সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর উপন্যাস

প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

জুলফিকার নিউটন
সব মহৎ রচনার মতো সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর উপন্যাস 'চাঁদের অমাবস্যা'-রও সার্বকালিক ও সার্বজনিক গূঢ়ার্থ আছে, কিন্তু প্রথম পাঠেই আমার মনে হয়েছিল দরিদ্র, অনবিজ্ঞ, শূন্যস্বাস্থ্য, গ্রামবাসী, 'বয়োতীত' যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর কাহিনীতে বিশেষভাবে সমকালীন বাংলাদেশের আত্যন্তিক সংকটই উদ্ভাসিত হযেছে। অথচ কৌতূহলী হয়ে যাকেই প্রশ্ন করি তিনি বলেন 'চাঁদের অমাবস্যা' এক দুর্বোধ্য উপন্যাস। এটির লেখক দীর্ঘকাল যাবৎ প্রবাসী হওয়ার ফলে দেশের বাস্তব অবস্থা বিষয়ে অজ্ঞ এবং অনবহিত, তার অনাশ্রয় কল্পনা তৎকালীন পশ্চিমি সাহিত্যের অনুচিকীর্য। অথচ 'চাঁদের অমাবস্যা' কোনো অর্থেই রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। উপন্যাসটির সংক্ষিপ্ত ভূমিকা থেকে জানা যায় যে এটির 'বেশিরভাগ ফ্রান্সের আলপস পর্বত অঞ্চলে পাইন-ফার-এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে লেখা হয়।' এটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ঢাকায় ১৯৬৪ সালে। আরেফ আলী বিশেষ স্থানকালের বিশেষ একজন মানুষ। 'কোপন নদীর ধারে ক্ষুদ্র চাঁদপারা গ্রামে তার জন্ম', 'দরিদ্র সংসার, হাতের তালুর মতো এক টুকরো জমিতে জীবনধারণ চলে না', 'কষ্টে-সৃষ্টে নিকটে জেলা-শহরে গিয়ে আই-এ পাস করেছে', 'বয়স বাইশ-তেইশ, কিন্তু তার শীর্ণ মুখে, অনুজ্জ্বল চোয়ালে বয়োতীত ভাব', গ্রাম্যস্কুলের শিক্ষক, গ্রামের বড়বাড়ির কর্তা দয়াশীল ও ধর্মপ্রাণ দাদা সাহেবের আশ্রয়ে সে-বাড়ির বাইরের ঘরে তার বসবাস, মাইনে বাবদ যে-সামান্য টাকা পায় গ্রামে বুড়ি মায়ের হাতে দিয়ে আসে। কিন্তু একই সঙ্গে আরেফ আলী সব দেশের ভীত, সংকুচিত, দুর্বল, অসহায়, কল্পনাপ্রবণ, অনুভূতিশীল, বিবেকী কিন্তু নিরুদ্যম, সহৃদয় ও ম্রিয়মাণ সাধারণ মানুষেরই প্রতিভূ। ওয়ালিউলস্নাহ-র মহত্ত্ব এইখানে যে সংকটাক্রান্ত আরেফ আলীর আর্ত অপহ্নবের প্রয়াসকে তিনি যেমন দুর্লভ নিপুণতায় অপাবৃত করেছেন, তেমনি পরিশেষে তার অনভিভাবনীয়, অঘোষিত, প্রত্যাশারিক্ত, শঙ্কাদীর্ণ দায়িত্ববোধের অনাদৃত প্রকাশকেও আমাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস্য করে তুলেছেন। ওয়ালিউলস্নাহ সার্থক শিল্পী ও যথার্থ মানবতন্ত্রী। 'চাঁদের অমাবস্যা'-র আখ্যানিক পরিণাহ মোটামুটি এই মতো : শীতের এক উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাতে আরেফ আলী 'শারীরিক প্রয়োজনে' ঘুম ভাঙলে আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। শিক্ষকতা করা সত্ত্বেও তার মনে 'জ্যোৎস্না রাতের প্রতি আকর্ষণ' এখনো পর্যন্ত 'অদমনীয়'। তার মনে হয় এত সৌন্দর্য অর্থহীন নয়, তা মহারহস্যের ইঙ্গিতবাহী, এই রকম রাতে 'বিম্বভূমন্ডল রহস্যময় ভাষায় কথালাপ করে'। কিন্তু এসব ভাবনা সে গোপন রাখে। সে নিঃসঙ্গে, বন্ধুহীন। শারীরিক প্রয়োজন মিটিয়ে ঘরে না ফিরে সে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নার রূপ দেখে। সেই সময় তার চোখে পড়ে যে তার আশ্রয়দাতা আলফাজউদ্দিন চৌধুরী বা বড়বাড়ির দাদা সাহেবের ছোটভাই কাদের চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। কাদের নিষ্কর্মা, দিনের বেশিরভাগ সময় বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে থাকে, কখনো বা সারাদিন পুকুরধারে ছিপ-বড়শি নিয়ে কাঁটায়, কারও সঙ্গে মেশে না, হঠাৎ রেগে ওঠে বিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বউয়ের উদাসীন, রাতে বেরিয়ে যায় এবং সকালে যখন ফেরে 'তার মুখ ফ্যাকাসে রক্তহীন, কিন্তু চোখে অতু্যজ্জ্বল দীপ্তি অলৌকিক তৃপ্তি-সন্তোষ-ভাব'। দাদাসাহেব তার এই অদ্ভুত প্রকৃতির ভাইটিকে নিজের পরিবারে ও সমাজে গ্রহণীয় করার জন্য রটিয়েছে যে কাদের 'দরবেশ মানুষ', রাতে সে 'বুজুর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়'। কথাটা তিনি নিজে 'সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন, তা নয়', তবে বিশ্বাস করতে চান, অন্তত অন্যদের বিশ্বাস করাতে চান, যদিও ছোটভাইকে তিনিও আদৌ বোঝেন না। জ্যোৎস্নালোকে কাদেরকে দেখে আরেফ কৌতূহলী হয়ে তাকে অনুসরণ করে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে হারিয়ে ফেলে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে বাঁশবন থেকে সে চাপা ভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ভয় পেয়ে সে 'হাততালি দিয়ে রাখালের মতো গোরুডাকা আওয়াজ করে ওঠে।' পরক্ষণেই বাঁশবনে একটি মেয়েমানুষের সভয় চিৎকার এবং পাথরচাপা দেওয়া স্তব্ধতা-সাপের মুখে ঢোকা ব্যাঙের ঢাক হঠাৎ থেমে যাওয়ার মতো। অবশদেহ আরেফ শুনতে পায় বাঁশবন থেকে কে যেন সরে যাচ্ছে। মনে জোর করে এগিয়ে যেয়ে দেখে যে বাঁশঝাড়ের 'আলো-আঁধারের মধ্যে একটি যুবতী নারীর মৃতদেহ, অর্ধউলঙ্গ, পায়ের কাছে এক ঝলক আলো'। বিভ্রান্ত অবস্থায় বাঁশঝোঁপ থেকে বেরিয়ে দ্রম্নতপায়ে হাঁটতে আবার সে হঠাৎ দেখে সামনে দাঁড়িয়ে কাদের। আরেফ 'কখনো বিজন রাতে বাঁশজাড়ের মধ্যে যুবতী নারী মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই।' 'সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে শুরু করে'। সে বাড়ি ফেরার পর শেষ রাতে কাদের তার ঘরে আসে, প্রশ্ন করে, আরেফ বাঁশবনে কী করছিল, কেন সে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আরেফ উত্তর না দিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কাদের ঘর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে যায়। রাতের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সারাদিন আরেফকে ভাবায়, অভিভূত করে রাখে। সে 'একটা গোলকধাঁধা ঢুকেছে যার আকৃতি-পরিধি কিছুই জানে না, যার অর্থ সে বোঝে না।' নিজেকে সে বোঝাতে চেষ্টা করে বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি যতই বীভৎস হোক, সে নিজে 'দর্শক মাত্র', এই দৃশ্যের 'পাপ-নৃশংসতা তাকে স্পর্শ করতে পারবে না'। কিন্তু রাতে কাদের আবার তার ঘরে আসে, 'যন্ত্রচালিতের মতো বিমূঢ়' আরেফকে সঙ্গে নিয়ে যায়, বাঁশঝাড় থেকে মৃতদেহটি তুলে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়ার কাজে আরেফকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করে। আরেফ কাদেরের অন্ধকার মুখে দেখতে পায় আরেফের প্রতি তার 'পরম ঘৃণার ভাব'। কাদের চলে যায়, আর তারপর থেকে শুরু হয় আরেফের নিজের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই। আরেফ মনের অন্তস্থলে জানে কী ঘটেছে, কে খুনি, নিহত নারীর শব যে সে দেখেছে এবং সেই শব নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার কাজে খুনিকে সে যে যত অনিচ্ছাতেই হোক, যত বিমূঢ় দশাতেই হোক, সহায়তা করেছে, এ সত্য প্রকাশ্যে স্বীকার করা তার অলঙ্ঘনীয় দায়িত্ব, এ কথা প্রকাশ না করলে ওই নারীর মৃতু্য অর্থহীন এবং তার নিজের জীবনের শূন্যগর্ভতা অসহনীয়। অপরপক্ষে দাদাসাহেব এবং কর্তৃপক্ষের কাছে এ কথা বলার অবশ্যম্ভাবী ফল কী তা নিয়েও তার মনে সন্দেহ নেই। দরিদ্র, নিরাশ্রয়, নির্বান্ধব মানুষ সে। তার আশ্রয় ঘুচবে, চাকরিটি যাবে, দয়ালু শক্তিমান আশ্রয়দাতা তার শত্রম্ন হয়ে উঠবে, কর্তৃপক্ষ খুব সম্ভবত তার কথা আদৌ বিশ্বাস করবে না, তার আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীরা তার এই সত্যকথনের সমর্থন তো করবেই না, উলটে তার নির্বুদ্ধিতার নির্দয় সমালোচনা করবে, তার আচরণের পিছনে কোনো কুৎসিত কারণ খুঁজবে। আরেফ জানে যে সে 'ভীত, দুর্বলচিত্ত, অসহায় মানুষ।' এখানে অন্তত সে নিরাপত্তা, বাসস্থান ও যত কম