জেলেপলস্নীর জীবন

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

কনক কুমার প্রামাণিক
বর্ষাকালে হাঁটু কাদাজল পাড়ি দিয়ে আসতে হয় এ পাড়ায়। বড্ড কষ্ট করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। বছরে কমপক্ষে তিন-চার মাস এ রকম পানিবন্দি জীবন কাটে ওদের। জেলে পলস্নীর জীবন সংগ্রাম বড়ই কষ্টের। একেবারে সহজ নয়। ঝড় বৃষ্টি বন্যা সবকিছুর সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাঁচতে হয় ওদের। মশা ম্যালেরিয়ার রাজত্ব এখানে। এখানকার বাসিন্দারা সব নিম্নবিত্ত। ঈশ্বরের সৃষ্ট তৃতীয় শ্রেণির জীব। আধুনিক নাগরিক সুবিধার কল্পনা করাও যেখানে বাহুল্যতা। এখানকার প্রতিটি ঘর একটার সঙ্গে আরেকটি যেন লেপ্টে আছে। খুবই ঘনবসতি এ পলস্নীতে। শহরের বস্তি ঘরগুলোর মতো। সারাদিন বউ ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে মুখর থাকলেও সন্ধ্যা হলেই নামে রাজ্যের নিঃস্তব্ধতা। এখানে বিদু্যতের কোনো ব্যবস্থা নাই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তখন মনে হয় সভ্যতা বিবর্জিত এ যেন অন্য কোনো গ্রহ। এ অঞ্চলের সমাজপতিদের চোখে ওরা অনেক ছোট নিম্নজাতি। জাতপাতের হিসাব-নিকাশ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বতর্মান সভ্যতায় এসেও এখানে অপরিবর্তিত। তাই সামাজিক মর্যাদা এদের অত্যন্ত নগণ্য। ভোটের সময় ওদের কদর কিছুটা বাড়ে। নেতার এসে হাত মেলায়, কোলাকুলি করে। একেকজন নেতা এসে একেক রকমের বড় বড় উন্নয়নের প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে যান কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এখানকার ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে না। কেউ কোনোদিন স্কুলে যায় না। একটু বড় হলেই ছেলেরা বাপ-দাদার সঙ্গে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যায়। বড় অভাবী এখানকার সবার। দিন আনে দিন খায়। মেয়েরা এর ওর বাড়িতে কাজকর্ম করে। মেয়েরা একটু বড় হলেই তাদের বিয়ে দেয়। ওদের ছেলেমেয়েদের নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়েশাদি হয়। হরিরামপুর গ্রামের জেলেপাড়ার চালচিত্র এটি। হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে এখানে প্রায় দু'হাজার লোকের বাস। এটি একটি আধুনিক গ্রাম। সব সুযোগ-সুবিধা থাকলেও জেলে পাড়ার বাসিন্দারা যুগ যুগ ধরে এখানে বঞ্চিত অবহেলিত। বর্ষাকালে জেলেপাড়ায় মানুষের মধ্যে চর্মরোগের ব্যাপক বিস্তার দেখা যায়। চুলকানি খোস পঁচড়ায় আধিক্য ঘরে ঘরে। সঠিক চিকিৎসাপত্রও জোটে না ওদের কপালে। এখন ভরা বর্ষা মৌসুম। খালবিল জলে থইথই করছে। এ সময়টাতে বেশি বেশি মাছ ধরা পড়ে। তাই জেলেপাড়ার লোকজন দিনভর মাছ ধরতে ব্যস্ত থাকে। অনেকে রাতের বেলাতেও মাছ ধরতে যায়। রাতে মাছ ধরতে যাওয়াতে অনেক ঝুঁকিও রয়েছে। অন্ধকারে নানা রকম বিষধর সাপখোপ আর পোকামাকড়ও বের হয়। তবুও জীবনের মায়া না করেই ওরা মাছ ধরতে যায়। আজ কদিন যাবৎ পাশের বিলে খুব মাছ ধরা পড়ছে। রাতে অনেকেই মাছ ধরতে বের হয়। একাব্বর তার দশ বছরের ছেলে শাহীনকে নিয়ে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে বের হয় মাছ ধরতে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে অনেকটা মাছ ধরে ওরা। শাহীন টুকরিতে ভরে রাখে সেগুলো। মাছে টুকরিটা প্রায় ভরে গেছে। বাড়ির দিকে রওনা দেয় ওরা। কিছুদূর আসতেই উফফ করে চিৎকার করে ওঠে শাহীন। সাপে কেটেছে ওকে। একাব্বর টর্চের আলো ফেলে দেখে সাপটা শাহীনকে কামড়ে দিয়ে জলের ওপর দিয়ে দ্রম্নত পালিয়ে যাচ্ছে। ছেলে শাহীনকে কাঁধে করে দ্রম্নত বাড়ি ফিরে আসে একাব্বর। ততক্ষণে জেলে পলস্নীতে হুলস্থুল পড়ে গেছে। সাপে কাটা স্থানের কিছুটা ওপরে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধন দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন মিলে চুন, মাটি আর গোবর দিয়ে লেপে দিয়েছে। কয়েকজন মিলে একজন ও ঝাঁকেও ডেকে এনেছে। ওঝা অনবরত আক্রান্ত স্থান থেকে বিষ টিপে টিপে বের করে দিচ্ছে আর ঝাড়ফুঁক দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শাহীন ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মাঝরাত পর্যন্ত ওঝা আর রোগীর এমন খেলা চলতে থাকে। কিন্তু অবশেষে নিয়তিরই জয় হলো। সারা শরীর নীল হয়ে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ল অকালে একটি তাজা প্রাণ। কুসংস্কার আর অজ্ঞতা ভরা এমন সমাজ আজও রয়েছে পৃথিবীতে। নির্মূল হয়নি দেশ থেকে। অসাঢ় হয়ে পড়ে আছে শাহীনের নিথর দেহ। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে একাব্বর ও তার স্ত্রী কান্নায় গড়াগড়ি করছে। আর যে ওদের কোনো সন্তান নেই। শাহীন ছিল ওদের একমাত্র সন্তান।