিত হয়েছিল।’ কেউ কেউ মনে করেন, কবিতার জন্মজঠর হচ্ছে কল্পনা ও সাধনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বলেই ফেলেছেন, ‘কবিতা কল্পনা-লতা। সাধনার ধন।’ ইংরেজ কবি কিটস্-শেলি-মিল্টন তাদের প্রেয়সির বিরহে লিখেছেন অনেক কবিতা। নজরুলও লিখেছেন। কালিদাস ‘মেঘদূত’ লিখেছিলেন প্রিয়াবিরহের বেদনা থেকে। তাহলে কি বিরহী-বিলাপ শব্দের, বাক্যে অন্ত্যমিলে প্রকাশিত হলেই তাকে কবিতা বলে? আল মাহমুদ কবিতার পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে, ‘কবিতা কী? কবিতা তো শৈশব স্মৃতি কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস ¤øানমুখ বউটির দড়িছেঁড়া হারানো বাছুর কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার...।’ (কবিতা এমন) আল মাহমুদ শুধু কবিতাই লিখেন নি। তিনি গল্প লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন উপন্যাস ও আত্মজীবনী। তিনি কবিতায় যেমন সাবলীল, গদ্যেও তেমন। বেশ ঝর্ঝরে তার গদ্যের ভাষাশৈলী। পড়তে গেলে ঠেঁাটের আরাম হয়। পাঠক হয় মোহগ্রস্ত। তার বিখ্যাত সোনালি কাবিনসহ অন্যান্য গ্রন্থে তিনি সময়ও সমকালকে ইতিহাসের নিক্তিতে মাপতে চেয়েছেন। তুলে ধরতে চেয়েছেন সময়ের ইতিহাসকে। তার কবিতা পড়লে আমাদের মনে ধারণা জাগে, আমাদের অতীত কেমন ছিল আর কী আছে ভবিতব্য। সময় নিয়ে এত যিনি সচকিত; সেই সময়-ই তাকে কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছে? তিনি একটি গদ্যে লিখেছিলেন, ‘আমি লেখক হওয়ার, কবি হওয়ার মোহে দৃঢ় বাসনা পোষণ করতাম, আর লোকে তো এখন আমাকে কবিই বলে। ... আমি কবিতা লিখেছি, গল্প-উপন্যাসও লিখেছি। সব মিলিয়ে সমালোচকেরা একদিন আমার বিচার করবে। আশা করি আমি সুবিচার পাব।’ আল মহমুদ এখন অস্তগামী ¤øান হয়ে আসা এক প্রহরে বাস করছেন। তার জন্য অপেক্ষা করছে নিবিড় নিশিতে ঝিঁঝির গুঞ্জন। কিন্তু এ নিয়ে তিনি ভীত নন, তিনি বরং এ ভাবনায় শিহরিত। কেননা তিনি যে কবি, এক অপাজিত সত্তা।