বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অন্য একজন

রুহুল আমিন রাকিব
  ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

শালিকার লাল টকটকে বস্নাউজটা খুলতে খুলতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার আমাকে মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই তো?

নিশি আমার প্রশ্নর উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইল। ওরদিকে তাকিয়ে দেখি লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে আছে।

কী হলো? কোনো কথা বলছো না কেন? দুলাভাই আরেকটু সময় দিন আমায়। আমার ভালো লাগছে না কিছুই। নিশির মুখ থেকে কথাটা শুনে আর এক মুহূর্ত দেরি করলাম না আমি। বস্নাউজের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বললাম, তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি ভুলেও স্পর্শ করব না তোমায়। এইটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো।

আমি জানতাম আপনি আমার মনের অবস্থাটা ঠিক বুঝবেন দুলাভাই। তুমি কি এখনো আমায় দুলাভাই বলেই ডাকবে? দেখো আমি সবকিছু মানতে রাজি। এটা কিন্তু একদম মানব না। দুলাভাই ডাকবো না তো কি ডাকবো? অভ্যাস হয়ে গেছে যে। এই অভ্যাসটাকেই পরিবর্তন করতে হবে। আমি এখন আর তোমার দুলাভাই নই। আলস্নাহপাকের ইচ্ছেতে আমাদের ভেতরে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাই এখন থেকে আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। খালিদের কথা শুনে নিশি বলল। তাহলে কি আপুও আলস্নাহর ইচ্ছায় মারা গেছে? নিশির মুখ থেকে কথাটা শুনে কিছুটা চমকে ওঠে খালিদ। নিরার নিষ্পাপ মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কয়েক ফোঁটা অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়ে বুকের জমিনে। নিশি খালিদের পাশে বসে নিজের হাতে চোখের অশ্রম্ন মুছে দিতে দিতে বলল। খালিদ আজ থেকে আমরা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখব। আমার সবটুকু জুড়ে আজকের পর থেকে তুমি আর আপুর রেখে যাওয়া অস্তিত্ব ফাহিম বিচরণ করবে।

ফাহিম হচ্ছে নিরা ও খালিদের এক মাত্র ছেলে বয়স মাত্র দুই মাস হতে চলছে। আলস্নাহর নির্মম পরিহাস ফাহিম যেদিন পৃথিবীতে এসেছে সেদিন ভোরে ফাহিম জন্মের কিছু সময় পরে মারা যায় নিরা। কর্তব্যরত চিকিৎসক এখন অবধি মৃতু্যর সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। অথচ সিজার করেই ফাহিমকে এই পৃথিবীর আলো বাতাস দেখিয়েছে নিরা। নিশি খালিদের হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল। তুমি আপুর কথা ভেবে ভেবে এখনো অন্যমনস্ক হয়ে থাক? আমি তো আছি এখন তোমার পাশে। তোমার জীবনে যা ঘটেছে সবকিছু অতীত। ওসব ভেবে মনে কষ্ট বাড়িয়ে সময় নষ্ট করো না তো। একথা বলে নিশি ও খালিদ একটু অন্তরঙ্গ হওয়ার মুহূর্তে ফাহিম কেঁদে ওঠে। খালিদ নিশির হাত নিজের বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে ছেলের কাছে যেতে চায়। নিশি বাঁধা দিয়ে নিজে দৌড়ে দোলনার কাছে গিয়ে ফাহিমকে কোলে নেয়। গালে মুখে চুমো দিতে দিতে নানা রকম গল্প বলে। এক সময় নিশির কোলে ফামিহ ঘুমিয়ে পড়ে। ফাহিমের প্রতি নিশির এমন ভালোবাসা দেখে খালিদের গর্বে বুকটা ভরে যায়। মনে মনে আলস্নাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। নিজের পরিবারকেও ধন্যবাদ দিতে ভুল করে না। বিশেষ করে নিজের বাবাকে। কারণ নিরার মৃতু্যর পরে বাবা সবার থেকে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে নিশিকে এই বাড়ির বউ বানানোর জন্য। অনেক রাত হয়েছে। যে যার মতো করে ঘুমিয়ে পড়ে খালিদ ও নিশির মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে ফাহিম। সকাল বেলা খালিদের ঘুম ভাঙ্গে ফাহিমের কান্নার শব্দ শুনে। পাশে তাকিয়ে দেখে নিশি কোথাও নেই। হয়তো ঘুম থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গেছে ফ্রেশ হতে। হঠাৎ নিশির ফোনটা বেজে উঠে। রিসিভ করে খালিদ কিছু বলার আগে ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল।

