শেষ সর্বনাশ

প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

রেজাউল করিম খোকন
১ 'কেউ জানতে পারব না। তোরে দেইখ্যা নাকি বেশ ভালো লাগছে মাস্টারের, যদি তুই তার সঙ্গে থাকতে চাস'- বড় বোন শাকিলার মুখে তেমন কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়েছিল রোজিনা। নিজের বোন হয়ে সে কীভাবে এমন কথা বলতে পারল! শাকিলার ছোট বোন রোজিনা থাকে কেরানীগঞ্জ। ওর ছেলেমেয়ে নেই। বিয়ে হয়েছে অনেক দিন। স্বামী থাকে ইতালিতে। দুই-তিন বছর পর পর দেশে আসে। কিছুটা বয়স্ক মানুষ, এক সময় মারাত্মক কিছু অসুখ-বিসুখে নিজের সক্ষমতা হারিয়ে ফেললেও তা গোপন রেখেই বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর রোজিনা ব্যাপারটা টের পেলেও তার করার কিছু ছিল না। বেশ কিছুদিন বাপের বাড়িতে ঝিম মেরে থাকলেও সবার চাপাচাপিতে আবার স্বামীর ঘরে ফিরে আসতে হয়েছে। প্রতি মাসে ইতালি থেকে পাঠানো ইউরোর বিনিময়ে ব্যাংক থেকে তোলা কাড়ি কাড়ি টাকা রোজিনার মানসিক অশান্তি, অতৃপ্তি, অসন্তুষ্টি অনেকটা দূর করলেও তার মনের গভীরে অনেক কিছু না পাওয়ার বাসনা অনেক কষ্টে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। স্বামী শারীরিক সুখ, আনন্দ, পরিতৃপ্তি দিতে না পারলেও যদি তাকে একটি ছেলে অথবা মেয়ে সন্তান দিতে সক্ষম হতো তাহলেও সেই অপূর্ণতা ভুলে থাকার চেষ্টা করত রোজিনা। দুই-তিন বছর পর পর লোকটা দেশে এসে থাকে এক-দেড় মাস। আসার সময় লাগেজ ভর্তি কসমেটিকস, জামা-কাপড় নিয়ে আসে রোজিনা এবং তার বাপের বাড়ির সবার জন্য। বিশেষ করে রোজিনার বড় বোন শাকিলা এবং তার দুই মেয়ের জন্য আলাদা একটি লাগেজ থাকে প্রতিবারই। ফলে রোজিনার সঙ্গে বড় বোন শাকিলার সম্পর্কটা একটু গভীরই বলা চলে। শাকিলাদের বাসায় তার যাওয়া আসা খুব বেশি না হলেও যখন আসে বেশ কয়েকদিন বেড়ায় এখানে। রুমানা-সুমনাকে অনেক আদর করে তাদের রোজিনা খালা। বেড়াতে এলে বোন এবং দুই ভাগ্নিকে নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়, বড় বড় শপিংমলে গিয়ে অনেক কেনাকাটা করে। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে, অন্যান্য নামিদামি খাবার দোকানে ঢুঁ মারে। কত কী খাওয়া-দাওয়া করে। স্বামীসঙ্গ সুখ থেকে বঞ্চিত, অতৃপ্ত একজন নারী এভাবেই নিজের অপ্রাপ্তিগুলো ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু নিত্যদিন চারপাশে অন্য আটদশজনকে স্বাভাবিক জীবনে স্বামী-সন্তান নিয়ে সময় পার করতে দেখে এক ধরনের হতাশার গস্নানি পেয়ে বসে তাকে। তার তো সবই ছিল। দারুণ রূপসী, সুন্দর চেহারা, চমৎকার শরীরের গড়ন, যে কোনো পুরুষকে আকর্ষণ করার যাবতীয় গুণ- সবই থাকার পরও কেন তাকে এমন অতৃপ্ত অসুখী জীবনের অস্বস্তি, কষ্ট-দুঃখ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। রোজিনার জন্য এলাকার সব যুবক রীতিমতো পাগল ছিল। যখন স্কুলে যেত, পথে-ঘাটে কত ছেলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত তাকে দেখার জন্য, নানা ছুতোয় তার কাছে আসার চেষ্টা করত, কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে থাকত। তাদের চোখে 'বিশ্বসুন্দরী' ছিল রোজিনা। অনেকে আড়ালে-আবডালে, কেউ কেউ প্রকাশ্যে তাকে এ নামে ডাকত। তাকে মুগ্ধ করার জন্য তার মন জয় করতে এলাকার যুবকদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলত। তখন সে মনে মনে ভীষণ উপভোগ করত ব্যাপারটা। যদিও তা কারো সামনে প্রকাশ করত না। অনেকটা রাজরানীর মতো ভাব নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত রোজিনা। তার চলে যাওয়া দেখে কতজনের হৃদয়ে অদ্ভুত শিরশির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ত তার হিসাব ছিল না। ব্যাপারটা এলাকার সবাই জানতো। এলাকার গণ্যমান্য সুরুজ মেম্বারের মেয়ে বলে তাকে কেউ সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দিতে ভয় পেত। এছাড়া বড় বোন শাকিলার বিশেষ নজরদারিতে ছিল রোজিনা। অনেকটা চোখে চোখে রাখতো সে ছোট বোনটিকে। নানাভাবে সাবধান করত, অসময়ে না বুঝে না শুনে কারো প্রেমের ফাঁদে পড়া যাবে না। তাহলে সবকিছু বরবাদ হয়ে যাবে। জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। জীবনভর পস্তাতে হবে। চেনাজানা ছেলেদের মধ্যে কাউকে কাউকে বেশ লাগতো রোজিনার। তাদের কথাবার্তা, কাছে আসা, সান্নিধ্য- তাকে ভেতরে ভেতরে উতলা করলেও কোনো সময়ে তা প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। স্কুলের গন্ডি পেরোতেই একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছিল। তেমন সুন্দরী মেয়েকে এভাবে ঘরে রাখলে কোন সময় কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে কে জানে। ভয় ছিল মা-বাবা, ভাইবোনদের। এ দেশের প্রায় সব পরিবারের একই অবস্থা। মেয়ে সুন্দরী হলে, বয়সটা বাড়তে থাকলে পরিবারের অভিভাবক এবং অন্য সবার মধ্যে এক ধরনের টেনশন, অস্বস্তি বাড়তে থাকে। কেউ কেউ হয়ত সেই টেনশন আর অস্বস্তিটাকে এড়িয়ে মেয়েটিকে আরো লেখাপড়া করে জীবনে এগিয়ে যেতে সুযোগ করে দেয়। আবার বেশির ভাগই দ্রম্নত বিয়ে দিয়ে পাত্রস্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। রোজিনার বেলায়ও তাই ঘটেছিল। পাত্র ইতালি প্রবাসী। অবস্থাসম্পন্ন ঘর। বয়সটা একটু বেশি হলেও অপেক্ষাকৃত কমবয়সি, সুন্দরী বউ পেতে লোকটির তেমন বেগ পেতে হয়নি। মেয়েপক্ষ মানে রোজিনাদের পরিবার তেমন পাত্র পেয়ে বর্তে গিয়েছিল। শুরুতে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে-থা করে সংসারি হতে মন না চাইলেও ইতালি প্রবাসী স্বামীর আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় বিলাসী জীবনের হাতছানিতে তার মনটা ঘুরে গিয়েছিল। যে স্বপ্ন নিয়ে ইতালি প্রবাসী অবস্থাপন্ন স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত জীবন শুরু করেছিল, তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে বেশি দিন লাগেনি রোজিনার। বিয়ের পর মাত্র কয়েকদিন স্বামীর সঙ্গে একান্ত কাটানোর পর তার উপলদ্ধি হয়েছিল, লোকটার বয়স একটু বেশি হলেও তেমন সমস্যা ছিল না। যদি সে তার বউয়ের শারীরিক আকাঙ্ক্ষা ঠিকভাবে পূরণ করতে পারত। তাহলে আক্ষেপ ছিল না। তারপরও রোজিনার শেষ ভরসা ছিল, যদি তার স্বামী তাকে একটা সন্তান দিতে সক্ষম হয়। অনেক পুরুষ তার বউকে পরিপূর্ণভাবে তৃপ্তি দিতে অক্ষম হলেও সন্তান দেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকে। তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়। জীবনটা কোনোভাবে, দায়সারাভাবে কেটে যায়। তাদের দাম্পত্য জীবনের গভীরতম বিষয়গুলো বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। হয়তো স্বামীটি তার অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা নিয়ে তার বউয়ের কাছে যায়, সময় কাটায়। জীবনভর মানুষটি এক ধরনের দুঃখবোধ, অপরাধবোধ, অনুশোচনার গস্নানি বয়ে বেড়ায়। বাইরে থেকে দেখে বোঝা না গেলেও এরকম অনেক মানুষ রয়েছে চারপাশে- ঘরে ঘরে। \হবিয়ের আগে কত যুবক, কত পুরুষ তার জন্য কী রকম পাগল ছিল। তাকে ভালোবেসে নিজেকে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ছিল। তাদের কারো সঙ্গে যদি নিজের জীবনটা জড়িয়ে যেত তার, তাহলেও কী তেমন ঘটতো তার জীবনে? বোধ হয়, তেমনটি ঘটত না। তখন হয়ত জীবনটা অন্যরকম হতো- রোজিনা মাঝে মাঝে ভাবে। হঠাৎ তার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অনেক যুবকের মন ভেঙে গিয়েছিল। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল তারা। হয়ত সেই সব ভাঙা হৃদয়ের অভিশাপে তার জীবনটা এমন হয়েছে। প্রবাসে প্রচুর উপার্জন করা পয়সাঅলা স্বামী, প্রাচুর্য, বিলাসী জীবন- সবই পেয়েছে। কিন্তু দেহমনে সুখের নাগাল পায়নি সে। এখন পর্যন্ত তার কোলজুড়ে কোনো সন্তান আসেনি। একটা ছেলে কিংবা মেয়ে থাকলে তাকে অবলম্বন করে সব না পাওয়ার দুঃখ, হতাশা, গস্নানি ভুলে থাকতে পারত। কার অভিশাপে তার জীবনটা এমন মরুময়, অশান্ত, অসুখী হয়ে গেল? রোজিনা নিজের দুঃখবোধগুলোকে চাপা দিয়ে রাখতে নানাভাবে চেষ্টা করলেও সেগুলো কোনো না কোনোভাবে আবার তার পিছু নেয়, এলোমেলো করে দিতে চায় সবকিছু। তার মন চায়, বিদ্রোহী হতে। বেপরোয়া হয়ে নিজের আনন্দ-সুখ, পরিতৃপ্তির জন্য কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে অস্থিরতা পেয়ে বসে। কিন্তু দূর প্রবাসে থাকা স্বামীর কথা ভেবে, শ্বশুর বাড়ির সম্মান মর্যাদা ইত্যাদির কথা ভেবে চুপসে যায় ভেতরে ভেতরে। যদি সে চায় নিজের চাহিদা মেটাতে গোপনে কত কী করে ফেলতে পারে। কেউ তা জানতেও পারবে না, বুঝতেও পারবে না। কিন্তু নিজের বিবেকের সঙ্গে লড়াই করে বারবার হেরে যায় রোজিনা। ভেতর থেকে বিবেক তাকে বাধা দেয়, নিবৃত্ত করে। নিজেকে বিচু্যত করতে চেয়েও পারে না। কিন্তু সে এভাবে কতদিন পারবে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে- প্রশ্ন করে বারবার। অথচ জবাব পায় না সেসব প্রশ্নের। শুরুতে বড় বোন শাকিলার মুখে তেমন প্রস্তাব শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল রোজিনা। বিভিন্ন সময়ে প্রবাসী স্বামীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য বঞ্চিত রোজিনার মনে মনে নিজের শরীরে জেগে ওঠা বাসনা পূরণে দুর্দান্ত বেপরোয়া হয়ে উঠতে চাইলেও নিজেকে অনেক কষ্টে দমন করে এসেছে পারিবারিক মূল্যবোধ, সম্মান, মর্যাদা বদনাম ইত্যাদির কথা ভেবে। কিন্তু বড় বোনের বাসায় বেড়াতে এসে তার দুই মেয়ের গৃহশিক্ষক, একজন পরপুরুষ শরিফুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর প্রস্তাব শুনে প্রথমে সে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। আগেও বহুবার এ বাসায় এসেছে সে বেড়াতে। তখন রুমানা-সুমনার গৃহশিক্ষক শরিফুলকে দূর থেকে দেখেছে বেশ কয়েকবার। কথাবার্তাও হয়নি তখন। কিন্তু তখন দূর থেকে দেখে কথাবার্তা শুনে তাকে ভদ্র এবং ভালো মানুষ মনে হয়েছে। কিন্তু শাকিলার প্রস্তাব শুনে মনে হয়েছে, অনেকটা বাধ্য হয়ে চাপে পড়েই শরিফুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর জন্য বলছে সে। এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তাদের। প্রথমে শুনে ভীষণ খারাপ লাগলেও তার মনেও এরকম কিছু একটা করার বাসনা সুপ্ত ছিল। শাকিলার বাসায় বেড়াতে এসে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের অগোচরে তেমন বাসনা পূরণের চমৎকার সুযোগ পেয়ে মনে মনে আবার খুশিও হয়েছিল রোজিনা। এভাবে পরপর বেশ কয়েকবার বড় বোনের বাসায় ঘন ঘন বেড়াতে এসে শরিফুলের সঙ্গে রোজিনার ঘনিষ্ঠতা বেশ জমে ওঠে। রোজিনা প্রথমে ভেবেছিল, শুধুমাত্র তাকে বিশেষভাবে পছন্দ করেছে বলে তার সঙ্গে শরিফুল গোপনে সম্পর্কটা গড়েছে। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে শরিফুলের আসল রূপটা জানার পর তার নিজের ওপর ঘৃণা জেগেছে। লজ্জা আর অপমানে কোনোভাবে শাকিলাদের বাসা থেকে পালিয়ে বেঁচেছে। শরিফুল এর আগে তার বড় বোন শাকিলা এবং তার দুই মেয়ে রুমানা ও সুমনাকে একইভাবে....। আর ভাবতে পারে না সে। ২ বড় বোন শাকিলার বাসা ছেড়ে পালিয়ে শ্বশুরবাড়ি কেরানীগঞ্জে চলে এলেও শরিফুল তার পিছু ছাড়েনি। এক সঙ্গে কাটানো ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোর ছবি ও ভিডিও মোবাইল ফোনের মেসেঞ্জারে, হোয়াটসআপে পাঠিয়ে বলেছে, নগদ ১০ লাখ টাকা না দিলে এসব ছবি আর ভিডিও ছড়িয়ে দেবে সবখানে। ইতালিতে রোজিনার স্বামীর কাছে পাঠাবে। আর এ ছবি ও ভিডিও যদি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ইতালি প্রবাসী স্বামীর চোখে পড়ে, তাহলে তার অবস্থা কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে? কারো সামনে দাঁড়াতে পারবে না সে। দূর দূর করে শ্বশুর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে তারা। শরিফুল যাতে তেমন কিছু না করতে পারে- তার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তার সর্বনাশা খেলা বন্ধ করতে হলে চাহিদা মতো আগে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। টাকা পেলেও শরিফুল তাকে ছেড়ে দেবে- এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, টাকা পেলে তার লোভ আরো অনেক বেড়ে যাবে। এরপর আরো লোভী হবে, আরো ভয়ংকর, বেপরোয়া হবে সে। কিন্তু শরিফুলকে নিবৃত্ত করতে হলে একসঙ্গে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। ইতালি থেকে স্বামীর পাঠানো অনেক টাকা ব্যাংকে জমা পড়ে আছে। এসব টাকা রোজিনার নামে খোলা ব্যাংক হিসাবেই রয়েছে। নিজের কিছু ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে এতগুলো টাকা এক লম্পটের হাতে তুলে দিতে মন না চাইলেও একটি সময়ে তাকে হার মানতে হয়। সবার অগোচরে শরিফুলের দাবি করা ১০ লাখ টাকা গোপনে দিয়ে দেয় রোজিনা। শাকিলা কিংবা তার দুই মেয়ে রুমানা-সুমনাকেও জানতে দেয় না সে ব্যাপারটা। বরং এ বাসায় শরিফুলের সঙ্গে একান্তে কথা বলে পুরো ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে এসে আবারও তার লালসার শিকার হতে হয় তাকে। তখনই রোজিনা সিদ্ধান্ত নেয়, এই জঘন্য চরিত্রের লম্পটটাকে যত দ্রম্নত সম্ভব পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় করতে হবে। শরিফুলকে খুন করার নীলনকশা করতে থাকে সে মনে মনে। তবে যা করবে সে বড় বোন শাকিলাকে সঙ্গে নিয়ে করতে চায়। কারণ, একজন সাধারণ গৃহবধু হিসেবে এতবড় একটা ঝুঁকিবহুল, বিপজ্জনক কাজ একাকী করতে পারবে না। তাছাড়া তার আজকের এই পরিণতির জন্য তো বড় বোন শাকিলাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। সে ই তো সেদিন নিজের স্বার্থে শরিফুলের লালসার শিকার হতে প্ররোচিত করেছিল। বড় বোন হিসেবে যদি সেদিন সে রোজিনাকে এই জঘন্য পাপ কাজে জড়াতে উৎসাহিত না করত তাহলে আজকের এই ভয়ানক বিপদের মুখোমুখি হতে হতো না তাকে। \হ ৩ কিছু অবৈধ গোপন সম্পর্কের জেরে শাকিলা, রোজিনা, রুমানা ও সুমনার মনে শরিফুলের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছে। তারা প্রত্যেকেই এই লম্পট, অমানুষের কবল থেকে রক্ষা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। শরিফুলের অপকর্ম আর অপরাধের শেষ নেই। কিন্তু তার বিরুদ্ধে পুলিশ কিংবা অন্য কোথাও অভিযোগ জানানোর উপায় নেই। চাইলেই থানায় গিয়ে নয়তো ঘরে বসেই ট্রিপল নাইনে ফোন করে শরিফুলের বিরুদ্ধে তার যাবতীয় অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা যায়। কিন্তু এর মাধ্যমে ভেতরের অনেক গোপন বিষয় প্রকাশ্যে জনসমক্ষে চলে আসবে। যা এতদিন সবার আড়ালে ছিল, তার সবই জানাজানি হবে। তারা তখন এই সমাজে মুখ দেখাবে কীভাবে? সবাই তাদের আসল রূপটা জেনে ফেলবে। এরপর থেকে এখানে সম্মান, মর্যাদা নিয়ে থাকতে পারবে না। এত সব কথা ভেবে তারা বারবার পিছিয়ে এসেছে। কিন্তু এভাবে তো বেশি দিন মুখ বুঁজে থাকাও সম্ভব হবে না। শরিফুলের লাম্পট্য আর লোভ-লালসার শিকার হতে হতে এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে থাকে তারা চারজনই। রোজিনা বড় বোন শাকিলাকে আজকের পরিণতির জন্য দায়ী করে। এ থেকে রক্ষা পেতে ভালো কোনো উপায় খুঁজে বের করতে বলে, আপা, তোরা মা আর দুই মেয়ে মিলস্ন্যা আমারে চরম সর্বনাশের পথে টাইন্যা আনছস। এই পাপের পথে আমি হাঁটিনি আগে কোনো সময়ে। ইচ্ছা জাগলেও দাঁতে দাঁত চাইপ্যা সবকিছু দমাইয়া রাখছি। সব সহ্য করছি। কিন্তু সেই দিন আপা তুই তোর নিজের স্বার্থে আমারেও একই পথে নামাইলি। আমি আগ পিছ কিছু না ভাইব্যা জড়াইয়া পড়লাম ঐ ভয়ংকর লম্পটের জালে। এখন তো আর পারতেছি না। এই শয়তানডার হাত থেকে বাঁচতে কিছু একটা উপায় বের করতে হইবো আমাদের। কিন্তু শরিফুলের কবল থেকে রক্ষা পেতে কিছু একটা করতে গেলে মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। সেটা সামাল দেওয়াটা কঠিন হবে তাদের জন্য। খুন-খারাবির মতো ব্যাপার ঘটে গেলে পুলিশ আসবে, মামলা হবে তদন্ত করবে। সব কিছুর খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে এক সময় আসল ঘটনা জানাজানি হবে। এ ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে নিশ্চয় পুলিশ আটক করে জেলে পাঠাবে। মার্ডার কেসের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে তার শাস্তি নির্ঘাৎ মৃতু্যদন্ড হবে। ফাঁসিতে ঝুলতে হবে শেষ পর্যন্ত! একজন লম্পট, অমানুষকে সাজা দিতে গিয়ে নিজেরাই ভয়ংকর বিপদে পড়ে যাব। নানাভাবে বিভিন্ন দিক চিন্তাভাবনা এবং বিচার বিশ্লেষণ করে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়ে তারা প্রত্যেকেই। কিন্তু শরিফুলের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। যে কোনো মূল্যে এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নেয় তারা। \হ৪ বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দেখলে আজকাল যে কেউ আঁতকে ওঠেন। দূষণের কবলে পড়ে বুড়িগঙ্গা ঐতিহ্য যেমন হারিয়েছে, তেমনিভাবে সৌন্দর্য বিলীন হয়েছে উৎকট কালো বর্ণের বিষাক্ত পানিতে। লঞ্চে কিংবা নৌকায় নদী পাড়ি দিতে গিয়ে যাত্রীদের দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় পানির ভয়াবহ দুর্গন্ধে। বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ বেশি থাকায় কালো বর্ণ কিছুটা হালকা হয়ে আসে বটে। তবে আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা হয়ে ওঠে না। বৃষ্টি না হলে আবার নদীর আশপাশের পরিবেশ দূষিত পানির দুর্গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে। সেই বুড়িগঙ্গায় নৌকার মাঝিরা বস্তাবন্দি একটি লাশ খুঁজে পায়। কয়েকদিন আগে বস্তাবন্দি লাশটি নদীতে ফেলেছে কেউ। প্রথমে ডুবে গেলেও পরে পঁচে ভেসে উঠেছে। আজকাল বুড়িগঙ্গায় মাঝে মধ্যে তেমন লাশের দেখা মেলে। সব লাশের পরিচয় মেলে না অনেক সময়। আবার পুলিশ কোনো কোনো লাশের পরিচয় খুঁজে পেয়ে তদন্ত শুরু করে। এক পর্যায়ে আসল খুনি, অভিযুক্ত, দায়ী অপরাধীদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ, রিমান্ড ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে খুনের পেছনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আর নদীতে পাওয়া অজ্ঞাত লাশের দাবিদার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ না এলে বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দেওয়া হয়। অজ্ঞাত হিসেবে হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। শরিফুলের ভাগ্য ভালোই বলা যায়। বুড়িগঙ্গা নদীতে বস্তাবন্দি লাশটি কয়েকদিন ডুবে থাকার পর শেষ পর্যন্ত পঁচে ভেসে উঠেছিল। পঁচে ফুলে যাওয়া লাশটিতে নদীর রাক্ষুসে মাছের নজর পড়েছিল। তারা এসে বেশ কয়েকবার ঠুকরে খাওয়ার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী মনে করে খায়নি। বোধ হয় অরুচি লেগেছে। তাই ছেড়ে অন্যদিকে চলে গেছে রাক্ষুসে মাছের দল। মাছে না খেলেও তার মুখের নানা অংশের মাংস খুলে যাচ্ছিল। তেমন অবস্থায় তাকে কোনোভাবেই শনাক্ত করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু প্রত্যেকটি খুনের ঘটনায় কিছু আলামত, প্রমাণ রয়ে যায়। যার মাধ্যমে খুনিদের ধরতে সক্ষম হয় পুলিশ, গোয়েন্দারা। এটাই যেন পৃথিবীর অনেক অলিখিত নিয়মের মধ্যে একটি। শরিফুলের প্যান্টের পকেটে তার মানিব্যাগটি অক্ষত ছিল। সেই মানিব্যাগে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্রটি লেমিনেটেড হওয়ায় পানিতে ডুবে থাকার পরও তা নষ্ট হয়নি। পুলিশ সেই জাতীয় পরিচপত্রের সূত্র ধরে তার পরিচয় জেনে নেয় খুব সহজেই। বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে শরিফুলের ব্যাপারে অনেক তথ্য জানতে পারে পুলিশ এবং এভাবেই তার রহস্যজনক হত্যার ঘটনার পেছনে সন্দেহভাজন হিসেবে শাকিলা বেগম এবং তার দুই মেয়ে রুমানা ও সুমনাসহ শাকিলার ছোটবোন রোজিনাকে পুলিশ আটক করে।