বাসন্তি আমার মা

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

তপন কুমার দাশ
একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায় বাবু! বাড়ির কাজের মেয়েটির কথায় চমকে ওঠেন ভবতোষ বাবু। এতক্ষণ ঘরের দাওয়ায় বসে কি যেন ভাবছিলেন তিনি। জানতে চান, কোন মেয়ে, কোথা থেকে এলো? জানিনা বাবু, শুধু বলল, ভবতোষ বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। বয়স এই বছর বিশেক হবে। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর বাবু! এ নিয়ে আর কথা বাড়ান না ভবতোষ বাবু। বলেন, যাও মেয়েটাকে এখানে আসতে বল। দুপুর গড়িয়ে গেছে সেই কখন, দূরের আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে লাল আভা। রঙিন হতে শুরু করেছে চারদিক। দু’একটি করে পাখি উড়তে শুরু করেছে নিজ নিজ ঘরের দিকে। ঘরের দাওয়ায় বসে এসব দেখছিলেন আর ভাবছিলেন ভবতোষ বাবু, আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হবেন। অবশ্য নিয়মিতই তিনি এ সময়ে জামাকাপড় পরে বাইরে যান। অনেক রাত অবধি বাইরে থাকেন। এখানে সেখানে বসে আড্ডা দেন। তিনি কোথায় যান, এত রাত অবধি কোথায় থাকেন, কার সঙ্গে মেলামেশা করেন এসব নিয়ে কথাবাতার্রও অন্ত নেই। কিন্তু এসব নিয়ে গা করেন না তিনি, ঘরে ফেরেন মাঝ রাতে। এ নিয়ম কিংবা অনিয়ম করে চলার জন্য ভবতোষ বাবুকে কিছু বলার মতো কেউ নেই। তার স্ত্রী নেই, সন্তান নেই। ছোট ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে তিনি থাকেন, এক পরিবারের মধ্যেই। তবে তারা কেউ তার এ বেহিসেবি জীবন নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাড়িতে তার কাছে কখনো তেমন কেউ আসে না। কোনো মেয়ের তো আসার প্রশ্নই ওঠে না। সবাই জানে লোকটি বদমেজাজি এবং কিছুটা অন্যরকমও। তাই তাকে অনেকে ভয়ও করে। তা ছাড়া কারও তেমন দরকারও পড়ে না এ লোকটির কাছে। আজ হঠাৎ করে ভবতোষ বাবুর বাড়িতে এসেছে এক অচেনা অতিথি। তাও আবার একটি মেয়ে। সবাই ভেবেছিল হয়তো ভবতোষ বাবুর ছোট ভাইয়ের মেয়ে রিনার কাছে মেয়েটি এসেছে। কিন্তু মেয়েটি ভবতোষ বাবুর সঙ্গেই কথা বলতে চায়। কী আর করা! ভবতোষ বাবু মেয়েটিকে কাছে ডাকলেন। মেয়েটি হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, নমস্কার, আমার নাম মিতু। আমি বিদেশে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করি। ভবতোষ বাবু কিছুক্ষণ পলকহীন চোখে চেয়ে থাকলেন মেয়েটির দিকে। হাসি মুখে বললেন, নমস্কার। তা এখানে কোথায় এসেছো? মেয়েটি বলল, এখানে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছি। আমার গ্রামের বাড়ি কিন্তু আপনাদের কাছেই। পাশের ডিস্ট্রিক্ট। আবার যেন কিছুটা হতবাক হলেন ভবতোষ বাবু। জানতে চাইলেন কোথায়? মেয়েটিও এবার যেন সচকিত হলো। ভবতোষ বাবু পরিষ্কার দেখলেন, মেয়েটির ভ্রæ জোড়া যেন একটু বঁাকা হলো, নেচে উঠলো চোখ জোড়া, ঠেঁাটের কোণে যেন খেলে গেল একটু হাসির ছটা। মেয়েটি বলল, আমার বাড়ি হেমন্তপুর। সূযর্ তখন পশ্চিম আকাশে আরও কিছুটা ঢলে পড়েছে। বাড়ির পেছনের দিকে উঁচু গাছগুলোর পাতার ফঁাক দিয়ে এলোমেলো আলোর ঝলক এসে লাগছিল ভবতোষ বাবুর মুখে। সে আলোকে পরিষ্কার দেখা গেল। হেমন্তপুরের নাম শুনেই তার কপালের ভঁাজগুলো যেন আর একটু স্পষ্ট হয়ে উঠল। সাদা আর কমলা মেশানো টকটকে গায়ের রং ভবতোষ বাবুর। সে ঝলমলে রংও যেন কিছুটা মলিন হলো। আচমকাই যেন কালো ছাপ পড়ল তার কপালজুড়ে। কিন্তু নিমিষেই তিনি সামলে নিলেন। ঠেঁাটে একটু হাসির ঝিলিক তুলে তিনি খুব ছোট করেই উচ্চারণ করলেন, হেমন্তপুর! কোন বাড়ি? হেমন্তুপুরের মজুমদার বাড়ি! মজুমদার বাড়ির বাসন্তির সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়েছিল না! মেয়েটির আচমকা এ প্রশ্নে প্রচÐ ধাক্কা খেলেন ভবতোষ বাবু। তিনি উঠে দঁাড়ালেন। সারা গা যেন ভিজে গেল ঘামে। তিনি অদ্ভুত স্বরে বললেন, হ্যঁা, তা