নিশাচর

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

অরূপ রতন
রাতে ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকানো যায় না। পোকা কিলবিল করে। কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে পোকাদের দৌড়ঝাঁপ আর ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে ভালোই লাগে চন্দনের। রাতে হাঁটতে বের হলে চন্দন প্রথমে ল্যাম্পপোস্টের দিকে যায়। পোকা-মাকড়ের দৌড়ঝাঁপ দেখার জন্য। আজও সে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণ ভরে উপভোগ করছে পোকা-মাকড়ের দৌড়ঝাঁপ খেলা। কী ভয়ঙ্কর! চন্দনের কাছে এটি রীতিমত ভয়ঙ্কর খেলা। পোকাগুলো ল্যাম্পপোস্টের নিচে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাচ্ছে। মৃতু্য গ্রাস করছে ওদের প্রাণ। কী আশ্চর্য! তাতে কারো মাথা ব্যথা নেই। যেন সবাই মেতেছে জীবনযুদ্ধে। হয় বাঁচব, নয় মরব এমন সংকল্পে আবদ্ধ সবাই। চন্দন অবাক হচ্ছে। সে ভাবছে, 'কী আছে এই আলোর মধ্যে। যা উদ্ধারের জন্য পোকাগুলো চালাচ্ছে ভয়ঙ্কর অভিযান। যেন মৃতু্যকেও পরোয়া করছে না সাহসী যোদ্ধার মতো। রীতিমত তেনজিং হিলারির এভারেস্ট জয়ের অভিযান। যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ লড়ে যাব। শীর্ষ বিন্দুতে কী আছে দেখবই। হয় সফলতা, নয় মৃতু্য। অবশেষে তারা এভারেস্ট জয় করল।' কিন্তু কী আছে এই আলোর মধ্যে, যা আবিষ্কারের নেশায় পোকাগুলো অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে। গভীর চিন্তার বিষয়। একটু সময় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। যেনতেনভাবে কোনো কঠিন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে নেই। ল্যাম্পপোস্টের নিচে পোকা-মাকড়ের দৌড়ঝাঁপ চন্দনের কাছে রীতিমত কঠিন বিষয়। সামনে ফাঁকা রাস্তা। চন্দন গন্তম্যহীনভাবে হাঁটছে। কিছু পথ পেরুতেই ওভারব্রিজ। অন্ধকারের মধ্যে তিনজন মহিলা আসছে। এত রাতে কোনো ভদ্র মহিলাকে নিশ্চয় বাজারে দেখা যায় না। যাদের দেখা যায় তারা হলো নিশিকন্যা। চন্দন মহিলা তিনজনকে চিনতে পারল। গত কয়েক রাতে তার সঙ্গে ওই মহিলা তিনজনের কয়েক দফায় সাক্ষাৎ হয়েছে। এত রাতে নিশ্চয় খদ্দের বিদেয় করে ফিরছে। এদের দেখা যায় সন্ধ্যায় রেল স্টেশনে বা সিনেমা হলের সামনে। খদ্দের জুটিয়ে সময় কাটায়। চন্দন দূরে সরে গেল। এখন ওদের ছায়াও অপবিত্র। চন্দন লক্ষ্য করল একটি পুলিশ ভ্যান ওই মহিলা তিনজনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মহিলা তিনজন পালাতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। কনস্টবেল জোর করে তাদের গাড়িতে তুললেন। চন্দন দূর থেকে মহিলা তিনজনের চিৎকার শুনতে পেল। সে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার গাড়ি থানার দিকে টান দিলে চন্দন আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। সামনে সুনসান। মুহূর্তে আবার নীরবতা। সে উত্তরদিকে হাঁটতে শুরু করল। ঠান্ডা বাতাস বইছে। চারদিকে লাল-নীল আলোয় ভরপর। বড় বড় দালানগুলো স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে একফালি চাঁদ জোছনা ছড়াচ্ছে। অপূর্ব দৃশ্য। রাতের শহর আসলেই অন্য রকম। প্রকৃতি কত রূপেই না সাজায় নিজেকে। দিনে এক রকম রাতে আর এক রকম। মুহূর্তে যেন বদলে ফ্যালে দৃশ্যপট। প্রকৃতির লীলাখেলা বুঝা মুশকিল। চন্দন হাঁটতে হাঁটতে গায়তে লাগল ... 'আমার এ পথ চাওয়াতেই আনন্দ খেলে যায় রোদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত।' ব্রীজের এক পাশে কিছু মানুষ গোল হয়ে বসে আছে। এমন ভাব যেন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। চন্দন লক্ষ্য করল সবার মুখ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। হাতে গাঁজা ভরা বাঁশি। চক্রের মাঝখানে পড়ে আছে কয়েকটি সিগারেটের প্যাকেট আর অসংখ্য সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ। চন্দনের আর বুঝতে বাকি রইল না যে, এটা জয়নগর। সিদ্ধির আসর বসেছে। সে কোনো দিকে না তাকিয়ে ব্রিজের পূর্বপাশ দিয়ে হেঁটে তিনতলা বিশিষ্ট এক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। 'কে আপনি? এত রাতে কী চান?' সদর দরজা পেরিয়ে একজন জিজ্ঞেস করল। 'আমি চন্দন। কিছুই চাচ্ছি না। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।' 'এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?' 'কোথাও নয়। এই একটু হাঁটছি। ক্লান্তি বোধ করছিলাম। তাই ছাউনির নিচে দাঁড়িয়েছি।' 'দোতলার বেলকোনি থেকে দেখলাম কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ভূত না মানুষ তা যাচাই করার জন্য এলাম।' 'তার মানে এই বাড়িটা আপনার।' 'হঁ্যা, এই ঠিকানাটা নিয়েই আছি। বাই দা বাই, আমি মনোয়ার হোসেন। কী করেন আপনি?' 'এতদিন ছাত্র ছিলাম। পড়াশোনা শেষ তাই এখন বেকার। আপনি?' 'জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলাম। স্টেশন বাজার শাখা, নাটোর। এখন রিটায়ার্ড।' 'ঘুম আসছিল না বুঝি, তাই বেলকোনিতে পাইচারি করছিলেন।' 'একদম তাই। আপনি কী করে বুঝলেন!' 'অনেক কিছু আন্দাজ করে বলা যায়। অনেক সময় মিলেও যায়। যেমনটি আপনার বেলায় হলো।' 'আপনিতো বেশ ইন্টারেস্টিং মশাই।' 'একটা প্রশ্ন করি?' 'হঁ্যা হঁ্যা, করুন।' 'আমি একটা জটিল সমস্যার মধ্যে আছি। কোনো ক্রমেই সমাধান করতে পারছি না। আবার কারো সঙ্গে শেয়ারও করতে পারছি না।' 'আমাকে বলুন, আমি শুনছি।' মনোয়ার হোসেন আগ্রহ দেখালেন। 'আচ্ছা, আপনি কী বলতে পারবেন ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মৃতু্য অনিবার্য জেনেও পোকারা দৌড়াঝাঁপ করে কেন?' চন্দনের প্রশ্নে মনোয়ার হোসেন খানিকটা চমকালেন। তার ভ্রম্ন কুঁচকে গেল। কিছুটা বিস্ময়জড়ানো কণ্ঠে বললেন, 'আপনার মাথা ঠিক আছে জনাব।' প্রশ্নটা করে চন্দন বেশ বোকা বনে গেল। সে ইতস্তত করে বলল, 'ঠিক আছে আমি তাহলে আসি।' চন্দন সামনে পা বাড়াল। মনোয়ার হোসেন চন্দনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আস্তে আস্তে চন্দন রাতের আঁধারে মিশে চোখের আড়াল হয়ে গেল। মনোয়ার হোসেন দোতলার বেলকোনিতে আবার উঠে এলেন। তিনি অস্থির বোধ করছেন। তার মাথায় এখনো প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। মৃতু্য অনিবার্য জেনেও পোকাগুলো ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দৌড়াঝাঁপ করে কেন? মনোয়ার হোসেন গভীরভাবে ভাবছেন। বিষয়টা বেশ জটিল। তিনি এর সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনদিন পর চন্দন পত্রিকায় একটা সংবাদ দেখতে পেল। মো. মনোয়ার হোসেন। সাবেক ব্যবস্থাপক, জনতা ব্যাংক, স্টেশন বাজার শাখা, নাটোর। তিন দিন যাবত খঁঁঁঁুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংবাদটিতে চন্দনের চোখ আটকে গেল। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, 'লোকটি বেশ ভালো, হঠাৎ নিখোঁজ হলো কীভাবে। চন্দনের মন খারাপ হয়ে গেল। রাত প্রায় একটা বেজে ১০। চন্দন দূর থেকে লক্ষ্য করল কেউ একজন ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। লক্ষ্য করল মনোয়ার হোসেন খুব আগ্রহ নিয়ে ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে পোকা-মাকড়ের দৌড়ঝাঁপ খেলা দেখছেন। চন্দন পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মনোয়ার হোসেন বললেন, 'বিষয়টা খুব জটিল।' চন্দন আর মনোয়ার হোসেন ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব উদ্বিগ্ন তারা। চোখে মুখে ভয় আর হতাশা। রাত বাড়ছে কিন্তু কোনো সমাধান হচ্ছে না। একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে তিনটে রাত গভীর হচ্ছে। হঠাৎ চন্দন লক্ষ্য করল তাদের ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে। সবাই হতবাক হয়ে ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে আছে। এই কঠিন বিষয়টা নিয়ে সবাই চিন্তিত।