বই এবং বইয়ের লেখক

প্রকাশ | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

আ শ ম বাবর আলী
'জীবনে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই আর বই।' জীবনে সত্যিকারের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে যার অনীহা, খ্যাতিমান ব্রিটিশ লেখক বার্নাডশ'র বিখ্যাত উক্তিটার সঙ্গে শুধু তিনিই দ্বিমত পোষণ করবেন। এ কথা সত্যি যে, শুধু খাদ্যখাবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে জগতের সব জীব, সব ইতর অথবা অনুরূপ প্রাণধারী প্রাণী। কিন্তু মানুষের জন্য খাদ্যখাবারটাই বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির কথায়, 'অ সধহ পধহ হড়ঃ ষরাব রিঃয ড়হষু ড়হব ঢ়রবপব ড়ভ নৎবধফ, হববফং ধহুঃযরহমং সড়ৎব'. এই 'ধহুঃযরহমং' জিনিসটা কি? এটা তা-ই, যা একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচিতি দিতে সহায়ক হয়। একমাত্র সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন ছাড়া কেউ তার জীবনকে সমৃদ্ধতা দান করতে পারে না। এই জ্ঞান সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হতে পারে বই পড়ার মাধ্যমে। এই বই পড়ার গুরুত্ব যে কত বেশি, সে কথা অনেক বিজ্ঞজন, বিজ্ঞ মনীষীরা বিভিন্নভাবে বলে গেছেন। তাই সে প্রসঙ্গে না যেয়ে আমি এই বইয়ের লেখক প্রসঙ্গে, লেখকের নানা বিড়ম্বনা প্রসঙ্গে কিছু কথা বলব। একখানা বই লিখতে লেখকে অনেক জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। তার অনেক সাধনার প্রয়োজন হয়। অনেক ধৈর্যশীল সাধক হতে হয়। তা হচ্ছে জ্ঞানের সাধনা। জ্ঞানার্জনে ধৈর্যশীল। জ্ঞানস্পৃহা অর্থাৎ জ্ঞান সংগ্রহের নেশা থাকতে হয় সবার আগে। আর এই স্পৃহাটা থাকতে হবে প্রাথমিকভাবে যতটা নিজের জন্য, তারচেয়ে বেশি অন্যের জন্য। নিজের জন্য নেশা সৃষ্টি না হলে, অন্যের জন্য তা সংগ্রহ অথবা বিতরণের আগ্রহ আসবে না কখনো। তাই বই লেখার আগে তাকে হতে হবে একজন সঠিক সত্য জ্ঞানী ব্যক্তি। নিজে জ্ঞানী না হলে অন্যকে তিনি জ্ঞানদান করবেন কীভাবে? আর তার জ্ঞান অসম্পূর্ণ অথবা ত্রম্নটিপূর্ণ হলে অন্যে তা গ্রহণই বা করবে কেমন করে? আর যদি করেই, সে জ্ঞান যদি ত্রম্নটিপূর্ণ হয়, সে জ্ঞান নিয়ে পাঠক যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার জন্য তো লেখকই দায়ী হতে হবে। তাই একজন বইলেখককে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট প্রাজ্ঞ হয়ে, দায়িত্বশীল হয়ে- তবেই বই লেখার কাজে ব্রতী হতে হয়। মনে রাখতে হবে, একজন ভালো বই লেখক একটা ভালো সমাজ ও জাতি তৈরি করতে পারেন আর একজন মন্দ লেখক দ্বারা একটা জাতি ধ্বংসের পথে এগিয়ে যেতে পারে। ভালো লেখক তিনি, যিনি তার লেখার মাধ্যমে সুষ্ঠু এবং উন্নততর জ্ঞান বিতরণ করেন। আর মন্দ লেখক তিনি, যার লেখা বই পড়ে নষ্ট পাঠক তৈরি হয়। নষ্ট পাঠক তৈরি মানে, নষ্ট সমাজ, নষ্ট জাতি তৈরি। তাই সবদিক চিন্তা করে একজন বই লেখককে অত্যন্ত দায়িত্বশীল হতে হয়। কিন্তু অতি দুঃখের ব্যাপার, একজন দায়িত্বশীল লেখক হয়েও তাকে অনেক সময়, এমনকি অধিকাংশ সময় অনেক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। সেটাই বর্তমান আলোচনার বিষয়। বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রবন্ধকার সৈয়দ মুজতবা আলী তার 'বইপড়া' প্রবন্ধে বলেছেন, 'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।' কিন্তু আমি বলি, বই কিনে কেউ দেউলিয়া না হলেও বই লিখে লেখক দেউলিয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে বলি, বই লিখে লেখক যেমন দেউলিয়া হয়, তেমনি বন্ধু হারাও হয়। কেমন করে, সে কথা প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনায় আসব। প্রথমে দেখুন, আপনি যখন নিজের খরচায় আপনার লেখা বইটি প্রকাশ করলেন। (এ দেশে নিজের লেখা প্রথম দিকের বই নিজের খরচেই প্রকাশ করে থাকেন অধিকাংশ লেখকই, কারণ ব্যবসায়ের বিবেচনায় প্রকাশকরা নতুন লেখকের বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হন না।) তখন আপনার বন্ধুরা আপনার কাছে এসে সরাসরি দাবি করবেন তাকে একটা সৌজন্য কপি দেওয়ার জন্য। অথচ আপনার বই প্রকাশের ব্যাপারে আপনার বন্ধুদের উচিত ছিল আপনার লেখা প্রথম বই প্রকাশের ব্যাপারে যে কোনোভাবে আপসাকে সহযোগিতা করা। তা না করে অনেক কষ্টে, এমনকি আপনার অনেক কিছু প্রিয় এবং প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে যে বই আপনি ছাপালেন, অবিবেচক বন্ধুরা আপনার প্রতি সহযোগিতাশীল না হয়ে উল্টো আপনাকে আরও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থাতে ফেরার জন্য কোমর বাঁধলেন। তা হলে বলুন, বই লিখে আপনি দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন, কথাটা কি আমি ঠিক বলিনি? শুধু প্রথম বই নয়, অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের বেলাতেও যে এমনটি ঘটে না, তা নয়। কিন্তু তারা বোঝেন যে, এসব লেখকরা প্রকাশকদের কাছে থেকে সীমিতসংখ্যক মাত্র কয়েকটি সৌজন্য কপি পেয়ে থাকেন। বন্ধুদের বোঝালেও তা বুঝতে চান না। উল্টো নানাভাবে ভুল বুঝতে থাকেন। উভয় ক্ষেত্রেই বন্ধুর আবদার পূরণ করতে না পারলে বন্ধু বেজার হন, অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। তা হলে হলোটা কি? বই লিখে আপনি দেউলিয়া হলেন, বন্ধুও হারালেন। কই লিখে আপনি প্রশংসা প্রাপ্তির বদলে অপরাধী হলেন সবার কাছে। ভাবতে অবাক লাগে। একজন কৃষিখামারি যখন তার কৃষিজমিতে ভালো ফসল ফলান, কেউ এসে বলেন না, 'ভাই, আপনার জমিতে আপনি উত্তম ফসল ফলিয়েছেন, তা থেকে আমাকে কিছু দান করুন।' একজন মৎস্যখামারির খামারে অনেক মৎস্যের চাষ হয়েছে। কেউ এসে দাবি করেন না, ওখান থেকে কিছু মৎস্য তাকে দেওয়ার জন্য। একজন হাঁস-মুরগির খামারির কাছে এসে দাবি করে না, তার খামার থেকে দুয়েকটা হাঁস-মুরগি অথবা কয়েকটা ডিম দেওয়ার জন্য। অথচ অনেক মেধা, শ্রম আর অর্থ ব্যয় করে বই লেখকের কাছে সবার অযাচিত আবদার। এমনকি আবদার বা দাবি নয়, যেন পাওনা। ভেবে পাই না, ওইসব ফসল আর হাঁস-মুরগির চেয়ে বই কী অতি সহজলভ্য আর স্বল্প মূল্যের বস্ত? আর ওই চাষির চেয়ে বইয়ের লেখক কি অনেক অপরাধী। ভালো ফসল আবাদ করে আবাদকারী সবার কাছে কৃতিত্বপ্রাপ্ত হন। আর ভালো বইয়ের লেখক হয়েও বন্ধুদের কাছে তিনি বিরাগভাজন হন। এতই কি পাপী তিনি? বই আর বইয়ের লেখকের প্রতি এ আমাদের কেমন দীনতা? কেমন অবহেলা? আমরা কেন বইকে সমাদর করি না? কেন বইয়ের লেখককে সম্মান দিতে জানি না? কেন তাকে উৎসাহ দিতে পারি না? এ আমাদের কেমন চিত্তের দীনতা? এ দীনতা আমাদের ব্যক্তির এবং জাতির। এ ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে কেন আমরা এত পিছিয়ে? প্রাসঙ্গিকভাবে আমি একটা ঘটনার কথা বলি। অনেক আগে। আমাদের দেশে একটা জার্মান প্রজেক্টে এ দেশের সরকারি প্রতিনিধি হয়ে কাজ করার সুযোগ আমারসহ কয়েকজনের হয়েছিল। সে দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রতি মাসে মাসিক কো-অর্ডিনেশন সভা হতো। এমনি এক সভার কয়েকদিন আগে আমার লেখা একটা প্রথম বই প্রকাশিত হয় আমার নিজেরই খরচে। সবাইকে দেখানোর জন্য আমার কিছু বই নিয়ে গেলাম সেখান। এ দেশীয় আমার মাত্র কয়েকজন সহকর্মী বন্ধু বইয়ের গায়ের দাম দিয়ে কয়েকটা বই কিনে নিলেন। বেশির ভাগ বন্ধুরাই বন্ধুত্বের দাবিতে (!) অনেকগুলো বই ফাও নিয়ে নিলেন। ওই সভায় আমার একজন বন্ধু আমার বই ছাপানো প্রকৃত ঘটনার বিবরণ দিলেন। সভাশেষে ওই প্রজেক্টের শীর্ষ কর্মকর্তা আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে আমার আমার লেখা অন্তত ১০০ কপি বই তার কাছে বিক্রি করার জন্য অনুরোধ জানালেন। ব্যাপারটা আমার কাছে বোধগম্য হলো না। একজন বাংলা না জানা জার্মান ব্যক্তি বাংলাভাষায় রচিত আমার লেখা বই নিয়ে কি করবেন? বিস্মিতভাবে আমি ভাবতে লাগলাম। যা হোক, পরের দিন ১০০ কপি বই নিয়ে আমি তার অফিসে হাজির হলাম। তিনি বইগুলো আমার কাছ থেকে নিয়ে এক গোঁছা টাকা আমার হাতে দিলেন। গুণে দেখলাম, বইয়ের প্রকৃত মূল্যের অন্তত চারগুণ বেশি। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম! কিছুক্ষণ পর তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি আমাকে এত টাকা দিচ্ছেন কেন? নিশ্চয়ই আপনি হিসেবে ভুল করছেন।' তিনি হেসে বললেন, 'না প্রিয় লেখক, আমার কোনো ভুল হয়নি। ইচ্ছে করেই এ টাকা আমি আপনাকে দিয়েছি। একজন লেখকের মূল্য অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। এ তো অতি সামান্য আরও কিছু দিতে পারলে আমি খুশি হতাম। আর তাছাড়া যে কোনোভাবে লেখকদের যদি একটু উৎসাহ দেওয়া যায়, তাহলে তার লেখার প্রেরণা তো আরও বেড়ে যাবে। বিপরীতে লেখক যদি বই লিখে অর্থের দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে তার লেখার আগ্রহ তো কমে যাবে। দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে কীভাবে?' একজন বিদেশি নাগরিকের কাছে আমি যেন অবাক হয়ে রূপকথা শুনছিলাম! আর ভাবছিলাম, 'হায়রে! আমরা কোথায় আছি? ওদের তুলনায় আমাদের অবস্থান আজ কোন পর্যায়ে। এখনো ভাবি, তেমন অবস্থান থেকে আজও কি আমাদের কোনো উত্তরণ ঘটেছে? অথবা কখনো ঘটবে কি?