নিশি আপনার কথা মতো সেদিন আমি আপনার বোন নিরাকে অপারেশন রুমে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ করে হত্যা করলাম। কিন্তু চুক্তি অশুযায়ী আমার পুরো টাকা আজও পেলাম না। খালিদ নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। এটাও কি সম্ভব? হাত থেকে মেঝেতে ছিটকে পড়ে ফোন। খালিদ গভীর ভাবনায় পড়ে, নিজের বোনকে হত্যা করতে ডাক্তারের সঙ্গে চুক্তি করেছে নিশি। কিন্তু কেন? নিশি রুমে ঢোকার আগে খালিদ ফোন থেকে নাম্বারটি ডিলিট করে। মনে মনে পরিকল্পনা করে নিরার মতো নিষ্পাপ মায়াবতী একটা মেয়েকে হত্যা করার মূল রহস্য কি? নিশি কিছু সময় পরে ফ্রেশ হয়ে খালিদের জন্য সকালের নাস্তা বানিয়ে রুমে ঢুকে।

ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রেখে বলল। উঠেছ বাবু? যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার জন্য নাস্তা সাজিয়ে রাখলাম। একথা বলে নিশি ফাহিমকে কোলে নেয়। সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। ফিটারে দুধ নিয়ে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে খাইয়ে দেয়। খালিদের কানে বারবার ভাসে একটু আগে ঘটে যাওয়া সেই ফোন কল। কিন্তু একথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কার কাছে প্রকাশ করবে সে? কেউ শুনলে বলবে বউয়ের শোকে আমি পাগল হয়েছি। আবোল তাবোল প্রলাপ বকছি। খালিদ সিদ্ধান্ত নিল একথা কারো কাছে বলবে না। নিরার হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে যা যা করতে হবে তার সবটাই করবে একাকি। আজ কয়েকদিন হতে চলছে নিরার হাতে তিলে তিলে সাজানো রেখে যাওয়া সংসারে এসেছে নিশি। ওর ব্যবহারে বাড়ির সবাই মুগ্ধ! নিরা যে এ বাড়ির বউ ছিল, নিশিকে পেয়ে একথা ভুলে গেল সবাই। খালিদ মনে মনে ভাবে এটাই বাস্তবতা মানুষ মরে গেলে পচে যায় কেউ মনে রাখে না। রাখার প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু খালিদ আর সবার মতো না। রোজ মনে পড়ে নিরার কথা। নিরার হাসি মাখা মুখ, কথা বলা, এক সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, হাঁটাচলা করা। খালিদের এখনো মনে আছে ফাহিমের জন্মের আগ মুহূর্তে নিরা বারবার বলেছিল খালিদের বুকে মাথা রেখে। খালিদ পৃথিবীর সবাই আমাকে ভুলে গেলেও তুমি আমাকে ভুলে যেও না। তোমার অনাগত সন্তানের মা হতে দেখ আমি কত কষ্ট করে সবকিছু মেনে নিয়ে চলছি। তোমার সন্তানের মা হবো আমি। যখন তোমার সন্তান আমাকে মা বলে ডাকবে, ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করার সমস্ত কষ্ট ভুলে যাব আমি। এই পৃথিবীতে সেদিন আমার থেকে সুখী মানুষ আর কেউ থাকবে না খালিদ। অথচ এসবের কিছুই হলো না নিরা মারা গেল ফাহিম পৃথিবীতে আসার কিছু সময় পরে। যদিও খালিদ এখন জানতে পেরেছে নিরা মারা যায়নি নিরাকে হত্যা করা হয়েছে সেদিন। কিন্তু একথা কি করে বিশ্বাস করাবে সবাইকে? নিশির ব্যবহার কেমন যেন দিনে দিনে সন্দেহ হচ্ছে খালিদের কাছে। বাড়ির আর সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেও ইদানীং নিশি কেমন যেন করে খালিদের সঙ্গে। কি যেন লুকানোর চেষ্টা করে। অথবা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু খালিদ ভেবে পাচ্ছে না নিশি কেন তার সঙ্গে এমনটা করতেছে। মনে মনে ঠিক করল আজ রাতে নিশির কাছে জানার চেষ্টা করবে। খালিদ আজ একটু তাড়াতাড়ি বাহির থেকে ঘরে এসেছে। নিশি তখন ফাহিমকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। খালিদকে দেখে বলল, তুমি আজ এত তাড়াতাড়ি এসেছ? যাও হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আস। খালিদ ওয়াশ রুমের লাইট জ্বালিয়ে বেসিনের গস্নাসে তাকাতেই আঁতকে উঠে। জিনিয়া এখানে এলো কি করে? জিনিয়া খালিদের ডাইরি পাতায় অতীত নাম। পাঁচ বছর আগে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে মেয়েটিকে গলা টিপে হত্যা করেছে