বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নসিব

মো. মাঈন উদ্দিন
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

এক.

সুমনের উত্থানটা রাতারাতি। রূপকথার গল্পের সেই আলাদিনের প্রদ্বীপ পাওয়ার মতো। প্রদ্বীপে ঘষা দেওয়া হলো আর একটা ইচ্ছাপূরণ দৈত্য এসে বলল, বলুন হুজুর, আপনার কী চাই। বলা হলো, আমার টাকা চাই, অগুণিত টাকা। ধন-দৌলত চাই, ঘরভর্তি ধন-দৌলত। হীরা-জহরত চাই, বস্তা বস্তা হীরা-জহরত। আর ইচ্ছাপূরণ দৈত্য মুহূর্তেই এনে দিয়ে গেল টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, হীরা-জহরত। ব্যাপারটা কিছুটা এরকমই।

সুমন ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা গঞ্জের আড়তে পানের ব্যবসা করত। একমাত্র ছেলে সুমন উপজেলা সদরে ছাত্র রাজনীতি করত। মাঝারি প্রকৃতির নেতা। প্রবাদে আছে, 'যদি থাকে নসিবে এমনি এমনি আসিবে'। লোকে বলে, 'গোবর থাকে শুকায়া, আর কপাল থাকে লুকায়া'। সুমনের বেলায়ও হয়েছে এমনটি মাঝাীর প্রকৃতির এই নেতা সুমন কপালগুণে হঠাৎ করেই উপজেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে যান। সভাপতি পদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে পেয়ে যায় আলাদিনের আশ্চর্য প্রদ্বীপ। দুই বছরে বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ- সবই দিয়ে গেছে সেই ইচ্ছাপূরণ দৈত্য। ছাত্র রাজনীতির ফল- সে আজ তার গ্রামের দু'চারজন ধনীদের মধ্যে সে একজন। সম্পদের ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুমনের নামের ওজনও বেড়েছে। বাবা-মার রাখা সুমন মিয়া নামটি সুমনের কাছে ওজনে হালকা মনে হয়েছে। তাই মিয়া শব্দটির পরিবর্তে সে নিজের মতো করে লাগিয়েছে ফরায়েজি। সে এখন সুমন মিয়া নয়, সুমন ফরায়েজি।

\হসে অনেক আগের কথা। এখন বয়স হয়েছে। প্রত্যক্ষ রাজনীতি সে আর করে না, তবে উপজেলা সদরে রয়েছে রাজনৈতিক চেম্বার যেখানে প্রতিদিন বসে, রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে গাল-গল্প করে। জনগণ বলে, উপজেলা সদরে নেতা বানানোর কারিগর এই সুমন ফরায়েজি। যার পিঠে সুমন হাত রাখে সেই নেতা হয়ে যায়। সে শুধু নেতাদের নয় দরিদ্রদের প্রতিও সদয়। কোনো গরিব অসহায় লোক তার কাছে হাত পাতলে অকাতরে দান করে, কাউকে ফিরিয়ে দেয় না। কোনো কোনো কর্মী কখনো কখনো বলে, আপনি তো মহান, কোনো ফকির-মিসকিনকেই ফিরিয়ে দেন না। উত্তরে সে বলে, দু'চারটা শকুনের ভরে বটগাছ নুয়ে পড়ে নারে বেটা।

প্রতি বছর রমজানে জাকাতের কাপড় দান করে। মুসলিস্নদের খাতির আত্তি করে, কিন্তু মসজিদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। নামাজ এক ওয়াক্তও পড়ে না। কবে পড়েছে তাও হয়তো বলতে পারবে না।

এ নিয়ে মহলস্নাহর মসজিদের ইমাম আফতাব উদ্দিন তাকে বললেন,

\হ'গরিব অসহায়দের দান করেন, রমজান মাসে জাকাতের কাপড় দান করেন- সবই ভালো, আরো ভালো হতো মসজিদে এসে নামাজটা আদায় করলে।'

'ওগো মাওলানা, মসজিদ ঘরে আলস্নাহ থাকে না।' সুমন ফরায়েজি গানের সুরে উত্তর দেন।

\হ'তাহলে আলস্নাহ কোথায় থাকেন সাহেব?' ইমাম সাহেব মুচকি হেসে প্রশ্ন করেন।

\হ'আলস্নাহ ইজ এভরিহয়ার। শোনেন হুজুর, ইংরেজিতে একটা কথা আছে, দ্যা ভয়েজ অব দি পিপল ইজ দ্যা ভয়েজ অব গড অর্থাৎ জনগণের বাণীই ঈশ্বরের বাণী। এই এলাকার এমন কোনো মানুষ আছে যে, আমাকে খারাপ বলে?' ইংরেজি বাংলার সংমিশ্রণে ব্যাখ্যা দেয় সুমন।

\হ'ফরায়েজি সাহেব, আপনার সামনে আপনাকে ভালো বলবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পেছনে তো আপনাকে কেউ কেউ কসাই সুমন নামে ডাকে, সে খবর কী আপনি রাখেন।'

থতমত খায় সুমন। বলে, 'পেছনের কথা বাদ দেন। পেছনে তো রাষ্ট্রপতিকেও অনেকে গালি দেয়।'

দুই.

ফজরের নামাজের পর ইমাম সাহেব খানিক হাঁটতে রাস্তায় এলেন। দেখলেন সুমন প্রতিদিনের ন্যায় প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সুমন বলল,

'হুজুর, আজ আমার দলের নেতার মৃতু্যবার্ষিকী। উনার মৃতু্যদিবস উপলক্ষে গরিব-মিনকিনকে আজ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছি। বাদ জোহর আপনি থাকবেন।'

\হ 'নেতার মৃতু্যদিবসে মিসকিন খাওয়াচ্ছেন কেন?' ইমাম সাহেব সরাসরি প্রশ্নটা করে বসলেন, কারণ ইমাম সাহেব জানেন, আর যাই হোক সুমন উনার সঙ্গে রাগ করবে না।

'নেতার আত্মার মাগফিরাতের জন্য।'

'নেতার আত্মার মাগফিরাতের জন্য এতসব করছেন, নিজের জন্য কী করলেন? মনে রাখবেন গরিব-মিসকিন খাওয়ানো ফরজ কাজ নয়। গরিব-মিসকিন খাওয়ান- ভালো কথা। সঙ্গে নামাজ পড়ে আলস্নাহর দরবারে নেতার জন্য দোয়া করুন, এতে আপনার ফরজও আদায় হয়ে গেল, আলস্নাহ চাহে তো আপনার এই দোয়ার বরকতে আপনার নেতাকে আলস্নাহ জান্নাত দান করতে পারেন।'

তিন.

মাসখানেক ইমাম সাহেবের সঙ্গে সুমনের দেখা নেই। হঠাৎ করেই একদিন সমজিদের সামনে সুমন আর ইমাম সাহেব মুখোমুখি।

'সুমন সাহেব, আপনি কিন্তু আমার ইচ্ছাটা পূরণ করলেন না। আমি ইচ্ছাপোষণ করি, আমার সঙ্গে আপনি জামাতে নামাজ আদায় করুন। আমি তৃপ্তি পাব।' বললেন ইমাম সাহেব।

'ইমাম সাহেব, আপনি আমাদের মহলস্নার মসজিদের ইমাম ও খতিব। পরহেজগার মানুষ, মুত্তাকি মানুষ। আপনাকে তো যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি, যথেষ্ট ভক্তি করি। তারপরও আপনি আমাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করেন কেন? বলেন তো।'

'উত্ত্যক্ত করি আপনার ভালোর জন্যই, আপনার মঙ্গলের জন্যই, আমার মঙ্গলের জন্য নয়, আমি কিন্তু জানি, আপনার যত ধনসম্পদ, সবই অবৈধ পথে উপার্জিত। এগুলি অর্জন করতে জীবনে কম অন্যায় তো করেননি। সরকারদলীয় থানা সভাপতি থাকাকালে কত অসহায় মানুষকে ফাঁদে ফেলে টাকা কামিয়েছেন, কতজনের রক্ত চোষে নিয়েছেন, মনে পড়ে না?' মাথা নত করে সুমন। 'আলস্নাহ তাআলা মানুষের পাপ মোচনের অনেক রাস্তাই খোলা রেখেছেন। আলস্নাহ তাআলা বলেছেন, আমার বান্দা যদি পাহাড় সমান পাপও করে এবং তওবা করে মাফ চায় তবে আমি তাকে মাফ করে দিই। মসজিদে আসুন। নামাজ আদায় করুন। সহি নিয়তে তওবা করে আলস্নাহর কাছে মাফ চান। আলস্নাহ তাআলা চাহে তো আপনাকে মাফ করে দিতে পারেন।

এতক্ষণ শুধু মাথা নিচু করে শোনছিল সুমন। কারণ প্রতিবাদের কোনো সুযোগই ছিল না তার।

এবার সে মাথা তুলে বলল,

'ঠিক আছে হুজুর। আপনি যেহেতু এত করে বলছেন, আগামী পনেরো দিন পর রমজান মাস শুরু হবে। এবারে রমজানের রোজাগুলিও রাখব এবং প্রথম রমজান থেকে নামাজও শুরু করব- কথা দিলাম, আর মনে রাখবেন, সুমন কথা দিলে কথা রাখে।

চার.

রমজান মাস শুরু হতে মাত্র দু'দিন বাকি। সুমনের নামাজ পড়ারও আর দু'দিন বাকি। ধর্মপ্রাণ মুসলিস্নরা রমজানের মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ঘরে ঘরে মহিলারা বিছানা-কাপড় ধোয়া-মোছা করছে। আসরের নামাজ শেষে ইমাম সাহেব মসজিদ থেকে বেরিয়েছেন। মসজিদের পাশেই কাপড়-চোপড় রোদে শুকিয়ে আছে, ওগুলি বাসায় নিতে হবে। ইমাম সাহেব দক্ষিণাকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ওখানটায় ঘনকালো মেঘমালা জমে আছে। এখনই না হলেও হয়তো শিগগিরই মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে। বাতাসের গতিও একটু একটু করে বাড়ছে।

হঠাৎ মহিলাদের চিলস্নাচিলিস্নর শব্দ বাতাসে ভেসে এলো ইমাম সাহেবের কানে। তিনি মনযোগ দিয়ে শোনছেন কোথায় কী হয়েছে। বুঝতে পারলেন, চিলস্নানি নয় সুমন সাহেবের ঘর থেকে মহিলাদের চিৎকার ভেসে আসছে। মুহূর্তেই মানুষের জটলা। স্বাভাবিক গতির চেয়ে একটু দ্রম্নত গতিতে হেঁটে গেলেন ইমাম সাহেব। ভিড় ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলেন। সুমন শুয়ে আছেন খাটের মাঝে। নিথর, নির্জীব, নিশ্চল। ইমাম সাহেব সুমনের বুক চাপলেন, হাতের পালস দেখলেন। বুঝে গেলেন, সুমন আর নেই। তিনি শ্বাস ছাড়লেন। দীর্ঘ এক শ্বাস। মনে মনে বললেন, দু'দিন তার নসিবে ছিল না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে