ছোটদের বড় নজরুল

প্রকাশ | ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০

সাগর জামান
বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী আমাদের দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ছোটদের অনেক বড় ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। তিনি ছোটদের খুব ভালোবাসতেন। নজরুলকেও শিশুরা নিখাঁদ অকৃত্রিম ভালোবাসায় আপস্নম্নত করত। শিশুদের মধ্যে নজরুল অপার সম্ভাবনা দেখতে পেতেন। ছোটদের দেখলে নজরুল ছুটে যেতেন, অবিচ্ছেদ্য মমতার সম্পর্কে বেঁধে ফেলতেন। শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন সহমর্মী ও সংবেদনশীল। মাত্র আট বছর বয়সে নজরুল পিতৃহারা হয়েছিলেন। তছনছ হয়েছিল তার শৈশব। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাকে। তার জীবনে নেমে এসেছিল দুঃসহ দুঃখ-দুর্দশা। তবু তিনি হেরে যাননি, দমে যাননি। বরং জয় করে নিয়েছেন তার সমস্ত প্রতিকূলতাকে। জীবন যুদ্ধে অপরাহত থেকেছেন তিনি। তিনি শিশুদের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলে তার হারানো শৈশবকে খুঁজে ফিরতেন। ছোটদের নিয়ে হইচই করতেন, গান শোনাতেন। শিশুতোষ ছড়া, কবিতা আবৃত্তি করতেন। আবার কারও কারও কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি শিশুদের মধ্যে মিশে যেতেন। নিজেকে আবিষ্কার করতেন। কাজী নজরুল যেমন বিদ্রোহী কবির অভিধা নিয়ে দ্রোহের কবিতা লিখেছেন, শেকল ভাঙার গান গেয়েছেন, তেমনি তার লেখনিতে উঠে এসেছে শিশু মনের নানা ভাবনা। নজরুল তার ছন্দের জাদু দিয়ে ছোটদের মনে নানা ভাব জাগিয়ে তুলতেন। তাদের সম্ভাবনা উসকে দিতেন। ছোটদের সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখাতেন। নজরুল শিশু মনের নির্মল অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করতেন। নজরুলের শিশুতোষ লেখাগুলো নিছক কল্পনাপ্রসূত নয়। তিনি ছোটদের নিয়ে যেসব রচনা করেছেন সবকিছুর মধ্যে আলাদা আলাদা কাহিনী সূত্র কাজ করেছে। উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে; কাঠবিড়ালী, কাঠবিড়ালী পেয়ারা তুমি খাও? গুড় মুড়ি খাও, দুধ ভাত খাও? বাতাবি লেবু, লাউ? বেড়াল বাচ্চা কুকুর ছানা তাও? নজরুলের খুকি ও কাঠবিড়ালী শীর্ষক এই ছড়ার পেছনে রয়েছে এক মজার কাহিনী। নজরুল বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। তিনি যেখানেই যেতেন শিশুদের সাথে তার সখ্য গড়ে উঠত। ১৯২১ সালে তিনি কুমিলস্নায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। তিনি উঠেছিলেন ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। অঞ্জলি নামে ইন্দ্রবাবুর একটি ফুটফুটে মেয়ে ছিল। নজরুলের ক্ষুদে বন্ধুদের তালিকায় এই মেয়েটিও স্থান করে নিয়েছিল। নজরুল একদিন দেখলেন এই মেয়েটি একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে উপরে তাকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। নজরুল কাছে গিয়ে দেখলেন মেয়েটি একটি কাঠবিড়ালীর সঙ্গে কথা বলছে। তিনি অবুঝ মেয়েটির সারল্য দেখে বিমুগ্ধ হলেন। তিনি লিখলেন, খুকি ও কাঠবিড়ালী কবিতাটি। নজরুল বিচিত্র অভিজ্ঞতার সন্ধানে হয়তো ভ্রমণ করতেন, ঘুরে বেড়াতেন একস্থান থেকে অন্যস্থানে। ভারতের দেওঘর নামে একটি জায়গা আছে। অনাবিল আবহাওয়ার এই জায়গাতে নজরুল কিছুদিন ছিলেন। নজরুল এখানে যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির ওপরতলায় একটি চঞ্চল মেয়ে থাকত। কিছুদিনের মধ্যে মেয়েটির সঙ্গে নজরুলের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নজরুল মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, গান শোনাতেন, কবিতা শোনাতেন। তিনি দেওঘর থেকে চলে আসার পর একটি চিঠি পেলেন। চিঠিতে নজরুলকে সেই মেয়েটির জন্মদিনে আসার কথা বিশেষভাবে উলেস্নখ করা ছিল। নজরুল মেয়েটির জন্মদিনে উপহারস্বরূপ লিখলেন; নামহারা তুই পথিক শিশু এলি অচিন দেশ পারায়ে কোন নামে আজ পরলি কাকন বাঁধনহারা কোন কারা এ। নজরুল তার সিদ্ধহস্তে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন। নজরুলের শিশুতোষ ছড়ার মধ্যে বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য পিলেপটকা, খাদু দাদু, লিচু চোর, মটকু মাইতি, খুকি ও কাঠবিড়ালী প্রভৃতি। নজরুলের সঙ্গে আলী আকবর নামে এক ভদ্রলোকের পরিচয় হয়েছিল। ভদ্রলোকটি শিশুদের পাঠ্যবই লিখতেন। একদিন শিশুদের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তির জন্য আলী আকবর সাহেব কবিতা লিখে নজরুলকে দেখিয়ে ছিলেন। নজরুলের কাছে লেখাটা যথাযথ মানের মনে হয়নি বলে নজরুল ভদ্রলোককে বলেছিলেন। তখন আকবর আলী সাহেব নজরুলকে লিখতে বলেছিলেন একটি কবিতা। তখন নজরুল লিখলেন; বাবুদের তাল পুকুরে হাবুদের ডাল কুকুরে সেকি ব্যস করল তাড়া বলি থাম একটু দাঁড়া। নজরুলের শিশুতোষ রচনার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। তিনি কোমলমতি শিশুদের মধ্যে অমিত সম্ভাবনার শক্তি দেখতে পেতেন। তিনি শিশুদের অন্তর্গত অগ্নিময় শক্তির স্ফুরণ তার শিশুতোষ রচনায় ঘটাতেন। তিনি ছোটদের দুর্বল ভাবতেন না। তিনি শিশুদের শক্তিময় হওয়ার, জ্বলে ওঠার উৎসাহ জোগাতেন। নজরুল ছোটদের সম্ভাবনাকে প্রজ্বলিত করার বাণী উচ্চারণ করেছেন; তুমি নও শিশু দুর্বল, তুমি মহৎ মহীয়ান জাগো দুর্বার, বিপুল বিরাট অমৃতে সন্তান। সাহিত্যের এই মহান কারিগর কাজী নজরুল ইসলাম তার অগ্নিঝলসিত রচনার মাধ্যমে দোর্দন্ড প্রতাপের সঙ্গে যেমন শাসন করেছেন, অণ্যাচারীদের তেমনি তার শিশুতোষ সৃষ্টি কুশলতা দিয়ে তিনি জয় করে নিয়েছেন শিশুদের কোমল মনোজগৎকে। নজরুল অবশ্যই সর্বজনবিদিত সাহিত্যের বরপুত্র। একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। নজরুলের সৃষ্টি আমাদের শিশুদের অসাম্প্রদায়িক হতে শেখাবে। তার রচনা সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ অক্ষুণ্ন রাখার, সমাজের বিভাজন দূর করার চেতনাকে প্রজ্বলিত করবে এমনটাই প্রত্যাশা করি। নজরুলের যাপিত জীবন ও তার আদর্শ থেকে আমাদের শিশুদের শিক্ষা দেওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে।