নিমাই

প্রকাশ | ২২ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

শওকত নূর
ঘন মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। দমকা বাতাস আকস্মিক পড়ে গিয়ে বৃষ্টি ঘোর হয়ে নামল। তীব্রতা এমন যে, তা ভর দুপুরের চিরায়ত তেজকে, দিবা ঔদ্ধত্বের গৌরবকে পরাজয়ে মৌন-অশ্রম্নপস্নাবিত করে যেন অন্ধকার অসময়োচিত রাত টেনে আনল। বৈরাগীর ম্স্নান চোখ ম্স্নানতর হতে থাকে; কণ্ঠে নামে নিস্তেজতা। মোটামুটি শ্রবণযোগ্য হওয়ার স্বার্থেই হয়তো সে খানিকটা কেশে নিল। তারপর খোলা জানালায় গাঢ় মেঘের দিকে চেয়ে অন্যমনষ্কে বলল, আমাদের শৈশব কৈশোরগুলো প্রায়ই ব্যর্থ কাঙাল হয়ে থাকে, বুঝলেন? তারই ধারাবাহিকতায় কখনো আমরা ওদের দিকে শূন্য হাত প্রসারিত করে কাল কালান্তরের পথে ছুটি। কেউ ব্যর্থ হই, কেউ বা বড় অসময়ে হলেও মেকি সার্থকতার ছদ্মাবরণে ওদের পাই- বড় অসময়ে পাই। এখানে যাকে দেখতে পাবেন বলে জেনেছেন, যাকে ঘিরে এতটা আগ্রহ কৌতূহল আপনার চোখের তারায় ভর করে আছে, সে আমার তেমনই এক পাওয়া। নিমাই কইরে? নিমাই। আয় দেখি এদিকে। ভেতর ঘরে যাওয়ার পথের গাঢ় লাল পর্দা ঠেলে নিমাই এলো। এতক্ষণে বাধ্যতামূলক হয়েই নিমাইকে চোখে পড়ে। ওর পরনের শাড়িটা দরজার পর্দার রঙের মতই টকটকে লাল, কপালের বড় লাল টিপ, মাথার ফিতে লাল, সদ্য চিবানো পানের রসে ঈষৎ লাল দুটি ঠোঁট। নিমাইকে লাজুক দেখতে পাওয়ার যে গোপন ভাবনা এতক্ষণ ধরে আমাকে নতমুখ করে রেখেছিল, নিমাইর সশব্দ ফিকে হাসি তা অসার প্রতিপন্ন করে আকিস্মক ঘুম ভাঙানিয়া বজ্রশব্দের মতো আমাকে চেতনায় ফিরিয়ে নিয়ে এলো। বললাম, কী নিমাই, কেমন আছ? ভালো। ভালো আছি। নিমাই আবারো খিলখিল করে হাসলো। নিমাইর এ অপ্রত্যাশিত হাস্যোচ্ছলতা কী কারণ আমাকে অপ্রত্যাশিত মৌনতায় ডোবালো। পথে বৈরাগীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় থেকে শুরু করে এ বন্য কুটিরে আসা অবধি নিমাইর সম্ভাব্য জীবনচিত্র তথা হাল-হকিকত নিয়ে যে কল্পজাল বুনেছি তাতে করে নিমাইর কাছ থেকে উলিস্নখিত প্রশ্নে এমন জবাবের জন্য আমি নিজেকে প্রস্তুত রাখিনি। ফলে নিমাই ভালো আছে, ভালো থাকুক- সে প্রত্যাশা যেন আমার পরাজয়েরই নামান্তর। অথচ এ পরাজয়বোধ একেবারে আকস্মিক উদ্ভুত; যৌক্তিকতার কোনো পটভূমিকা আপাতদৃষ্টে এতে নেই। থাকতে পারে না। নিমাই নেহায়েতই আমার দূর প্রতিবেশী। গাঁয়ের ও মাথায় ওদের বাড়ি, যেখানে আমি বা আমাদের যাতায়াত কিংবা খোঁজখবর করবার প্রবণতা এত কম যে, ওর এ মুহূর্তের ভালো থাকা না থাকাতে বস্তুত আমার উলেস্নখ্য করাতে কিছু যায় আসে না। ধর্মের প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। তবে কেন এমন হলো? নেহায়েত সমাজ চেতনা থেকে? বৈরাগীর সঙ্গে ওর বাল্যবিয়ে হয়েছে কবে কখন কিভাবে তার কিছুই আমার জানা নেই। এখানে বিপদে পড়ে আশ্রয় গ্রহণ না করলে এ জীবনে আদৌ হয়তো কোনো দিন তা জানা কিংবা শোনাই হতো না। সমাজ চেতনার বাইরে আর কী থাকতে পারে? ভেতরে সূক্ষ্ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে স্মৃতি হাতড়াই। কী এমন স্মৃতি? একটাই স্মৃতি মনে উঁকি দিল- যা একান্তই তিক্ত। সেই শৈশবে শেষবার যখন ওকে দেখি, তখন ওর বয়স নয় কি দশ (এখন বড় জোর ষোল)। গুদারা নৌকায় উঠছিলাম আমি ও এক সহপাঠী। তখন আকস্মিকভাবে খুব আঘাত করেছিল ওর এক মন্তব্য: দেখ, ছেলেটার মুখ কেমন? ওর সঙ্গী মেয়েটি তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়, হুম। খুব কৌতূহল উৎকণ্ঠায় পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম আমি ও সহপাঠী নয়ন। নয়ন তৎক্ষণাৎ ঘোঁত ঘোঁত করে বলেছিল, নিতাই সন্যাসীর মেয়ে নিমাই। ছেমড়ির সাহস কত? আমরা কমছে কম ওর ৮/৯ বছরের বড়। আমাদের মুখ নিয়ে কথা বলে। ছেমড়ি একটা পাক্কা। আজ এখানে আশ্রয় নেয়ার আগে বৈরাগীর মুখে যখন ওর এখানে পাত্রস্থ হওয়ার খবর বিস্তারিত জানলাম, তখন ওর সেই দশ বছরের মুখটিই মনে ভেসে উঠেছিল। সেই অতটুকু বয়সেও ও বেশ ছিল। গায়ের রঙ হলদে, খাড়া নাক, মায়াবী চোখ মুখ; বয়সের তুলনায় উচ্চতাটা ঢের। সমাজ চেতনার পাশাপাশি সে স্মৃতিটুকুও হয়তো অবচেতন ভাবনায় এ নির্জন বন্য কুটিরে বয়সী বৈরাগীর সঙ্গে ওকে এভাবে মেনে নিতে পারেনি। এ অসন্তোষ নিশ্চয়ই তারও ফলশ্রম্নতি হয়ে আপাত লঘু করে দিয়েছে ওর কিংবা ওদের সমাজের সঙ্গে আমার দূরত্বসূচকতাকে। আমি মাথা নিচু আনমনে ভাবতে থাকি। নিমাই আবারও খিলখিল হেসে ওঠে। মুখ তুলে লক্ষ্য করি ওর চোখেমুখে দ্বিধা সংকোচের লেশমাত্র নেই। ওতো আগেভাগেই জেনেছে আমি ওর বাপের গাঁয়েরই এক অতিথি। এখন স্বচক্ষে দেখে হয়তো শনাক্ত করতেও সক্ষম হয়েছে। সংকোচের আর কী থাকবে? ভাবলাম, ওর আবেগ উচ্ছ্বাসের কারণ হয়তো এসবই। আমি অনিচ্ছায় ওর হাসিতে হাসি মিলিয়ে বললাম, তা নিমাই, আমাকে চিনতে পেরেছ? হুম, খুউ-ব। চিনব না কেন? হিঃ হিঃ হিঃ। বেশ তো স্মরণশক্তি দেখছি তোমার। সেই কতগুলো বছর! আর খুব বেশি হলে দু'চার দিনই হয়তো দেখেছ আমাকে। ভুলে যাওয়ারই কথা। আমি অবশ্য পথেঘাটে তোমাকে দেখলে চিনতে পারতাম না মোটেও। বেশ বড়োসড়ো হয়ে গেছ তুমি। আমি আপনাকে পথেঘাটে অনেক দেখেছি। কোন পথে? ওই যে আমাদের বাড়ির বাইর দিয়ে যে পথ। বেড়ার ফাঁকে আপনাকে কত দেখতাম! ওই মুখ বাঁকা ছেলেটাকে নিয়ে স্কুলে যেতেন যে? মনে আছে? হিঃ হিঃ হিঃ। হুম, মুখ বাঁকা- কোন ছেলেটা? ওই যে কী জানি নাম। বাঁকা যে মুখটা। লম্বা কোঁকড়ানো চুল, হেলেদুলে হাঁটত যে। ও হঁ্যা হঁ্যা, মনে পড়েছে ওর নাম নয়ন। সত্যি তো; ওর কথাই তো বলবে তুমি। কিন্তু ওর মুখ তো বাঁকা নয়। যে সময়ের কথা বলছ, ফুটবল খেলতে গিয়ে তখন দাঁত ভেঙে গিয়েছিল ওর। মাড়ির ব্যথায় মুখ বাঁকা করে থাকত। তা নিমাই, বাপের বাড়ি যাওয়া হয়? নাহ্‌। যেতে দিলে তো। ও কথা বললেই একতারা নিয়ে বেরিয়ে যায়। গাছতলায় বসে করুণ করুণ গান গায়। কেমন শব্দে যেন হাই তোলে! মিথ্যে কথা দাদা, একদম মিথ্যে। ও ছেলে মানুষ। ওর মাথার ঠিক নেই। খুব আবোলতাবোল বকছে ও। প্রায়ই এমন বকে। বৈরাগী চেঁচাল। না না, আপনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। ও আমাকে সারাক্ষণ বন্দি রাখতে চায়। ভাবে, আমি বাপের বাড়ি গেলে ও চিরতরে একা হয়ে যাবে। কী মিথ্যে ভাবনা! আমি ওকে ছেড়ে যাব কেন? মা মরে যাবে ক'দিন পরই। তখন আমার কেউই তো থাকবে না পৃথিবীতে। আচ্ছা নিমাই, তুমি এবার ভেতরে যাও। বড়দের সব কথায় তর্কে যেতে নেই, যাও। আপনি কিছু খেয়ে যাবেন কিন্তু। আমি রান্না চড়াচ্ছি। না খেয়ে গেলে খুব কষ্ট পাব। এখানে কোনো মানুষই আসে না। কাকে খাওয়াব? কী একটা জীবন ! তা নিমাই, সেই সময় কি আমি পাব? বৃষ্টি কমলেই তো আমি ছুট দেব। সময় নেই হাতে। না না, তা হবে না। একটুই সময় লাগবে আমার। বসবেন ধৈর্য ধরে। নইলে ওর গান শুনুন আবারও। তা কী খাওয়াতে চাচ্ছ, বল শুনি। লুচি, পায়েস আর লাড়ু। লাড়ু করাই আছে। লুচি পায়েসে অল্প একটু সময় লাগবে। বসুন দয়া করে। নিমাই ভেতরে গেলে বৈরাগী আবারও মুখ খোলে, দাদা, বলছিলাম যে কথা। জি বলুন। আমাদের শৈশব কৈশোর নিয়ে কী যেন বলছিলেন। আবার শোনা যাক বলুন। ওই তো পুরোটা শৈশব কৈশোরে আমরা ওদের নিয়ে খুব করে ভাবি। ওদের পেতে এখানে ঢুঁ দিই, ওখানে ছুটি, একে পেতে চাই, ওকে পেতে চাই, এভাবে পেতে চাই, ওভাবে পেতে চাই, কত ভাবেই না ওদের কল্পনা করি। ভেবে দেখুন সেই দুরন্ত শৈশব কৈশোরের সেই সব অদম্য গোপন ইচ্ছেগুলোর কথা। মন কী-না চাইত তখন। কিন্তু পেত না। সবাই যে পেত না- তা নয়। কচিৎ দু'একজন যারা পেয়ে যেত, তারা খুব করে ডুবত। নেশা হয়ে যাওয়ায় ফিরত না সে পথ থেকে। পরবর্তীতে খুব অন্ধকারে হারাত তারা। গোটা জীবনে কলংকের ছাপ বয়ে বেড়াত। আচ্ছা নিমাইটাকে কেমন দেখলেন? ও বেশ। সেই একেবারে ছেলেবেলায় দু'একবার দেখেছি ওকে। বয়স তখন নয় কি দশ হবে বড়জোর। তা বলুন যে কথা বলছিলেন? ওই তো ওই সময়গুলোতে আমরা যারা সৎ স্বচ্ছ থাকি, ওসবে তারা খুব কমই সার্থক হই। তাই বলে আমাদের অবদমিত ইচ্ছেগুলো একেবারে মরে যায় না। ইচ্ছেগুলোর সুপ্ত অবস্থা নিয়ে আমরা বাড়তে থাকি। সময় ধারায় যাদের পাই, তারা ভিন্ন মানুষ, বেশ পরিপক্ক মানুষ হওয়ায় তাদের মাঝে আর ওরা থাকে না ; তবু অনেকে এডজাস্ট করেই জীবন পার করি। সময় সুযোগে কারো কারো মনে ওরা ফোঁড়ন দিয়ে ওঠে। ওরা সম্মোহনী হাত বাড়ায়। কেউ কেউ সে সম্মোহনের ফাঁদে পড়ি। আসলে সেই না পাওয়া কিশোরীরা মন থেকে কখনো একেবারে মরে যায় না। বলতে গেলে প্রায় প্রত্যেকের স্বপ্নেই ঘুমিয়ে হলেও তারা আজীবন বাস করে। আচ্ছা, নিমাইর আচার ব্যবহার আপনার কেমন লাগছে ? হুম, ওর আচরণ বেশ, তা বলাইবাহুল্য। ওই যে ও ভেতরে আমার জন্য কী সব আয়োজন করছে। হাজার হলেও ওর বাপের গাঁয়ের অতিথি আমি। ও ভালো মেয়ে বলেই হয়তো এতটা তোড়জোর। তারপর বলুন, আমরা বড় হলেও আমাদের স্বপ্নে না পাওয়া কিশোররা আজীবন থাকে মর্মে যেসব বলছিলেন। আবার শুরু করুন। নিমাই খেতে ডাকবার আগে যতটা সম্ভব বলুন, শোনা যাক। ওইতো কৈশোরে না পাওয়া সেই স্বপ্নের কিশোরীকে যখন অনেকে পাই, তখন আর আমরা নিজেরা কিশোর থাকি না। কারো কারো অবস্থা তো কৈশোর থেকে দূরে, অনেক অনেক দূরে অবস্থান করে। এই অসামঞ্জস্য নিয়েই মানুষের কথার অন্ত থাকে না। অন্তরে বড় জ্বালা ধরে যায় কারো কারো কথায়। নিন্দুকের নিন্দা কথায়, নিন্দা কাজে লোকসমাজে টেকাই যেন হয়ে ওঠে দায়। কেমন লাগছে আমার এ বন্য কুটির? বড় সাধের কুটির এ আমার। চমৎকার! এমন একটা বন্য কুটিরের স্বপ্ন আমিও মাঝে মধ্যে দেখি। বলেন কী? বন্য কুটির ভালো লাগে? বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার। আপনি এমন শান্ত নিরীহ মানুষ। ঠিকই বলছি। মানুষ মাত্রই একঘেয়ে লোকালয় থেকে সাময়িক হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চায়। একাকিত্বে সাময়িক স্মৃতিবিস্মৃত, আত্মবিস্মৃত হতে চায়। কিন্তু নিমাইটা প্রথম প্রথম এখনাটা পছন্দ করত না। পরবর্তীতে মানিয়ে নিয়েছে সব। ওপাশে আমার চমৎকার একটা বাগান আছে। একজোড়া গাই আছে আমার। একটা পাঁঠা, ক'টা মোরগ-মুরগী। বেশ কাটে ওদের নিয়ে। নিমাইকে নিয়ে প্রায়ই আমি হাঁপিয়ে যাই। তখন ওদের মাঝে স্বস্তি খুঁজে পাই। তা নিমাইর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ কবে কখন? বেশতো দূর এখান থেকে। এমনিতে জানতে চাইছি। ওদের জীবন সম্পর্কে আমরা জানি না খুব একটা। ওই তো বাউল হয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় গান গাইতাম। প্রায়ই বেশ দূরে যাওয়া হতো। একদিন ঠিক এমনই এক ঝড়ো হাওয়ার সন্ধ্যায় ওদের আঙ্গিনা থেকে ওদের ঘরে আশ্রয় নিই। সে রাতে আমার চোখের সামনেই ওর বুড়ো বাপটা স্বর্গে চলে যান। জানেন তো খুব গরিব আর একঘরে ছিল ওরা। লাশ সৎকারসহ নানা কর্তব্যের দায়ভারে আটকা পড়ি আমি। ওদের ছেড়ে আসতে পারি না। জানি না এক সময় কখন নিজের অজান্তেই ওর সঙ্গে ্ত্ত। থাক সে নিগূঢ় রহস্য কথা। নিমাই, বাগান আর এই ঘন ঝোপজঙ্গল নিয়ে ভালোই কাটে আমার। মন বেশি ভারি হলে কাগজে কবিতা লিখি। হয় না আমার কবিতা, তবু লিখি। অনেকই হয়েছে লেখা। আপনি আধুনিক মানুষ; যদি একটু দেখতেন দু'একটা পয়ার। হঁ্যা, হঁ্যা বেশ তো। কবিতা দেখতে আপত্তি নেই আমার। শুধু সময়টাই একটু কম বলে আমাকে তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে। দিন দেখি হাতের ওই পৃষ্ঠাটাই, দেখি একবার। নিমাই নিমাই কেবলই নিমাই আমার নিমাই, আমারই নিমাই ভালো নিমাই, ভালোই নিমাই ভাল আছি তাই, আছে যে নিমাই। কবিতাটা বেশ লম্বা। এটুকু পড়তেই ছেদ পড়ল। নিমাই চলে এসেছে। ও পর্দা উঁচিয়ে বললো, ও কবিতা পড়বেন না। ওটা কোনো কবিতা হলো? সারা কবিতা জুড়ে শুধু নিমাই নিমাই। নিমাই ছাড়া যেন জগতে আর কিছু নেই। ছোটবেলায় প্রাইমারি স্কুলে কত ভালো কবিতা পড়েছি আমরা। কৃষ্ণ গোপাল স্যারের কথা মনে আছে আপনার ? কত সুন্দর করে যে কবিতা পড়াত : আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে সূয্যি গেছে পাটে খুকু গেছে জল আনতে পদ্মদীঘির ঘাটে। স্কুলের ও পাশের সেই পদ্মদীঘিটা তো আজও আছে। সেখানে কি এখনও পদ্মফুল ফোটে? আমাদের গাঁয়ের ওই পশ্চিমে যে দশমিনার গাঁও, সেই গাঁয়ের মাথায় কি সূয্যি পাটে যায়? দেখেছেন? হঁ্যা, নিমাই, সবই তেমন আছে। সেই আগের মতই আছে। তা একবার গিয়ে দেখে এসো না হয়। হঁ্যা, দেখতে খুব মন চায়। অবশ্যই দেখব। কৃষ্ণ গোপাল স্যারকেও খুব দেখতে মন চায়। গেলে স্যারকে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করে আসব। এবার খাবেন চলুন। খাবার জুরিয়ে যাবে। হঁ্যা চলো। সময় খুবই কম। বৃষ্টিও কমে এসেছে। এখনই বেরোতে হবে। খাওয়া শেষে বৈরাগীর কুটির থেকে বাইরে পা দিতেই চোখে পড়ল বৃষ্টি কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে। বৃষ্টিস্নাত গাছপালায় রোদঝলমল করায় খুব মনোরম লাগছে চারদিক। বৈরাগীর বাগানের রঙ বেরঙের ফুলগুলো নিমিষে দৃষ্টি কাঁড়ল। বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। সত্যিই চমৎকার এক বাগান। ওঠার পথে তাড়াহুড়োর সময় চোখেই পড়েনি। পেছন থেকে নিমাই অকস্মাৎ বলে উঠল, কতগুলো ফুল না হয় নিয়ে যাই। আপনি নিয়ে বাড়িতে সাজিয়ে রাখবেন। ওই লাল গোলাপ আর জবাগুলো! কী সুন্দর না ? ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বিস্মিত হই। নিমাইর আপাদমস্তকে নতুন সাজ পোশাক। ওর কপালের এক চিলতে সিঁদুর দাগ বেশ বিমোহিত করল। আরো বিমোহিত করল ওর কাঁধের ঝোলা ব্যাগটি। ও হাত বাড়িয়ে বাগান থেকে কতগুলো জবা আর গোলাপ ছিঁড়ে ওর ঝোলায় ভরল। আবারও সেই ফিকে হাসি হেসে বলল, এখন আমার ঝোলাতেই থাক। গাঁয়ে পৌঁছে তো আগে আমাদের বাড়ি পড়বে। আমাদের আঙ্গিনায় উঠে সব বের কওে দেব আপনার কাছে। আপনি নিয়ে যাবেন তখন। বৈরাগীর কাশি অনুসৃত ঝাঁঝালো কণ্ঠ অকস্মাৎ খুব করে নাড়িয়ে দিল। সে গলা ঝেড়ে বলল, তা নিমাই, কার সঙ্গে যাবি বাপের বাড়ি ? কে নেবে তোকে ? নিমিষে যেন গোটা আবহে তুষার শীতল নীরবতা নেমে এলো। বৈরাগীর কাছ থেকে আমার আগেই বিদায় নেয়া হয়েছে। নিমাইর উদ্দেশে অস্ফুট 'আসি' বলে পা চালাই। নিমাই সেখানটাতেই নির্বাক নিশ্চুপ থমকে আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে ও ক'টা গোলাপ জবা ছিঁড়েছে মাত্রই। ক' কদম হাঁটার পর ইচ্ছে হলো পেছন ফিরে দেখি নিমাই কেমন করছে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হলো না। কারণ, স্পষ্টতই অনুভব করছিলাম, নিমাই খুব করে কাঁদছে।