গুচ্ছগল্প

প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
নূূর কামরুন নাহারের 'গুচ্ছগল্প' প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে। গল্পগ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণ এখন বাজারে। এই গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো প্রথমবার অনেকদিন আগে পড়া হলেও বেশ কয়েকটি গল্প এখন পর্যন্ত মনে আছে। এর অর্থ হলো তার রচিত গল্প নিজগুণে একজন পাঠককে মনে রাখতে বাধ্য করেছে। নূর কামরুন নাহারের গল্পগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গল্পগুলোয় গল্প থাকে, গতিময় লেখা পড়তে শুরু করলে একটানে শেষ করা যায়। 'ফর্ম' এবং 'কন্টেন্ট' কোনোটা নিয়েই অকারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গল্পের সহজাত আকর্ষণকে ভারাক্রান্ত করেন না। ছোট ছোট বাক্যে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যান ফলে পাঠক দ্রম্নত তার গল্পের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন। 'সমবৃত্ত' গল্পের ভূমিকা পর্যায়ে সমাজের সমসাময়িক অবস্থা তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে : 'মানুষের কাছে টাকা এখন কলাপাতা। ঘরে ঘরে মানুষ বিদেশ গেছে। টাকা আসে। টাকায় বাড়িতে দালান ওঠে। পকেটে যাদের টাকা, তারা আর হাঁটে না, রিকশা দিয়ে চলাচল করে। বাছা জিনিসে রসনা মেটায়। চলে মেহমানদারি। বাজারে দুধ, মাছ, মাংস কেনা হয়। চাহিদা বাড়ে। ক্ষেতে ঘরে গতর খাটানোর মানুষ কই। মানুষ নাই, সব সাহেব।' পরিবেশ পরিস্থিতি বা মনোজগতের ভাবনা প্রকাশের ক্ষেত্রে অধিকাংশ বর্ণনায় ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করা হলেও নূরকামরুন নাহার যে দীর্ঘ বাক্য রচনায়ও যে সিদ্ধহস্ত, তার প্রমাণও ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন গল্পে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। 'শীতের পাখি' গল্পে একটি চরিত্রের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, 'আবদুল কাদির সাদাসিধা এবং নিরামিষ জীবন কাটালে এবং এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত থাকলেও পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য এবং ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গর্ব করেন এবং প্রায়শই এটার প্রকাশ ঘটান।' চারপাশের খুব সাধারণ এবং প্রতিদিনের পরিচিত বিষয় থেকে তিনি গল্প নির্মাণ করেন। প্রতিদিনের এসব দৃশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করি, দেখি এবং শুনি। এসব অকিঞ্চিতকর দৃশ্য হয়তো কারওই দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। নূর কামরুন নাহার সেই ছোট্ট বিষয়গুলো ধরতে পারেন এবং সেই মুহূর্তের দেখা থেকে অথবা প্রায় অশ্রম্নত একটি শব্দ থেকে তিনি গল্প নির্মাণ করেন। 'সময়ের সাহসী কবি' গল্পের 'নিলু মফস্বলের কবি। নওগাঁর মেয়ে। সবাই বলে নিলু খুব ভালো লেখে।' এই প্রতিশ্রম্নতিশীল মফস্বলের কবির সঙ্গে এক খ্যাতিমান কবির পরিচয় ঘটে এক সাহিত্য আসরে, সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে যেমনটা প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। সাধারণ এ ঘটনাকে নূর কামরুন্নাহার গল্পে রূপান্তরিত করেন, দৃশ্যটি নির্মাণ করেন এভাবে : 'কবির চোখ আটকে থাকে নিলুর বুকে। কবি নিলুর মুখোমুখি আর একটু ঝুঁকে এসে উন্নত বক্ষের প্রায় ছুঁইছুঁই দূরত্বে দাঁড়িয়ে কবিতার মতো বলেন- অবশ্যই পৌঁছাতে পারবেন। আর খ্যাতি সে তো সব বিসর্জন দিয়ে দিতে পারি যদি কখনো পৌঁছানো যায় আপনার ওই চূড়ার কাছে। যেমন হাফিজ প্রিয়ার একটি তিলের জন্য লিখে দিয়েছিল সমরখন্দ।' তবে পর মুহূর্তেই আকাঙ্ক্ষার সেই শিখর থেকে 'সময়ের সাহসী কবি'কে তিনি আছড়ে মাটিতে ফেলেই ক্ষান্ত হননি, একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। যথাযথ শব্দ প্রয়োগ করে অল্প কথায় চিত্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে নূর কামরুন নাহারের পরিমিতি বোধ অসাধারণ। প্রথমেই বলা যায় তিনি যে গল্প রচনা করেন সে গল্পের ভেতরে এক ধরনের রহস্যময়তা, একটি গতি ও আকর্ষণ সৃষ্টি করেন যা পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। যেমন 'দখিন হাওয়া' গল্পটি। এ গল্পে ইউরোপ থেকে ব্যবসায়ী মাহিন চৌধুরী দেশে এসে লন্ডন থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকায় নিয়মিত নারীবিষয়ক লেখালিখি করতে পারেন এমন একজনকে খোঁজ করছেন। গল্পের লেখিকা লীনার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। মাহিন চৌধুরী নামি ব্যয়বহুল হোটেলে উঠেছেন। লীনাকে লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানান। লেখিকা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন একটি নিভৃত হোটেল কক্ষে যাবেন কি না। লীনা, যখন আশঙ্কায় দ্বিধান্বিত, তখন পাঠক আশান্বিত হয়ে ওঠে। এবার নিশ্চয়ই হোটেলের কক্ষে কিছু একটা ঘটবে। লেখিকার সাথে এই আশা-আশঙ্কার দোলাচলে দুলতে দুলতে পাঠক হোটেলের নিভৃত নির্জন কক্ষে একাধিক দিন আসা-যাওয়া করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই ঘটে না। বরং ব্যবসায়ী ভদ্রলোক লীনাকে না জানিয়েই হোটেল ছেড়ে চলে যান। লন্ডনে ফিরে যাওয়ার আগে লীনার সাথে দেখা করে বলেন, 'আপনার সাথে যতই মিশতে লাগলাম, আপনার প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ অনুভব করতে থাকি। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, আপনাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়, আপনার হাসি, ওই প্রতিভাদীপ্ত অসাধারণ সরল চাহনি, আমার বুকের মধ্যে জ্বালা ধরিয়ে দিল। কিন্তু আপনার মধ্যে যে বিশালকে আমি দেখেছি আর আপনি এতো সুন্দর যে নিজেকেই আমার ভীষণ ভয় হতে থাকে। আপনার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে পবিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যে সুন্দর আমি ধারণ করেছি, তা টিকিয়ে রাখার জন্য আমি আপনার কাছ থেকে পালিয়ে যাই।' হোটেল থেকে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় লেখিকার ভাষ্য, 'আমি জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা একজন, আমার বাতায়নে দখিনা বাতাস যতই আছড়ে পড়ুক আমাকে দেখতে হবে রোদের তেজ, পাতাহীন বৃক্ষের সৌন্দর্য।' এই সংগ্রামী জীবনের ছবিই এই গল্পের মূল শক্তি। 'দখিন হাওয়া' গল্পে ঘটনা না ঘটলেও অন্য গল্পে কিছু ঘটে না, তা কিন্তু নয়। গুচ্ছগল্পের আরেকটি গল্প 'দূরত্ব'। এই গল্পে শুরুটাই এমনভাবে হয়েছে, যাকে লেখকদের লেখক লাওস এগরি তার 'আর্ট অফ ড্রামাটিক রাইটিং' গ্রন্থে বলেছেন 'পয়েন্ট অফ অ্যাটাক' বা শুরুতেই পাঠককে বড়শিতে গেঁথে ফেলা। 'দূরত্ব' গল্পে সে রকম এক ঘটনা এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় ঘটে। এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বৃষ্টির রাতে স্ত্রীর ছোট বেলার বান্ধবী রেবেকাকে মিরপুর থেকে তার পুরনো ঢাকার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার খুব সাদামাটা কাহিনী নিয়ে তৈরি গল্পে পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গল্পকার রচনা শৈলী ও সৃষ্টিশীলতার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মনস্তত্ত্বের ছাপ রেখে যায়। গল্পটিতে রয়েছে দুজন নারী-পুরুষের নৈকট্য এবং প্রাকৃতিকভাবে অনুকূল একটি সন্ধ্যা, এই গল্পের চমৎকারিত্ব বোঝা যাবে 'দূরত্ব' থেকে খানিকটা তুলে দেওয়া হলে 'রেবেকার বেডরুমে বড় একটা ছবি। রেবেকার প্রথম যৌবনের। আমি ছবিটা দেখছিলাম। সাদা-কালো, মায়াবী। রেবেকা পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল- ছবিটা ভালো লাগছে? আমি ফিরে তাকিয়েছিলাম। রেবেকার মুখে একেবারে প্রথম যৌবনের উচ্ছলতা, দু-চোখে কিশোরীর মতো চঞ্চল জিজ্ঞাসা। না তখনও কোনো আহ্বান ছিল না। তারপর আমাদের হঠাৎ কি হয়েছিল। আমরা কেউ তা জানি না। সেই সন্ধ্যায় রেবেকার সাথে আমার হয়েছিল। হতেই পারে। এ আর এমন কি। এমন নয়, যে আমি স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারী স্পর্শ করিনি। আমার এমন বহু হয়েছে। এটাকে আমি বিশ্বস্ততার মানদন্ড ভাবি না। হতেই পারে। দুজনেরই ইচ্ছে থাকলে হতেই পারে। ...' '...আসলে ওই সন্ধ্যায় কি হয়েছিল আমরা জানি না। আমরা কেউ ভাবিনি। কেউ সামান্য ইশারাও করিনি। শুধু বৃষ্টি হচ্ছিল। জানালার খুব পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সন্ধ্যা।' নূর কামরুন নাহারের গল্পের আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার গল্পের চিত্রকল্প বা ছবি। বাংলা কথাসাহিত্যে চিত্রকল্পের প্রসঙ্গে প্রথমেই যে নামটি আসে সেটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যে কোনো দৃশ্য চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো চোখের সামনে তুলে ধরতে এখন পর্যন্ত তার সমকক্ষ কাউকেই আমরা খুঁজে পাই না। পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে বাংলাদেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দীর্ঘ বাক্যে ও বর্ণনায় এবং জহির রায়হান তার ছোট ছোট কথায় ও সংলাপে চমৎকার সব চিত্রকল্প রচনা করেছেন। কামরুন কিভাবে অতি সহজেই তার গল্পে এক একটি দৃশ্যের ছবি ফুটিয়ে তোলেন, তা আমার কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। যেমন 'জীবন কখনো কাশফুল' গল্পটি। একটি সাধারণ গলি- যে গলিতে বসবাস করেন এক দম্পতি ও তাদের দুটি সন্তান। গল্পটিতে শুধু বিবরণ পাঠ করি না, দৃশ্যগুলো দেখতে পাই। লেখকের লেখা পড়ে দৃশ্যগুলো দেখতে পাওয়া এবং চারপাশের শব্দ শুনতে পারা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। একটি চিত্রকল্প যখন পাঠকের চোখের সামনে ছবির মতো ভাসতে থাকে, তখন লেখকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং একই সাথে গভীর অনুভবের ভেতর দিয়ে দৃশ্য ও শব্দ নিজের ভেতরে ধারণ করে তা লেখার অক্ষরে উপস্থাপনের শক্তিটি বোঝা যায়। 'জীবন কখনো কাশফুল' গল্পের শুরুতেই যে দৃশ্য আমরা দেখি, তা এই রকম, 'একটা ল্যাম্পপোস্ট। রংহীন পস্নাস্টার করা দেয়াল। শেওলা ধরা। তার ওপর সাদা চক দিয়ে লেখা - এখানে ময়লা ফেলবেন না- নিচে স্তূপ করা আবর্জনা। তরকারির খোসা, মাছের কাঁটা, মুরগির নাড়িভুঁড়ি, রক্তমাখা স্যানেটারি ন্যাপকিন, মালটার খোসা। তিন হাত দূরে নকল রাজার মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছে লাল ইটের দোতলা বাড়ি। ব্রাউন কালার গেট। দেয়ালে কম্পিউটারে টাইপ করে শাটানো কাগজ, -যে ময়লা ফেলে সে কুকুর- লেখার নিচে দেয়াল ঘেঁষে পস্নাস্টিকের ভাঙা কন্টেইনার, জুতার ছেঁড়া পাটি, ক্ষয়ে যাওয়া পাপস, ছেঁড়া ব্রা। গলির বাতাসে উড়ন্ত কাগজ, পলিথিনের ব্যাগ আর ভ্যাপসাটে গন্ধ।' এ ধরনের নোংরা আবর্জনার স্তূপ থেকে একটি গল্পের সূচনায় পাঠকের অস্বস্তির হতে পারে। শুধু দৃশ্য নয় পুঁতিগন্ধময় এই ময়লার ঢিঁবি থেকে যে দুর্গন্ধ উৎসরিত হয় তাও পাঠকের নাকে এসে লাগে। প্রকৃতপক্ষে দৃশ্য-শব্দ-গন্ধ মিলিয়ে যে জীবন শেষ পর্যন্ত একটি পরিপূর্ণ জীবনের রূপ লাভ করে এবং গল্পটি শেষ হয় একটি আশাবাদ ব্যক্ত করে। 'অন্ধকারে কাশফুলগুলো চেয়ে থাকে। আমাদের রিকশর মুখোমুখি টুংটুং ঘণ্টা বাজিয়ে একটা আইসক্রিমের গাড়ি আসে। ব্রেক কষে রিকশাটা ঝাঁকি খায়। আমার ভারসাম্যহীন দেহ হাবিবের বুকের কাছে চলে আসে। হাবিব আমাকে শক্ত করে ধরে, বলে- মিনু একটা আইসক্রিম খাবে? জীবন শুধু গলির না, কখনো কাশফুলের।' রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছেন, তেমনি ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, নিতান্ত সহজ-সরল দুঃখ ব্যথা নূর কামরুন নাহার তার গল্পে তুলে এনেছেন। অধিকাংশ গল্পেই কোনো তত্ত্বকথা বা উপদেশ নেই এবং ঘটনার ঘনঘটাও তার গল্পে লক্ষ্য করা যায় না। স্বভাবতই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্পের সংজ্ঞা তিনি যথার্থই আত্মস্থ করেছেন। - ফরিদুর রহমান