বাংলা সাহিত্যে শরৎ স্তুতি

প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ড. আবদুল আলীম তালুকদার
বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু হচ্ছে শরৎকাল। কালের ধারায় বিশ্বজগতে প্রাণের সজীবতা, রং, রূপ, রস ও স্নিগ্ধতা নিয়ে এসেছে ঋতুরানী শরৎ। শরৎ আমাদের মাঝে বিভিন্ন উৎসবের আগমনী বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। বর্ষার ক্রমাগত বর্ষণ শেষে অশ্রম্নসজল বিদায়ে আগমন ঘটে শরতের। শরৎ হলো বর্ষার পরবর্তী ঋতু। বর্ষার অতিবর্ষণ ও অবিরাম মেঘমলস্নারের ডামাডোল থেমে গিয়ে প্রকৃতিতে নেমে আসে শান্ত-সুনিবিড় মনোহারি পরিবেশ। আকাশে-বাতাসে দূর্বাঘাসে শরৎরানী তার স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়। শরতের রূপবৈচিত্র্য নিঃসন্দেহে উপমাহীন। \হবাংলার কবি সাহিত্যিক ও সুধিজনরা শরৎকালকে ঋতুর রানী বলে অভিহিত করেন। শরৎকালে প্রকৃতি হয় কোমল, শান্ত-স্নিগ্ধ ও উদার। শ্রাবণ শেষে বিরামহীন বাদলের সমাপ্তি ঘটলেই প্রকৃতি নতুনরূপে সজ্জিত হয়। এ সময় আকাশের বুকে ভেসে চলে সাদা-শুভ্র পেঁজা তুলোর মতো মেঘমালা। মাটিতে ও সবুজ ধান গাছের ডগায় রোদ আর ছায়ার লুকোচুরি খেলা দেখা যায়। মাঠে মাঠে সবুজ ধান গাছের চারা খুশিতে নেচে ওঠে। ঘাসে শিশির পড়ে। সূর্যের কিরণ হয় দীপ্তোজ্জ্বল আর বাতাস হয় অমলিন। ভাদ্রের ভোরের সূর্য মিষ্টি আলোর স্পর্শ দিয়ে প্রকৃতির কানে কানে ঘোষণা করে শরতের আগমনী বার্তা। তাই শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি থাকে নির্মল ও স্নিগ্ধ। শরৎ মানেই ঝকঝকে গাঢ় নীলাকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা। শরতের মতো গাঢ় নীল আকাশ আর কোনো ঋতুতেই দেখা যায় না। শোভা ছড়ানো পুষ্পবন আর শস্যের শ্যামলতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শরৎ। সোনা ঝরা রোদ্দুর, নদীর পাড়ে মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাওয়া সাদা সাদা কাশফুলের সমাহার, পাখ-পাখালির দল মহাকলরবে ডানা মেলে আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালা গেঁথে উড়ে চলা। ভোরবেলা শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দূর্বাঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছানো থাকে সুমধুর ঘ্রাণ মেশানো রাশি রাশি শিউলি ফুল। শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়ের মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। \হশরৎকালের রাতে জ্যোৎস্নার ঝলমলে আলো অপরূপ রূপ পরিগ্রহ করে। আকাশটা ফক্‌ফকে জোছনায় ভরে যায়। মেঘমুক্ত আকাশে যেন জোৎস্নার ফুল ঝরে। চাঁদের আলোর শুভ্রতায় যেন আকাশ থেকে কল্পকথার পরিরা ডানা মেলে নেমে আসে পৃথিবীতে। শরতের আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের সঙ্গে শৈশবের স্বপ্নেরা ঘুরে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায় লাটাই বাঁধা কাগজের তৈরি ছোট্ট ঘুড়িরা। শুভ্র মেঘরাশি চাঁদের জোছনায় কেমন দুধেলা হয়ে ওঠে। রাতের রুপালি আলোয় শরৎ নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পৃথিবী। আনন্দে দোল খায় মন। কোনো মানুষই শরৎকালে প্রকৃতির রূপ-লাবণ্য দেখে মোহিত না হয়ে পারে না। তাইতো প্রকৃতির এমন রূপের বাহারে কবি-সাহিত্যিকের মনোজগতও আনন্দের আতিসায্যে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। তাদের কলমের ডগায় চলে আসে লেখনির জোস। যুগযুগ ধরে হাজারও কবি, মহাকবি, শিল্পী-সাহিত্যিক শরৎ নিয়ে রচনা করেছে হাজারও পদাবলি। প্রকৃতির এই অনন্যসুলভ রূপসৌষ্ঠব জনমানুষের দোর গোড়ায় সঞ্চারিত করতে সৃষ্টি করেন নতুন নতুন সাহিত্যকর্ম। শরৎ মানেই শিউলির মধুগন্ধ ভেসে বেড়ানোর দিন। শিউলির মতো চমৎকার এ ফুল নিয়ে দুটি গ্রিক ও ভারতীয় উপকথা আছে। সুসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসে শিউলির বিশাল বন ও তার তীব্র ঘ্রাণের কথা বলা হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, প্রকৃতিপ্রেমি কবি জীবনানন্দ দাশ এরা সবাই বারবার শিউলির প্রশংসা করেছেন। তাই শরতের প্রশস্তি গেয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। আদি সাহিত্য চর্যাপদের পদ অধীশ্বর থেকে শুরু করে এই আধুনিককালের নবীনতম কবির রচনায়ও শরৎকাল তার নান্দনিক ব্যঞ্জনা নিয়ে উদ্ভাসিত। বৈষ্ণব সাহিত্যের তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাদ্র মাসকে নিয়ে বৈষ্ণব পদাবলির এই গদ্যটি সম্ভবত বিদ্যাপতি রচিত রাধা বিরহের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ। \হবাংলা সাহিত্যের গুরু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শরৎ নিয়ে প্রচুর কবিতা-গান রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করেছেন। তিনি বলেছেন, 'শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙুলি। শরৎ তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে/বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে। আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি'। \হবিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশির ভাগ রচনায় রয়েছে প্রকৃতির জয়গান। তিনি পদ্মায় নৌকা ভ্রমণকালে শরতের ময়ূরকণ্ঠী নীল নির্মল আকাশে শিমুল তুলার মতো শুভ্রমেঘেদের দল বেঁধে ছুটে বেড়ানো দেখে লিখেছিলেন- 'অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/ দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণি বাওয়া।' \হশরৎ বন্দনায় এগিয়ে রয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তার অসংখ্য গান ও কবিতায় শরতে বাংলার প্রকৃতির নিখুঁত আল্পনা এঁকেছেন। তার 'শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ', 'এসো শারদ প্রাতের পথিকসহ অনেক গানই শরৎ-প্রকৃতির লাবণ্যময় রূপ নিয়ে হাজির রয়েছে। শরতের অসম্ভব চিত্ররূপময়তা ফুটে উঠেছে এ সব রচনায়- 'এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে। দলি শাপলা শালুক শতদল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল/ নীল লাল ঝরায়ে ঢলঢল এসো অরণ্য পর্বতে।' বাংলা সাহিত্য জগতে মহাকবি কালিদাস 'মেঘদূত' কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায়ও ছিলেন অগ্রবর্তী। তিনি বলেন, 'প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎ কাল সমাগত।' কবি 'ঋতুসংহার' কাব্যে শরৎকাল বিষয়ে লিখেছেন- 'কাশ ফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুলস্ন পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।' কবি কল্পনায় শরতের সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর এই উপমা দেখে বিস্মাভিভূত না হয়ে উপায় নেই। শরতের আরেকটি উলেস্নখযোগ্য দিক হলো- এ সময় মাঠজুড়ে থাকে সবুজ ধানের সমারোহ। ধানের কচিপাতায় জমা হওয়া শিশিরের ওপর প্রভাতের তরুণ আলো মুক্তার মতো দু্যতি ছড়ায়। আমাদের দেশের কৃষকরা নবান্নের আশায় দিন গোনে। আর বাঙালির সার্বজনীন প্রাণের উৎসব হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসবের কথা বলাই বাহুল্য। শরৎকাল শারদীয় আরাধনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যেমন উৎসবমুখর করে, তেমনি বিজয়ার বেদনায়ও করে তোলে ব্যথিত। শরৎ বাংলার প্রকৃতিতে আসে শুভেচ্ছাস্মারক হিসেবে, নানামাত্রিক আনন্দের বারতা নিয়ে। কবি বিনয় মজুমদার শরতের একটি চিত্র এঁকেছেন- 'শরতের দ্বিপ্রহরে সুধীর-সমীর পরে জল-ঝরা শাদা শাদা মেঘ উড়ে যায়; ভাবি, এক দৃষ্টে চেয়ে, যদি ঊর্ধ্বপথ বেয়ে শুভ্র অনাসক্ত প্রাণ অভ্র ভেদি ধায়!' \হতবে শরৎকে কবি রবীন্দ্রনাথ বরাবরই দেখেছেন শান্তি, মঙ্গল ও সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে। তিনি বলেছেন- 'আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ শেফালী ফুলের মালা/ নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা এসো হে শারদ লক্ষ্ণী তোমার শুভ্র মেঘের রথে/ এসো চির নির্মল নীল পথে। শরৎ মূলত শুভ্রতার প্রতীক। পবিত্রতার চিহ্ন। বর্ষাকালের লাগাতার বৃষ্টি প্রকৃতিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেয়। শরৎ তাই একটু বেশি পূতঃপবিত্র অন্যান্য ঋতু থেকে। দেখলে মনে হয় ঝক্‌ঝকে ও তক্‌তকে। সকালবেলা দূর্বাঘাসের ডগায় জমে বিশুদ্ধ শিশির জল। বাতাস হয়ে যায় দূষণহীন। চিত্তে বাজে আলাদা গন্ধ, ছন্দ ও রং। ব্যাকুল হয়ে যায় মন। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে বিশ্বকবির সেই কবিতা- 'শরৎ এসেছে'। তাইতো কবি উচ্চারণ করেছেন- আজি কি তোমার মধুর মুরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে,/ হে মতবঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে। পারে না বহিতে নদী জলধার/ মাঠে মাঠে ধান ধরে না কো আর/ ডাকিছে দোয়েল, গাহিছে কোয়েল/ তোমার কানন শোভাতে। শরতের আগমন সম্পর্কে কবি বলেছেন- 'আজি শরৎ তপনে প্রভাত স্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়/ ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো/ আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে, রহে না আবাসে মন হায়/ কোন কুসুমের আশে কোন ফুলবাসে সুনীল আকাশে মন ধায় গো।'