চিকনমাটিয়ার বিলে

প্রকাশ | ২২ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

আবু সাইদ কামাল
শরতের শেষের দিকে খাল-বিল-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। দেশে তখন সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ। রফিকদের বাড়ি সীমান্তের এক কিলো দূরত্বের মধ্যে এবং গারো পাহাড়ের পাদদেশ থাকায় সব সময় এটি মুক্ত অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। কারণ, এ এলাকা মুক্তিবাহিনী অধু্যষিত বলে কখনো পাকবাহিনী হানা দিতে সাহস করেনি। তা ছাড়া প্রাকৃতিকভাবেই এলাকাটি ছিল সুরক্ষিত। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে রফিকদের গ্রামের মানুষ যে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে, তা অকপটে বলা যায়। আগের বছরও শরতের মাঝামাঝি সময়ে বড়ভাইসহ পাড়ার কয়েকজনের সঙ্গে রফিক চিকনমাটিয়ার বিলে গিয়েছিল চিংড়ি মারার জন্য। তখন বড়ভাই ঠেলা জালি বেয়েছে। আর রফিক খালুই বহন করে গিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। সে সময়ে প্রচুর পরিমাণে স্থানীয় জাতের মিঠাপানির চিংড়ি ধরে এনেছিল ওরা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কারণে অধিকাংশ জেলে-পরিবার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে বলে জলাশয়ে তেমন মাছ ধরা হয়নি। ফলে নদী-খাল-বিলে বেড়েছে মাছের পরিমাণ। চিকনমাটিয়ার বিলটা এলাকায় চিংড়ি মারার বিল বলে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যান্য বিলের মতো এ বিলেও চিংড়ি মাছের পরিমাণ ছিল আগের যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি। এ বিলের দক্ষিণ-পশ্চিমে মেদি বিলের অবস্থান। অনেক বড় বিল সেটা। মস্ত বড় ওই বিলের দক্ষিণ প্রান্ত কলমাকান্দা-দুর্গাপুর সংযোগকারী রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই রাস্তা দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা চলাচল করত। পুবে খাসপাড়া এবং পশ্চিমে বড়দল পর্যন্ত লম্বায় বিলটা পাঁচ কিলো তো হবেই। ক'দিন আগে কলমাকান্দায় অবস্থানকারী পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে উভয়পক্ষে বেশ ক'জন হতাহত হয়েছে। নিখোঁজ হয়েছে গ্রামের দুজন সাধারণ মানুষও। মেদি বিলের দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে পাক হানাদার আর রাজাকারদের চলাচল থাকলেও চিকনমাটিয়ার বিলে ওদের যাতায়াত নেই। কারণ, ওদের যাতায়াতের মতো রাস্তা নেই। নৌকা যোগে চিকনমাটিয়ার বিলে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেটে পড়ার ঝুঁকি আছে। মেদি বিলকে চিকন মাটিয়ার বিলের সঙ্গে সংযোগ করেছে পাহাড়ি নদী গণেশ্বরী এবং মঙ্গলেশ্বরীর মিলিত স্রোতধারা। যা চিকনমাটিয়ার খাল নামে পরিচিত। রফিক সহপাঠী জাহিদকে নিয়ে পাড়ার তিন-চারজন কিশোর-যুবা মিলে ভোরেই চিংড়ি মাছ ধরার জন্য ঠেলা জালি এবং খালুই নিয়ে রওনা হয়। ওদের বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ কিলো দক্ষিণ-পূর্বে বিলটির অবস্থান। এক ঘণ্টা হেঁটে ওরা বিলে পৌঁছে। গায়ের হাতাকাটা গেঞ্জি বা জামা খুলে ওরা মাথায় বাঁধে। তার ওপর বাঁধে খালুইয়ে চিকন দড়ি। ফলে খালুইটা মাথার পিছনে ঘাড়ের সমান্তরাল দুলতে থাকে। মাছ ধরার প্রস্তুতি নিয়ে বিলে নামে সবাই। জলের নিচে কিছুদূর জালি ঠেলে নিয়ে জলের ওপর যেই ভাসায়, অমনি অসংখ্য চিংড়ি লাফাতে থাকে। লম্ফ-ঝম্পরত চিংড়ির সঙ্গে পালস্না দিয়ে তড়িঘড়ি জালি উপরে তোলে রফিক। জালির টুনে এসে জড়ো হওয়া চিংড়ি মাছ মোটভরে মাথার পিছনে খালুইয়ে রাখে রফিক। বিলের উত্তর কিনারে ওদের গলা পর্যন্ত পানিতে ঠেলা জালি ঠেলে কিছুক্ষণ মাছ ধরে। কখনো বা বুক-পানিতে আবার কখনো বা কোমর পানিতে জালি ঠেলে চিংড়ি মাছ ধরে চলে রফিক। প্রতিবার জালি ঠেলে মুঠি মুঠি ইচা মাছ খালুইয়ে ভরে। মাছের পরিমাণ বেশি বেশি বলে ওদের মাছ ধরার উৎসাহও যায় বেড়ে। ফলে মাত্র এক ঘণ্টা সময়ে ইচা মাছে ওরা খালুই প্রায় ভরে ফেলে। এভাবে মাছ ধরতে ধরতে একপর্যায়ে ওরা পরস্পর থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রফিক বুঝতে পারে তার মাথায় বাঁধা খালুই গলা-সমান ভরে গেছে। এ জন্যই ভারী ভারী লাগছে। কাজেই আর বেশিক্ষণ মাছ ধরতে হবে না বলে মনে হচ্ছে তার। এ পর্যায়ে সে ভাবে, অনেকক্ষণ তো ইচা মাছই ধরেছে। এবার অন্য কিছু মাছ ধরার সাধ হয় তার। ঠিক তখনি তার দৃষ্টি যায় চিকনমাটিয়া খালের পাড়ের হিজলগাছের দিকে। হিজলগাছটি তার কোমর পর্যন্ত ঝোপ নিয়ে পানিতে ডুবে আছে। জলে-ডোবা শাখা ঘিরে কিছু কচুরিপানার ধাম রয়েছে। রফিক ভাবে, ওসব কচুরিপানার নিচ দিয়ে জালি ঠেলে উপরে তুললে কই, পুঁটি কিংবা কালি বাউশের পোনা পাওয়া যাবে। এই ভাবনায় সে ঠেলা জালি নিয়ে হিজলগাছের কাছাকাছি যায়। প্রায় বুক সমান পানির নিচে দিয়ে জালি ঠেলে কচুরিপানার ধামের নিচে ঢোকায়। রফিক জানে, এসব কচুরিপানার ধামে অনেক সময় সাপও থাকে। তবে ওসব সাপ বিষাক্ত হয় না। এ জন্য ওসব জলজ সাপকে ভয় পায় না সে। জালি ঠেলে হিজলগাছের শাখা পর্যন্ত নিয়ে আস্তে আস্তে জালিটা গায়ের জোরে ভাসাতে থাকে। আর মনে মনে ভাবে, নিশ্চয় ভালো জাতের কিছু মাছ পাওয়া যাবে। কিন্তু ঠেলা জালিটা যেই না কিছু কচুরিপানাসহ জলের ওপর ভাসাতে চায়, তখন বুঝতে পারে-ভারী একটা কিছু তার জালিতে ঠাঁই নিয়েছে। প্রাণপণে তাই আর একটু যেই উপরে ভাসয়া, বীভৎস একটি দৃশ্য দেখেই খেই হারায় রফিক। ভয়াল এ দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে সারা গায়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে যেন স্নায়ুরাজ্যে বিদু্যৎ প্রবাহিত হয়। মাথার চুলসহ শরীরের সব লোম এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে যায়। ভেতর দেশে রি রি করতে থাকে। পচা-গলা একটি লাশের মাংস জলে খসে খসে পড়ছে। মাছ বা জলজ প্রাণীরা জলে ধোয়া পচা মাংস ঠুকরে ঠুকরে বুঝি খায়। সে সব মাছই ঠেলা জালিতে আটকে খলবল করছে। এমন ভয়ঙ্কর কোনো দৃশ্য দেখে কি স্থির থাকা যায়! কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিশোর রফিক তখন কী করবে বুঝতে পারে না। তবে পালাতে হবে- এ সত্য বুঝে সে ঠেলা জালিটা আবার পানির নিচে চেপে ধরে। জালিটা জঞ্জালমুক্ত করে পানির নিচে টেনে পলায়নপর রফিক বিলের উত্তর কিনারে ধেয়ে ছুটে যেতে থাকে। মানুষের লাশকে গ্রামের কে ভয় না পায়! আর লাশ নিয়ে নানা কুসংস্কার বা ভুতুড়ে ভয় তো আছেই। তার ওপর লাশটা যদি নিবিড় জলে পচা-গলা হয়, তেমন কোনো বীভৎস লাশ দেখলে কারও মন সুস্থ থাকার কথা নয়। রফিককে ধেয়ে বিলের পাড়ে উঠতে দেখে জাহিদ হেঁকে বলে, কী রে রফিক! কী হইছে তোর? শিং মাছের কাঁটার খোঁচা খাইছস, না কি সাপে কামড় দিছে? জবাবে রফিক কোনো কথা বলে না। বরং সে প্রবল গতিতে প্রাণপণে বিলের কিনারের দিকে ছুটতে থাকে। তাতে জাহিদের উদ্বেগ আরও বাড়ে। সে আবার হাঁক ছেড়ে বলে, কী রে কথা কস না কেরে? -শিং মাছের গলা কিংবা সাপের কামড়ও খাই নাই। তবে তারচেয়ে মারাত্মক কিছু। বাড়িতে গেলে তাড়াতাড়ি আয়। -আইচ্ছা খাড়া। আমি আসতেছি। এই বলে জাহিদও অল্প সময়ের ব্যবধানে চলে আসে বিলের কিনারে। তার খালুইও ইচামাছে ভরে গেছে প্রায়। কাছে এসে রফিককে বলে, কী অইছে রে? -লাশ। -কী কস, কীয়ের লাশ? -মানুষের লাশ। -লাশ কইত্তে আইলো? -কেডা জানে। পচা-গলা লাশ। একনজর দেইখ্যা আমার সারা গায়ে আঁতকা ঝাঁকুনি দিল। মনে অয় জ্বর আইবো। চল, আর কোনোদিন ইচা মারতে আইমু না। -তুই কি লাশ দেইখ্যা ডরাইছস। -তা জানি না। তবে লাশ দেখার পর থাইখ্যা খারাপ লাগতেছে। -ডরের কী আছে। লাশ তো লাশই। কয়দিন আগে যে পাশের গ্রামে পাকবাহিনী আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ অইছে, ওই সময়ে গুলি খাইয়া কেউ মরছে বোধ হয়। -চিনার উপায় নাই। আমার আর কথা কইতে ভালো লাগতেছে না, চল তাড়াতাড়ি। বলেই ঠেলা জালি কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে রফিক। তার পিছনে পিছনে হাঁটে জাহিদও। দুটি কিশোর নিঃশব্দে কিছুক্ষণ হাঁটে। পিছন থেকে জাহিদ বলে, কার লাশ অইবার পারে রে রফিক? -ক্যান শুনস নাই। লোকের মুখে মুখে তো ঘটনাটা ছড়াইছে। -কোন ঘটনা। -গেল মাসের শেষের দিকেই তো ঘটছিল ঘটনাটা। -আমি শুনি নাই। একটু খুলে বল না-ঘটনাটা কী? -আচ্ছা বলছি। এরপর সংক্ষেপে রফিক যে ঘটনাটা বলে, তা হলো- এই চিকনমাটিয়া বিলের দক্ষিণের গ্রামের রায় বাড়ি এলাকায় সুপরিচিত। এলাকার সবাই জানত, রায়বাড়ির ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। বয়সে ছোট হলেও সুবল রায়ও তখন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। এ সংবাদ পাকবাহিনীদের কাছে ছিল। কাজেই এ বাড়িটা তাদের টার্গেটে পরিণত হয়। সম্ভবত এ জন্যই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাকবাহিনী। বাবা দেবল রায় ছিলেন সাহসী মানুষ। গ্রামের বাড়ি তথা জন্মভিটার প্রতি বলতে গেলে দেবল রায়ের ছিল সীমাহীন টান। বছরখানেক আগেই নকশা করে সুন্দর একটা চৌচালা আধাপাকা টিনের ঘর বানিয়েছিল। আশপাশের দশগ্রামে এমন সুন্দর বাড়ি ছিল না বললেই চলে। ফেলে আসা বাড়িটা একনজর দেখার বড় সাধ হলো তার। তখন একাত্তরের শ্রাবণ মাসের ২৪ তারিখ। সেই কবে শরণার্থী শিবিরে গিয়েছেন। তার ইচ্ছে মেঘালয়ের মহাদেও এলাকা থেকে পাঁচ-ছয় কিলো দূরে অবস্থিত খাসপাড়া গ্রামে এসে বাড়িটা দেখে যাবেন। নিজের ছোট্ট নৌকাটা নিয়ে দেবল রায় একাই সেদিন ভোর বেলায় রওনা হন। ঘণ্টা দেড় সময়ে হস্তচালিত নায়ে তিনি বাড়ির ঘাটে পৌঁছেন। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, তিনি যখন পিছন দিক দিয়ে নৌকা থেকে বাড়ির আঙিনায় উঠে বেশ আবেগভরে এগোচ্ছেন, তার মিনিট কয়েক আগে পাকবাহিনীর একটা নৌকা বাড়ির ঘাটে এসে ভিড়েছে। ওদের দোসর রাজাকাররা তো দেবল রায়কে নাগালে পেয়েই পাকড়াও করে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যায় পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেনের কাছে। তারপর থেকেই কী অমানবিক নির্যাতন চলতে থাকে তার ওপর। একদিকে জ্বলতে থাকে স্বপ্নের বাড়ি অন্যদিকে দেবল রায়ের ওপর চলে বর্বর নির্যাতন। বাড়িতে দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে, তার সঙ্গে পালস্না দিয়ে চলে দেবল রায়ের আর্তচিৎকার। রাতেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ পর্যন্ত শুনে জাহিদ বলে, তাইলে কি এইটা দেবল রায়ের লাশ? -আমার তো তাই মনে হয়। তবে প্রমাণ ছাড়া তো আর নিশ্চিত হওয়া যাবে না। -কী ভয়ঙ্কর ঘটনা। লোকটা জন্মভিটার টানে গেল বাড়িতে। কী দুর্ভাগ্য তার! পড়লো ধরা। একদিকে তার স্বপ্নের বাড়ি পুড়লো, অন্যদিকে তার ওপর চললো বর্বর নির্যাতন। রাতেই সে হয়ে গেল লাশ!