মাইনের হোক একটি চাকরি পেয়েছে। দাদাসাহেবের 'স্নেহশীল ছাতার' নিচে থেকে সে তার 'জীবনে সর্বপ্রথম বেদনাদায়ক অভাব-অভিযোগটা যেন ভুলেছে'। মাকে মাইনের 'টাকা দেওয়ার সময় জীবনে এই প্রথম সে সুখবোধ করছে।' অতএব আর পাঁচজনের মতো আরেফ আলীও নানাভাবে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে যে-ভয়ানক ঘটনা সে দেখেছে ভাবছে তা হয়তো আসলে এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন মাত্র, অথবা হয়তো কাদের সত্যিই দরবেশ এবং এই খুন সে করেনি, অথবা সংসারের অন্তহীন রহস্যের মতো এও এক রহস্য যার অর্থ তার অবোধ্য, অথবা হয়তো কাদেরের আচরণের পেছনে একটি স্বল্পভাষী, গোপন স্বভাবের প্রেমিক মানুষের অথবা হয়তো প্রচন্ড প্যাশন এবং আত্মকর্তৃত্বহীন দিশেহারা আকস্মিক ভয় কাজ করেছিল, অথবা সত্য প্রকাশের দ্বারা কারও উপকারের সম্ভাবনা নেই, এবং আশ্রয়দাতা দাদাসাহেবকে তার দ্বারা নিষ্ঠুর আঘাত করা হবে, কাদেরের চরম শাস্তি হতে পারে এবং তার নিজেরও সমূহ সর্বনাশ ঘটবে। কিন্তু নিজেকে বিভিন্ন 'কাল্পনিক অথবা' দিয়ে নানাভাবে বুঝিয়েও সে না পারে আপন চেতনায় সত্যকে চাপা দিতে না পারে নিজের দায়িত্ববোধকে এড়িয়ে যেতে। শীতকালের শান্ত নিস্তেজ নদীতে স্টিমারের উজ্জ্বল সাদা সন্ধানী আলোয় মেয়েটির ফেঁপে ফুলে ওঠা বিবস্ত্র শব আবিষ্কৃৃত হয়। জানা যায় মেয়েটি ওই গ্রামেরই করিম মাঝির বউ। কাদের নিজেই তার কাছে রাতের গোপনে দু'-এক কথায় স্বীকার করে যে, সে ভয় পেয়ে পারিবারিক সুনামের কথা ভেবে তার উপযাচিকাকে খুন করেছে। তার স্ফিত, রক্তবর্ণ, ঘূর্ণমান চোখ দেখে আরেফের মনে কোনো সংশয়ের অবকাশ থাকে না যে 'কাদেরের পক্ষে দরিদ্র মাঝির বউয়ের প্রতি কোনো ভাবাবেগ বোধ-করা সম্ভব নয়'। কাদের আবার রাতে এসে তাকে শাস্তির ভয় দেখায়। কোনও রকমের স্তোভ থেকেই আরেফ আলী শান্তির বা স্বস্তি পায় না। তাকে নিজের কাছে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে যে 'আত্মরক্ষার প্রবল বাসনা' থেকেই তার এই অধ্যবসায়ী আত্মপ্রবঞ্চনার উদ্ভব; 'ভীতির নগ্ন চেহারা দেখে বিবেকের কণ্ঠস্বর স্থব্ধ হয়েছে'। কিন্তু যে মানুষ জীবিত থাকার জন্য সত্যকে অস্বীকার করতে প্রস্তুত এবং নিহত নারীটির জন্য যার মনে সমবেদনার বোধ পর্যন্ত নেই সে 'নামেই শুধু জীবিত'। আসলে তেমন মানুষ মৃত, তার জীবন 'ধার করা জীবন'। অতএব আরেফ আলী শেষ পর্যন্ত দাদাসাহেবের কাছে সত্যকথাটি নিবেদন করে, তারপর 'বিসদৃশভাবে উঠে দাঁড়িয়ে' তার কাছে বিদায় নেয়। সে হাঁটতে শুরু করা মাত্র স্তম্ভিত বড়বাড়ি থেকে দাদাসাহেবের গুরুগম্ভীর ডাক আসে। ভীত আরেফ আলী তখন ছুটতে শুরু করে। থানায় গিয়ে সমস্ত ঘটনার কথা পুলিশকে জানায়। কিন্তু পুলিশ কর্মচারীটি তাকে ধমকায়, বাঘাগলায় বলে 'চালাকি করতে চেয়েছিলেন,' থুথু ছিটিয়ে আবার বলে, 'কী, অপরাধ স্বীকার করতে রাজি আছেন'। তাকে ভয় দেখায় 'আজগুবী কথা' না ছাড়লে আরেফের নিজেরই ক্ষতি হবে বলে সতর্ক করে। তাকে মনে করিয়ে দেয় তার বৃত্তান্তের পক্ষে কোনো সাক্ষী নেই, সে নিজে কাউকে খুন করতে দেখেনি, কিন্তু যুবতীয় লাশের পাশে তার উপস্থিতি কাদের সচক্ষে দেখেছে। পুলিশের এসব যুক্তিই আরেফ আগে থেকে জানে, তার কাজের 'কী পরিণাম হবে, কেন হবে, কী কী ভাবে হবে-সেসব কথা উপলব্ধি করে তার ভীতির শেষ থাকে নাই।....