কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদ

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

শাহরিয়ার সোহেল
বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভাবান ও শক্তিমান কবি আল মাহমুদ। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে তিনি অতুলনীয়। বিগত কয়েক দশকে কবি আল মাহমুদের হাত ধরে বাংলা কবিতা চরম উৎকৃষ্ট ও উন্নত হয়েছে। বাংলা কবিতাকে নতুন রূপে নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে উপমা ও চিত্রকল্পের রঙে রাঙিয়ে নতুন ধারায় আধুনিকতার পরশে নির্মাণ করেছেন। কবিতার সঙ্গেই গড়ে তুলেছেন একান্ত ঘর-সংসার। তিনি বলেছেন, 'কবিতা আমার জীবন।' অবশ্য কবি আল মাহমুদ শুধু কবি হিসেবেই নয়, তিনি একাধারে একজন শক্তিমান গাল্পিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাংবাদিক, কলাম লেখক প্রভৃতি। সাহিত্যের অনেক শাখাতেই তার অবাধ বিচরণ। তার সৃষ্টির পরিধি সাহিত্যের বিশাল আকাশজুড়ে বিরাজমান। এত কিছু ছাড়িয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন কবি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমানের পর বাংলা কবিতায় যে ক'জন কবির নাম প্রকটভাবে বলা যায়, তার মধ্যে আল মাহমুদ অন্যতম। আল মাহমুদের নিপুণ হাতের জাদুর ছোঁয়ায় কলমের কালিতে বাংলা কবিতা যেন নক্ষত্রের মতো কাব্যাকাশে ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে। আল মাহমুদ একজন কবি হিসেবে নিজের চিন্তাচেতনা, ভাব, রূপ-রস-গন্ধ, ছন্দ-তাল, বোধ, আবেগ, অনুভূতি ও ইচ্ছা শক্তি দ্বারা বাংলা কবিতাকে করে তুলেছেন দীপ্তমান, বৈচিত্র্যময় ও সৃজনশীলতার এক সৌন্দর্যের অরণ্যভূমি। কাব্য জগতে যে নতুনের ভাবধারা ভাষা তিনি সৃষ্টি করেছেন, তার সমসাময়িক (৫০ দশকে) সময়ে অন্য অনেক কবি তা করে উঠতে পারেননি। কবি আল মাহমুদ তার কবিতায় সাধারণত আঞ্চলিক শব্দের সমাহার ঘটান এবং আধুনিক বাংলা ভাষার ভেতরে আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে কবিতা নির্মাণ করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, 'আঞ্চলিক ভাষা মানেই হলো জীবন্ত ভাষা।' কবিতাকে তিনি আধুনিকতার রঙে রাঙিয়ে প্রকৃত কবিতা করে তুলেছেন। তিনি বাংলা কবিতার মহানায়ক। বাংলা কবিতায় কাব্যরাজা হয়ে তিনি বাংলা কবিতাকে কাব্যময় শিল্পময় পাঠক প্রিয়তা করেছেন। ১৯৫৪ সাল থেকে তার তরুণ বয়সে লেখা কবিতা ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। আর তখন থেকেই তার কবি নাম ঢাকা ও কলকাতার পাঠকদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' নামক সাহিত্য কাগজে লেখা প্রকাশ হলে কবি মহলে আল মাহমুদকে নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। সেই থেকে বাংলা সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনে সুনিপুণ শক্তিমান কবি হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলা কবিতাকে সুনির্মাণ করে চলেছেন কবি আল মাহমুদ। কবি আল মাহমুদ তার অশেষ অপার বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল হাতে বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করছেন। দক্ষ কারিগর হয়ে কবিতা তৈরি করেছেন। একজন ভালো ও বোদ্ধাপাঠক এবং সমালোচক মাত্রই জানেন, কবি আল মাহমুদ বাংলা কবিতার জগতে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ এককভাবে জুড়ে আছেন। বাংলা কবিতার আকাশে কালজয়ী সৃষ্টি 'সোনালি কাবিন' কাব্যগ্রন্থটি কবি আল মাহমুদকে সত্যিকারার্থে অন্যতম প্রতিভাবান প্রতিশ্রম্নতিশীল প্রজ্ঞাবান, সৃজনশীল এবং শ্রেষ্ঠরূপকার কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 'সোনালি কাবিন' কবি আল মাহমুদকে কাল থেকে কালান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে, অতীত থেকে বর্তমানে আর বর্তমান থেকে সুন্দর আগামীতেও বহমান খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কবি আল মাহমুদের অপার সৃষ্টি 'সোনালি কাবিন' লেখার পরে তিনি যদি আর কোনো কবিতা নাও লিখতেন তবুও তিনি বাংলা কাব্যাকাশে অমর, অক্ষয় এবং চির ভাস্মর হয়ে জাগ্রত থাকতেন। 'সোনালি কাবিনের' জন্যই কবি মানুষ ও সমাজের কাছে, পাঠক ও কালের কাছে শতাব্দী থেকে শতাব্দীকাল বেঁচে থাকবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 'সোনালি কাবিন' সম্পর্কে কবি আল মাহমুদ বলেছেন ''সোনালি কাবিন' নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওর ইশারা ইঙ্গিত কোনো দৈব কারণে হয়তো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। অবশ্য আমি এটি বুঝি 'সোনালি কাবিন' আমার রচনার মধ্যে প্রিয় কবিতা হয়তো বা। 'সোনালি কাবিন' লিখে আমি মনে করেছি যে, আমি এক ধরনের স্বার্থকতায় পৌঁছেছি। এটি আমাকে সবসময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সোনালি কাবিনের শব্দগুলো আমি এ মাটির গন্ধ থেকেই আহরণ করেছি, ব্যবহার করেছি। ভাটি বাংলার মানুষের মুখের ভাষাকে আমি কাব্যের আধুনিকতায় জাগিয়ে দিতে চেয়েছি, এবং দিয়েছি। যা 'সোনালি কাবিন' ধরে রেখেছে তার বুকে।' একজন কবি মূলত পৃথিবীর মধ্যে অন্যদের চেয়ে বড় প্রেমিক এবং বিশ্বাসী। আর সেই প্রেম ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে গভীর মনে কবি আল মাহমুদ সোনালি কাবিনে বলে উঠেছেন- 'সোনার দিনার নেই, দেন-মোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি ভালোবাসা দাও যদি আমি দেবো আমার চুম্বন ছলনা, জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।' এমন সত্য দৃঢ় ভালোবাসার কথা কবি ছাড়া আর কে বলতে পারে? একজন কবি প্রেম পূজারি, সত্যের সাধক ও দৃঢ়ভাবে আত্মবিশ্বাসী। কবির হাত দুটি স্বার্থ ছাড়াই সব চেয়ে বিশ্বাসী। এখানে কবি প্রেমিকার জন্য কোনো ছলচাতুরী, ধোঁকা, ভন্ডামি, চালাকি, প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতার স্থান দিতে পারেন না। কবি জীবনে প্রেম ভালোবাসা বিশ্বাস ছাড়া কোনো স্বার্থপরতার ব্যবসা শিখতে পারেননি। এখানেই কবির কাব্য জগতের স্বতন্ত্র প্রকাশ। কবির চিন্তা ও অস্তিত্বে বাউল সম্রাট ফকির লালনের উপস্থিতি প্রকাশ ঘটেছে সোনালি কাবিনের কয়েকটি কবিতায়। এখানে কবি তার মনের প্রিয় মানবীকে বাউলের এক তারার সঙ্গে তুলনা করে নিজে হতে চেয়েছেন একজন সত্যিকারের প্রেমিক তরুণ লালন। এক তারার সঙ্গে একজন বাউলের কিংবা লালনের আসলে সম্পর্কটা কী এবং কতটা সেই প্রেমময়, সুধাময় গভীরতা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কবি প্রেয়সীকে একতারায় বেঁধে নিজে ভাবুক দরিদ্র বাউল সেজে গেয়ে উঠেছেন- 'এর চেয়ে ভালো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল আরশী নগরে খোঁজা বাস করে পড়শী যে জন আমার মাথায় আজ চুড়ো করে বেঁধে দাও চুল তুমি হও একতারা, আমি এক তরুণ লালন।' কাব্যচর্চা মূলত সুন্দরের আরাধনা। সাহিত্যে অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে কাব্যচর্চা অত্যন্ত সৃজনশীল শিল্পময় এবং সবচেয়ে কঠিন। যদিও কবিতা সৃজনশীল মননশীলতার বহিঃপ্রকাশ। এ বিষয়ে কবি আল মাহমুদ বলেছেন- 'কাব্য সহজ শিল্প নয়। কারণ কাব্য হলো ভাষারই অমরতার সোপানে আরোহণের বর্ণনা মাত্র। সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে। আমরা তাদেরই একবাক্যে বলে উঠি এইতো কবি।' কবি আল মাহমুদের কবিতায় উপমা, প্রতীক ও চিত্রকল্প দেখে অবাক হতে হয়। এসব সমন্বয়ে কবি তার কবিতায় নারী, নদী ও পাখিকে বারংবার তুলে ধরেছেন। তার কবিতায় মাটি, মানুষ, জীবন, নদী, নারী আর প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য গভীরভাবে স্থান পেয়েছে। তিনি নারীকে, নদীকে এবং পাখিকে করে তুলেছেন কবিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু তাই নয়, কবি প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমির সৌন্দর্য কবিতার পরতে পরতে রূপ দিয়েছেন। তার কবিতা পাঠ করলে নারীকে নতুন রূপে, নদীকে পাখিকে অন্যভাবে এবং এই সবুজ প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আকারে চেনা যায় ও জানা যায়। তার কবিতা খুব সহজেই পাঠককে নিবিড় করে কাছে টানে, অন্য এক আলাদা জগতে আপন মহিমায় নিয়ে যায়; কবিতার নতুন রসে আচ্ছাদন করে রাখে। পাশাপাশি তার কবিতায় প্রেম আছে, বিরহ আছে, না পাওয়ার যন্ত্রণা আছে, রাজনীতি আছে, দ্রোহের কথা আছে আর আছে সুন্দর, সুস্থ সমাজ নির্মাণ ও পরিবর্তনের কথা। তার কবিতায় সত্য, ন্যায়, সততা, সাম্য, মানবতাবোধ ও সহমর্মিতাবোধ জোরালোভাবে ফুটে উঠেছে। এখানেই কবি আল মাহমুদের কবিতা হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় মানবিকতার প্রেমময় ভাবের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যাওয়ার তরণী। তিনি বলেছেন- 'আমার রচনায় শুধু প্রেম নয়, বরং মানবিক ভালোবাসার বিজয় হয়েছে।' এ কথাটি কবি তার নিজের লেখা সম্পর্কে সুদৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছেন। সৃজনশীল লেখা বিষয়ে কবি আল মাহমুদ বলেছেন, 'আমি যখনই কিছু লিখেছি সেটি আমার হৃদয়ের অনুপ্রেরণা এবং একই সঙ্গে মস্তিষ্কের উন্মাদনা মিশিয়ে সৃষ্টি করেছি। এ সৃষ্টির কোনো তুলনা দেয়া অসম্ভব।' এই কথার মধ্য দিয়ে কবি সব কবির মনের চরম অভিব্যক্তিকেই পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। একজন কবি যখন কোনো কিছু লেখেন, তখন সেটি তার একান্তে মনের অনুপ্রেরণারই প্রকাশ এবং আপন মস্তিষ্কের সৃজনশীলতার উন্মাদনার অপার শিল্পময় সৃষ্টি। আর কবির এই সৃষ্টিকে পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়ে তুলনা দেয়া খুব কঠিন ও প্রায় অসম্ভব। একজন প্রকৃত কবি তার সৃষ্টি কবিতায় মানুষের কথা, জীবনের কথা, দেশের কথা, সুখ-দুঃখের কথা, সত্য-ন্যায়-আদর্শের কথা, চেতনা-বিশ্বাসের কথা, সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের কথা, প্রকৃতির কথা, মহান স্রষ্টার মহিমার কথা তুলে ধরেন খুব সহজেই। এই সমাজে বিদ্যমান অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের বিপক্ষে, ছোট-বড় বৈষম্য ভেদাভেদের বিরুদ্ধে এমনকি যত অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অগণতান্ত্রিক নষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে একজন কবির কবিতা হয়ে ওঠে চরম বিদ্রোহের হাতিয়ার। কবি বাধাহীন বিপস্নবী লড়াকু সৈনিক হয়ে কবিতাকে শব্দে শব্দে গেঁথে প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করেন। কবি আল মাহমুদ একজন দক্ষ শব্দশ্রমিকের মতো কবিতা নির্মাণের মাধ্যমে সব অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সতত আলোকিত পথে ছুটে চলেছেন। তার কবিতায় স্বপ্ন, আবেগ, প্রেম আছে। আছে সুখের অনুভূতি, সুন্দরের জয়গান, আনন্দের পশরা। তার কবিতার পরতে পরতে আলাদা রকমের গন্ধ পাওয়া যায়। নতুন সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখা যায়। অন্য রসে, অন্য রঙে, অন্য ঢঙে, অন্য বোধে, অন্য আবেদনে সুর খুঁজে পাওয়া যায়। একজন পাঠকের সঙ্গে তার কবিতার অন্তরঙ্গ প্রেমের ভাবের মিলন ঘটে। কবিতা কী? এ প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদ বলেছেন, 'একটি কবিতা তখনই কবিতা হবে, কবিতা পড়ে হৃদয় তৃপ্ত হবে, বারবার পড়তে ইচ্ছে করবে এবং স্মৃতিতে গেঁথে যাবে। আমিতো তাকেই কবিতা বলি।' নন্দিত যুগস্রষ্টা মৌলিক কবি আল মাহমুদ কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য ও গবেষণামূলক রচনাও লিখেছেন। তবে কবিতাই তাকে করে তুলেছে কবিতার বরপুত্র। বাংলা কবিতায় তিনি এক শক্তিমান ক্ষমতাধর সম্রাট ও শব্দের কারিগর হিসেবে বেঁচে থাকবেন নিরন্তর।