শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লালনের গানে সাম্যবাদ

মাজহার মান্নান
  ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা যার ঝুলিতে নেই, লোকে যাকে নিরক্ষর হিসেবে জানে এবং যে মানুষটি তার সহজাত প্রজ্ঞা, দর্শন আর বুদ্ধিবৃত্তির শ্রেষ্ঠত্বের কারণে একজন জ্ঞানতাপস ও মরমী সাধক হিসেবে এবং কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে আলোর দিশারি হিসেবে উপমহাদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি হলেন অসাম্প্রদায়িক এবং মানবতাবাদের পূজারি সুর সম্রাট ফকির লালন শাহ। তিনি এমনই একজন বড় মাপের দার্শনিক ছিলেন যিনি প্রজ্ঞার বূহ্য সাধন করে দিব্যানুভূতিতে কল্পনাতীতভাবে বিষয়ী চৈতন্যের গভীরতায় আত্মপ্রণিধান ঘটিয়েছিলেন। বহুমুখী প্রতিভাধর লালন সাঁই ছিলেন একাধারে বাউল সাধক, মরমী কবি, গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সমাজ সংস্কারক, মানবতাবাদী এবং দার্শনিক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনি অনুপদিষ্ট হলেও স্বীয় সাধনা, সিদ্ধি এবং তপস্যার গুণে জ্ঞানসাধক হয়েছিলেন। বিভিন্ন শাস্ত্র এবং ধর্মীয় জ্ঞানে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন এবং দিকদর্শী ওস্তাদে পরিণত হয়েছিলেন। গান এবং কাব্যকলায় বহুমাত্রিক নতুনত্ব স্বাঙ্গীকরণ করতে পেরেছিলেন। ১৯ শতকে বাউল গান ও কাব্য মানবতাবাদের বিকাশে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। অসাম্প্রদায়িক লালন কাব্য ও গান তৎকালীন সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তার গান ও কাব্য দর্শন প্রভাবিত করেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো কিংবদন্তি কবিকে। লালনের গান ও কাব্যে মানুষ আর সমাজই ছিল মুখ্য। তিনি মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদাভেদকে তিনি অন্তর থেকে অপছন্দ করতেন। তার কাব্যে সেটা সুস্পষ্ট।

\হহিন্দু, খ্রিষ্টান আর মুসলমান/ রক্তে বর্ণ নেই ব্যবধান

\হসুন্নত দিলে হয় মসুলমান/ বামুন চিনি পৈতার প্রমাণ

\হবামুনি চিনি কি ধরে।

মরমী সাধক লালনের প্রভাব কাজী নাজরুলের ওপর পড়েছিল ব্যাপকভাবে। লালনের মতো নজরুলও বিশ্বাস করতেন মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য নেই। জাতি, ধর্ম ভেদাভেদ নেই। তিনি তার সাম্যবাদী কাব্যে তা স্পষ্ট করে দেখিয়েছে।

\হগাহি সাম্যের গান

\হযেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান

\হযেখানে মিশছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম ক্রিশ্চান।

লালন মনে করতেন সব শাস্ত্রে কিছু উচ্চতর জ্ঞান রয়েছে। কঠোর সাধনা আর তপস্যার মাধ্যমে সেই জ্ঞান অর্জন করতে হয়। লালনের মতো নজরুল মনে করতেন আগে নিজ চক্ষুকে খুলতে হবে।

\হতোমাতে রয়েছে সকল কেতাব/ সকল কালের জ্ঞান

\হসকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা/ খুলে দেখ নিজ প্রাণ।

লালনের কাব্যিক পরিভাষার নিপুণতা, চিন্তার প্রসারতা, নান্দনিকতা, শব্দের কারুকাজ, পয়েটিক জাস্টিস ছিল ভিন্ন ধাঁচের। আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেন- যার বেশির ভাগই ছড়া কাব্যের অগ্রযাত্রাকে সমৃদ্ধ করেছে। তার কাব্যিক দর্শন মরমী ব্যঞ্জনা আর শিল্প গুণে সমৃদ্ধ। সহজ সরল শব্দ মালায় সাজানো তার অসংখ্য গীতিকাব্য অথচ শাব্দিক বৈচিত্র্য, অর্থের গভীরতায় ঋদ্ধ এবং মর্মস্পর্শী। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিমুক্ত এক সার্বজনীন ভাবরসে সিক্ত বলে তার গান ও কাব্য সব ধর্মের মানুষের কাছে সমাদৃত। তার বিখ্যাত চরণদ্বয় সেটাই প্রমাণ করে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তার বহু নজির আছে। লালন যেমন তার মনের মানুষকে খুঁজেছেন, ঠিক একইভাবে রবীন্দ্র কাব্যে তেমনটি দেখা যায়। 'পরম আত্মীয় বলে যারে মনে মানি, তারে আমি কতদিন, কতটুকু জানি।' রবী ঠাকুরের এই লাইনটি তেমনই ঈঙ্গিত দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সর্বপ্রথম লালনের কাব্য দর্শন, গানের তত্ত্ব দর্শন নিয়ে বহির্বিশ্বে আলোচনা করেন। পরবর্তী সময়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ, ডক্টর এনামূল হক, ডক্টর আহমেদ শরীফ ও মুহাম্মদ আবদুল হাই বাউল কাব্য ও তত্ত্বের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখেন।

লালন একজন প্রকৃতিজ কবি। তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমা, সহজাত রচনা কৌশল, সুর ও ছন্দের অন্বয়, ছন্দ দোলা, শিল্পবোধের কারণে বাংলা লোককাব্যে তার প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। লালন কাব্যে মানুষ মুখ্য। তার কাব্য মেটাফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও মানব প্রেমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। তার একটি বিখ্যাতে লাইন 'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি'- মানব প্রেমের বড় নিদর্শন। লালনের অসংখ্য গান নিখুঁত কাব্যের মর্যাদা লাভ করেছে। তার কাব্য ভাষা বহুমাত্রিকতায় ঋদ্ধ, ভাষা, ছন্দ আর অলঙ্করণের এক সূক্ষ্ন সমন্বয়। সহজাত শব্দ চয়নের এক শ্রেষ্ঠ কারিগর ও ভাষ্যকর। লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাব্য জ্ঞান ছিল না কিন্তু তার সুললিত পদাবলি তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তার কাব্য ও গান জাত পাতের দ্বান্দিকতা মুক্ত ছিল। মানুষকেই তিনি গ্রহণ করেছেন একমাত্র পূজনীয় হিসেবে। তিনি বলেন, 'মানুষ তত্ত্ব যার সত্য মনে হয় সে কি আর অন্য তত্ত্ব্ব মানে।' লালন কাব্য আর গান ভাববাদী তত্ত্ব্বে সমৃদ্ধ। এটা ঠিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মায়াবাদের মতো। লালন কাব্যে অতীন্দ্রিয় ভাববাদ স্পষ্ট। তার বিখ্যাত লাইন, 'আমার ঘরের কাছে আরশীনগর সেথা এক পড়শী বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।'... অতীন্দ্রিয় ভাববাদকে ঈঙ্গিত করে। লালন কাব্য ভাববাদী ধাঁচের হলেও ইহজগতের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদের অগ্নিশিখা। অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, মানবতার জয়গান করতে গিয়ে তাকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক অত্যাচার। কিন্তু সত্য আর ন্যায়ের পথে থেকেই তিনি তার গান আর কাব্য রচনা করেছেন।

\হএকই ঘাটে আসা যাওয়া/একই পাটনী দিচ্ছে খেওয়া

\হকেউ খায় না কারও ছোঁয়া/ ভিন্ন জলকে কোথায় পান।

লালনকে কেউ কাব্যিক ছন্দ, রীতি ও মাত্রা শিখিয়ে দেননি, অথবা তিনি কারও কাছ থেকে এগুলো শিখেননি। কিন্তু ছন্দ, মাত্রা, অন্তঃমিল ঠিক রেখে যে নিখুঁত কাব্য রচনা করেছেন তা নিতান্তই সহজাত আর স্বভাবসুলভ। তার গান ও কাব্যের গঠনশৈলী, ভাব মাধুর্য, নৈপুণ্য, রঙ্গ, ব্যঙ্গ, অনুপ্রাস, অলঙ্কার, ব্যঞ্জনাসহ ধ্রম্নপদী কাব্যের সব উপাদান প্রতিনিধিত্ব করে। কাব্য ও গানে এক নতুন ধারার সূচনা করে বাংলার লোকসাহিত্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। 'জোড়া বাঁধা' গানের রীতি তার এক অনন্য সৃষ্টি। তার কাব্য ও গান বিকশিত হয়েছে প্রশ্নোত্তরমূলক পদ্ধতিতে। এটাকে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিও বলা যায় যেটা সক্রেটিস অনুসরণ করতেন। প্রাচীন চর্চাপদে এই রীতির সন্ধান মিলেছে। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির কাব্য রীতির এক সহজ ভার্সন আমরা লালনের কাছ থেকে পাই। তার কাব্য ও গানে যে সার্বজনীন রূপ বিকশিত হয়েছে উনিশ শতকের অন্য কারো লেখায় তেমনটা পরিলক্ষিত হয় না। কাব্যিক পঙক্তিমালার বিন্যাসে তার স্বভাবজাত দক্ষতা তাকে শ্রেষ্ঠ করেছে। ঈশ্বরগুপ্ত, বিহারীলাল, কাঙাল হরিনাথ, মীর মোশাররফ হোসেন লালন কালের শিক্ষিত কবি ও লেখক। স্বভাব কবি লালন তার গানের বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের কারণে এক কালোত্তীর্ণ যুগের সৃষ্টি করেছেন। দেশজ-লোকজ সুরের ঘ্রাণে, বৈষ্ণব, সুফি আর বাউল ভাবধারার দ্রবণে দ্রবীভূত হয়ে লালনের গান স্বকীয়তায় ভাস্বর। রূপক, উপমা, গুরুপদ আর ব্যঞ্জনায় স্বাতন্ত্র এবং কাব্যের বহুমাত্রিক বিন্যাস লালনের সৃষ্টির এক বড় সংযোজন। তার কাব্যতত্ত্ব্বে বিভিন্ন বিষয় স্থান পেয়েছে। তাদের মধ্যে আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মন, গুরুতত্ত্ব, প্রেম, ভাব, সাধনা, মিলন, মুরশিদী, খোদা প্রেম, নামতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, কৃষ্ণপ্রেম, বিরহ, সূক্ষ্ন ধর্ম, মর্ত্য, জীবন, নৃতত্ত্ব, পরম তত্ত্ব্ব, লীলাতত্ত্ব, রাসূলতত্ত্ব, পঞ্চবেনাতত্ত্ব, মনের মানুষ তত্ত্ব্ব, জাতিতত্ত্ব, করণতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, ত্রিপেনী তত্ত্ব্ব, গৌরলীলা অন্যতম। আত্মা ও পরমাত্মার অদ্বৈত সুর লালন কাব্যে স্পষ্ট। মানবজীবন দ্বান্দিকতায় পূর্ণ। কিন্তু লালন তা অতিক্রম করে পরম আরাধ্যকে ধরতে চান। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ভাষায় মিলন ব্যাকুলতায় লালন হুদয়তন্ত্রীতে বান ডেকে উঠে। মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে। বাংলা কাব্যে রূপক তত্ত্ব্বের রয়েছে এক বিশেষ স্থান। লালন কাব্যে রূপক তত্ত্বের অবিরাম ব্যবহার দৃশ্যমান যা বাংলা কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে। 'মন তত্ত্বই রইলি খাঁচার আশে, খাঁচা যে তার তৈরি কাঁচা বাঁশে, কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে।' এ ধরনের হাজারো রূপক লালন কাব্য ও গানে স্থান পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যে প্রেমতত্ত্ব্বের এক বড় বুনিয়াদ তৈরি করেছে লালন কাব্য। নর-নারীর যে সাধারণ প্রেম সেটা থেকে লালন কাব্যের প্রেমতত্ত্ব ভিন্ন ধাঁচের। অসীমের সঙ্গে সসীমের প্রেম বন্ধন লালন কাব্যকে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। 'অমাবস্যায় চন্দ্র উদয়, দেখতে যার বাসনা হৃদয়।' গুরু শিষ্যের মণি কাঞ্চন যোগ লালন কাব্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লালন বলেন, 'গুরু শিষ্য এমনই ধারা, চাঁদের কোলে থাকে তারা।' লালন কাব্য একদিকে যেমন মরমীবাদকে ধারণ করে, একই সঙ্গে সুফিতত্বের বিকাশে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। লালনের ভাষায়, 'মুরশিদের চরণ সুধা, পান করিলে হরে ক্ষুধা।' পরম আত্মায় আত্মসমর্পণ লালন কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। 'পারে লয়ে যাও আমায়, অপার হয়ে বসে আছি হে দয়াময়' চরণটি পরম তত্ত্বের এক দারুণ অভিব্যক্তি। লালন ছিলেন একজন কাব্য সাধক। তার মতে প্রকৃত সাধককে চাতক পাখির মতো ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হয়। 'কামের ঘরে কপাট মেরে, উজান মুখে চালাও রস; দমের ঘর বন্ধ রেখে যম বাজারে কর যশ।' লালনের কাব্য সাধনার গভীরতা বুঝার জন্য এই চরণগুলোই যথেষ্ট। সৃষ্টিতত্ত্বকে বুঝতে হলে ক্ষিত, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পাঁচটি উপাদান এবং তাদের সমন্বয় বুঝা প্রয়োজন। লালন কাব্য আর গানে এই উপাদান গুলোর সাক্ষাৎ মিলে। লালনকে একজন মরমী কবি ছাড়াও প্রকতির কবি এবং ছান্দসিক কবি বলা যায়। ব্যাকরণ সিদ্ধ কাব্যে লালনের পান্ডিত্য আর মুন্সিয়ানা দৃশ্যমান, যদিও তিনি নিরক্ষর ছিলেন। ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং বাক্যতত্ত্ব তার কাব্যে এক বিশেষ ভঙ্গিমায় ব্যবহৃত হয়েছে। লালনের কাব্য এবং গানে আঞ্চলিক শব্দের সঙ্গে আরবি, ফারসি, ইংরেজি, পুর্তগিজসহ আরো নানান ভাষার মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। লোকায়িত জীবনের উপাদানের সঙ্গে শিষ্ট ভাষার শব্দকে আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে লালন কাব্য ভাষা নির্মিত হয়েছে। সাধুরীতি এবং চলিত রীতির এক অভিনব মিশ্রণ ঘটেছে লালন কাব্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের এ ধরনের গুরুচন্ডালীর জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। বহু ভাষার মিশ্রণে নির্মিত হয়েছে লালনের এই চরণগুলো। 'আরবি ভাষায় বলে আলস্না, ফারসিতে কয় খোদা'তালা; গড বলিছে যীশুর চ্যালা, ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাবে।' লালন কাব্যে প্রবাদ প্রবচন ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেটা কাব্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার কাব্যের বিখ্যাত কিছু প্রবাদ হলো- ক) কাক মারিতে কামান পাতা খ) সুই ছিদ্রে চালায় হাতি ইত্যাদি। শব্দালঙ্কার, অর্থালঙ্কারসহ বাক্যান্তে ছন্দের মিলের ফলে লালন কাব্য সাধারণের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। লালন কাব্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ শব্দের ব্যবহার এক বিস্ময়কর অধ্যায়। রূপক বা প্রতীক ব্যবহারে লালন ছিলেন ঋদ্ধ। কাব্যে প্রতীকের ব্যবহার করে লালন আধুনিক কাব্যের অগ্রযাত্রাকে সমৃদ্ধ করেছে। তার বিখ্যাত একটি চরণ হলো- নিরাকারে ভাসছে রে এক ফুল। লালন কাব্যে অনুপ্রাসের বহুমাত্রিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। 'কারুণ্য তারুণ্য এসে লাবণ্যে যখন মিশে'- এমন অনুপ্রাসিক চরণ লালন কাব্যের যেন প্রাণ। লালন গীতিকাব্যে যমক অলঙ্কার দৃশ্যমান। এমন অলঙ্কার খুব কম কবির কাব্যেই দেখা যায়। 'আমার আপন খবর আপনার হয় না' চরণে যমক অলঙ্কার রয়েছে। আরো দুটি চরণেও এমনটি দেখা যায়- যাদের সঙ্গে রলি চিরকাল, কালাকালে তারাই হবে কাল। শ্লেষ অলঙ্করণে ঠাসা লালনের গান ও কাব্য। 'শহরে ষোলো জনা বোম্বেটে, করিয়ে পাগলপারা নিলো তারা সব লুটে।' অর্থালঙ্কার আর উপমায় লালন কাব্য স্বমহিমায় ভাস্বর। 'প্রেম- রত্ন ধন পাবার আশে, ত্রিপীনের ঘাট বাঁধলাম কষে।' দারুণ একটি উপমা দেখায় যায় এ চরণ যুগলে- 'মণিহারা ফণির মতন, প্রেম রসিকের দুটি নয়ন।' ডক্টর আহমেদ শরীফের মতে, সাহিত্য হিসেবে বিচার করলে বাউল কাব্য ও গানকে লালিত্য বিরল লোকগীতি বলা যায়। কাব্যিক শব্দচয়ন, কাব্যিক ন্যায়, বাক্য বিন্যাস ও ব্যঞ্জনা লালন গীতিকাব্যের বড় বৈশিষ্ট্য। 'যন্ত্রেতে যন্ত্রী যেমন, যেমত বাজায় বাজে তেমন।' বাউল কাব্যের আরেকটি উলেস্নখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সপ্ত সুরের সমন্বয়। এ সমন্বয় দেখা যায় তার কাব্য ব্যঞ্জনায়। 'জাতের কাছে হয় না খবর, কি দেখতে যাও দিলিস্ন লাহোর।' কাব্যে অনুরূপতা ব্যবহারে লালনকে মাস্টার বলা যায়। বাউল কাব্যে প্রতিমূর্তি স্থান পেয়েছে ছান্দসিক রূপে। 'লাল জরদ সিয়া মণি, বেওরে সেই রূপের খনি।' অতিশয়োক্তি লালন কাব্যের এক বিরল বৈশিষ্ট্য। চড়বঃরপ ঐুঢ়বৎনড়ষব প্রাচীন সাহিত্যে নতুন কিছু নয়। তবে লালন কাব্যে সেটার রীতিসিদ্ধ ব্যবহার কাব্যকে আরো চিত্তাকর্ষক করেছে। 'লালন ম'ল জল পিপাসায়, কাছে থাকতে নদী মেঘনা।' লালনের গান ও কাব্যে যে ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে তাতে বিভাবনা অলঙ্কার স্থান পেয়েছে। 'মূল ছাড়া সে ফুলের লতা, ডাল ছাড়া তার আছে পাতা।' বিশেষোক্তি লালন কাব্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। 'পানির মধ্যে চাঁদ দেখা যায়, ধরতে গেলে হাতে কে পায়।' আরো কিছু চরণেও এমনটি দেখা যায়। 'ফাঁদ পাতিলাম শিকার বলে, ফাঁদ উঠিলো আপন গলে।' লালন কাব্যের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কাব্য ছন্দ। আমরা জানি কাব্য ও গানে ছন্দের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। প্রাচীন কাব্যে ত্রিপদীই ছিল ছন্দের মূল বাহন। চর্যাপদে ছন্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। কবি ভারতচন্দ্রের হাতে বাংলা ছন্দ বিকশিত হয়। সুর ও ছন্দের এক জাদুকরী ছোঁয়া লালন কাব্যে দেখা যায়। বাউল কাব্যে গীত, বাদ্য ও নৃত্য এই তিনের সমন্বয় দৃশ্যমান। ছন্দে রয়েছে অন্তঃমিল। লালন কাব্যে চরণ ও স্তবক রচনায় অনন্য কৌশল ও পান্ডিত্যের ছাপ স্পষ্ট। 'সাঁই আমার কখন খেলে কোন খেলা, জীবের কি সাধ্য আছে তাই বলা।' কাব্যে বিভিন্ন ধরনের ছন্দের ব্যবহার থাকলেও মূলত তিন ধরনের ছন্দের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। সেগুলো হলো- অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত। লালন কাব্যে এই তিন ধরনের ছন্দেরই সফল ব্যবহার দেখা যায়। ৮+৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার লালন গানে রয়েছে।

\হ'মুরশিদ জানায় যারে মর্ম / সেই জানিতে পায়/ জেনে শুনে রাখে মনে / সে কি কারে কয়।'/আবার ৬+৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগও লালন কাব্যে দৃশ্যমান।

' কেনে ভ্রান্ত হও / রে আমার মন/ ত্রিবেণী নদীর / কর অন্বেষণ।'

লালন কাব্যে বৈচিত্রপূর্ণ মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ৫+৫ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

\হ' যবন ছিল / দবীর খাস/তারে গোসাঁই / পদ প্রকাশ।

স্বরবৃত্ত ছন্দেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন লালন। তার কাব্য ও গানে ৪+৪ মাত্রার স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ দেখা যায়।

\হ' গর্তে গেলে / কূপ জল কয়/গঙ্গায় গেলে / গঙ্গাজল হয়।'

বাউল কবি লালনের মনের অজান্তেই ছন্দ এসে ধরা দিয়েছিল তার সহজ কবিত্ব শক্তির কাছে। ওয়াকিল আহমেদ লালনের সৃষ্টি সম্পর্কে বলেন, সিদ্ধি সমৃদ্ধ দিব্য দৃষ্টি লালনের গানকে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। 'যে রূপে সাঁই আছে মানুষে, রসের রসিক না হলে কি পাবে তার দিশে।' ফকির লালনের হাত ধরেই বাউলের বিশ্বায়ন হয়েছে। প্রাচীন গীতি কবিতার ধারা লুইপা থেকে লালন পর্যন্ত এক ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। সাধন সঙ্গীত আর গীতি কবিতায় লালনের জুরি মেলা ভার। 'আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যেরে।' লালনের গান মানব হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তার গানে যে বাণীগুলো রয়েছে সেটা খুবই প্রজ্ঞাসুলভ এবং দূরদর্শী। 'সময় গেলে সাধন হবে না' অথবা 'তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে' -- এ ধরনের গীতিতে সর্বজনীন বাণী প্রচারিত হয়েছে। আমরা সকলেই জানি যে, লালন ছিলেন একজন বড় মাপের দার্শনিক। নিজে নিরক্ষর হলেও তার দার্শনিক প্রজ্ঞা ছিল সার্বজনীন। নিচের চরণগুলোতে তার দার্শনিক প্রজ্ঞার সাক্ষাৎ মিলে।

\হ'শ্বেত অন্ত জরায়ু ধরে/একেক ঈশ্বর সৃষ্টি করে

\হআগম নিগম চরাচরে/তারে ভিন্ন জাত বলে।'

লালনের অসংখ্য গান আর কবিতা যুগে যুগে বেঁচে থাকবে তাদের নিজস্ব গুণে। লালনের কাব্যর সঙ্গে সিগমন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্বেরও কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। লালন বলেন, 'ঘুমের ঘরে দেখলাম যারে, চেতন হয়ে পাইনি তারে।' যাহোক লালনের কাব্য ও গান নিছক বিনোদনের কোনো বিষয় ছিল না। তার গানে জীবন বোধের বার্তা আছে। 'আপন ঘরে বোঝাই সোনা, পরে করে লেনাদেনা।' লালনের গান আর কাব্যের প্রভাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুলের ওপর সরাসরি পড়েছে। নজরুল লিখলেন, 'চরণ ফেলি গো মরণ-ছন্দে মথিয়া চলি গো প্রাণ, মর্তের মাটি মহীয়ান করি, স্বর্গেরে করি ম্স্নান।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৫০টি গান রচনা করেছিলেন। তিনি তার 'গোড়া' উপন্যাসের সূত্রপাত করেন লালনের গান দিয়ে। বিদেশি কবি গিন্সবার্গ 'আফটার লালন' নামে একটি কবিতা রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, লোকসাহিত্যবিহীন সাহিত্য প্রাণহীন। আর সুর সম্রাট লালন ছিলেন লোকসাহিত্য বিকাশে এক ঋষিপুরুষ। বাউল গানের কাব্য সৌন্দর্য চিরন্তন ও শাশ্বত। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেন, লালনের সাহিত্য কর্ম বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। লালন বাংলা ভাষার মানুষগুলোর কাছে কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন তার সৃষ্টির জন্য। লালন আমাদের সবার। আমাদের সংস্কৃতির একটি বড় অংশ লালনের গান আর কাব্য। তাই লালনের সৃষ্টিগুলোকে যত্ন নেওয়ার মাধ্যমেই আমাদের সংস্কৃতির গতিধারাকে আরও বেগবান করা সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে