স্বাধীনতা ও কবিতার দায়বদ্ধতা

প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

আব্দুর রহমান
স্বাধীনতার স্বাদটা পৃথিবী জুড়ে সবাই আদিকাল থেকেই গ্রহণ করার চেষ্টায় ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাইতো কবিতার সেই লাইনগুলো আজ বড্ড বেশি মনে পড়ে যায়, 'স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, \হকে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, \হকে পরিবে পায়।' (কবিতা-স্বাধীনতা হীনতায়, কবি- রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়)। এই কারণেই এত এত যুদ্ধবিগ্রহ এবং হানাহানি। সেই বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে বাঙালি কবিরাও স্বাধীনতার জন্য কবিতা লিখে গেছেন। যা শুরু হয়েছিল মূলত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হতে ফেরত আসা বাইশ বছরের যুবক কবি নজরুল ১৯২১ সালে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের এক রাতে রচনা করেন বিদ্রোহী কবিতাটি। 'বল বীর- বল উন্নত মমশীর!' (কবিতা-বিদ্রোহী, কাব্যগ্রন্থ-অগ্নিবীণা)। যেখানে তিনি সব বাঙালিকে জেগে ওঠার আহ্বান জানান। পাশাপাশি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের কবিরাও বাঙালি জাতির স্বাধীনতার দাবিতে কবিতা লিখতে থাকেন। এভাবেই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশ ভাগাভাগি হয়। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় ভাষার জন্যও বাঙালি জাতিকে পুনরায় ১৯৫২ সালে আপন ভাইদের কাছে প্রাণ দিতে হয়। তখনই এই জাতি বুঝতে পেরেছিল তাদের আবারও স্বাধীন হতে হবে। আর সেখানেই নতুন করে স্বাধীনতা লাভে প্রকৃতভাবে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন ষাটের দশকের কবিরাও। তাদের মধ্যে ছিলেন কবি শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামছুল হক প্রমুখ। এভাবেই দীর্ঘ পরাধীনতার যন্ত্রণা থেকে অবশেষে বাংলাদেশ মুক্তিপায় একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। যেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে কবিতার রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। কবিতা যদিও কোনো অস্ত্র নয়। তবে কবিতা কিন্তু অস্ত্রের চাইতেও অনেক ধারালো। 'যেমন : একটি অস্ত্র দিয়ে একই সময়ে মাত্র একজন যোদ্ধা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু একটি কবিতা পারে মানুষের মনকে পরিবর্তন করতে এবং হাজার হাজার যোদ্ধার ঘুম ভাঙাতে। যার রেশটা বা দাপটটা রয়ে যায় অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। কবিতার অবদান যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অপূরণীয় তেমন যুদ্ধের পরেও স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রেও এর অবদান অতুলনীয়। কে না জানে মহামূল্যবান সেই কথাটি, স্বাধীনতা অর্জনের চাইতে রক্ষা করা কঠিন। তাই লাখো বাঙালির রক্তর বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা রক্ষায় কবিতার গুরুত্ব নিয়ে কিছু আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে গল্প, কবিতা, উপন্যাস- এই পর্যন্ত অনেক কিছুই লেখা হয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচাইতে বেশি রচিত হয়েছে কবিতা। এসব কবিতাগুলো মানুষকে অনুপ্রেরণার মশাল হাতে নিয়ে সংগ্রামে নামতে যেমন বাধ্য করেছে, তেমন স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রেও এখনো পর্যন্ত উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। এক্ষেত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামের দুয়েকটি কবিতার শিরোনাম না বললেই নয়। আর সেটা বললেই বলতে হয় স্বাধীনতার কবি শামসুর রহমানের কথা। যিনি ১৯৭১ সালের এপ্রিলের দুপুরবেলা দেশের সংগ্রামের মূহূর্তে চারিদিকের ভয়াবহতা দেখে লিখেন, 'স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাদ সাতার।' (কবিতা-স্বাধীনতা তুমি, কাব্যগ্রন্থ-বন্দি জীবন থেকে) \হ'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়।' (কবিতা- তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, কাব্যগ্রন্থ-বন্দি শিবির থেকে)। স্বাধীনতা সংগ্রামের লেখা কবির এই দুটি বিখ্যাত কবিতা আজও অমর হয়ে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে এ কথা বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতা অমর হোক এটাতো সব শহীদের দাবি। জাতি হিসেবে এ দায়িত্বভার আমাদেরই গ্রহণ করতেই হবে। সঙ্গত কারণেই কবি নির্মলেন্দু গুন বলেন, 'জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উলঙ্গ শিশুর মতো বেরিয়ে এসেছো পথে স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও।' (সংগ্রহ : কবিতা-স্বাধীনতার উলঙ্গ কিশোর,)। এভাবেই একাধিক গুনি কবিরা স্ব স্ব দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন অসংখ্যা স্বাধীনতাভিত্তিক কবিতা। তবে সবার কথার সারমর্ম আবার একটাই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। সেই প্রসঙ্গেই বলতে হয় বর্তমান প্রজন্মের কবিদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে কিছু কথা। কারণ বর্তমান প্রজন্মকে এসব কবিতাগুলো পাঠ করতে হবে এবং পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে গল্প, উপন্যাস বা ইতিহাস পাঠ করে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর তার ভিত্তিতেই স্বাধীনতার যুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উপহার দিতে হবে অসাধারণ কিছু কবিতা। তবে এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে হয়, বেশ কয়েকজন গুনি কবি এবং লেখক মনে আক্ষেপ নিয়েই বলেছেন, বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক ভালো উপন্যাস বা গবেষণা গ্রন্থের শূন্যতা সম্পর্কে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তলস্তয় লিখেছেন বিশ্ববিখ্যাত 'ওয়ার এন্ড পিস' এবং আর্নেস্ট হেমিং ওয়ে লিখেছেন 'এ ফেয়ার ওয়েল টু দি আর্মস।' তবে বাংলা সাহিত্যে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে যে দুয়েকটি উপন্যাস রচিত হয়েছে এর বাইরেও আরও কিছু কালজয়ী গ্রন্থের আশা ব্যক্ত করেছেন তারা। পাশাপাশি এটাও আশা করছেন হয়তো, এই কবিতা, গল্পে, প্রবন্ধের তথ্যগুলোর ওপরে নির্ভর করেই ভবিষ্যতে কারও কলমের কারিশমায় বেরিয়ে আসবে, স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক কোনো বিখ্যাত উপন্যাস বা গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থ। সেই দায়িত্বটা নিতে হবে বর্তমান প্রজন্মকেই। তাই লিখে যেতে হবে স্বাধীনতাভিত্তিক কালজয়ী কিছু কবিতা। এর জন্যই হয়তো কবি হেলাল হাফিজ অনেক আগেই বলে রেখেছেন, 'এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।' (কবিতা- নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, হেলাল হাফিজ)। আবার কবিতা সম্পর্কে বাংলা একাডেমির বর্তমান সন্মানিত মহাপরিচালক মুহম্মদ নুরুল হুদা বলেন, 'বোধের সম্প্রসারণের নাম কবিতা। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের ঈপ্সিত মান অর্জনে জন্য বোধের সচেতন সম্প্রসারণই জরুরি মনে করেন তিনি।' (সংগ্রহ : গোগল)। উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, দেখতে দেখতে স্বাধীনতা যুদ্ধের বায়ান্নটি বছর পার হয়েছে। বায়ান্ন বছরের স্বাধীন ভূখন্ডে যত ঘটনাই ঘটে থাকুক। সবাইকে মনের মধ্যে থেকে ঝেরে মুছে একাত্তর/ স্বাধীনতা যুদ্ধটাকে বুকে ধারণ করতে হবে এবং স্বাধীনতাকে রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে। আরও মনে রাখতে এই স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সালে কাগজে কলমে এলেও এলোনা সেটা বাস্তবে। আর বাস্তবে স্বাধীনতা এলো আরও অনেক অনেক প্রাণের বিনিময়ে একাত্তরে। তাই প্রাণের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য স্বাধীনতাভিত্তিক কবিতা পাঠ করতে হবে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী লিখার চেষ্টা করতে হবে। দূর করতে হবে এ দেশ থেকে সব ধরনের দুঃখ-দুর্দশা এবং মনে রাখতে হবে শহীদদের কাছে আমাদের দেওয়া প্রতিজ্ঞার কথাটা। যা সব সময় মনে করিয়ে দিয়েছেন কবি হেলাল হাফিজ, 'কথা ছিল একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখবোনা বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।' (সংগ্রহ : একটি পতাকা পেলে- হেলাল হাফিজ)।