এবারের বুকার পেলেন বুলগেরীয় জর্জি গোস্পোদিনভ আতাতুর্ক

প্রকাশ | ০২ জুন ২০২৩, ০০:০০

কামাল পাশা
২০২৩ সালের বুকার পুরস্কার পেলেন জর্জি গোস্পোদিনভ। ১৯৬৯ সাল থেকে দেওয়া বুকার পুরস্কারের ইতিহাসে এ-ই প্রথম একজন বুলগেরীয়কে দেওয়া হলো এ পুরস্কার। বুলগেরীয় বিবিধচারী এ লেখক তার ঞরসব ঝযবষঃবৎ উপন্যাসের জন্য এবার বুকার পুরস্কার পেলেন। দাবি করা হচ্ছে তার বই ও বিভিন্ন লেখাগুলো বিশ্বের ২৫টিরও বেশি ভাষায় প্রকাশ হচ্ছে। অ্যাঞ্জেলা রডেল এই টাইম শেল্টার বইটি অনুবাদ করেছেন ইংরেজিতে এবং বুকার পুরস্কারের ৫০ হাজার পাউন্ডের অর্ধেক পাবেন তিনি ও বাকি অর্ধেক পাবেন লেখক জর্জি গোস্পোদিনভ। জর্জি গোস্পোদিনভ বুলগেরিয়ার ইয়াম্বলে ১৯৬৮ সালের ৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। এশিয়া, ইউরোপ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে কমিউনিজমের পতনের পর এই বুলগেরীয় লেখকের বই সবচেয়ে বেশি অনূদিত ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছে। তার উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য এবং গ্র্যাফিক নভেল তাকে ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। পুরস্কার দিতে গিয়ে বিচারকমন্ডলী বলেন, জাতীয়তা, পরিচয়, বার্ধক্য সম্পর্কিত এবং স্মৃতির নিরাময় ও ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলোকে নিয়ে একটি বিস্তৃত, চিন্তা-উদ্দীপক, বিভীষিকাময় হাস্যরসাত্মক উপন্যাস এই ঞরসব ঝযবষঃবৎ বা (সময়াশ্রিত) টাইম শেল্টার উপন্যাস। বিচারকদের সভাপতি লেইলা স্স্নিমানি মন্তব্য করেন, 'বিরম্বনা ও বিষণ্নতায় ভরা এই উজ্জ্বল উপন্যাস' বর্ণনা করেছে এবং যোগ করেছে, 'একটি গভীর কাজ যেখানে একটি সমসাময়িক প্রশ্ন এবং একটি দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে কাজ করে, আমাদের স্মৃতিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলে আমাদের কী পরিণাম হয়।' তবে জর্জি গোস্পোদিনভের এই তৃতীয় উপন্যাসটি বুকার পাওয়ার আগে গতবছর ইতালি সংস্করণের জন্য ইউরোপের মর্যাদাপূর্ণ প্রেমিও স্ট্রেগা (চৎবসরড় ঝঃৎবমধ ঊঁৎড়ঢ়বড়/ ঊঁৎড়ঢ়বধহ ডরঃপয চৎরুব) অর্জন করে। তার আগেও জর্জি গোস্পোদিনভের গ্রাফিক নভেল দ্য এটারনাল ফ্লাই (ঞযব ঊঃবৎহধষ ঋষু) ছিল প্রথম বুলগেরীয় গ্র্যাফিক লেখা এবং তার ছোট গল্প 'বস্নাইন্ড ভাইশা' (ইষরহফ ঠধুংযধ) একটি ছোট অ্যানিমেশন ফিল্মে রূপান্তরিত হয়েছিল যা ২০১৭ সালে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়। এ উপন্যাসটি লেখার অনুপ্রেরণা তিনি কোথা থেকে পান, এ প্রশ্নে এক সাক্ষাৎকারে লেখক বলেন, 'এই বইটি লেখার জন্য আমার তাগিদ এসেছিল এই অনুভূতি থেকে যে সময়ের ঘড়ির কাঁটাতে কিছু ভুল থেকে গেছে। বাতাসে ঝুলে থাকা দুশ্চিন্তার ঘ্রাণ তুমি ধরতে পার, আঙুল দিয়ে ছুঁতে পার। পপুলিজিমের আধিপত্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপে 'মহান অতীতের' তাস খেলার সঙ্গে বিশ্বেও বিচ্ছিন্নতা আমাকে উসকে দিয়েছে। বেক্সিট ছিল অন্য ট্রিগার। আমি এমন একটি সিস্টেম থেকে এসেছি যা কমিউনিজমের অধীনে একটি 'উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ' বিক্রি করেছে। আমি আমার নিজের ত্বকের মাধ্যমে জানি যে, উভয় চেক বাউন্স যা কোনো কিছুই দিয়ে সমর্থিত হয় না। সে কারণেই আমি ইউরোপের প্রতিটি দেশ কর্তৃক পরিচালিত 'অতীতের ওপর গণভোট' সম্পর্কে এই গল্পটি বলতে চেয়েছিলাম। অর্থ এবং ভবিষ্যতের ঘাটতি নিয়ে কীভাবে জীবনযাপন করা যায়? অতীতের মহামারি যখন আমাদের গ্রাস করে তখন আমরা কী করব? উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে অতীত আমাদের বর্তমান জীবনে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকে আবারও কার্যকর করার জন্য সৈন্য এবং ট্যাংকগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে প্রতিবেশী দেশের ভূখন্ডে আক্রমণ করে।' মানুষের স্মৃতিশক্তি দ্রম্নত লোপ পায়, এই ধারণা লেখকের মাথায় আসে ১৫ বছর আগে। তা নিয়ে লেখক ছয়-সাত বছর অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্ক লাইব্রেরির কুলম্যান সেন্টারে তার উপন্যাসের গাওস্টিন চরিত্র তৈরি করতে থাকেন। উপন্যাসটি লিখে শেষ করতে তার তিন বছর সময় লাগে। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখবার পরও মানুষ এসব খুব অল্প সময়ে ভুলে যায় আলঝেইমার অসুখের কারণে। পরে তারা আবার প্রতিবেশী দেশগুলোতে মারণাস্ত্র ছুঁড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কমিউনিজম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে মানুষ বেরিয়ে এলেও এর একটি সুস্থ ধারাবাহিকতা ভুলতে থাকে মানুষ এক ধরনের আলঝেইমারের কারণে। মানুষের মাঝে এক ধরনের সভ্যতা ও সংস্কৃতিহীন উলস্নাস প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং তা বড় হয়ে উঠতে থাকে। এ নিয়েই বর্তমান সময়ের কাছে আশ্রিত গাওস্টিন চরিত্র। লেখক এখানে বলছেন, গাওস্টিনকে তিনি আলঝেইমার রোগের গৃহে ঢুকিয়েছেন এবং ঢোকার সময় ঘরের দরজাটি একটু খোলা রেখেছেন। সেখানে কিছুক্ষণ রেখে তাকে আবারও বের করে নিয়ে এসেছেন। গল্প বা উপন্যাসটিতে পরিশেষে চরিত্রটি আলঝেইমারে আক্রান্ত হয়ে তার অতীত ভুলে যায়। উপন্যাসটি লিখতে লেখককে ইংরেজ কবি টমাস মান, মার্সেল প্রম্নস্ত, উইস্টান হেগ অডেনকে এবং আরও কিছু লেখককে পড়তে হয়েছে; বিশেষ করে অডেনের কবিতা সেপ্টেম্বর ১, ১৯৩৯ একটি প্রধান চালিকাশক্তির প্রভাব ফেলেছে। কারণ উপন্যাসটি এক ধরনের ম্যাজিক মাউন্টেন বা জাদু বাস্তবতা হিসেবে সামনে চলে আসে। উপন্যাসটিতে কখনো কখনো গানের আবহ চলে এসেছে। কারণ লেখক বলছেন, গান আমাদের স্মৃতিশক্তিকে খুলে দেয়। এ কারণে হোটেল কালিফর্নিয়ার ঈগলের গানগুলো, বিটলস্‌-এ ম্যাগী গানগুলো, আলাবামার গানগুলো অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে এই বইয়ে। মূলত অনেক গবেষণা আর দীর্ঘসময়ের চিন্তা-ভাবনার পর উপন্যাসটি তিনি শেষ করতে পেরেছেন। উপন্যাসটিতে বুলগেরীয়দের কাব্যপ্রীতি, গল্প বলার নিজের ধরন, গীতিকবিতার আবহ স্থান পেয়েছে। পরিশেষে গাওস্টিন এক স্মৃতি বিস্মৃতির বলয়ে চলে যায়।