আল মাহমুদের গল্পের বিষয় ও বাস্তবতা

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

আশরাফ উদ্‌দীন আহ্‌মদ
আধুনিক ছোটগল্পের বয়স একশো বছর পার হয়ে গেছে, আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের হাতেই ছোটগল্প পূর্ণতা লাভ করেছে, যার কারণে রবীন্দ্রনাথই ছোটগল্পের প্রকৃত জনয়িতা। পরবর্তী সময়ে বাংলাসাহিত্যের এই শাখায় অনেকেই এসেছেন এবং পরিপূর্ণতা দিয়েছেন, বিশেষ করে তারা-মানিক-বিভূতি বাংলাসাহিত্যকে ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছেন, একজন নারীকে যতখানি অলংকার পরালে তাকে মোহনীয় লাগে, ঠিক ততখানি হয়তো আরও বেশি বাংলাসাহিত্যকে দিয়েছেন, আজ বাংলাসাহিত্য একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, বাংলা ছোটগল্প শাখাটিতে দীর্ঘসময় ধরে যারা রাজত্ব করেছেন, তাদের মধ্যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় তো আছেন, তারপর সমরেশ বসু-জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী-সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ-অচিন্ত্যকুমার-গোলাম কুদ্দুস-নরেন্দ্রনাথ-আবদুল জব্বার-বুদ্ধদেব বসু-প্রেমেন্দ্র মিত্র-অমিয়ভূষণ এবং জীবনানন্দ দাশকে মাথায় রেখেই বলতে হয় এই শাখাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন এরাই। তারপর রমাপদ চৌধুরী-শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা সন্তোষকুমার ঘোষের মতোই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ যেভাবে এসেছেন, তেমনি আবু জাফর শামসুদ্দীন-শওকত ওসমান-আলাউদ্দীন আল আজাদ-আবু রুশদ্‌-শহীদ আখন্দ-শওকত আলী বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-আবদুল মান্নান সৈয়দ-রশীদ করীম বা মাহমুদুল হক-হাসান আজিজুল হক গল্পসাহিত্যেটিকে আরও গতিশীল করেছেন, এবং তাদের সঙ্গে একই পথের পথিক হয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে এসেছেন আল মাহমুদ (১৯৩৬) তারপর অনেক পথ হেঁটে অনেক সাগর পাড়ি দিয়ে আজ একটা স্থানে এসে পৌঁছেছেন, মূলত বাংলাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা কবি তিনি, আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশ দশকীয় ভাবধারার ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট-নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনাচাঞ্চল্য ও নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করে আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোয় অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মধ্যে নতুন পুলক সৃষ্টি করেন, জীবনভর অত্যন্ত সংগ্রামী মানুষ, আজীবন সাংবাদিকতা পেশায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। কবিতা-গল্পের পাশাপাশি লিখেছেন 'উপমহাদেশ' 'কাবিলের বোনে'র মতো অজস্র উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন দুই হাতে, পেয়েছেন দেশের সব সম্মানিত পুরস্কার। 'পানকৌড়ির রক্ত' 'সৌরভের কাছে পরাজিত' 'গন্ধবণিক' 'ময়ূরীর মুখ' 'সপ্তর্ষী' প্রভৃতি গল্পসংকলনের রচয়িতা। তার গল্প বলার স্টাইল ভিন্ন রকম, ভিন্ন আঙ্গিকে গল্পের পটভূমি নির্মাণ করেন, সেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় অন্য আরেক আল মাহমুদকে, তারপরও পাঠক হারিয়ে ফেলে, কারণ 'সোনালী কাবিন'-এর কবি কবিতাদ্বারা এতখানিই আবিষ্ট যে তাকে কবিতায় দেখতে চায় কথাসাহিত্যে নয়। কিন্তু কবি যে হস্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তাই তার রচনাসমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনকে। তিনি বাংলার আবহমানকালের স্মৃতি-ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন, লালন করেছেন তার সব সৃষ্টিসম্ভার, আল মাহমুদ বাঙালি এবং বাংলার কবি, দেশজ এবং লোকজ কাহিনীমালা তার সৃষ্টিসম্ভারে বিদ্যমান, তাই তিনি বাঙালির কাছের মানুষ, মনের মানুষ, সৃষ্টি-সুখে উলস্নাসে ভরা কবি তার রচনাসমগ্র দিয়ে ভরিয়ে তুলেছেন বাংলাসাহিত্যের আঙিনা। মানুষ যেমন সৌরভের কাছে পরাজিক তেমনি জৈবিকতার কাছেও মাথা অবনত করে, ফ্রয়োডীয় তত্ত্ব সে কথায় বলে, একজন পৌঢ় রাসু নিজেকে সংবরণ করতে পারেনি, কামনার কাছে আবদ্ধ হয়েছে, হয়তো এটাই স্বাভাবিকতা, জীবনধারা প্রবাহিত হয় কোনো নিয়ম-নীতি মেনে নয়, কিছু অসঙ্গতি সেখানে থাকেই, উদ্দাম বেগ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় শেষাবধি তা কে বা বলতে পারে। কারণ জীবন চলমান নদীর মতো, নদী যেমন কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে না, সে শুধু চলতেই জানে পায়ে তার মহাবিশ্বে চাকা, তাই স্রোতরাশির সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে যায়, জীবনও তেমনি একটা লাটাই ছাড়া ঘুড়ি, কখনো কারও বশে থাকে না, কবি আল মাহমুদ এমনই একজন জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক, যার দৃষ্টি জীবনের মধ্যে ঘুরপাক খায়, কখনো সে স্থানচু্যত হন না, 'কালো নৌকা' গল্পে যে চিত্র দেখাতে চেয়েছেন তা আসলে মানুষের সহজাত মনোবৃত্তির একটা প্রকাশ। মানুষই কখনো-সখনো পশুত্বের কাছে মাথানত করে বসে থাকে, তখন তার ভেতরের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় অথবা সে একটা আস্ত জানোয়ারে পরিণত হয়, হয়তো এটাই স্বাভাবিক, রাসুর পুত্র দামোদর বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে গিয়ে আকস্মিক তুফানে পড়ে এবং চৌদ্দজন জেলের সঙ্গে সেও নিখোঁজ হয়ে যায়, পরবর্তী সময়েও তার আর কোনো সংবাদ আসে না। ঘরে তার নববিবাহিত স্ত্রী কালী, সে অপেক্ষা করে স্বামী তার আসবে অথচ দামোদর আর আসে না, হয়তো সলিল সমাধি হয়েছে, কালী তার বাপ-ভাইয়ের কাছে চলে গেলও আবার ফিরে আসে স্বামীর ভিটেয়, তারপর থেকেই শ্বশুর অর্থাৎ রাসুর দৃষ্টি পড়ে কালীর ওপর, তাকে নানান ভাবে প্রলুব্ধ করে এবং একটা সময় কামিয়াব হয়। গল্পটি মনস্তাত্ত্বিক, কবিতার একটা আবহ বিরাজমান, আমাদের স্মরণ রাখা আবশ্যক, কবি আল মাহমুদের প্রিয় কবি জসীমউদ্‌দীন এবং জীবনানন্দ দাশ, যার কারণে কবিতার মতো তার গদ্যেও চিত্রকল্প-চিত্রকলা উপমা-রূপক প্রতীক অলংকার অবিরল ধারায় বহুল ব্যবহার চোখে পড়ে, বিভূতিভূষণ বা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী অথবা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাহিত্যেও যেভাবে কবিতাশ্রিত ভাষার একটা আবরণ আছে, তাতে কথাসাহিত্য নিজের ভাষায় শক্তি ফিরে পেয়েছে। আল মাহমুদের গল্পে এমনই ভাষাশক্তি ফিরে-ফিরে আসে নদীর স্রোতরাশির মতো মনে হয়। তার বিখ্যাত গল্পগুলো নিয়ে হামেশা আলোচনা হয়, কিন্তু কিছু গল্প আছে হয়তো সে সব গল্প অপেক্ষাকৃত একটু অপরিচিত অথবা পাঠক আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেনি, সে রকম কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তাতে কবির একটা ভিন্ন ইমেজ প্রকাশ পাবে, হয়তো স্বতন্ত্র আল মাহমুদ এখানেই। 'ভেজা কাফন' গল্পে ভালোবাসার একটা চমৎকার রূপ দেখতে পাওয়া যায়, সাজ্জাদ কিছুটা ভালোলাগা থেকে ভালোবেসে বিয়ে করে নূরীকে, যার শরীরে বাসা বেঁধেছে কঠিন রোগ, চিকিৎসকের কড়া নির্দেশ বিয়ের মতো কোনো শারীরিক উত্তেজনা আপনার শরীর নিতে পারবে না এবং তাতে আশু সংক্ষেপ হয়ে যাবে, কিন্তু তারপরও নূরী চেয়েছে শরীরিক তৃপ্তি নিয়ে মরতে, কিন্তু রুগ্না নূরী চায়নি তার সন্তান আসুক, তাতে সাজ্জাদ বিয়ে করতে পারবে না, ভালোবাসার একটা দিক এখানে ফুটে উঠেছে, মৃতু্যর পরে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে খাটিয়ায় যখন গোরস্থানে নেয়া হয়, তখনো নূরী সুন্দর একটা গোলাপ পাপড়ি, তার দিকে তাকিয়ে থাকে সাজ্জাদ, যেন সে মরেনি, ভালোবাসার মতো সজীব একটা মুখ, নিঃশব্দে দেখে শুধু, কিন্তু শেষবারের মতো দেখবার সময়, নূরীর নাকফুলটি নাকে না থাকার কারণে বড় অপরিচিত লাগে, পুকুরের শাপলাগুচ্ছ তুলে ফেলার পর পরিষ্কার টলমলো পানিকে যেমন দেখায় ঠিক তেমন লাগে নূরীকে, কিন্তু তারপরও একটা ভালোবাসা উতলে ওঠে বুকের ভেতর থেকে, আল মাহমুদ এভাবেই জীবনের একটা দিক সাজিয়ে তুলেছেন ফুলের মতো সৌন্দর্যে রাঙিয়ে। 'তৃষিত জলধি' গল্পে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের একটা সৃজনশীল কর্মসূচিকে সামনে রেখে আখ্যান নির্মিত হয়েছে, দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীসহ দেশের খ্যাতিনামা কিছু ব্যক্তিদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি একবার বঙ্গোপসাগর সফরের চিন্তা করেন, হিজবুল বাহার জাহাজটি ছিল বিশাল, একসময় জাহাজটি হজযাত্রী বহন করতো, তাতে চড়ে সাগরসহ সুন্দরবনের সঙ্গমস্থলের অদূরে হিরণপয়েন্ট পর্যন্ত যায়, কবি আল মাহমুদও সেই ভ্রমণের একজন সম্মানিত ব্যক্তি, রাষ্ট্রপতি সেমিনারে কিছু উপদেশ বাণী প্রদান করেন, এবং উদ্দেশ্যটা ছিল মূলত কিছু গুরুত্মপূর্ণ ঘোষণা, তিনি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে, আমরা দশ কোটি মানুষ যথেষ্ট সাহসী নই বলে শত্রম্নরা, পররাজ্যলোলুপ রাক্ষসরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এই স্বাধীন জলাধিকারে আনাগোনা করছে...তিনি আরও বলেন, আমাদের সমুদ্রের সীমানায় তেল-গ্যাস কয়লা-চুনাপাথরসহ আরও অনেক কিছু আছে, এমনকি তেল অর্থাৎ পেট্রোলও আছে, এই সমুদ্রের মধ্যে আরও জমি জেগে উঠবে, প্রায় বাংলাদেশের মতো আরও একটা ভূমি আমাদের এখানে আছে। গল্পে যে সম্ভাবনার কথা বলেছেন তা বর্তমানে সত্যে প্রমাণিত হয়েছে, তালপট্টি-নিঝুমদ্বীপসহ আরও জমির কথা বলেছেন, তার যে দূরদৃষ্টি তার যে প্রজ্ঞা তাই কবি তুলে ধরেছেন গল্পের আঙ্গিকে, রাষ্ট্রপতির চিন্তার গভীরতা কতটা প্রগাঢ় তার একটা ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়, গভীররাতে গেঞ্জি পরে জাহাজের ছাদে একা বসে আছেন, কবিকে দেখে তার বোধগম্য হলেও তিনি যে সত্যিকার অর্থে দেশকে কতটা ভালোবাসতেন তার একটা ছবি চিত্রায়ণ হয়েছে, তিনি যেমন একজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আবার তিনিই দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকারী, তার মতো মানুষের মহৎ হৃদয়ের কাছে কবি বারবার ছুটে গেছে কারণ তিনিই তো জাহাজের মাস্তুল অর্থাৎ আলোকবতিকা। 'ময়ূরীর মুখ' গল্পের প্রধান চরিত্র ময়ূরী, যার ঠোঁট থেকে মুখ পর্যন্ত ঢাকা থাকে, দুর্ঘটনায় পোড়া মুখ কাউকে দেখাতে চায় না, বাপ আফজাল কেরানি সামর্থ্যানুযায়ী মেয়ের চিকিৎসা করায়, লেখাপড়া শেখায়, তার ইচ্ছা সে মানুষ হউক, একটা সময় ময়ূরী চারুকলায় সুযোগও পায়, সে তখন নিজের মুখচ্ছবি আঁকে, বিশাল ক্যানভাসে ধাবমান মাছের ছবির ওপর রং বোলাতে গিয়ে চমকে ওঠে, রাজা হোসেন নামে চারুকলার আরেকজন গরিব ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়, সে তার ক্যানভাসে ময়ূরীর ছবি ফুটিয়ে তোলে, ভালোবাসার রং মিশিয়ে দুজনের দুঃখ দুজন ভাগ করে নিতে চায়, ময়ূরী তখন হয়ে ওঠে দেবী, তার অস্তিত্ব খুঁজে যায় আরেক ময়ূর, তারপর দুজনে চাঁদের মতো সামন্তরাল পথে হারিয়ে যায়, দুজনের আর কারও কষ্ট থাকে না। মানবিক একটা ছবি সুস্পষ্ট দৃশ্যমান গল্পের শরীরে। নদীর মতো সীমাহীন হয় ভালোবাসার নদী, গল্পে শিল্পসত্তার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে গল্পটিকে আরও আকর্ষণীয় করেছে। মুস্তফা সাহেব একজন পূর্ণ যুবক, এবং সবিতাও পূর্ণ যুবতী, দুজনে একই অফিসে কাজ করে, কিন্তু যৌবনের যা ধর্ম, না মানে শাসন-বারণ, না মানে নিয়ম-নীতি, কাছাকাছি থাকাতে একটা সম্পর্ক, পাশাপাশি অবস্থানের ফলে একটা নিবিড়তা গড়ে ওঠে, যা থেকে ভালোবাসার উত্তাপ তৈরি হয়, কাছে পেতে ইচ্ছে করে আরও কাছে নিজের একান্ত করে পেতে, যখন না পায়, তখন একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়, ভালোবাসা তখন ছাপিয়ে ওঠে অন্য মাত্রায়, মুস্তফা কিন্তু মানসিক রোগী নয়, বলা যায় একতরফা প্রেমের প্রেমিক। 'স্বপ্নের ভেতর হাঁটাচলা' গল্পে মুস্তফাকে দেখি, যে স্বপ্নে ভেতর তার দয়িতার কাছে পৌঁছে যায়, হয়তো একেই সত্যিকার ভালোবাসা বলে, স্বপ্নের ভেতর নিজেকে তার হাতে সমার্পণ করে, সবিতা দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, তার কাছে ভালোবাসার কোনো আলাদা তাৎপর্য নেই, সবই সমান, সমস্ত পুরুষকে সে ওই পালস্নায় মেপে দেখেছে, তাই ভালোবাসা অর্থহীন। অথচ মুস্তফা ভালোবাসে, হয়তো সেটা শারীরিক ভালোবাসা অথবা মানসিক ভালোবাসা, কিন্তু তাতে সবিতার কি, সে তো বাঁচতে চায়, একটা চাকরিকে অবলম্বন করে সে বেঁচে আছে, হয়তো এটাই তার কাছে বড় সত্য। 'নিশি বিড়ালীর আর্তস্বর' গল্পটি মনস্তাত্ত্বিক, দিবানিশি বিড়ালের বাচ্চার কান্না অতিষ্ঠ করে হোমাকে, নিজেকে কোনোভাবে ওই কান্নার মিউ-মিউ শব্দ থেকে সরাতে পারে না, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে সর্বদা, কিন্তু বিড়ালের কান্না হোমাকে শান্তি দেয় না, একদিন রাস্তায় যখন দেখে, একটা লোক বিড়ালের বাচ্চাকে ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে তখন ভিড় ঠেলে জনসাধারণের মুখোমুখি এসে সেই লোকটার ওপর তেড়ে মারতে যায়, এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে, তারপর রাতের অন্ধকারে সেই বিড়ালের কান্না আবার শুনতে পায়, তখন অনেক ঝড়-বৃষ্টির রাত্রি, তারপরও হোমা তার একমাত্র মেয়ে সেতুকে নিয়ে বিড়ালটাকে ড্রেনের কাদা-পানি থেকে রক্ষা করে আনে, এভাবেই একটা গল্প পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে, আল মাহমুদ তার কুশলি চেতনায় গল্পটিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় এ' গল্পের মধ্যদিয়ে। 'গন্ধবণিক' গল্পে দেখা যায় যে গন্ধবণিক জীবনভর সুগন্ধি আতর বিক্রি করলো, কিন্তু সে কিনা মৃতু্যর সময় পচা-গলা দুর্গন্ধে পরিণত হলো, মন্তু নানার গল্পটা এখানেই হয়তো শেষ হতো অথচ একটা রেশ থেকে যায় কুলসুম-কলিমের দম্পতির মধ্যে। বাস্তব ঘটনা হলো, মন্তু নানা মারা গেছে, তার শরীর থেকে যে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে তাতে কলিমের বমি হয়, জ্ঞান হারায়, তারপর ঘুমের মধ্যে রাত্রি কেটে যায়, ফজরের আজান ভেসে আসে সকাল হয়, মন্তু নানার আতরের সুভাসে পৃথিবী মাতোয়ারা ছিল, মানুষজন তারিফ করতো তার সুগন্ধি আতরের; কিন্তু মৃতু্যর পর সে আতর উধাও হয়, বিনিময়ে পুঁজে গন্ধে বাতাস দূষিত হয়, কারণ মৃতু্যর পর তার নফস্‌ পচে যায়, তার আত্মাকে জাগ্রত রাখতে সে পৃথিবীতে ইবাদত বা নামাজ-বন্দেগি করেনি, যার ফলস্বরূপ সে নাস্তিক হয়েই জীবন সমাপ্তি করেছে, 'গল্পবণিক' গল্পে কলিম যে মন্তু নানাকে নিজের আপনজন বা বন্ধু বলেই জেনেছে, তার মৃতু্যর খবর সে প্রথম পায় রিকশাওয়ালা আফজালের মুখ থেকে, ঢাকা থেকে ফেরার সময় সেই সংবাদটি দেয়। গল্পটি আদর্শের হলেও মানবিক দিক প্রতীয়মান হয়েছে, এভাবেই কেউ-কেউ নিজেকে বিলিয়ে দেয়, কোনো রকম খামতি রাখে না, কলিমও শেষঅবধি নানার প্রকৃত বন্ধুরই পরিচয় দেয়। 'তুষের আগুন' মনস্তাত্ত্বিক একটি গল্প, জটিল এবং প্রশ্নবিদ্ধ সময়ের এ' গল্পে জীবন যেন একটু ভিন্ন হয়ে ধরা দিয়েছে, মুনীরা এবং মতিয়া দু' বোন একজন তরুণ সাংবাদিক শাহেদকে ভালোবাসে, যে কিছুটা ভিতু এবং অস্থির প্রকৃতির মানুষ, নিজের সম্পর্কে নিজেই ওয়াকিবহাল নয়, সিদ্ধান্ত নিতে যার অনেক বেশি সময় লাগে, এমন একজন মানুষের জীবনটাকে কয়লা করতে দুজন মেয়ে মানুষ যথেষ্ট, কিন্তু ফুপাতো বোন তামান্না অস্বাভাবিক এই মৃতু্যযন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে, বিধবা এই ফুপাতো বোনটিকে বিয়ে করানোর জন্য ফুপু যতোই চাপ দিক না কেন, তামান্না কিন্তু তার মহৎ হৃদয়ের কাজটাই করেছে, গল্পে যে সমস্যা উঠে এসেছে প্রকৃতপক্ষে এমনই হয়, প্রখর বুদ্ধিসম্পূর্ণ তামান্না তার ভাই শাহেদের জন্য মতিয়াকে পছন্দ করে দেয়, এভাবেই গল্পটি একটা পরিণতির দিকে যায়, মানুষ এভাবেই সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খায় আবার ফিরে আসে কিন্তু তার ভেতর যে কষ্ট জমা হয় তা হয়তো কাউকে সে বলে বোঝাতে পারে না, তুষের আগুন গল্পে গাল্পিক জীবন থেকে বৃহৎ একটি সমস্যাকে চমৎকারভাবে সমাধানের পথ দেখিয়ে দিয়েছে অত্যন্ত সুচারুভাবে। পৃথিবী এভাবেই এগিয়ে যায়, কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করে না, কাশেমী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার নিজের অবস্থানে ফিরে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দলাদলিতে পা দিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারানো অধ্যাপক, যার বিধবা স্ত্রী তামান্না সেভাবেই বুঝেছে একটা জীবনকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়াটাই মূল কথা, কেউ কারও কাছে দায়বদ্ধ নয়, জীবনের রহস্য হয়তো একেই বলে। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের এক প্রেস ব্রিফিং নিয়ে 'এক পলক' গল্পটি নির্মিত, নবীন সাংবাদিক আসিফ চলচ্চিত্রের সেই সেমিনারে উপস্থিত হয়, এবং তবাসসুম তাহেরা নামে এক উঠতি নায়িকার সন্ধান পায়, যে তার নিজ জেলা এবং একই কলেজের ছাত্রী, দীর্ঘদিন পর তারা আবার একে অপরের সান্নিধ্য পায়, তারপরও মূল কথা হলো নবীন সাংবাদিক আসিফকে নিজের পাশে পেতে মরিয়া, কারণ একজন সাংবাদিকই পারে একজন নায়িকাকে সিঁড়ি করে দিতে, তাহেরা সে সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায় না, ভালোবাসার খেলায় মত্ত রাখে নিজেকে। এক পলক গল্পটি ভালোবাসার গল্প হলেও একটা স্বার্থ কাজ করে, মানুষ হয়তো এভাবেই সামান্য স্বার্থের জন্য কদাচিৎ নিজেকে বিলিয়ে দেয়, হয়তো এটাও একরকম ভালোবাসা হতে পারে, কিন্তু তার ভেতর ভালো থাকলেও বাসা কতখানি নিরাপদ তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। সাংবাদিক আলফাজ সাহেব যখন জানলেন, তার ভালোবাসা মুনিরার সঙ্গে এজন্মে বিয়ে হবে না, কারণ মেয়েপক্ষেও কেউই সাংবাদিকের সঙ্গে বিয়েতে রাজি নয়, মনেপ্রাণে সে তখন ভেঙে পড়ে, নিজেকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলে, নিজের ভেতর যে ভালোবাসা-উদারতা বাসা বেঁধে ছিল শুধু মুনিরার জন্য, সে তখন অস্থির হয়ে ওঠে, তারপর কাজের মেয়ে পাপিয়ার মধ্যে নিজের ভালোবাসাকে খুঁজে পায়, 'অন্সরীর গোসল' গল্পে পাঠক দেখে দেখতে পায়, কাজের মেয়ে অশিক্ষিত-ছোটলোক কিন্তু তার শরীরের যে বিদু্যৎবিভা, তাতে কোনো ভিন্নতা নেই, পৃথিবীর সমস্ত নারীই সমান, পাপিয়ার স্নান দেখে গাল্পিকের ধারণা, এ যেন অন্সরীর গোসল। প্রেমে ব্যর্থ না হলেও মানুষের কাছে যদি সামান্যতম আন্তরিকতা থেকে কেউ বঞ্চিত হয়, তার ভেতর শেষাবধি প্রতিক্রিয়া হয় এভাবে, যে সে পারে আরও একজনকে তার সমকক্ষ উপযোগী করে তুলতে, আলফাজ হয়তো জেদের বশে কাজের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, হয়তো এটা স্বাভাবিক নয়, কিন্তু এটাই সত্য, মনস্তাত্ত্বিক এ গল্পে জীবনের মানে এভাবে বদলে গেছে। নবীন স্পোর্টস রিপোর্টারের অভিজ্ঞতার আলোকে 'দৌড়' গল্পের কাহিনী গড়ে উঠেছে, সম্পাদক মহাশয় একদিন বললেন, দৌড়ের মেয়ে ময়নার বিষয়ে কিছু নোট আনতে। টেলিফোন না করে সরাসরি হাজির হয়, তখন সে মহিলাদের খেলার মাঠে প্র্যাকটিস করছিল, দারোয়ান বাধা দিলেও অনেক বুঝিয়ে মেয়েদের সংরক্ষিত জায়গায় পৌঁছে যায়, ময়না দেখে প্রথমে থতমত খেয়ে গেলেও নিজেকে একসময় সামলে নেয়, কারণ তার কাছেই সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য এসেছে, এবং তাকে নিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি হবে ছবিসহ প্রকাশিত হবে জাতীয় কাগজে, যাতে সারাদেশে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে, এর জন্য উলস্নাসিত মনে-মনে, কিন্তু একসময় ময়না বলে, মেয়েদের দৌড় দেখতে যারা স্টেডিয়ামে আসে, তারা পুরুষ মানুষ, কি দেখে, দৌড়! তারা দেখে নারীর প্রায় উলঙ্গ মাংসপেশি, এতেই পুরুষের দৃষ্টি তৃপ্ত হয়, নারীশরীরের সৌন্দর্য দেখার অভিপ্রায় সমস্ত মানুষের মধ্যেই আছে, এমনকি আপনার চোখও তাই কামনা করে, নবীন রিপোর্টার ময়নার এমন সাহস দেখে হতচকিয়ে যায়, সত্য কথা সবাই বলতে পারে না, তবে কেউ কেউ তো বলে, মানুষের ভেতরের প্রকৃত মানুষটাকে খুঁজে বের করার যে অদম্য ইচ্ছে তা আল মাহমুদের 'দৌড়' গল্পে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দক্ষ ভাষাশিল্পী কবি আল মাহমুদ নিজেকে বারবার ছিঁড়েকেটে যেমন দেখেছেন তেমনি যা বলেছেন তাই প্রকাশ করেছেন সাবলীলভাবে, একটা দেশ একটা জাতিকে সামনে দাঁড় করিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বাংলাসাহিত্য শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে, তার ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত। আল মাহমুদ দেশের প্রথম কাতারের একজন কবি, তিনি জীবনভর সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কবিতার মতো গল্পও তাকে পরিচিত করেছে, 'পানকৌড়ির রক্ত' 'জলবেশ্যা' 'কালোনৌকা' 'খনন' 'বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা' বা 'গন্ধবণিক'-এর মতো গাল্পিক বাংলাসাহিত্যে বিরল প্রতিভা বলা অপেক্ষা রাখে না। তার নির্মাণে যে শিল্পসত্তা জড়িয়ে আছে তা বাংলাভাষাভাষী পাঠকসমাজকে বিমুগ্ধ করে।