মধুসূদনের সাহিত্যে আন্তজাির্তকতা

প্রকাশ | ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

শাহরিয়ার সোহেল
‘দঁাড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল, এ সমাধিস্থলে’ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার অন্তরের শক্তি ব্যক্ত করেছেন এখানে। সত্য কঠিন, কঠিনকে তিনি ভালোবেসেছেন অন্তরে-বাইরে। সমাজ ছেড়েছেন, দেশ ছেড়েছেন, ধমর্ ছেড়েছেন, বিদেশে গেছেন শুধু কবি হওয়ার বাসনায়। ভাগ্য বিধাতা তাকে ফিরিয়ে দেননি। তাকে মহাকবি করেছেন বাংলা সাহিত্যে। নিজের ভুল বুঝতে পারার পর এক অথের্ তওবা করে বঙ্গভাষা কবিতার মাধ্যমে ফিরেছেন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে। তিনি চির স্মরণীয়, বরণীয় এবং বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের পথের দিশা। তিনি জন্মগ্রহণ না করলে বাংলা ভাষা অনেক বেশি দুদর্শাগ্রস্ত হতো। অত্যন্ত মেধাবী, অমিত শক্তিধর মধুসূদন জয় করেছেন বিশ্ব সাহিত্য। আন্তজাির্তক সাহিত্যাঙ্গন থেকে মধুসূদন অনেক উপাদান গ্রহণ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। অপরিচিত তৎসম শব্দ ও সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যের তুলনামূলক দশর্ন শুরু হয় তার কাছে থেকেই। তিনি বিভিন্ন দেশের সাহিত্য থেকে বাক্য ব্যবহার, ছন্দ-অলঙ্কার, মিথ, পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। সাহিত্যে সংশ্লেষণ করেছেন আইরিশ, গ্রিক, লাতিন, ইণালি, জামার্ন, ফরাসি, পারসিক সাহিত্য থেকে। তার সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। সিগমুÐ ফ্রয়েড, আন্দ্রে ব্রেঁতো, হেগেল, কালর্মাকের্সর দশর্ন তাকে প্রভাবিত করেছে। বিশ্ব সাহিত্য থেকে তিনি বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করেছেন। হোমারের ইলিয়াড, মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট, দান্তের ডিভাইন কমেডি, ট্যাসোর জেরুজালেম ভেলিভাডর্, বাল্মীকির রামায়ণ, ব্যাসদেবের মহাভারত থেকে উপাদান সংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে সবর্প্রথম অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, বিদ্রোহী কবি ও নারী মুক্তির প্রথম আহŸায়ক। বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম সংযোগ সংস্থাপনকারী তিনি। বিশ্ব বরেণ্য ইণালীয় কবি দান্তের ষষ্ঠশত জন্মবাষির্কী উপলক্ষে সে দেশের রাজা দান্তের ওপর এক প্রতিযোগিতার আহŸান করেন। দান্তের ওপর সনেট লিখে মধুসূদন প্রথম হন। সেটিই প্রথম বাংলা সাহিত্যে আন্তজাির্তক স্বীকৃতি। পরবতীের্ত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাংলা ভাষার মান আরও একধাপ এগিয়ে দেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষাকে স্থায়ী আসন প্রদান করেন। ইণালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল মধুসূদনকে বলেছিলেন, ‘আপনার কবিতা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করবে।’ ‘আত্মদ্ব›েদ্ব পরাভ‚ত বা অভিভ‚ত মানব মনের করুণ রসাত্মক কাহিনীই ট্র্যাজেডি’, অ্যারিস্টটল বলেছিলেন। কবি মধুসূদন তার ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্য ট্র্যাজেডি দিয়েই ভরপুর। তার সাহিত্যের প্রধান রস করুণ রস, যা পাঠকদের বিগলিত করে, কষ্টে নিমজ্জিত করে। বিশ্ব সাহিত্যে যখন রোমান্টিসিজমের ব্যাপকতা চলছে, ঠিক সে সময় মধুসূদন ক্ল্যাসিক সাহিত্য সংযোজন করলেন। বীর ও করুণ রসের মিলনে সাথর্ক ট্র্যাজেডি রচনা করেছেন। তার লেখা গদ্য-হেক্টরবধ, নাটক-কৃষ্ণকুমারী, মায়াকানন, মহাকাব্য-মেঘনাদ বধ, পত্র কাব্য-ব্রজাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা, প্রহসন-বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রেঁা, একেই কি বলে সভ্যতা প্রভৃতির ভেতর রয়েছে হিরোয়িক ট্র্যাজেডি। ইটালির কবি পেত্রাকের্র অনুসরণে তিনি সনেট লিখেছেন। সনেট লেখায় যাদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তাদের ভেতর দান্তে, শেক্সপিয়র, মিল্টন, ওয়াডর্সওয়াথর্ উল্লেখযোগ্য। তার চতুদর্শপদী কবিতায় রয়েছে মৌলিকত্ব। দেশীয় ঐতিহ্যকে তিনি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন তার ১০৮টি চতুদর্শপদী কবিতায়। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতিতে আধুনিক জীবনবোধ ও নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছেন, যা আজও খরস্রোতা নদীর মতোই বহমান। বিভিন্ন ভাষা শেখার প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল। কলকাতার ছাত্রজীবনে তিনি প্রায় বারোটি ভাষা আয়ত্ত করেন। বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রæ, ফরাসি, জামার্ন, ইটালিয়ান প্রভৃতি ভাষায় তার দক্ষতা ছিল অপরিসীম। বিশ্ব সাহিত্যে যেসব কবি ও সাহিত্যিকরা বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রেখেছেন, মধুসূদন তাদের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। তিনি বিশেষভাবে অনুসরণ করেছেন বাল্মীকি, বেদব্যাস, বায়রন, মিল্টন, শেক্সপিয়র, হোমার, ভাজির্ল, দান্তে, ট্যাসো, পেত্রাকের্দর। বিশ্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের লেখার উপাদান নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। হাজার বছরের বাংলা কাব্যের ধমির্নভর্র ধারার বিপরীতে প্রথম মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনার শিল্পভাষ্য নিমার্ণ করেন। মধুসূদন একাধারে যুগস্রষ্টা ও যুগসৃষ্টি। বিদেশি সাহিত্যের রতœভাÐার থেকে মণি-মুক্তা এনে মাতৃভাÐারকে পরিপূণর্তা দান করেছেন। তিনি জানতেন, বাংলা সংস্কৃত ভাষার কন্যা, সংস্কৃত ভাষার গাম্ভীযর্ অমিত্রাক্ষর ছন্দের অলঙ্কার। এ ছন্দেই তিনি লিখেছেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। মেঘনাদ বধ কাব্য বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এ কাব্যে পাশ্চাত্য ভাবধারার স্রোত বহমান। মেঘনাদ বধ রচনার পরই মধুসূদন লন্ডন যাত্রা করেন। তিনি সাহিত্যের ভেতর নারী চরিত্রকে সুমহান শক্তিশালী ও প্রতিবাদী হিসেবে দেখিয়েছেন, যা বাংলা সাহিত্যে নারী নিয়ে প্রথম সাহসিকতার প্রমাণ। বিভিন্ন নারী চরিত্রের ভেতর রয়েছে শকুন্তলা, তারা, কৈকয়ী, শূপর্ণখা, দ্রৌপদী, উবর্শী প্রভৃতি। পরবতীের্ত তিনি বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। ইংরেজি সাহিত্যের ভেতর ‘ভিশন অব দ্যা পাস্ট’, ‘দ্যা ক্যাপটিভ লেডি’ লিখেছেন। এগুলো খুব একটা সমাদৃত হয়নি। এর পরপরই তিনি ইংরেজি সাহিত্য থেকে বিদায় নেন। চেক কবি মিরোশ্লাভ বলেন, ‘কবিতা যখন জেগে ওঠে তখন আর কিছুই করার থাকে না, কবিতাই শৃঙ্খলা সৃষ্টির শেষ চেষ্টা’। মধুসূদনের জীবনে কবিতা জেগে উঠেছিল, এজন্য তিনি সব কিছু বিসজর্ন দিয়ে কবিতাকেই অঁাকড়ে ধরেছিলেন। চেশোয়াভ মিউশ বলেছেন, ‘কাকে বলে কবিতা, যদি তা না বঁাচায় দেশ কিংবা মানুষ’? মধুসূদন বিদেশি সাহিত্য থেকে বিভিন্ন উপাদান এনে নিজের মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। এটি এমন এক অবদান, যা চিরকাল স্মরণ করতেই হবে। শুধু তাই নয় আজীবন বাংলা ভাষা যাদের মাতৃভাষা, তাদের ঋণী থাকতে হবে তার কাছে। মধুসূদনের ভেতর আমিত্ববোধ ছিল ব্যাপক। এই বোধই তাকে কালজয়ী করেছে। ডেকাটর্ যেমন ভেবেছিলেন, ‘আমি চিন্তা করতে পারি, অতএব আমার অস্তিত্ব আছে’। জ্যা-পল-সাত্রর্ ভেবেছেন, ‘ভয়াবহ অন্ধকার ও যন্ত্রণার অগ্নিকুÐেই ফুল ফুটিয়ে দেখাতে হবে যে, আমি বেঁচে আছি, আমি অস্তিত্ববান’। মধুসূদনের জীবনে এ সত্য মারাত্মক ও ভয়াবহভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। অস্তিত্ববাদী যে সব দাশির্নকদের কাছ থেকে তিনি অনুপ্রাণিত ও সাহসী হয়েছিলেন, তাদের ভেতর রয়েছে : সোরেন কিয়েকের্গাদর্, হাইডেগার, নিটশে, আলবেয়ার কাম্যু, অঁাদ্রে মালরো, সিনক্লেয়ার, ডরোথি রিচাডর্সন, ফ্রয়েড, ভাজিির্নয়া উলফ, জেমস জয়েস, শেরউড এন্ডারসন, ইউন্ডারহাম, জ্যা-পল-সাত্রর্, জ্যা রাসেন, বোদলেয়ার, রাবো, মরিয়ক, মালোর্, ডেকাটর্ প্রমুখ। তার সাহিত্য আন্তজাির্তক মানের। তার আমিত্ব শক্তি এতটাই প্রখর ছিল যে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি অমর হবেন। তার কাব্য বেঁচে থাকবে অনন্তকাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। এ জন্যই তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার জীবনী লিখিও, কারণ আমি বড় কবি হইব।’ একথা তিনি ছাড়া বাংলা সাহিত্যে আর কেউ বলে যেতে পারেননি। এমন সাহসী আর কেউ হয়ে উঠতে পারেননি। তবু তার মিনতি মাতৃভ‚মির সবার প্রতি, ‘রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে’।