খালিদ নিজের হাতে। ঘটনার মোড় ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে হত্যার পরে গাছের ডালে ফাঁসি ঝুলিয়ে রেখে পালিয়ে যায় খালিদ। জিনিয়ার গরিব বাবা-মা থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি। কোনোরকম মামলাও দায়ের করেনি। স্রষ্টার কাছে অভিযোগ জানিয়ে দাফন করা হয় জিনিয়াকে। লোক মুখে শোনা যায়, জিনিয়ার পেটে বাচ্চা ছিল। অথচ জিনিয়া বিয়ে করে নাই তখনো। খালিদ চিৎকার করে ওয়াশ রুম থেকে বাহিরে বেরিয়ে আসে। চিৎকার শুনে নিশি দৌড়ে এসে বলল। খালিদ কি হয়েছে তোমার? তুমি এতটা ভয় পাচ্ছ কেন? তোমার কি হয়েছে? আমাকে বল। খালিদ নিশিকে কিছু বলতে গিয়েও আটকে যায়। জিনিয়ার খুনি একমাত্র খালিদ নিজে। খুন হওয়ার এত বছর পরেও সে কথা কেউ জানে না খালিদ ছাড়া। জিনিয়ার পেটে খালিদের সন্তান ছিল। দিনের পর দিন অবাধে মেলামেশার ফসল। পাষাণ মনের অধিকারী খালিদ সেদিন জিনিয়ার আত্ম চিৎকার কর্ণপাত করেনি। জিনিয়াও তার অনাগত সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে অনেক দূরে সরিয়ে ফেলে। ভালোবাসার নির্মম অভিনয়ের কাছে হেরে যায় জিনিয়া। ভালোবাসার মানুষ খালিদের হাতে নিভে যায় জীবন প্রদীপ। কিন্তু আজ এতটা বছর পরে জিনিয়া এভাবে খালিদের কাছে ফিরে এলো কীভাবে? আর কীসের প্রতিশোধ নিতে এসেছে? খালিদ সাত পাঁচ ভাবতে না ভাবতে নিজে থেকে নিশি বলতে লাগল। খালিদ তোমার কি মনে পড়ে জিনিয়ার কথা? জিনিয়া আমার ক্লাসমেট ছিল। ওর আর তোমার বিষয়ে সবকিছু জানি আমি। জিনিয়া আমার কাছে তোমার বিষয়ে সবকিছু শেয়ার করত। এমন কি শেষ যেদিন তোমার কাছে বিয়ের দাবি নিয়ে গিয়েছিল সেদিনের বিষয়টিও আমি জানি। জিনিয়ার মতো এত ভালো একটি মেয়েকে তুমি এমন নিখুঁত অভিনয় করে হত্যা করলে অথচ কেউ জানল না। আমার বোন নিরা তোমার পরবর্তী ভালোবাসার মানুষ। নিরাকে তোমার বিষয়ে আমি সবকিছু খুলে বলেছি। কিন্তু আমার বোন নিরা আমার কথা শুনেনি। উল্টো আমাকে বলেছে, আমার চরিত্র খারাপ। তোমার সঙ্গে প্রেম করার জন্য আমি না কি সব বানিয়ে বলেছি জিনিয়ার বিষয়টি। অথচ সবকিছু চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর মতো সত্যি ছিল। তোমার আর নিরা আপুর যেদিন বিয়ে হলো। সেদিনের পর থেকে মাঝে মাঝে জিনিয়া আমার কাছে আসতো। স্বপ্নলোকে নানারকম কথা বলতো। আমাকে সব সময় বলতো, আমার মৃতু্যর রহস্য কেউ না জানলেও তুমি তো জানো। আমার মৃতু্যর প্রতিশোধ তোমাকে নিতে হবে নিশি। তুমি যদি আমার মৃতু্যর প্রতিশোধ না নাও। তবে আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব না মনে রাখিও। জিনিয়া মাঝে মাঝে বলতো, আমার অনাগত সন্তানকে যেমন এই পৃথিবীর আলো বাতাসের মুখ দেখতে দেয়নি। আমি চাই, খালিদের স্ত্রী নিরাও যেন তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে না পারে; তার আগে যেন মেরে ফেলা হয়। জিনিয়া বলেছিল, তার কথা মতো সবকিছু না করলে আমাকে আর আমার পরিবারের সদস্যদের সবাইকে মেরে ফেলবে। খালিদ তুমি আমাকে মাফ করে দিও। জিনিয়ার কথা রাখতেই আমি ডাক্তারের সঙ্গে চুক্তি করে অপারেশন রুমে মেরে ফেলি আমার বোন নিরাকে। এছাড়া আমার যে আর কোনো উপায় ছিল না খালিদ। হঠাৎ খালিদের দরজার সামনে উপস্থিত হয়ে উলিপুর থানার পুলিশ অফিসার বলল। আপনার স্ত্রী নিরা সেদিন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়নি। আমাদের কাছে তথ্য আছে। লাশের ফরেন্সিক রিপোর্ট এই মুহূর্তে আমাদের হাতে এসেছে। নিরার মৃতু্যর জন্য দায়ী আপনি। শুধু তাই নয়, আপনার নামে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আছে- থানায় চলুন আমাদের সঙ্গে। খালিদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের গাড়িতে করে থানায় নিয়ে চলল। খালিদ স্মৃতির পাতায় সবটা জুড়ে দেখতে পায় নিকোষ কালো অন্ধকার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে