মধুসূদনের স্বদেশ চেতনা এবং বাঙালি জাতীয়তাবোধ

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

সাইফুদ্দিন সাইফুল
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনক, বাংলা সাহিত্যের নবযুগের অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিভার অধিকারী, বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবতর্ক, বাংলা নবজাগরণের কালজয়ী স্রষ্টা ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ এবং বাংলা কবিতার প্রথম বিদ্রোহী কবি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘‘স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ’’ নিয়ে বিষদ গুরুত্ব ও আলোচনার শুরুতেই তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য চিন্তা -চেতনা ভাব-ভাবনা বিশ্বাস-অবিশ্বাস মানুষিক গভীর আস্থাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্ বিষয় হিসেবে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। উল্লিখিত বিষয়টি বুঝতে ও জানতে পারলে তখনই মধুসূদনের স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ বিষয়টি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ ছাড়া ‘স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ’ বিষয়টি কি এবং কেন পাঠক মাত্রই উপলব্ধিতে মননে বিশ্বাসে চেতনায় মধুসূদনের সাহিত্য সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হবে। আর সময় এটাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় এনে পাঠকের সামনে একান্তে সৃজন ও মননশীলতার আবরণে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। জানি যে, কবি মধুসূদন ব্যক্তি জীবনে হিন্দু না মুসলিম এবং মুসলিম না খ্রিস্টান ছিলেন এটা বড় কথা না, কথা হলো তিনি ছিলেন একজন খঁাটি বাঙালি মানুষ। বাংলা তার মাতৃভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবোধ তার বিশ্বাসের জায়গা। পৃথিবীর সবদেশে সবকালে প্রকৃত ভালো লেখকরা তার সাহিত্যের মধ্যে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনাকে ধারণ করে থাকে। মধুসূদনও দক্ষতার সহিত এটাকে ধারণ করেই নিপুণ হাতে অনবদ্য সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি করেছেন। একজন বিদগ্ধ সচেতন নিরপেক্ষ পাঠক মাত্রই জানেন যে, আমাদের বাঙালি রেনেসার কালজয়ী প্রতিভাবান শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে মধুসূদনের সৃজনশীল বৈচিত্র্যময় সাহিত্যে স্বদেশ চেতনার চিন্তাভাব ও ভাবনার ঐকান্তিক রূপ-রসের কত বেশি বিকাশ ঘটেছে। আর তাই সুদূর ভাসার্ই নগরে থেকেও কবি তার স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা দেশের কথা শৈশব জীবনের হাজারো মধুময় স্মৃতি এতটুকু ভুলে যাননি বলেইতো তিনি তার অমর সৃষ্টি ‘কপোতাক্ষ নদ’ শীষর্ক কবিতায় স্বদেশের একটি নদের জলকে গভর্ধারিণী জননীর দুধের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে প্রবল আবেগে আপ্লুত হয়ে এভাবেই মনের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেনÑ ‘‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ; বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ ¯েœহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে? দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে! ’’ আসলে একথা আজ সবর্জনবিদিত যে, মধুসূদন তার সাহিত্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে অনেক বেশি জাগ্রত ও বিনিমার্ণ করেছে। ফলে বাংলা কাব্যজগতে মধুসূদনের আবিভাের্বর কারণেই বাঙলা সাহিত্যে বাঙালির মনে মননে ও বিশ্বাসে এক নতুন আশা-আকাক্সক্ষার দীপ্ত আলো আলোকিত হয়ে ধরা দিয়েছিল। তার ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি তারই জলন্ত উদাহরণ হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। বাংলাসাহিত্যে অনেক বড়ো বড়ো কবি সাহিত্যিকের আবিভার্ব হয়েছে এবং তারা বাংলা ভাষায় কাব্য কথাসাহিত্য গদ্য ইত্যাদি নিমর্ল সাহিত্যের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু দেশের কোনো নদীকে কাব্যে তুলে ধরেছেন কয়জ’না তার হিসেব মেলে না। অথচ মধুসূদন তার কবিতায় তার শৈশব কৈশর ও যৌবনের স্মৃতির সাক্ষী প্রিয় ‘কপোতাক্ষ নদ’কে এক দুলর্ভ জীবন্ত রূপ দান করেছেন। এখানেই মধুসূদনের বিশেষ শক্তিময়তা ও সত্তা লুকায়িত রয়েছে। মূলত মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষা ও বাংলাসাহিত্যকে একেবারে স্বদেশ প্রেমের রঙে রাঙিয়ে উন্মুক্ত নীলাকাশের গায়ে রংধনুর মতো অপরূপ সৌন্দযের্র নান্দনিক এক লীলাক্ষেত্র তৈরি করেছে। আর এখানেই স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ সম্পূণর্ আপন সত্তা পরিপূণর্ অখÐ ভাব ও ভাষা নিয়ে আবিভূর্ত হয়েছে। এটাকে অস্বীকার করা যাবে না। কবি মধুসূদনের চিন্তা-চেতনায়, ভাবনায়, বিশ্বাসে ও তার সাহিত্যে স্বদেশ চেতনা এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল বলেই না তিনি আজ আধুনিক বাংলা কবিতার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন। কেননা, একজন যুগসচেতন কবি হিসেবে মধুসূদনের অবদান বাংলা কাব্যকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছে। অবশ্য আমরা একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, বিগত ঊনিশ শতকের বাংলা কবিতার নবজাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং শক্তিমান প্রধান কবি মধুসূদনের ক্ষণকালের বণার্ঢ্য যাপিত জীবনে একদিকে যেমন স্বদেশ চেতনার যারপরনাই উন্মেষ ঘটেছে, তেমনি আবার তার গোটা বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল সাহিত্য কমের্র মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রসার অত্যাধিক লাভ করেছে। মোটকথা, স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ নিরেট মৌলিক সত্তার মতো কবিকে জাগিয়ে তুলেছে। আর সবকিছু মিলেই কবি মধুসূদনকে এক অনন্য রূপে কালের সামনে দঁাড় করিয়েছে। তার চেতনায় স্বদেশ ভাবনা বিস্ময়কর ভাবে প্রকাশ হয়েছে। আর তাই তার সাহিত্যে স্বদেশ চেতনা প্রতিটা পাঠককে মুগ্ধ ও অবাক করেছে। আসলে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধ মধুসূদনকে এতটাই আলোকিত করেছে যে, তিনি সমাজ ও ধমের্র প্রচলিত প্রথাকে ভাঙতে ও অস্বীকার করতেও এতটুকু পিছপা হননি। অনেক প্রথাকেই তিনি প্রশ্নের সম্মুখীন দঁাড় করিয়েছেন। যদিও এই জন্য তাকে সমাজের কাছ থেকে কটূক্তি বদনাম শুনতে হয়েছে। তার প্রতি বঁাকা চোখে তাকানো হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও মধুসূদন নো-কেয়ার করে তার সাহিত্য ভাÐারকে সমৃদ্ধ করে আগামীর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আজ একথা দিবালোকের মতো সত্য যে, কালের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর প্রতিবাদী মুখ মহাবিদ্রোহী মহাকবি মধুসূদনের সমগ্র সাহিত্যে অথার্ৎ তার কি কবিতায়, কি নাটকে, কি প্রহসনে এবং কি তার মহাকাব্যে মূলত স্বদেশ চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধেরই সফল জাগ্রত রূপই প্রকাশ পেয়েছে। আর এ কারণেই বাংলাসাহিত্য বলি কিংবা বাংলা কাব্য-মহাকাব্য যাই বলি না কেন, কবি মধুসূদনের কাছে ঢের বেশি ঋণী হয়ে আছে। মধুসূদনকে উপেক্ষা করলে বাংলাসাহিত্য, বাংলা কাব্য, বাংলা মহাকাব্য আপন শক্তিতে দঁাড়াবাড় ক্ষমতায় হারিয়ে ফেলবে। কাজেই যতদিন বাংলা সাহিত্য-কাব্য-নাটক ও মহাকাব্য থাকবে ততদিন মধুসূদন মহিরুহ হয়ে সৃজনশীলতার আলো ছড়াবে। এমন কে আছে ধমের্র জিকির তুলে মধুসূদনকে দূরে ঠেলে দেবে, কে আছে নিজ ভাষা-সাহিত্যকে অবজ্ঞা অবহেলার অজুহাত তুলে তাকে উপক্ষো করবে; এই দুঃসাহস জানি কেউই দেখাতে পারবে না। কেননা, মধুসূদন স্বদেশ চেতনা আর বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্য রচনা করেছিলেন বলেই তিনি আজ আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের জনক হতে পেরেছে, বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহাকাব্য রচনা করে বাংলা কাব্যকেই সম্পূণর্ নতুন রূপে তুলে ধরেছেন এবং গোটা বিশ্বকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা বাঙালিরা দেশপ্রেমে চেতনায় জাতীয়তাবোধে অন্যদের চাইতে অনেক অনেক বেশি স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছি এবং তা পারিও বটে। মহাকবি মধুসূদন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং জাতীয়তাবোধে নিজেকে শামিল করে তার সব সাহিত্যকমের্ক এক অনন্যরূপে অসাধারণ আঙ্গিকে নতুনের ষ্পশের্ অভিনব নিমার্ণ করে কালের হাওয়ায় আগামীর চেতনায় বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেহেতু পাশ্চাত্য ভাষা-শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি কবি মধুসূদন অধিক পরিচিত ছিলেন, সেহেতু তিনি স্বদেশ, চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙলা ভাষা ও বাঙলা কাব্যকে পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে বের করে এনেছিলেন। এখানেই তার কাব্য রচনার স্বাথর্কতা খঁুজে পাওয়া যায়। এবং স্বদেশ চেতনা জাগ্রত হয়েছে। হ্যঁা এটা ঠিক যে, মধুসূদন তিনি তার নিজের ভাষা-সাহিত্য-স্বজাতির প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা করেছেন, মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে পরভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, আপন ধমর্-সংস্কৃতিকে বদলিয়ে অন্যের ধমর্ সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিলেন; এখন প্রশ্ন হলো তার কেন এই অবজ্ঞা, কেন এই অবহেলা? এটা কি শুধুই পরধমর্ ভাষা সংস্কৃতি গ্রহণ করে বিশ্বের মাঝে বড়ো একজন কবি বা লেখক (এলিয়ট, কিটস, বায়রণ, শেক্সপিয়র) হওয়ার জন্যই করেছেন নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য অথবা চিন্তা-চেতনা লক্ষ্য ছিল! আজ নতুন করে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। অতএব, কবি মধুসূদনের গায়ে হরহামেশা যে অপবাদ দিচ্ছি সেটা আমরা কতটুকু জেনে বুঝে ভেবে করছি তাও আমাদের ভাবতে হবে। আসলে আমরা একটু খেয়াল করলে দেখতে পাব যে, তিনি যখন জন্মেছেন তখন বাংলা কবিতার আকাল চলছিল এবং বাংলা সাহিত্য মৃতপ্রায় অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। এমতাবস্থায় মধুসূদন এসে বাংলা কবিতার হাল ধরলেন। বাংলা কাব্যকে নতুন করে জন্ম দিলেন। একটি কথা এখানে অপ্রিয় হলেও বলতে চাই যে, বিগতকালে কিংবা বতর্মানে অনেক সুন্দর মানসম্মত বাঙলা কাব্য-কথাসাহিত্য বাঙলাতে রচনা হলেও বা করলেও কি আন্তজাির্তকভাবে নোবেল (!) পুরস্কার কিংবা ম্যান-বুকার প্রাইজ (!) বাঙালিদের অজর্ন হবে কি? হয়তো বা হবে না। আর না হওয়ার পেছনের একটিই কারণ তা হলো সাহিত্যকমের্ক বাঙলাতে লেখা। তবে কি আমরা বাঙালিরা পদক কিংবা পুরস্কার পাওয়ার জন্য বাংলাতে লেখা ছেড়ে দেবÑ অবশ্যই না। আসলে উল্লিখিত পুরস্কারদ্বয় অজর্ন বাংলাতে ভালো কিছু লিখলে হবে না, এটা শুধুমাত্র ইংরেজিতেই লিখতে হবে। অবশ্য এই নিয়ম আগামীতে পরিবতর্ন হবে কিনা জানি না, তবে পরিবতর্ন হলে অনেক ভাষা থেকে ভালো ভালো সাহিত্য বেরিয়ে আসবে। আর তাই মধুসূদনের নিজ ভাষা-স্বজাতিকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষাতে লিখতে যাওয়াটা তেমন দোষের কিছু না। একথা আমাদের মানতেই হবে যে, দেখা দৃষ্টিতে তিনি তার ভাষা-ধমর্-দেশ-জাতিকে ছাড়লেও মনে-প্রাণে তিনি তার আপন বলতে যা বোঝায় কোনো কিছুকেই অস্বীকার করেননি বা ভোলেননি। যদি ভুলতো তবে তিনি বিদেশে বসবাস করেও দেশের তরে ভাষার তরে জাতির তরে এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারতেন না। অন্তরে গভীরে নিজ ভাষাকে চরম আপন করে ভেবেছিলেন তাই বাংলা কাব্যে আজ এত বৈচিত্র্যময় কাব্য সাহিত্যকমর্ রচনা করতে পেরেছেন। বাংলা কাব্যকে নতুনের মোড়কে উদ্ভাসিত করেছেন, প্রচÐ প্রতিভার জোরে মহাকাব্য সৃষ্টি করে পৃথিবীকেই অবাক করে দিয়েছেন। এই সবকিছু মিলে আমাদের কাছে মধুসূদনের ব্যক্তিগত জীবন না তার অপার সাহিত্য জীবনই বারংবার মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং উঠবে। কলকাতার লোয়ার সাকুর্লার সড়কের পাশে মহাকবি মধুসূদনের সমাধিস্থল অবস্থিত। কবির এই সমাধি ফলকে লেখা (মধুসূদনের মৃত্যুর কিছুদিন আগে নিজ স্বহস্তে) তার এপিটাফে দৃঢ় বিশ্বাস ও অধিকার নিয়ে মনের কথা বলেছেন- ‘‘দঁাড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে।’’ প্রিয় পাঠক একটু ভেবে দেখুন যে, এখানে এই কবিতায় কবি তিনি তার সমাধিক্ষেত্রে লিপিবদ্ধ এপিটাফে ‘দঁাড়াও’ এর পরিবতের্ দঁাড়ান কথাটি বলতে পারতেন কিন্তু তা বলেননি, বলেছেন দঁাড়াও অথার্ৎ নিজ বঙ্গদেশের কোনো বঙ্গ পথিকের কাছে আপন অধিকারের অভিব্যক্তি এভাবে সম্বোধন করেছেন। আসলে নিজ দেশের, দেশের মানুষের, ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ভালোবাসা প্রেম বিশ্বাস ছিল বলেই তিনি এমন দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পেরেছেন। কবি মধুসূদন এখানেও সফল ও স্বাথর্ক। আমরা যদি বাংলাসাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য হিসেবে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’টিকে রাজনৈতিক পারিবারিক সামাজিক ও সমাজতাত্তি¡কভাবে বিচার করে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, এই মহান সৌন্দযর্ অনুপম মহাকাব্যের মাধ্যমে মধুসূদনের মধ্যে লুকায়িত স্বদেশ চেতনা এবং জাতীয়তাবোধেরই প্রতিফলন ঘটেছে এবং তা মেঘনাদবধ কাব্যের চরিত্রের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। এখানে দেশপ্রেমের এক অতিসুন্দর অকাট্য ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি কবি মধুসূদন অমিত্র-ছন্দে তুলে ধরেছেন। আর প্রকাশ পেয়েছে অপার দেশপ্রেমের কাব্যিক পরিচয়। এ ছাড়া এই মহাকাব্যে রাবনপুত্র ইন্দ্রজিতের দেশপ্রেমের প্রতি উদ্বুদ্ধের ভাষণ, বিভীষণের মনে-প্রাণে ও বিশ্বাসে দেশপ্রেম এবং প্রিয় লঙ্কার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কঠিন লড়াই-সংগ্রামের কথা সাবলিলভাবে উঠে এসেছে স্বদেশ চেতনাকে সামনে রেখে। পাশাপাশি আদরের সন্তান হারাবার আকুলতা ক্রন্দন বিষাদ পিতা রাবণের মধ্যে দিয়েও প্রকাশ পেয়েছে। মেঘনাদবধ মহাকাব্যে স্বদেশ চেতনা জাতীয়তাবোধ মানবতা ও প্রেমের জয়গান ফুটে উঠেছে। প্রতিবাদের দীপ্ত ভাষায় বিদ্রোহের সুরে মানবিকতাবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কাব্যটির পাতায় পাতায় কবি মধুসূদনের স্বদেশপ্রেম, স্বদেশ চেতনা, স্বদেশবোধ ও স্বাজাত্যবোধেরই আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে। মূলত সনেট কবিতা, অন্য কবিতা, নাটক, ট্র্যাজেডি, পত্রকাব্য, গদ্য, মহাকাব্য কিংবা প্রহসনের ন্যায় মেঘনাদবধ কাব্যে স্বাদেশিকতার পরিচয় জোড়ালোভাবে প্রকাশ হয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরাণকাহিনী, ধমর্, বিশ্বসাহিত্য, সৃষ্টিশীল ক্ষমতা-জ্ঞান আর চিন্তাবোধের প্রতি মধুসূদনের জানা-দেখা-বোঝার নিরিখ ছিল বলেই আমরা এই মহাকাব্যের মধ্যে স্বগর্-মতর্্য-পাতাল, দেব-দানব-মানব, ক্রোধ-করুণা-বেদনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক কাব্যসৌন্দযর্ রূপ অবলোকন করতে পারি। বাংলা সাহিত্যে এই মহাকাব্যটি স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই অনন্য অসাধারণ এক বিরল সৃষ্টির স্বাক্ষর বহন করে আছে। এ ছাড়া শিল্পনিষ্ঠা মনের অধিকারী কবি মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে পত্রাকারে রচনা ‘‘বীরাঙ্গনা’’ কাব্যটিতে পৌরাণিক কাহিনীর নারীরা এখানে খুউব প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। এখানে কবি মধুসূদন ভারতীয় পুরানন্ধিত নারী চরিত্রগুলোকে মাধ্যম করে এই বীরাঙ্গনা কাব্যটি সৃষ্টি করেছেন। আমরা জানি যে, ধমের্র ভয় ও কথা বলে আবহমানকাল ধরে ভারতীয় হিন্দু সমাজে ও জীবনে নারীদেরকে নিযার্তন অত্যাচার অপমান করা হয়েছে। আর তাই এই সমাজের নিযাির্তত নিষ্পেষিত অবহেলিত লাঞ্চিত নারীরা পুরুষের সমাজব্যবস্থা ভেঙে, ধমের্র গোড়ামি ছেকল ছিঁড়ে, শাসকের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে দৃঢ় প্রত্যয়কে ধারণ করে আপন অধিকারের স্বপ্নকে বুকে নিয়ে চরম বিদ্রোহ করেছে সব অন্যায় জুলুম অত্যাচার আর নিযার্তনের বিরুদ্ধে। এসব নারীকে কবি মধুসূদন স্বদেশ চেতনার প্রতীক হিসেবে এই বীরাঙ্গনা কাব্যকে পাঠকের সামনে দঁাড় করিয়েছেন। কবি মধুসূদনের অন্তরে যে বোধ ভাব বিশ্বাস শক্তি সত্য ধারণা এবং মুক্তি ও চেতনা জাগ্রত তা তিনি এই কাব্যে নারীদের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। নারীরা মাটির পুতুল নয় যে, এদের সোকেচে কিংবা ঘরের মধ্যে আটকিয়ে রাখতে হবে। নারীরাও মানুষ, তাই কবি মধুসূদন নারীদের ঘরের বাইরে বের করে এনেছেন। আর নিজেদের দাবি ও অধিকারের কথা দৃঢ় কণ্ঠে বলিয়েছেন এবং অসত্য অন্যায় বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলেছে। কবি মধুসূদন স্বাধীনতা মুক্তির কথা বিশ্বাস করতেন, তাই তিনি নারীদেরও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ও মুক্তির প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বীরাঙ্গনা কাব্যে। এখানে স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিত্ব ও সমমযার্দার অভিপ্রায় নিয়ে নারীরা জীবনসত্যর জয়গান গেয়ে নিভীর্কচিত্তে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের ঝাÐাকে সমুন্নত করে ঊধ্বের্ তুলে ধরেছেন। মূলত এই পত্রাকাব্যে নারীরা অপার প্রেম ও ভালোবাসার মূলশক্তিতে বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠার পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিত্ব স্বাধীনতা ইচ্ছেশক্তি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছেন। পরিশেষে, এটাই বলতে চাই যে, একজন দেশপ্রেমিক সচেতন কবি বা লেখক তার নিজের ভাষা-সংস্কৃতি মননে ও বিশ্বাসে ধারণ করে বলেই সেই লেখকের লেখার মধ্যে তার স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের কথা সচেতনভাবে উঠে আসে। মহাকবি মধুসূদনের বেলাতেও তার ভিন্নতা ঘটেনি। মোটকথা, মধুসূদনের বৈচিত্র্যময় অমর সাহিত্যে স্বদেশ চেতনার প্রতিফলন যেমন ঘটেছে তেমনি আবার তার সাহিত্য বাঙালি জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করেছে। আর তাই আধুনিক বাংলাসাহিত্যে মধুসূদনের স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের যে বৈশিষ্ট্যের আত্মপরিচয় পাওয়া যায় তা বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ইতিহাস-ঐতিহ্য সভ্যতা ও সাহিত্যকে গুরুত্বপূণর্ করে তুলে ধরতে সাবির্ক সক্ষম হয়েছে। নিজ ভাষাকে সংস্কৃতিকে স্বজাতিকে জাতীয়তাবোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলেইতো কবি মধুসূদন পাশ্চাত্য শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি ছেড়ে আপনাকে বাংলাতে একাত্ম করে তুলেছিলেন। এ জন্যই বাঙলার নবজাগরণে বাংুলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মধুসূদন বাংলা নবজাগরণের মহাকবি।