গাঁও গেরামের কথা

প্রকাশ | ১৫ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

আলমগীর খোরশেদ
বীর শ্রেষ্ঠ ঈশাখাঁর স্মৃতি বিজড়িত, বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর জন্মস্থান মহুয়া মলুয়ার দেশ কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার নারান্দী গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। বর্ষায় দুকূল ভাসিয়ে পানি চলে আসতো উঠোনে। বাহাদিয়ার খালের স্স্নুইস গেট খুলে দিলেই এমন হতো। একটু বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখেছি, দেখতাম চৈত্র-বৈশাখ মাসে গ্রামে প্রচন্ড অভাব। গৃহস্থালি কোনো কাজ থাকত না, ফলে দিনমজুররা অভাবে পড়ে খেয়ে না খেয়ে থাকত। চৈত মাইয়া টানা্ত-বলতে একটা কথাই ছিল তখন। অভাবী মানুষ ভাতের পরিবর্তে ঘেচু আলু, কলাগাছের মোচা, শাপলা ফুলের গাছ সিদ্ধ করে খেত। খুদের জাউ, কাউনের জাউ, খেত। তখন লোকজন বাড়িতে টয়লেট বানাতো না। জমির আইল, জঙ্গল অথবা মাটি গর্ত করে উপরে বাঁশের ছাউনি দিয়ে টয়লেট বানানো হতো। সারা গ্রাম হাঁটলেও তখন বিল্ডিং চোখে পড়তো না। ছনের ছাউনি দিয়ে ও পাটশোলার, বেড়াটিনের ঘরই ছিল বেশি। রাতে বেশির ভাগ মানুষ পা ধুইতো না। এভাবেই শুয়ে পড়ত। তখন গাছকাটা, ঘরের কাফ, তৈরিতে করাতি লাগত। করাতিরা চার-পাঁচজন মিলে ঘুরে ঘুরে কাজ খুঁজতো। যে বাড়িতে কাজ করত, সে বাড়িতেই থাকা-খাওয়া চলত। শীতের শুরুতে গ্রাম কে গ্রাম কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব হতো। লোকজন বলাবলি করত, শেষ রাতের দিকে, তিন ঠ্যাংওয়ালা একটা সাদা ঘোড়া দৌড়ে যেত। ঘোড়া যেদিক দিয়ে যেত, কলেরা রোগ হয়ে যেত সেই সব মানুষের। মানুষ বলস্নম তীর, লাঠিসোটা, এসব নিয়ে পাহারা দিত। বলত, 'আলীর হাতে জুলফিকার মায়ের হাতে তীর, 'যে দিকেততে আইছো গো বালা সেদিকে তে ফির।'-সবাই জোরে চিৎকার করত। চৈত্র মাসে অসহনীয় গরম সঙ্গে অনাবৃষ্টি কৃষকের ফসল নষ্ট হওয়ার উপক্রম। তখন গ্রামের লোকজন দল বেঁধে- আলস্নাহ মেঘ দে পানি দে, ছায়া দেরে তুই আলস্নাহ, বলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে টাকা-পয়সা, ধান, জোগাড় করত। পরদিন সকালে জমিতে অনুষ্ঠান। বড় দুটি ব্যাঙ ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দিত। গ্রামে দেখতাম কারও কিছু চুরি গেলে পিতলের বাটিতে তুলা রাশির একজনকে তাবিজ নিয়ে ধরলেই বাটি দৌড়াতে থাকে। কাউকে সাপে কামড় দিলে গ্রামের লোকজন কাঁচামরিচ খেতে দিত। ঝাল লাগলে বিষ নাই। কোনো কবরস্থান, বড় শিমূলগাছ, গাবগাছ দেখলেই ভয় লাগত, ভূত আছে কিনা। কোথাও থেকে মাংস রান্নার সুবাস আসলে বলত- : তাড়াতাড়ি থু থু ফ্যাল, শয়তানে রানতাছে। ছোটবেলায় শোনতাম মাছ খাওয়ার চেয়ে গরুর মাংস ভালো। কারণ, গরুর মাংস খেলে ভূত আসতে পারে না। তিন হাইনেজয়া মানে মাগরিবের সময় আজানের আগ মুহূর্ত। আম্মা বলতেন- : তিন হাইনেজয়া আর সুবেহ সাদিক এই দুই টাইমে শয়তান ঘুইরা বেড়ায়। ঘর তে বাইর অইস না। আর ওই সময়েই আমার টয়লেট চাপতো, তখনি আম্মার কথা মনে পড়ত। যদি বাইর অইয়া দেহি শয়তান আসমান আর মাডি জুইড়া কারাইয়া রইছে, ওরে বাবারে, আমি শেষ। বসে থেকে মনে মনে বলতাম, : আমার হাগা ধরিস না, বুড়ির হাগা ধর... ভাবতাম সেই বুড়ি কি আসলেই হাগা ধরছে এতক্ষণে? গোয়াল তার কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ডাক দিত, গরুর চিকিৎসা লাগবে কিনা। গ্রামে কারোর গরু মারা গেলে গোয়াল এসে চামড়া তুলে নিতো। গোয়ালকে সবাই দোষারোপ করত, যে ওই বেটাই গরুকে মেরে ফেলে চামড়া নেয়ার লোভে। তখন আমরা গ্রামে এখনকার মতো কিছুই পেতাম না। কাঠ পেন্সিল বা শ্লেটে লিখতাম। কলম কিনে দিত না। একটু বড় হয়ে দোকান থেকে রঙের চাকতি কিনে আনতাম। চাকতিগুলো বিভিন্ন কালারের হতো। এগুলো পানিতে ঘুলিয়ে কালি বানাতাম, তারপর পাটশোলা বা বাঁশের কঞ্চি ধার করে কেটে কলম বানাতাম। এই কলম বারবার কালিতে ভিজিয়ে লিখতে হতো। তারপর ক্লাস ফাইভে যখন, তখন ফাউন্টেনপেন কিনে দেন আব্বা। ফাউন্টেনপেনে কালি ঢুকাতে হতো। কালির দোয়াত কিনতাম। পরীক্ষার সময় কালির দোয়াতও নিতাম সঙ্গে, যদি কালি শেষ হয়ে যায়? দুধমালাই আইসক্রিম নিয়ে আসত সাইকেলের পিছনে ছোট একটা বাক্সে। আইসক্রিম... আইসক্রিম, বলে ঘণ্টি বাজা তো আইসক্রিমওয়ালা। আগে থেকে গাছের সুপারি, ধান জমিয়ে রাখতাম, পাঁচটা সুপারি দিয়ে একটা আইসক্রিম দিত। মিষ্টিওয়ালা কাঁধে ভাঁড় নিয়ে আসতো বিভিন্ন খাবার, মিষ্টি, মুরালি, তিলেস্নায়া, বেলুন এসব নিয়ে। ধান দিয়ে গজার খেতাম, সন্দেশ দিত সুপারির বিনিময়ে। মাঠা, খিসসা খেতাম গরমের দিনে। আমরা যদি রাতে খেতে না চাইতাম, আম্মা বলতেন... : এক রাইত না খাইলে এক চড়ুইপাখির শরীরের গোশতের সমান গোশত কমে যায়।-অথবা বলতেন- : তাড়াতাড়ি খা, আইজ্জোয়া তুফান আইবো। ভয়ে খেয়ে নিতাম, তারপর একটু পর পর আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম... : কই আম্মা, তুফান তো আইলো না, : আইবো কেমনে, তুফান তো আইতো চাইছিন, আলস্নাহ বইলা দিছে, যারা আম্মু আব্বুর কথা শোনে তাদের দিকে যেও না। গ্রামে কবরস্থান, শ্মশান, জঙ্গলে বড় গাছ এসবে ভয় পেলে বলত, : তাফা খাইছে, ভূতের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ শইলেস্নর মধ্যে অহনো আছে।- ভয়ে কবরস্থানের দিকে যেতাম না কখনো। প্রায় বাড়িতেই দেখা যেত, বাড়িতে ঢোকার গেটে নতুন মাটির ঢাকনা টানিয়ে রাখত। ঢাকনায় আরবিতে লেখা থাকত। এটা নাকি বাড়ি বন্ধন। সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবে বাড়িকে। গ্রামে কারেন্ট ছিল না। কুপিবাতি আর হারিকেন ছিল ভরসা। রাতে কুপিবাতি পিঠা কুঠার গাইলে রাখা হতো। কয়েকজন একসঙ্গে বসলে, কেউ যদি নতুন জামা, জুতা এসব পরে আসত, তাকে সবাই ছেঁকে ধরতো... : মিলাদ দে, নতুন জিনিসের ভূত মানেই সাদা কাপড় পরা মহিলা, এটা কমন ছিল গ্রামের আড্ডায়। আমরা বেশ বড় হয়েও জন্মদিনের পোশাকে গোসল করতাম। আমাদের পুকুরের ওপর ঝুলে থাকা চম্পাবতী ফুলের বড় গাছ ছিল। আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে গাছের উঁচু ডালে উঠে লাফ দিয়ে পানিতে পড়তাম। এটা যে কি আনন্দ, না করলে বুঝবে না কেউ। গ্রামের বিয়ে খুব আচার, রীতি, সংস্কার মেনে হতো। অনেক রাতে বরযাত্রী আসতো বর নিয়ে। কলাগাছ বা যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বাঁশের তৈরি গেটে বর আটকাতো। গেটে টাকা নিয়ে খুব তর্কবিতর্ক হতো। মজা ও ছিল বেশ। সারারাত বিয়ের গীত গাইতো মেয়েরা- : দুই হাতে দুই চান্দের বাতি, সারা রাতি জ্বলছে, কইনছেন জামাই আইতে কেন এত দেরি অইছে। শীতের সময় গ্রামে খুব ভোরে উঠে খড়, গাছের পাতা এনে আগুন জ্বালানো হতো। সবাই আগুনের চারপাশে গোল করে বসে আগুনের তাপ পোহাতো। জাম্বুরা দিয়ে বল বানিয়ে আমরা বৃষ্টিতে ফুটবল খেলতাম। কাদায় লুটোপুটি একেবারে। গ্রামে চিকিৎসাব্যবস্থা ছিলই না। একজন কবিরাজ ও একজন হোমিও ডাক্তার ছিলেন। আমি যখন ক্লাস নাইনে, আমার টায়পয়েড হয়। কবিরাজী চিকিৎসা চলে আঠারো দিন। আমার অবস্থা কাহিল। একটা ট্যাবলেট কিনতে ও থানা শহরে যেতে হতো। জঙ্গলে জলাশয়সহ বেশ কয়েকটি শিমূলগাছ, শেওড়াগাছ ও বেতের ঝোপ ছিল। প্রায় রাতেই এই ঝোপ থেকে দুটি বা তিনটি লাইট বের হয়ে শ্মশানের দিকে চলে যেত। দেখে সারারাত ও আর ঘর থেকে বের হতাম না। বাড়িতে আব্বা অনেক আখ করতেন। আট দশ খানি জমিতে। বাবুই পাখি থাকত আখ ক্ষেতে। রাতে জাল নিয়ে আখ ক্ষেতের মাঝখানে জাল উপরে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অন্য পাশ থেকে পাখিদের ধাওয়া দিত, ফলে বাবুই অন্ধকারে উড়ে এসে জালে বসত। তখনই জাল পঁ্যাচ করে পাখিটাকে ধরে লুঙ্গির খোচ্চের ভিতর রেখে দিতাম। গাঁয়ের সেই বিদু্যৎবিহীন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ, আম্মার পিছন পিছন কুপিবাতি নিয়ে ঘুরতাম, কখন আম্মা শুইতে যাবেন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার সময়ও আম্মাকে ছাড়া শুইতাম না। কোথায় হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো? যারা মরে যায়, পৃথিবী থেকে কোথায় যায়? সৌরজগৎ, বস্ন্যাকহোল, বিগব্যাঙ, কোন বলয়ে গেলে পাওয়া যাবে? যে মানুষটা মনের সব আবেগজুড়ে ঠাঁই নিয়ে হঠাৎ হারিয়ে গেল, তার সঙ্গেও দেখা হয় না, কথা হয় না সারাজীবন। এটা কেমন সামাজিক রীতি-নীতি? যার চিন্তায় নির্ঘুম কত রাত, কত কথা, কত স্মৃতি, কেমন আছে সে, কয়টা বেবি? বর কেমন আদর করে? কিছুই জানা হয় না। বাবা-মা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়ে কি দূর আকাশের শুকতারা হয়ে আছেন? আমার নিঃশব্দ কষ্টগুলো বাবা-মা কি বুঝতে পারেন, এতদূর আকাশের তারা হয়ে? জানা হয় না কিছুই।...