শত বছরে মৈমনসিংহ গীতিকা

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

সৌরভ দুর্জয়
মৈমনসিংহ গীতিকা। বয়স একশ বছর পূর্ণ করেছে। যা আমাদের জন্য সাধারণ কথার এক অসাধারণ উপহার বটে। স্বশিক্ষিত অপরিচিত কবিদের রচিত এই গীতিকার শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা সবই সাধারণ এবং গ্রাম কেন্দ্রিক। যা গীত হতো কৃষক, মাঝি, জেলে, কামার, কুমার, শ্রমিক তথা গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। কণ্ঠের সুর ঢেলে দিয়ে গ্রামের মানুষ নিবারণ করত দেহের ক্লান্তি। মুছে ফেলতো গায়ের ঘাম। মনের মরা নদীতে ডেকে আনতো উচ্ছ্বাসের বাণ। গ্রামীণ অবয়বে রচিত মনোহারি এই গীতিকায় আছে ধনী জমিদার পুত্রের কথা। আছে গ্রাম্য দরিদ্র সুন্দরী যুবতীর কথা। আছে গ্রামের কথা। আছে হাওরের ঢেউ। আছে কোড়া পাখি শিকারের বীরত্ব। আছে প্রেমের কথা। আছে বিরহের কথা। আছে নদীর কলতান। সঙ্গে রূপালি জোছনার মায়াবি হাসি। আছে মিলন। আছে বিরহ। আছে অতিব দুঃখের পথ। আছে বুক ভাঙা কাব্যিক ছন্দ। ব্যবহৃত হয়েছে পয়ার এবং ধুয়ার ছন্দ, মাত্রা, সুর। মৈমনসিংহ গীতিকার কবিদের তেমন কোনো একাডেমিক শিক্ষা সনদ ছিল না। তারা হয়তো করেনি কোনো পদ্ধতিগত গবেষণা। যোগ দেন নাই বড় বড় সাহিত্য সম্মেলনে। তবুও পশ্চিমা লোক গবেষক, সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মৈমনসিংহ গীতিকাকে শেক্সপিয়ার, ফ্রান্সিস জেমস চাইল্ড, হোমারের সাহিত্য কর্মের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং পশ্চিমা ফোকলরের সঙ্গে একটি সমন্তরাল সাহিত্য চিত্র অঙ্কন করেছেন। একশ' বছরের আগে মৈমনসিংহ গীতিকার গীত মুখে মুখে গেয়ে কৃষক হালচাষের ক্লান্তি দূর করত। মাঝি মনের মরা গাঙে জোয়ার আনতো। প্রযুক্তিবিহীন গ্রামের মানুষ একটু চিত্ত বিনোদনের জন্য মুখে মুখে গাইতো এই গীতি। গ্রামীণ অবয়বে মঞ্চস্থ হতো সত্য। তবে পুস্তক আকারে মলাট বন্দি ছিল না মৈমনসিংহ গীতিকা। এমনকি মৈমনসিংহ গীতিকা নামও ছিল না। এক একটি পালার এক একটা ভিন্ন নাম ছিল। যেমন মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কামলা, কঙ্ক ও লীলা ইত্যাদি। গ্রামের সাধারণ মানুষ সুন্দরভাবে সাজায় গোছায় ও বিশুদ্ধ ভাবে হয়তো উচ্চারণও করতো না মৈমনসিংহ গীতিকার এসব পালার নাম। মৈমনসিংহ গীতিকাকে বাংলায় পুস্তক আকারে মলাট বদ্ধ করেন আজ থেকে একশ বছর আগে ড. দীনেশচন্দ্র সেন। বাংলায় পুস্তক আকারে মৈমনসিংহ গীতিকা মলাট বদ্ধ করার আগে ড. দীনেশচন্দ্র সেন আট খন্ডের ইংরেজি মৈমনসিংহ গীতিকার পালগুলো প্রকাশ করেছিলেন বটে- যা হোক মৈমনসিংহ গীতিকাকে পুস্তক আকারে মলাট বদ্ধ করার রূপকার ড. দীনেশচন্দ্র সেন। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের জীবনী থেকে জানা যায় : তিনি ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহাকুমার বগজুড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯০ সালে কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় পলস্নী অঞ্চল ঘুরে ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ করে তা থেকে উপকরণ নিয়ে ১৮৯৬ সালে 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' নামে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেন। ১৯১১ সালে তার 'ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ খরঃবৎধঃঁৎব বইটি প্রকাশিত হলে পাশ্চাত্য মনীষীদের কাছে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ লাভ করেন এবং তার আওতায় 'মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা' সম্পাদনা করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি. লিট ডিগ্রি এবং ১৯৩১ সালে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করে। ভারত সরকার ১৯২১ সালে তাকে 'রায় বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করেন। মৈমনসিংহ গীতিকা গ্রন্থটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনসমূহ আবিষ্কার ও সেসবের আধুনিক বিশ্লেষণে বাংলা সাহিত্যকে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করেন এবং বৈষ্ণব সাহিত্যের রস আস্বাদনে ও বাঙালি স্বরূপ সন্ধানে তিনি এক প্রকার পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। উনিশ শতকের শেষার্ধ বাঙালি জাতীয় মানসে স্বাজাত্য চেতনার যে ভাবাবেগ সৃষ্টি হয় দীনেশচন্দ্র সেনের জীবনবোধ তা থেকেই পুষ্টি লাভ করেছে। আত্মআবিষ্কার ও ঐতিহ্য অনুসন্ধানের ব্রত নিয়েই তিনি সাধকোচিত নিষ্ঠায় আমৃত্য সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। এই মহান ব্যক্তি ১৯৩৯ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতায় পরোলোক গমন করেন। ড. দীনচন্দ্র সেন শুধু মৈয়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা সম্পাদনা। 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য' কিংবা 'ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমষধ খরঃবৎধঃঁৎব' রচনা করেই তৃপ্তি লাভ করেন নাই। তার উৎসাহে এবং সহযোগিতায় জসীমউদ্‌দীন পলস্নীকবি হয়ে উঠেন। জসীমউদ্‌দীন যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র তখন তার কবর কবিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রবেশিকা শ্রেণির পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ভূমিকা অবর্ণনীয়। \হড. দীনেশচন্দ্র সেন কীভাবে মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করিয়াছিলেন তা ১৯২৩ সালের ২৪ নভেম্বর, ৭, বিশ্বকোষ লেন, বাগবাজার, কলিকাতায় বসিয়া মৈমনসিংহ গীতিকার যে ভূমিকা লিখিয়াছিলেন তা থেকে, ড. দীনেশচন্দ্র সেনের বয়ানে জানা যায় : ১৯১৩ খৃ. অব্দে মৈমনসিংহ জেলার 'সৌরভ' পত্রিকায় শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে প্রাচীন মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর সমন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। গ্রন্থকার চন্দ্রাবতীর কাহিনীর মর্মাংশটুকু মাত্র দিয়ে ছিলেন। কিন্তু যেটুকু দিয়ে ছিলেন, তাহা একে বারেই চৈত্র-বৈশাখী বাগানের ফুলের গন্ধে ভরপুর; সেই দিন কেনা রামের উপাখ্যানের সারাংশের ওপর আমার অনেক চোখের জল পড়েছিল। \হএই চন্দ্রকুমার দে কে, কেনারামের কবিতাটিই বা আমি কোথায় পাই, এই হলো আমার চিন্তার বিষয়। 'সৌরভ' সম্পাদক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মজুমদার মহাশয় আমার পুরাতন বন্ধু। আমি চন্দ্রকুমারের সম্বন্ধে তাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, চন্দ্রকুমার একটি দরিদ্র যুবক, ভালো লেখাপড়া শিখিতে পারেন নাই, কিন্তু নিজের চেষ্টায় বাঙ্গালা শিখিতে শিখিয়াছেন। আরও শুনিলাম, তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃতি হইয়াছে এবং তিনি একেবারে কাজের বাহিরে গিয়াছেন। এই ছড়াটির কথা চন্দ্রকুমার এমনই মনোজ্ঞ ভাষায় লিখিয়াছেন যে, উহাতে আমি তাঁহার পলস্নী কবিতার প্রতি উচ্ছ্বসিত ভালোবাসার যথেষ্ট পরিচয় পাইয়াছিলাম। আমি মৈমনসিংহের অনেক লোকের নিকটে জিজ্ঞেস করিলাম, কিন্তু কেহই তথাকার পলস্নীগাথার আর কোনো সংবাদ দিতে পারিলেন না। কেহ কেহ ইংরাজি শিক্ষার দর্পে উপেক্ষা করিয়া বলিলেন, 'ছোটলোকেরা, বিশেষত মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুন্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কী থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ ওরপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন? আপনি এই ছেঁড়া পুঁথি ঘাঁটা দিন কয়েকের জন্য ছাড়িয়া দিন।' \হকিন্তু আমি কোন অজানিত শুভ মুহূর্তের প্রতীক্ষায় রহিলাম। কোন্‌ দিন পলস্নী দেবতা আমার উপর তাঁহার অনুগ্রহ হাস্য বিতরণ করিবেন এবং কবে তাঁহার কৃপাকটাক্ষে মৈমনসিংহের এই অনাবিষ্কৃত রত্নখনির সন্ধান পাইব- ইহাই আমার আরাধনার বিষয় হইল। ইহার দুই বৎসর পরে, হঠাৎ একদিন কেদার বাবুর চিঠি পাইলাম। তিনি লিখিলেন- চন্দ্রকুমার অনেকটা ভালো হইয়াছেন এবং শীঘ্র কলিকাতায় আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিবেন। তাঁহার আরও চিকিৎসা দরকার। স্ত্রীর দুই-একখানি রৌপ্যের অলঙ্কার ছিল, তাহাই বিক্রি করিয়া চন্দ্রকুমার পাথেয় সংগ্রহ করিলেন এবং ১৯১৯ সালে পূজার কিছু পূর্ব্বে বেহালায় আসিয়া আমাকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন। রোগে-দুঃখে- মুখ পান্ডুবর্ণ- অর্দ্ধাসনে বিশীর্ণ ত্রিশ বৎসর বয়স্ক যুবক, অতি অল্পভাষী; তিনি পলস্নীজীবনের যে কাহিনী শুনাইলেন ও মৈমনসিংহের অনাবিষ্কৃত পলস্নীগাথার যে সন্ধান আমাকে দিলেন, তাহাতে তখনই তাহাকে আমার প্রিয় হইতে প্রিয়তর বলিয়া মনে হইল। এখানে শ্রীযুক্ত যামিনী ভূষণ মহাশয় বিনামূল্যে তাঁহার চিকিৎসার ভার লইলেন এবং শ্রীযুক্ত গোপাল দাস চৌধুরী মহাশয় কতক দিনের তাঁহাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। আমি তাহার সংগৃহীত পলস্নীগাথা সমন্ধে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে বলিয়া একটা ব্যবস্থা করিব, তাঁহাকে এই ভরসা দিলাম। চন্দ্রকুমার এইভাবে কতক দিন এখানে কাটাইয়া দেশে চলিয়া গেলেন। কি কষ্টে যে এই সকল পলস্নীগাথা তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহা তিনি ও তাহার ভগবান জানেন এবং কতক আমি জানিয়াছি। ------- ড. দীনেশচন্দ্র সেনের বর্ণনায় চন্দ্রকুমারের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা হলো: চন্দ্রকুমার ১৮৮৯ খৃ. অব্দে মৈমনসিংহ নেত্রকোনার অন্তর্গত আইথর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি গ্রাম্য পাঠশালায় সামান্যরূপ শিক্ষা লাভ করিয়া এক টাকা মাসিক বেতনে মুদিখানায় কাজ করিতেন। অনুপযুক্ত ও অমনোযোগী বলিয়া তাহার সেই কাজ চলিয়া যায়। তাহার পর দুই টাকা মাহিনায় একটি গ্রাম্য তহশিলদারি জোগাড় করেন। এই সূত্রে তাঁহার চাষাদের সঙ্গে অবাধে মিশিবার সুযোগ হয়। চাষারা তখন তন্ময় হইয়া এই সব পালা গাইতো, চন্দ্রকুমারও তাহাদের সঙ্গে তন্ময় হইয়া তাহা শুনিতেন। এই ভাবে পলস্নীজীবনের মাধুর্য ও কবিত্ব তাহার মনকে একেবারে দখল করিয়া বসিয়াছিল। তিনি এখন এমন সুন্দর বাঙ্গালা প্রবন্ধ লিখিতে পারেন যে, আধুনিক উচ্চশিক্ষিত নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সুলেখকগণের অনেকের সঙ্গেই তিনি প্রতিযোগিতা করিতে সমর্থ। এখানে বিশেষ ভাবে উলেস্নখ করা প্রয়োজন যে, চন্দ্রকুমার মাসিক দুই টাকার তহশীলদারি ছেড়ে দিয়ে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আনুকুল্যে মাসিক ৭০ টাকা সম্মানিতে মৈমনসিংহের গাথা সংগ্রহ করিবার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। চন্দ্রকুমার তিন-চার বছর পরিশ্রম করিয়া ২১ খানা পালা সংগ্রহ করেছিলেন। তা হলো : ১) মহুয়া-দ্বিজ কানাই প্রণীত ২) মালুয়া-গ্রন্থকারের নাম অজ্ঞাত, কেহ কেহ অনুমান করেন চন্দ্রাবতীর লেখা ৩) চন্দ্রাবতী ও জয় চন্দ্র- নয়নচাঁদ ঘোষ প্রণীত। ৪) কমলা-দ্বিজ ঈশান প্রণীত। ৫) কেনারাম- কেনারাম- চন্দ্রাবতী প্রণীত। ৬) রূপবতী-কবির নাম অজ্ঞাত। ৭) ঈশা খাঁ দেওয়ান- কবির নাম অজ্ঞাত ৮) ফিরোজ খাঁ দেওয়ান- কবির নাম পাওয়া যায়নি। ৯) মনোহর খাঁ দেওয়ান- কবির নাম পাওয়া যায়নি। ১০) দেওয়ান ভাবনা- কবির নাম অজ্ঞাত। ১১) ছুরত জামাল ও অধুয়া সুন্দরী-অন্ধকবি ফকির ফৈজু প্রণীত। ১২) জিরালনী- কবির নাম পাওয়া যায়নি। ১৩) কাজল রেখা- কবির নাম অজ্ঞাত। ১৪) অসমা- কবির নাম পাওয়া যায়নি। ১৫) ভেলুয়া সুন্দরী- কবির নাম অজ্ঞাত ১৬) কঙ্কা ও লীলা- রঘুসুত, দামোদর, শ্রীনাথ বনিয়া ও নয়নচাঁদ ঘোষ- এই চার কবির ভণিতা যুক্ত। ১৭) মদন কুমার ও মধুমালা- কবির নাম অজ্ঞাত। ১৮) গোপিনী-কীর্ত্তন- স্ত্রী কবি সুলাগাইন কর্তৃক রচিত। ১৯) দেওয়ানা মদিনা- মনসুর বয়াতি প্রণীত। ২০) বিদ্যাসুন্দর- কবি কঙ্ক প্রণীত। ২১) রামায়ন-চন্দ্রাবতী প্রণীত। এছাড়াও অনেক কবি ও যাত্রাপালা সংগৃহীত হয়েছিল ওই সময়ে যাতে ছত্রের সংখ্যা দাঁড়িয়ে ছিল ১৭,২৯৭টি। এর মধ্য হতে ১০টি গাথা নিয়ে মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশিত হয়েছিল। যা হলো: ১) মহুয়া ২) মলুয়া ৩) চন্দ্রাবতী ৪) কমলা ৫) দেওয়ান ভাবনা ৬) দসু্য কেনারাম ৭) কঙ্কা ও লীলা ৮) রূপবতী ৯) কাজল রেখা ১০) দেওয়ানা মদিনা। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ভূমিকা থেকে মৈমনসিংহ গীতিকার ১০টি পালার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা হলো : ১) মহুয়া : নমশূদ্রের ব্রাহ্মণ দ্বিজ কানাই নামক কবি (১৯২১ সাল থেকে) ৩০০ বছর পূর্বে এই গান রচনা করেন। প্রবাদ আছে কবি নিজে নমশূদ্র- সমাজের অতিহীন কুল-জাত এক সুন্দরীর প্রেমে মত্ত হয়ে বহু কষ্ট সয়েছিলেন এবং সে কারণেই নিজ অভিজ্ঞতা থেকে 'নদের চাঁদ' ও মহুয়া'র কাহিনীতে তিনি প্রাণ ঢালা সরলতা প্রদান করতে পেরেছিলেন। নদের চাঁদ ও মহুয়ার গান এক সময় পূর্ব ময়মনসিংহের ঘরে ঘরে গীত ও অভিনীত হতে। কিন্তু উত্তরকালে ব্রাহ্মণ ধর্মের কঠিন শাসনে এই গীতিবর্ণিত প্রেম দুর্নীতি বলিয়া প্রচারিত হয়। হিন্দুরা এই গানের উৎসাহ দিতে বিরত হন। বহু কষ্টে এই গীতিকার সম্পূর্ণ অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। গীতিকার প্রথম ১৬ ছত্রের স্তোত্র জনৈক মুসলমান গায়কের রচিত। গীতিবর্ণিত ঘটনার স্থান নেত্রকোনার নিকটবর্তী। খালিয়াজুড়ি থানার নিকট রহমতপুর হতে ১৫ মাইল উত্তরে 'তলার হাওড়' নামক বিস্তৃত 'হাওড়' ইহারই পূর্বে বামনকান্দি, বাইদার দীঘি, উলুয়াকান্দি, প্রভৃতি স্থান এখন জনমানবশূন্য হয়ে রাজকুমার ও মহুয়ার স্মৃতি বহন করছে। ১৯২১ সালের ৯ মার্চ চন্দ্রকুমার এই গাথা ড. দীনেশচন্দ্র সেনকে দিয়েছিলেন। এই গানে মোট ৭৫৫টি ছত্র আছে। ২) মহুয়া : গ্রন্থকারের নাম নাই। গোড়ায় চন্দ্রাবতীর একটা বন্দনা আছে। কেহ কেহ মনে করেন সমস্ত পালাটিই চন্দ্রাবতীর রচনা। কিন্তু ড. দীনেশচন্দ্র সেন তা বিশ্বাস করেন নাই। গীত বর্ণিত আরালিয়া গ্রাম ভাদৈর নদীর তীরবর্তী এবং কিশোরগঞ্জ হইতে ২২ মাইল উত্তর পূর্বে ; ইহার ৪/৫ মাইল দূরে 'সূত্যা নদীর কূলে চাঁদ বিনোদের বাড়ি ছিল, 'সূত্যা' নদী আরালিয়া হতে ৪/৫ মাইল দূরে অবস্থিত। 'মলুয়া' পালাটি চন্দ্রকুমার জাহাঙ্গীরপুরের উপকণ্ঠস্থিত 'পদ্মশ্রী' গ্রামের পাষাণী বেওয়া, রাজীবপুরের সেখ কাঞ্চা, মঙ্গলসিদ্ধির নিদান ফকির, খুরশীমলির সাধু ধুপী, সাউদ পাড়ার জামালদি সেক, দুলাইল নিবাসী মধুর রাজা এবং পদ্মশ্রীর দুখিয়া মালের কাছ থেকে সংগৃহীত। এই গাথায় মোট ছত্র সংখ্যা ১২৪৭টি। ৩) চন্দ্রাবতী : নয়নচাঁদ ঘোষ প্রণীত। এই কবি রঘুসুত, দামোদর প্রভৃতি অপর কয়েকজন কবির সহযোগে 'কঙ্কা ও লীলা' নামে আর একটি গাথা প্রণয়ন করেন। চন্দ্রাবতী গাথায় মোট ছত্র সংখ্যা ৩৪৫। ৪) কমলা : ভণিতায় দ্বিজ ঈশান পাওয়া গিয়াছে। কেন্দুয়ার নিকটবর্তী কোন গ্রাম বাসিনী তিন-চার রমণীর কাছ থেকে চন্দ্রকুমার সংগ্রহ করেছিলেন। বাঙলা ১৩২৮ সালের ১৯ আষাঢ় ড. দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে হস্তান্তর করেন। এই গাথায় ছত্র সংখ্যা মোট ১৩২০। ৫) দেওয়ান ভাবনা: দেওয়ানের অত্যাচারের কথা যে সব গীতিকায় বর্ণিত আছে তার কোনটিতেই কবির নাম পাওয়া যায় না। দেওয়ান ভাবনা '১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চন্দ্রকুমার সংগ্রহ করে ড. সেনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এই গাথায় মোট ছত্র সংখ্যা ৩৭৪টি। ৬) দসু্য কেনারাম: চন্দ্রাবতী প্রণীত। কেনারামের বাড়ি ছিল বাকুলিয়া গ্রামে। নলখাগড়ার বন সমাকীর্ণ সুপ্রসিদ্ধ 'জালিয়ার হাওড়' কিশোরগঞ্জ হতে ৯ মাইল দূরে পূর্ব দক্ষিণে, এখানের বংশীদাসের কেনারামের সাক্ষাৎ হয়। এই গীতোক্ত ঘটনা ১৫৭৫ থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো সময়ে হয়েছিল। প্রবাদ আছে প্রেমাহত চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লীলা সংবরণ করেন। ফুলেশ্বরী নদীর গর্ভেই কেনারাম তার মহামূল্য ধন-রত্ন বিসর্জন দিয়েছিল। এই গীতের ছত্র সংখ্যা ১০৫৪। ৭) রূপবতী: কবির নাম পাওয়া যায়নি। ১৯২২ সালের ৩০ মার্চ ড. দীনেশচন্দ্র সেনের হস্তগত হয়। ৮) কঙ্ক ও লীলা : এই গাথার রচিয়িতা ৪ জন। দামোদর, রঘুসূত, নয়ানচাঁদ ঘোষ ও শ্রীনাথ বেনিয়া। 'কঙ্ক ও লীলা'তে ছত্র সংখ্যা ১০১৪। ৯) কাজল রেখা: এটি একটি রূপকথা। তৎকালীন লাট রোনাল্ডসে এই পুস্তকের ভূমিকা লিখে দিয়ে ইহার গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। ১০) দেওয়ানা মদিনা: বানিয়াচঙ্গের দেওয়ানদের গাথা। ইহার লেখক মনসুর বয়াতি। তিনি যে নিরক্ষর ছিলেন, তা যেমন তার কাব্যে পাঠে স্পষ্ট বোঝা যায়। তেমনি ভাবে বোঝা যায় তিনি ছিলেন প্রকৃত কবিত্বশালী ও করুণা রস সৃষ্টিতে সুপটু। মৈমনসিংহ গীতিকার গাথাগুলি পূর্ব ময়মনসিংহের ঘটনা। এই গাথায় নেই কোনো হিংস্রতা। আছে নমনীয়তা। তাই বুঝি মহুয়া যখন নদেরচাঁদকে ডুবে মরতে বলছে। তখন জমিদার পুত্র নদেরচাঁদ রাগ না করে অথবা তরবারি না ধরে মহুয়াকে বলেছিল: 'কোথায় পাবো কলসি কন্যা কোথায় পাবো দড়ি / তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুইব্য মরি।' নারী চরিত্র প্রধান এই গীতিকায় আছে মিলন, আছে বিরহ, আছে ষড়যন্ত্র তবুও একে পূর্বদক্ষিণের উপকূলীয় গীতিকার মতো খুনোখুনি, হানাহানি নেই বলা যায়। অশিক্ষিত কবিদের দ্বারা রচিত হলেও নেই ভাষার অশ্লীলতা বা দুর্বলতা। বরং আছে কথ্যভাষার সৌন্দর্যের ছটা। মৈমনসিংহ গীতিকার ভায়া সংস্কৃতি প্রভাব মুক্ত ভাষা পলস্নীকবি জসীমউদ্‌দীন মৈমনসিংহ গীতিকার সহায়ক সংগ্রহকারী ছিলেন। তাইতো তিনি মৈমনসিংহ গীতিকার: 'আমার বাড়ি যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিঁড়া/ জলপান যে করতে দিয়াম শালি ধানের চিড়া// শালি ধানের চিড়া দিয়াম আরও শবরী কলা/ ঘরে আছে মইষের দুধরে, বন্ধু খাইয়ো তিনো বেলা'। এই গীত অবলম্বনেই লিখেছেন আমার বাড়ি কবিতা। যেখানে পলস্নীকবি লিখেছেন : 'আমার বাড়ি যাইও ভোমর/ বসতে দেব পিঁড়ে, / জলপান যে করতে দেব/ শালি ধানের চিড়ে।/ শালি ধানের চিড়ে দেব,/ বিন্নি ধানের খই, / বাড়ির গাছের কবরী কলা, / গামছা- বাঁধা দই'। এছাড়া পলস্নীকবি জসীমউদ্‌দীন মৈমনসিংহ গীতিকার লোককাহিনী সংগ্রহ করতে গিয়েই জানতে পেরেছিলেন রূপাই এবং সাজুর প্রেমের কাহিনী এবং রচনা করেছিলেন তার অমরকাব্য নকশীকাঁথার মাঠ। যা ইংরেজি, জার্মানসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও গুগল অনুসন্ধানে জানা যায় মৈমনসিংহ গীতিকা ২৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। \হমৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে যেমন আছে সমালোচনা। তেমনি আছে সু- আলোচনা। ড. আশ্‌রাফ সিদ্দিকীর ভূমিকা হতে বলা যায়: মহুয়ার বহু পাঠভেদ ময়মনসিংহের নানা অঞ্চলে প্রচলিত.... কিন্তু দীনেশ বাবু একটি মাত্র পালা অবলম্বন করে ময়মনসিংহ গীতিকায় সংকলন করেছেন। শ্রীযুক্ত আশুতোষ বাবুও বলতে বাধ্য হয়েছেন: বিশ্ববিদ্যালয় সংস্করণের মধ্যে এই প্রকার অন্যান্য হস্তক্ষেপের ফলে ইহার বিচার করা যায় না। কাজল রেখা ও দেওয়ানা মদিনা গাথা নয় উপাখ্যান বলে সমালোচনা করা হয়। আবার বারমাসীর সমালোচনা ও সু-আলোচনায় বলা হয়েছে: 'ঠধৎরধঃরড়হ রং পৎঁপরধষ :বংঃ ড়ভ ভড়ষশষড়ৎব.' আমরা যে পর্যন্ত কোন গান বা গীতিকার কোনো পাঠ ভেদ না পাই সে পর্যন্ত তাকে খাঁটি গান বা গীতিকা বলতে পারি না। পাঠভেদ দ্বারাই আমরা ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক উপায়ে যে কোনো গীতিকার সম্ভাব্য জন্মস্থান মোটামুটি সময় নির্ধারণ করতে পারি। শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন তার কোম গীতিকারই পাঠ ভেদ দেন নাই এবং তার সংগ্রহকরাও এদিকে রাখেন নাই। দীনেশ বাবু পাঠভেদ ছাড়া যেভাবে গীতিকাগুলোকে সম্পাদিত করেছেন সেভাবে বর্তমান যুগের কোনো লোকবিজ্ঞানীই সাহস করতেন না। তবে নতুন পাঠ ও পাঠভেদের মাধ্যমে এ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সুযোগ তো তিনি রেখেই গেছেন। শ্রীযুক্ত হগম্যান বলিয়াছেন, 'নায়িকাগুলো শেক্সপীয়র ও রেইনীর স্ত্রী- চরিত্রের মতো ইউরোপের ঘরে ঘরে পঠিত হওয়া উচিত। আমি এবং ম্যাতসিলা এডিলইন রোঁলা ( রোঁমা রোঁলার ভগিনী) পলস্নীগীতিকাগুলো ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করিতে চাই। প্রায় বিশ বছর যাবত আমি ভারতবর্ষের সাহিত্য পড়িয়া আসিতেছি, কিন্তু হঠাৎ যে এমন অপূর্ব জিনিস পাইব, তাহা স্বপ্নেও জানিতাম না।'... তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, 'মেটারলিংক ও ফরাসির সর্বপ্রধান লেখকদের নায়ক- নায়িকা অপেক্ষা বাংলা পলস্নীগীতির নায়ক- নায়িকারা শ্রেষ্ঠ, ইহাদের সৌন্দর্য সর্বকালস্থায়ী, বরং যুগে যুগে সমালোচকরা ইহাদের নতুন নতুন সৌন্দর্য আবিষ্কার করিবেন।' এমনভাবে মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে দেশ বিদেশের বহু বিজ্ঞজন পজেটিভ মন্তব্য করেছেন। লিখেছেন আর্টিকেল। দিয়েছেন ময়মনসিংহ গীতিকার পক্ষে অভিমত। \হমৈমনসিংহ গীতিকা ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর একশ বছর পূর্ণ করেছে। যা আমাদের নিকট ড. দীনেশচন্দ্র সেন, চন্দ্রকুমার, কেদারনাথ মজুমদার, শ্রী আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া সাধারণ কথার এক অসাধারণ উপহার বটে।