তা এমনই এক ধরনের ভীতি যা শরীরে কোথাও গভীর ক্ষতের মতো লেগে আছে, উপড়ানো যায় না, অস্বীকার করাও যায় না'। তবু সেই নারীর প্রাণহীন দেহের স্মৃতি তাকে তাড়িত করেছে, সত্যকে স্বীকার না করে, দায়িত্ব পালন না করে, নিজে শাস্তি নিয়েও ওই মৃতু্যকে নিরর্থতা থেকে রক্ষা না করে তার পক্ষে মানুষ হিসেবে বাঁচা সম্ভব নয়। পুলিশ কর্মচারীর ব্যঙ্গ, অবিশ্বাস, ভয় দেখানো তার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। তার 'গায়ের জীর্ণ আলোয়ানটি ঘরের উজ্জ্বল আলোয় অতিশয় জীর্ণ মনে হয়'। আরেফের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিষ্ঠুর সত্য এবং প্রতিশ্রম্নতিরিক্ত দায়িত্ব-চেতনাকে এড়ানোর জন্য তার আপ্রাণ চেষ্টা, সেই প্রয়াসের ব্যর্থতা, এবং ভয়ে, সঙকোচে, অনিচ্ছায় তবু ভিতরকার তাগিদেই তার আশাহীন সততার প্রকাশ-আসাম্য নিপুণতায় ধাপে ধাপে আরেফের আচরণ, কল্পনা, অনুভূতি এবং আত্মবিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে ওয়ালীউলস্নাহ্‌ এসব ফুটিয়ে তুলেছেন। ওয়ালীউলস্নাহ'র শব্দ নির্বাচন এবং বাক্যের গঠনে কিছু কিছু ত্রম্নটি পীড়া দেয়। জাতশিল্পী এবং নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও হয়তো দীর্ঘদিন জন্মভূমি থেকে দূরে থাকার ফলে তার বাংলা শব্দের কান যথেষ্ট শীলিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। শ্রম্নতিসুভগ ধ্বনি-বিন্যাসের চাইতে ব্যঞ্জিত বাকপ্রতিমা উদ্ভাবনে তিনি বেশি সিদ্ধহস্ত। কিন্তু 'চাঁদের অমাবস্যা'য় তিনি যে-মানবীয় সংকটকে তার উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়রূপে নির্বাচন করেছিলেন এবং সেই গভীর ও জটিল, ব্যক্তিক ও সার্বিক বিষয়টিকে তিনি যেভাবে তীক্ষ্ন অন্তর্দৃষ্টি ও সুবেদী কল্পনা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নিতান্ত দুর্লভ। অন্তত বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে যারা স্বীকৃতভাবে তার প্রধান পূর্বসূরি-বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ ও মানিক-তাদের উপন্যাসরাসিতে এই বিষয়টি এভাবে সার্থকতার সঙ্গে কোথাও পরিচিন্তিত ও পরিদৃশ্যমান হয়নি। ওয়ালীউলস্নাহর চেতনায় ডস্টয়েভ্‌স্কি, কাফকা, ফকনার ও কামু্যর প্রভাব পড়ে থাকাই সম্ভব। প্রভাব যদি পড়ে থাকে, সে প্রভাব তিনি সম্পূর্ণভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। ফলে যে দর্পণটিতে আমরা আমাদের বিপন্ন, বিমূঢ়, সংকটাক্রান্ত, দ্বিধাদীর্ণ মুখ দেখে চমকে উঠি সে দর্পণ নৈর্ব্যক্তিক থাকে না। সেটি হয়ে ওঠে একজন বিশেষ ব্যক্তি, বাইশ-তেইশ যার বয়স, যে ভিতরে অশান্তির জ্বালা নিয়ে 'ভক্তিমান শান্তচিত্ত ব্যক্তির মতো নামাজ পড়ে', যে দরিদ্র, সন্ত্রস্ত, কিন্তু জ্যোৎস্নারাতে ব্যঞ্জিত বিশ্বের নিভৃত আলাপ যার অশ্রম্নত নয়, যে নিঃসঙ্গ কিন্তু হৃদয়বান, নিজেকেও নানাভাবে প্রতারণা করার মতো কল্পনাশক্তির যে অধিকারী, কিন্তু দায়িত্ববোধও যার প্রবল এবং অনতিক্রম্য ভয় ও নৈরাশ্য নিয়েই যে সত্যের মুখোমুখি হতে শেষ পর্যন্ত সক্ষম। আরেফের সংকটাক্রান্ত অস্তিত্বের যেটুকু তার চেতনায় এবং আমাদের নজরে প্রত্যক্ষ, তার আড়ালে আরও অনেক দিকের ইঙ্গিত এই উপন্যাসে ছড়ানো আছে। আর আছে কিছু ছোট-বড় চরিত্র, কেউবা দাদাসাহেব আর তার ভাই কাদেরের মতো জটিল এবং মোটা ও সরু দুরকম তুলির টানে আঁকা, কেউ বা আরাবর মৌলবী অথবা দাদাসাহেবের মেয়েপক্ষের নাতি আমজাদ বা একচোখেকানা কর্কশকণ্ঠ মুয়াজ্জিনের মতো স্কেচ মাত্র। ক্যানভাস বড় নয়, বিষয়টি বড় এবং সেই বড় বিষয়কে পরিদৃশ্যমান করা হয়েছে অকম্প্য নিপুণতায়, গভীর অন্তর্দৃষ্টির সামর্থ্যে, উদাত্ত কল্পনার স্বয়ম্ভরতায়। ওয়ালীউলস্নাহর জীবনদর্শন সমকালীন ফরাসি অস্তিত্ববাদীদের ভাবনাচিন্তা থেকে কিছু গ্রহণ করেছিল; কিন্তু তার নিজস্বতা প্রশ্নাতীত। 'চাঁদের অমাবস্যা'র জগৎ একদিকে স্বয়ংসিদ্ধ; অন্যদিকে তা বিশিষ্টভাবে ব্যক্তিসাক্ষিক, বাংলাদেশি এবং আমাদের অধন্যতম সংকটেও প্রাসঙ্গিক। আমার বিচারে 'চাঁদের অমাবস্যা' ওয়ালীউলস্নাহর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। তবে তার অন্য দুটি উপন্যাসে এবং কিছু ছোটগল্পে তার প্রতিভার সাক্ষর মোটেই অপ্রত্যক্ষ নয়। প্রথম সংস্করণে 'লাল সালু'র পাঠক জোটেনি; কিন্তু পরে এটির অনেকবার মুদ্রণ হয়েছে। উর্দু, ইংরেজি ও ফরাসি ছাড়াও চেক এবং আরও কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় ভাষায় এই উপন্যাসটির অনুবাদ ছাপা হয়। ইংরেজি ও ফরাসি অনুবাদে মূলের কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন দেখা যায়। বাংলা সংস্করণে (অষ্টম মুদ্রণ: জুলাই, ১৯৭৩) যেখানে মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১৬, ফরাসি অনুবাদের সংস্করণে সেখানে পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯০ এবং ইংরেজি অনুবাদে পৃষ্ঠা সংখ্যা ২২৩। সৈয়দ আবুল মকসুদ মূল বাংলা সংস্করণ এবং ইংরেজি অনুবাদ সংস্করণের পার্থক্য নিয়ে কিছুটা বিস্তারিতভাবে তার গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে (পৃ- ১১১-১৫০-) আলোচনা করেছেন। তার সিদ্ধান্ত অনুসারে যদিও অনুবাদক হিসেবে ওয়ালীউলস্নাহর নাম ইংরেজি ও ফরাসি সংস্করণে উলিস্নখিত হয়নি, এইসব ঘঁষামাজা বাড়ানো বদলানো লেখক নিজেই করেছিলেন; এ কাজ অনুবাদকের সাধ্যায়ত্ত নয়। বাকি অংশ : আগামী সংখ্যায় 'লাল সালু' মজিদ ও মহব্বতনগর গ্রামের কাহিনী। মজিদ 'খোদার আলো ছড়াতে' এবং ভাগ্য ফেরানোর আশায় গারো পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে কিছুকাল কাটিয়েছিল। সুবিধা করতে না পারায় তিনদিনের পথ হেঁটে সে মহব্বতনগর গ্রামে পৌঁছয়। সেখানে একটা বড় বাঁশঝাড়ের কাছে মজাপুকুরের পাশে পুরনো এ আধারে টালখাওয়া কালো সবুজ শ্যাওলায় ঢাকা ছোট ছোট ইটের তৈরি একটা কবর দেখে সে এক মতলব ঠাওড়ায়। সে ঘোষণা করে "ওটা মোদাচ্ছের পীরের মাজার"। গ্রামবাসীদের ধমকে, অলৌকিক শক্তির ভয় দেখিয়ে তাদের অজ্ঞতা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, দুর্বলতা, আত্মনির্ভরতার অভাব এবং পরিবেশের বিমুখতার সুযোগ নিয়ে মজিদ ক্রমে নিজেকে ওই গ্রামের একচ্ছত্র ধর্মীয় নেতার পদে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। গ্রামের প্রতিপত্তিশালী জোতদার খালেক ব্যাপারীও ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক ব্যাপারে মজিদের নেতৃত্ব মেনে নেয় এবং দুজনের ভিতরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মজিদ জানে তার প্রভাব প্রতিপত্তির উৎস সেই কবর, সেটা কার কবর সে জানে না, কিন্তু যেটাকে মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে ধর্মভীরু গ্রামবাসীদের সে বিশ্বাস করিয়েছে। ইট-সুড়কি দিয়ে নতুন করা হয় মাজারকে, তার ওপর জালরওয়ালা লালসালু পড়ে দেখায় মাছের পিঠের মতো, মোমবাতি জ্বলে, আগরবাতি গন্ধ ছড়ায়। এ গ্রাম সে গ্রাম থেকে লোকেরা এসে মাজারের কাছে তাদের কান্না, কৃতজ্ঞতা, আশা, ব্যর্থতার কথা নিবেদন করে, আর সঙ্গে ছড়াছড়ি যায় পয়সা, সিকি, দুয়ারি, আধুলি, সাচ্চা টাকা, নকল টাকা। মজিদের ঘরবাড়ি ওঠে। এক 'ব্যাপ্তযৌবনা' শক্তসমর্থ মেয়েকে 'আলিঝালি' দূর থেকে দেখে আকৃষ্ট হয়ে শীর্ণদেহ মজিদ তাকে বিয়ে করে। পরে বুঝতে পারে যে যদিও ওই বেওয়া মেয়েটি আকারে লম্বা-চওড়া এবং যদিও সে শরীরের প্রচুর শক্তি ধরে তা সত্ত্বেও আসলে রহীমা ভারী 'ঠান্ডা, ভীতু মানুষ', রোগা বুড়োটে মজিদের 'পেছনে মাছের পিঠের মতো মাজারটির বৃহৎ ছায়া দেখে' মজিদকে যেমন সে ভয় তেমনি শ্রদ্ধা করে। গান, হাসি, আনন্দ, উৎসব, এসবের মজিদ একেবারে বিরোধী। বয়স্ক জওয়ানদের ধমকে কলমা পড়ায়; এক বাপ-বেটাকে জবরদস্তি পাকড়াও করে হাটবাজারের মধ্যে প্রকাশ্যে খৎনা দেয়; জমায়েত ডেকে খোদার নাম নিয়ে এক বদমেজাজি বুড়োর মনের মেরুদন্ড এমনভাবে ভেঙে দেয় যে সে চিরকালের মতো ঘর ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। মজিদের ঘরে মগড়ার পর মগড়া উপছে পড়ে ধানের প্রাচুর্যে। মজিদ অনুভব করে তার শক্তি খালেক ব্যাপারীর শক্তি থেকে ভিন্ন জাতের। 'মজিদের শক্তি ওপর থেকে আসে, আসে ওই সালুকাপড়ে আবৃত মাজার থেকে। মাজারটি তার শক্তি সূত্র।' মজিদের এই একচ্ছত্র ক্ষমতায় প্রথম ধাক্কা লাগে ভিনগ্রাম থেকে এক পীর সাহেবের আগমনের ফলে। লোকজন পীরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে দেখে 'একটা মারাত্মক ক্রোধ ঘৃণা মজিদের রক্তে টগবগ করতে থাকে'। তারপর মজিদ মাথা ঠান্ডা করে পীরের ধাপ্পাবাজি ধরিয়ে দেওয়ার মতলব আঁটে। তার চেষ্টা অংশত সফল হয়; তার গ্রামের কিছু যুবক 'জেহাদি জোশে বলীয়ান হয়ে' পীর সাহেবের সভায় গিয়ে হামলা করে। কিন্তু সংখ্যায় কম বলে তাদেরই মাথা ফাঠে, তাদেরই হাসপাতালে যেতে হয়। তারপর মজিদ দেখে খালেক ব্যাপারীর নিঃসন্তান প্রথম বিবি আমেনা সন্তান কামনায় পীরের থেকেই পানিপড়া চায়। মজিদ তখন বিস্তর মাথা খাটিয়ে নানা কাল্পনিক তত্ত্বের উদ্ভাবনা ও অনুষ্ঠানবিধির ব্যবস্থা করে ব্যাপারীকে বোঝায় যে আমেনা বিবির 'গুনাগার দিল' থেকে খালেকের 'পাক দিল' বিচ্ছিন্ন না করতে পারলে খালেকের অশেষ শাস্তি সুনিশ্চিত। 'খোদার কালামের সাহায্যেই' মজিদ এ কথা জেনেছে। ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাপারী তার নিরপরাধ ধর্মভীরু ও স্বামীভীরু বিবিকে চিরদিনের জন্য বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। বিদেশপ্রত্যাগত 'উচক্কা ধরনের ছেলে' যুবক আব্বাসের স্কুল খোলার প্রস্তাবকে কৌশলে বানচাল করে দিয়ে মজিদ তার জায়গায় গ্রামে এক পাকা গম্বুজওয়ালা মজিদ তৈরি করায়। কিন্তু বিত্ত প্রতিপত্তি এবং খোদার কালাম সত্ত্বেও মজিদের মনে শান্তি নেই। তার কোনো পোলাপাইন নেই, এবং ঠান্ডা, ভীতু রহীমাকে নিয়ে তার দেহের কামনা মেটেনি। গ্রাম্য ক্ষমতার চূড়ায় বসে মজিদ দ্বিতীয়বার বিয়ে করে। জামিলাকে প্রথম দেখে মনে হয়েছিল 'সে যেন ঠিক বেড়ালচানা'। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই বোঝা যায় কিশোরী জমিলার প্রকৃতি রহীমার একেবারে বিপরীত। সে যখন-তখন জোরে হেসে ওঠে; দুঃখীর দুঃখে তার মনে 'কূলকিনারাহীন অথই প্রশ্ন' জাগে; নামাজ পড়তে ভুলে যায়; মজিদের ধমকধামক গ্রাহ্য করে না; এমনকি যখন মগরেবের পরে দোয়া-দরুদ পাঠের শেষে জিকির করতে করতে মজিদ উদ্বেল জমায়েতের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে তখন বিভ্রান্ত জমিলা সব রীতিনিষেধ ভুলে বাইরে গাছতলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে-তার মাথায় ঘোমটা নেই। মজিদের জ্ঞান ফেরে, কিন্তু জিকির আর জমে না। পরদিন মজিদ পীরের মাজার সম্পর্কে জমিলাকে অনেক বানোয়াট ভয়ংকর গল্প বলে তাকে হুকুম দেয় রাতে নামাজ পড়ে মাজারের পীরের কাছে মাফ চাইতে। কিন্তু রাতে খুঁজতে এসে দেখে জমিলা জায়নামাজে ঘুমিয়ে আছে। তাকে হঁ্যাচকা টানে তুলে মজিদ মাজারের দিকে নিয়ে যায়। মাঝপথে জমিলা বেঁকে বসে, হাত ছড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে 'হঠাৎ সিধে হয়ে মজিদের বুকের কাছে এসে পিক করে তার মুখে থুতু নিক্ষেপ করল।' স্তম্ভিত মজিদ সন্ত্রস্ত রহীমার দিকে চেয়ে 'অদ্ভুত গলায় বলল : 'হে আমার মুখে থুতু দিল।' কিন্তু একে উদ্যোগী, শক্তিমান, মাতবর পুরুষ, তায় খোদার কালামের সহায়তায় প্রায় সর্বজ্ঞ ও শর্বশক্তিমান, কিশোরী বউয়ের বিদ্রোহে ঘাবড়াবার লোক মজিদ নয়। তাকে পাঁজাকোলে করে মাজারে নিয়ে যায়, সেখানে একটা খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে জমিলার কোমর বাঁধে, তারপর মাজার ঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে নিজের বাড়িতে চলে আসে। সে রাতে ভয়ংকর ঝড় ওঠে, তারপর অজস্র শিলাবৃষ্টি। রহিমা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে; মজিদ ছটফট করে; শিলাবৃষ্টি থামতেই মাজারে গিয়ে ঝাঁপটা খুলে দেখে লালসালু ঢাকা কবরের পাশে 'হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জমিলা, চোখ বোজা, বুকে কাপড় নেই'। মজিদ দড়ি খুলে তার অচেতন দেহ তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। 'মুহূর্তের মধ্যে মজিদের ভেতরেও কী যেন ওলটপালট হয়ে যাবার উপক্রম করে।.....কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাল খেয়ে সে সামলে নেয় নিজেকে।' মাঠে বেরিয়ে দেখে 'ক্ষেতে ক্ষেতে ব্যাপ্ত হয়ে আছে ঝরে পড়া ধানের ধ্বংসস্তূপ। .....চোখে ভাব নেই। বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে চোখ।' 'চাঁদের অমাবস্যা'র মতো 'লাল সালু'র শৈলী এতটা সূক্ষ্ণ নয়। ব্যঞ্জনাশ্রিত আভাসের চাইতে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিন্যাসের স্পষ্টতা এই উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু দুই উপন্যাসেই গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও অশিথিল একাগ্রতায় ধীরে ধীরে প্রধান চরিত্র দুটি প্রমিতাক্ষরিত। 'চাঁদের অমাবস্যা'র বস্তুত কোনো স্ত্রী চরিত্র নেই; 'লাল সালু'তে শুধু বিদ্রোহিণী জমিলা নয়, সন্ত্রস্ত সেবাব্রতী ও স্নেহপরায়ণ রহীমা, স্বামীভীরু আমেনা, বিধবা ধানভাননী হাসুনির মা ('শরীলে যার রং ধরেছে') এবং তার ঝগড়াটে ছোটখাটো, কোঁকড়ানো মাবুড়ি প্রত্যেকেই জীবন্ত। তা ছাড়া এ উপন্যাসটিতে মাজারপীর মোলস্নাশাসিত মুসলিম গ্রামসমাজের পরিচয় মেলে। জীবনের অনিশ্চয়তাজাত ভয় এবং অলৌকিক বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে বিত্তসম্বলহীন কিন্তু অভিনয়দক্ষ ও চতুর উদ্যোগীজন যে কিভাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে, খোদার কালাম যে তার ব্যবসায়ে কত বড় পুঁজি হয়ে উঠতে পারে, বাঙালি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ওয়ালীউলস্নাহর আগে আর কেউ কাহিনীর ভিতর দিয়ে এত অনাবিদ্ধ দুঃসাহসে সেটি ফুটিয়ে তুলেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। হিন্দু সাধুবাবা এবং ধর্মীয় আশ্রম প্রতিষ্ঠানের ভিতরকার চেহারা নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য লিখেছিলেন, কিন্তু 'অহিংসা' উপন্যাসের (১৯৪১) উৎকর্ষ লক্ষ্য করার পরও আর মনে হয় 'লাল সালু'র ধীপ্রদীপ্ত, অনন্যতন্ত্র সাহসিকতার তুলনা সেখানেও মেলে না। আসলে হিন্দু আশ্রমগুরুদের চরিত্র বিশ্লেষণের চাইতে মুসলিম পীরমোলস্নাদের চরিত্র বিশ্লেষণ যে কোনো বাঙালি লেখকের পক্ষে বেশি বিপজ্জনক। শুধু সার্থক উপন্যাস হিসেবে নয়, শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের সমকালীন মানসমুক্তির প্রচেষ্টার ইতিহাসেও "লাল সালু" বিশেষভাবে উলেস্নখনীয়। ওয়ালীউলস্নাহর তৃতীয় ও শেষ উপন্যাস 'কাঁদো নদী কাঁদো' তার অন্য উপন্যাস দুটির চাইতে গঠনের দিক থেকে জটিলতর, বক্তব্যের দিক থেকে আরও গূঢ় এবং কিছুটা অস্বচ্ছ। এটিতে একদিকে আছে নিপুণ বিশৃঙ্খলায় কথিত মুহাম্মদ মুস্তফার বিড়ম্বিত জীবনের কাহিনী, অন্যদিকে কুমুরডাঙ্গার সেখানে চড়া পড়ার ফলে কুমুরডাঙ্গাতে স্টিমার আসা বন্ধ হয়ে যায়। কুমুরডাঙ্গার অবক্ষয়ের বিবরণ। বালক বয়সে মুহাম্মদ মুস্তফার প্রথম বীর্যস্থলনের রাতে তার নির্দয় পিতা তাকে প্রচন্ড প্রহার করেছিল। অনতিক্রমণীয় আতঙ্ক মুস্তফার জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিব্যাপ্ত। সে সইতে শিখেছে, করতে শেখেনি। শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যা করে। কুমুরডাঙ্গার সঙ্গে মুস্তফার সম্পর্ক এই যে দেশের বাড়িতে ফিরে আত্মঘাতী হওয়ার আগে সে কুমুরডাঙ্গায় ছোট হাকিম হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিল। যে নদীর পারে কুমুরডাঙ্গা লোকদের মনেও কি একটা সদাজাগ্রত ভয়। যেন খোদাকে নয়, খোদার সৃষ্টিকে তাদের ভয়। দোজখকে নয়, নশ্বর জীবনকে তাদের ভয়।' 'সর্বপ্রকার মছিবতের জন্য তারা সদা-তৈরি এবং একবার কোনো মছিবত এলে তার অস্তিত্ব বা নায্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না।' স্টিমার চলাচল বন্ধ হওয়ার পর মোক্তারের মেয়ে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী সখিনা খাতুন 'একটি বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়'। 'কান্নাটি কোনো মানুষের নয়, কোনো জীবজন্তুর নয়, জীবিতের নয়, মৃতেরও নয়, অন্য কারও। কে জানে, কান্নাটি হয়তো নদীরই, হয়তো তাদের মরণোস্মুখ বাকাল নদীই কাঁদে।' ক্রমে কুমুরডাঙ্গার আরও অনেকে এই রহস্যময় কান্না শুনতে পায়। তারা তখন সবকিছুতেই 'আসন্ন ভীষণ বিপদের পূর্বচিহ্ন' দেখতে পায়, তাদের জীবন হয়ে দাঁড়ায় 'শ্বাসরুদ্ধকরা অপেক্ষা মাত্র'। 'কুমুরডাঙ্গা এবার যেন মধ্যযুগে প্রত্যাবর্তন করেছে।' মুস্তফা ও কুমুরডাঙ্গা দু-এর কাহিনীই আমাদের অভিভূত করে। কিন্তু এই উপন্যাস যে কাহিনীমাত্র নয় সূচনা থেকেই তা স্পষ্ট। এখানে ব্যক্তিগত ও সামুহিক মর্তুকাম বৃত্তির সূক্ষ্ণ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও দার্শনিক পরিপ্রেক্ষণ পদে পদে আমাদের ভাবায়, আমাদের ভোগবৃত্ত পঠনকে নানা প্রশ্নের দ্বারা উদ্দীপিত করে। কুমুরডাঙ্গা কি তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু পূর্ববাংলার প্রতীক, অথবা আধুনিক সভ্যতার মৃতু্যমুখিনতার, অথবা মানুষের আস্তিত্ত্বিক অর্থহীনতার? মনে হয় ওয়ালীউলস্নাহর চিঠিপত্র, ডায়েরি ইত্যাদি পাওয়া গেলে এই উপন্যাসটির নিগৃঢ়ার্থ স্পষ্টতর হতে পারে। ওয়ালীউলস্নাহর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা তিন। প্রম্নস্ত অথবা জীবনানন্দের মতো তিনিও হয়তো আরও উপন্যাসের খসড়া লিখে থাকতে পারেন; ভবিষ্যতে তা হয়তো আবিষ্কৃত হবে; কিন্তু তার স্ত্রী এ বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত করেননি। সংখ্যা মাত্র তিনটি হলেও প্রতিটি উপন্যাসই অনন্য, তাদের ভিতরে পুনরাবৃত্তির কোনো চিহ্ন নেই। বস্তুত প্রত্যেকটিতেই তিনি উপন্যাসের গঠনশৈলী নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। শুধু বিষয়বস্তুর নয়, প্রতিন্যাসের দিক থেকেও তার প্রতিটি স্বতন্ত্র। "লাল সালু"র নায়ক ধূর্ত এবং উদ্যোগী; সাধারণ স্ত্রী-পুরুষের ভয় এবং অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে; গ্রামবাসীর ধর্মবিশ্বাস তার ধাপ্পাবাজির অবলম্বন। অথচ অন্য সব মানুষকে বশে আনলেও নিজের অল্পবয়সি বউয়ের অসহযোগের মুখোমুখি হয়ে সে বিমূঢ় ও অপারগ। 'চাঁদের অমাবস্যা'র নায়ক দুর্বল, সন্ত্রস্ত, অনভিজ্ঞ, অসহায়; কিন্তু তার অনুভূতি সূক্ষ্ণ, তার কল্পনা সক্রিয়, তার বিবেক নিরত্যয়, নিরাকাঙ্ক্ষ, এবং সে কারণে শেষ পর্যন্ত ভয়কে অতিক্রম করে তা উলস্নম্ব। 'কাঁদো নদী কাঁদো'র প্রকৃতপক্ষে কোনো একজন নায়ক নেই। এটি তার সবচাইতে দীর্ঘ উপন্যাস এবং এটির কাহিনীবিন্যাস সবচাইতে অভিনব। এখানে দুটি পরস্পরে অনুসৃত ঘটনাপ্রবাহ একজন কথক এবং একজন শ্রোতার স্মৃতির মিশ্রণে ব্যাপ্তি ও রহস্যময়তা অর্জন করেছে। যাত্রীবাহী চলমান স্টিমারে বাকাল নদী, কুমুরডাঙ্গা এবং মুহাম্মদ মুস্তফার কাহিনী যে বলছে সে ঘটনাবলির দর্শক মাত্র। তার 'স্বভাব বেশ পরিপাটি ধরনের'; তার কোনো উচ্চাভিলাষ নেই। যে যাত্রীটি কথকের মুখে কাহিনীটির কিছু কিছু অংশ শুনে অতীতের নানা ঘটনা স্মরণ করছে এবং পরে আমাদের অর্থাৎ পাঠকদের সেই কাহিনী উপন্যাসের আকারে শোনাচ্ছে সেই 'আমি' ব্যক্তিটি মুহাম্মদ মুস্তফার চাচাত ভাই। সেও ছেলেবয়স থেকে 'মানুষের জীবনযাত্রা তাকিয়ে তাকিয়ে' দেখতে অভ্যস্ত; সাংসারিক কাজকর্মে 'নায়কনায়িকা অথবা কাহিনী' খোঁজায় তার আগ্রহ নেই। কিন্তু এই দুজনের পর্যবেক্ষণ এবং স্মৃতির টানাপড়েনে যে কাহিনী বোনা হয়েছে সেটি যেন একটি মিথ বা নিত্যকালীন ও রহস্যময় অতিকথা। মুহাম্মদ মুস্তফা 'ভাগ্যের নৌকায় একটি আরোহীর মতোই বোধ করে, যে নৌকা সে চালনা করে না, যার দিক-গতিপথ সে স্থির করে না'। লাজুক, ভীতু, শীর্ণ, অনুভূতিশীল মুস্তফার আত্মহত্যা আর মরণাপন্ন বাকাল নদীর কান্না-দুই মিলে 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসে একটি মহৎ আখ্যানের গুরুত্ব, গাম্ভীর্য ও গূঢ়তা সঞ্চারিত করেছে।