হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

অলোক আচাযর্্য
বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রবাদপুরুষ হুমায়ূন আহমেদ। যার সাহিত্য রচনায় পাঠক মুগ্ধ থেকেছে যুগের পর যুগ। বেঁচে থাকতে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গস্পশীর্ এবং তার মৃত্যুর পরেও তার জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমেনি। বরং তাকে জানার আগ্রহ আরও বেড়েছে। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয় তখনই বোঝা গিয়েছিল কথাসাহিত্যের বিশাল জগতে তিনি অল্প সময়ের জন্য আসেননি, তিনি এসেছেন রাজত্ব করতে। তিনি সহিত্যের ভুবনে ছিলেন সম্রাট। তার পাঠক শ্রেণি ছিল আলাদা। যারা গোগ্রাসে তার লেখা পড়তো। অবশ্য তার সমালোচক শ্রেণিরও অভাব ছিল না। সে সমালোচনা তাকে আরও উঁচুতে পেঁৗছে দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের লজিক ও অ্যান্টিলজিক চরিত্র হিমু ও মিসির আলী চরিত্র দুটি আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এ চরিত্র নিয়েই দেশে বহু আলোচনা হয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টাও করা হয়েছে। অনেক সময় চরিত্র দুটির স্রষ্টাকেই এই চরিত্রের সত্যিকারের মানুষ বলে মনে হয়েছে। কোনো কোনো লেখকের বই পাঠক গোগ্রাসে গিলে আবার কোনো কোনো বই পাঠক গোগ্রাসে না গিললেও তার গভীরতা পাঠককুলকে আকৃষ্ট করে। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে যে এক তুমুল জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ছিলেন সে কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়। তার মৃত্যুর পরেও বই মেলায় তার বইয়ের বিক্রি ছিল প্রচুর। তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তা জানতে হলে তার কমর্ এবং সৃষ্টির দিকে তাকাতে হবে। রবীন্দ্রনাথের পর যেমন বাংলা সাহিত্য বহু বছর তার ধারার স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে তেমনি হুমায়ূন আহমেদের লেখনীর ধারায় আজকের লেখনী চলে। কত বছর চলবে তা ভবিষ্যতই বলবে। তার উপন্যাসের স্বকীয়তা, সহজ স্বাভাবিক ভাবে জটিল তত্ত¡গুলোর বণর্না দিয়ে যাওয়া, চরিত্রের তুমুল জনপ্রিয়তা কেবল তার লেখনীতেই সাজে। দেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার উপন্যাস, ছোটগল্প আর চলচিত্র এক অনবদ্য সৃষ্টি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ‘১৯৭১’ প্রথম দিককার বই। এই বইয়ে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার চিত্র এগিয়েছে স্বাভাবিক অথচ খুব বাস্তবতার ভঙিতে। অনিল বাগচীর একদিন উপন্যাসটিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেসময়কার বণর্না দিয়েছেন। আমি বহুবার এই বইটি পড়েছি। প্রতিবারই পড়া শেষে অনিল ছেলেটার জন্য আমার মন এক ধরনের বিষণœতায় ডুবে গেছে। আবার অনিল বাগচীর একদিন বইয়ে অনিল নামের একজন হিন্দু যুবকের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বনর্ণার সাথে সাথে সেই সময়ের অবস্থা বণর্না করেছেন। উপন্যাসটির এক জায়গায় মিলিটারির সামনে এক সাংবাদিকের কাছে দেশের অবস্থার বণর্না দিতে গিয়ে অনিল বলে, আপনি কি রাস্তায় কোন শিশু দেখতে পাচ্ছেন? আবার বাস থেকে নামিয়ে যখন অনিলের নাম জিজ্ঞেস করা হয় তখন সে মিথ্যা নাম না বলে অবলীলায় সত্যি নামটি বলে দেয়। তার জন্য অবশ্য তাকে শেষ পযর্ন্ত ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধকে কাহিনীর বণর্নার মাধ্যমে এতটা বাস্তব করেছিলেন যে চোখের সামনে পাঠক সে সময়কার একটা চিত্র দেখতে পেতো। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচিত্র আগুনের পরশমণি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দশের্কর ঢল নেমেছিল। মাসের পর মাস এই চলচিত্রটি বক্স অফিস দখল করে রেখেছিল। শ্রেষ্ঠ চলচিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কার জিতে নিয়েছিল এই ছবিটি। কি ছিল না এই চলচ্চিত্রে? গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্থানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ, সাধারণ মানুষের পাকিস্তান বাহিনীর প্রতি ঘৃণা, ভালোবাসা সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ এই ছবিটি মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল। তারপরেও তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। সেগুলোও দশর্কদের কাছে সমান জনপ্রিয়। তার মক্তিযুদ্ধভিত্তিক আর একটি চলচ্চিত্র হলো শ্যামল ছায়া। সিনেমাটি বিদেশি ভাষার ছবির ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরুস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। শ্যামল ছায়া সিনেমাটির একেবারে শেষদৃশ্যে স্বাধীন পতাকা দেখে নৌকার দুই মাঝির চোখে মুখে যে অভিব্যক্তি, আনন্দ ফুটে উঠেছে তা সত্যিই অতুলনীয়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের বাইরেও তার দুইশতাধিক সৃষ্টির ভাঘণার রয়েছে তার প্রত্যেকটি বাংলা সাহিত্যের এক একটি সম্পদ। আজ আমি কোথাও যাব না বইয়ে এক অপরিচিত বয়স্ক মানুষের ভালবাসার জন্য, তাকে বঁাচানোর জন্য এক যুবক শেষ পযর্ন্ত তার বহু সাধনার আমেরিকা যাওয়ার পাসপোটর্ মাঝ নদীতে ফেলে দেয়। হুমায়ূন আহমেদের কাজ, তার সৃষ্টি বিশাল। হুমায়ন আহমেদকে স্বাধীনতা পরবতীর্ শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন বলতে যাকে বোঝায় তিনি ছিলেন সেরকম মানুষ। তিনি ছোলগল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, চলচিত্র নিমার্ণ করেছেন। তিনি উপন্যাস, নাটক এবং চলচ্চিত্র জগতে এদেশে নতুন যুগের সূচনা করেছেন। কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাইয়ের ফঁাসি না দেয়ার দাবিতে মিছিল হয়েছে। যা দেশের নাটকে একটি ইতিহাস। এই ইতিহাস সাক্ষ দেয় যে উপন্যাস, নাটক বা সিনেমার চরিত্রকে তিনি মানুষের মনে জীবন্ত করে তুলতে পেরেছিলেন। অনেকেই হিমু সেজে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করেছে। তিনি লেখনীর ধারায় পাঠক টেনেছেন, তিনি নাটকের চিরাচরিত ধারার বাইরে অনবদ্য কাহিনী সৃষ্টি করেছেন। তার চলচ্চিত্র মধ্যবিত্ত দশর্কদের হলমুখী করেছিল বহুদিন পর। তার চিন্তা ছিল অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তার কাছে গুরুত্ব পেত পাঠক বা সিনেমা, নাটকের দশর্ক। বাণিজ্যের জন্য নয় বরং পাঠকের জন্য তিনি লিখেছেন, দশের্কর জন্য সিনেমা নাটক তৈরি করেছেন। বিভিন্ন সময়ে তার নাটক ও সিনেমায় প্রচারিত গানগুলো তো মানুষের মুখে মুখে। তার হাত ধরে কত গুণী অভিনেতা নাট্য জগতে এসেছে। পৃথিবীজুড়েই তার বহু ভক্ত পাঠক রয়েছে। তার অসংখ্য পাঠকের মধ্যে একজন আমি। হুমায়ূন আহমেদের স্পশর্ যেন সফলতার অন্য নাম। সহজ, সরল সাবলীল ভাষায় পাঠককে গল্পের ভেতর টেনে নেওয়ার যে ক্ষমতা তা তার ছিল। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সফল হয়েছেন। বাদশা নামদার পরে মনে হয়েছে ইতিহাসের এমন চমৎকার একটি বিষয় গল্পের মাধ্যমে জানা যায় না পরলে বিশ্বাস করাই কষ্ট। আবার দেয়াল পরে নিজ দেশের ইতিহাসের অনেকখানি জানতে পেরেছি। ছোটবেলায় হুমায়ূন আহমেদ ভালোবাসতে সবুজ অরণ্য, বৃষ্টি আর টিনের চালে সেই ছন্দ, বৃষ্টির পানিতে ভেজা। তার তৈরি নূহাশ পল্লীতে তিনি সেভাইে সাজিয়েছিলেন প্রকৃতিকে। তার লেখার বহু বনর্ণায় সেসব পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি ঔপন্যাসিকদের তিনি অন্যতম। যে মানুষটা জ্যোৎস্না ভালোবাসতো, বৃষ্টির জল ভালোবাসতো, বৃষ্টি এলেই ভিজতে নেমে যেত তিনি ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এরকমই এক বষার্য় শায়িত হয়েছেন তার প্রিয় নূহাশপল্লীতে।