তুমি জান কী করে? একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল মেয়েটি। বাম হাতে বুক চেপে ধরলো যেন। আর ডান হাতের কটি আঙুলের মাথা দিয়ে চেপে ধরলো নিজের ঠেঁাট দুটি। প্রায় সত্তর বছর আগে ভবতোষ বাবুর পিতা শশিভ‚ষণ চাটুজ্যের তোলা এ জমিদার বাড়ি। বাড়ির পশ্চিম অংশজুড়ে প্রায় একশ’ হাত লম্বা দো-তলা ঘর। নানা রঙের কারুকাজ ঘরের দেয়ালে দেয়ালে। ফিকে হয়ে এলেও এখনো পরিষ্কার বোঝা যায় বারান্দার প্রতিটি খামের মধ্যেই সাদা, হলুদ, নীল আর বাহারি গোলাপি লাল রঙের নকশা অঁাকা। আজ এ গোধূলি বেলায় সে নকশার ওপর পড়া পড়ন্ত সূযের্র লাল আভা হঠাৎ করেই যেন ফিকে হয়ে গেল ভবতোষ বাবুর কাছে। সবকিছুই যেন কেমন ফ্যাকাশে মনে হলো। ঝিম ঝিম করে উঠলো মাথার বাম পাশটা। উঠে দঁাড়ালেন ভবতোষ বাবু। আস্তে আস্তে হেঁটে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেলেন। ত্রিশ বছর আগের কথাগুলো বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। জমিদার ঘরের বাউÐুলে বড় ছেলে ভবতোষ। যৌবন তখন উঁকি দিয়েছে মাত্র। সে বয়সেই প্রেমে পড়েন পাশের গ্রামের এক অতি সাধারণ পরিবারের সুন্দরী মেয়ে বাসন্তির। কাউকে না জানিয়ে বিয়েও করে ফেললেন। তারপর বাবার প্রবল আপত্তির মুখে বাসন্তিকে নিয়ে গ্রাম ছাড়লেন। উঠে এলেন কলকাতা শহরে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বাসন্তির মোহ কেটে গেল ভবতোষের। শুরু হলো আবার তার বেপরোয়া বাউÐুলে জীবন। তার মধ্যেই আবার পারিবারিক চাপ। ভবতোষের বাবা হাজার হাজার টাকা খরচ করলেন ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য। শেষ পযর্ন্ত বাসন্তিকে একা ফেলে রেখেই মাত্র দেড় মাসের মাথায় ভাবতোষ ফিরে এলো নিজ বাড়িতে। বাসন্তির কথা একরকম ভুলেই গেল সে। ওদিকে বাসন্তির যে আর দিন চলে না। এই বিশাল শহরে কার কাছে যাবে সে, কী করবে, কোনোই ক‚ল-কিনারা দেখতে পেল না বাসন্তি। একদিন নিজে নিজেই বাসন্তি ফিরে এলো নিজ গ্রামে। যোগাযোগ করল ভবতোষের সঙ্গে। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। ভবতোষ জমিদারের ছেলে, টাকা পয়সার কমতি নেই, লাম্পট্য তার অঙ্গে অঙ্গে। সে তখন জড়িয়ে পড়েছে শহরের অন্য এক নারীর সঙ্গে। ভবতোষ বাসন্তির কাছে সে কথা স্বীকার করল না, আর বাসন্তিও এ নিয়ে তাকে কিছু বলল না। লেখাপড়া জানা, দেখতে সুন্দর, চটপটে গুণী মেয়ে বাসন্তি। চালাক চতুরও কম নয়। সে কেন পড়ে থাকবে এ রকম স্বামীর কাছে। তিনি নিজেই ভবতোষকে ডিভোসর্ দিল। বাসন্তি গিয়ে উঠল ঢাকায় তার এক বন্ধুর বাসায়। শুরু করল স্কুলে শিক্ষকতা। তারপর সে বন্ধুটির হাত ধরেই সে পাড়ি জমায় অস্ট্রেলিয়া। গত কয়েক বছর ধরে তারা সেখানেই থাকে। সেখানে গিয়ে বাসন্তি আরও লেখাপড়া করেছে। চাকরিও নিয়েছে একটি বড় প্রতিষ্ঠানে। বেশ ক’বছর ধরে তারা সেখানেই থাকে। অন্তত ভবতোষ বাসন্তি সম্পকের্ তাই জানে। বাসন্তির কথা মনে পড়তেই ভবতোষ বাবুর বুক চিরে কষ্ট হতে লাগল। হ্যঁা, বাসন্তির সঙ্গেই তো আমার বিয়ে হয়েছিল। ও কেমন আছে? তার স্বামী? এবার যেন অন্যদিকে ঘুরে দঁাড়াল মেয়েটি। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল তার। মেয়েটি যেন চুপি চুপি কিছুটা কঁাদল। বিদেশে থাকা মেয়ে বলেই বোধ হয় সে কান্না কেউ দেখল না। ততক্ষণে এ মেয়েটিকে চা দেয়া হয়েছে। সঙ্গে কয়েকটি বিস্কুট। সামনের টেবিলে পড়ে থাকা সে দুটি বিস্কুটের দিক থেকে চোখ ফেরালো মেয়েটি। আবার চাইলো ভবতোষ বাবুর চোখের দিকে। ভবতোষ বাবুর মনে হলো একরাশ ঘৃণা মেয়েটির চোখে-মুখে। ভবতোষ বাবু চোখ ফেরালো অন্যদিকে। মেয়েটি বলল, বাসন্তির তো বিয়ে হয়নি। অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েই বুঝতে পারেন, তিনি মা হতে চলেছেন। আর তারপরই সে বন্ধুটি তাকে ছেড়ে চলে যায়। কে জানে, সে এখন কোথায় আছে। আবার ঘুরে দঁাড়ালেন ভবতোষ বাবু। তুমি এত সব জানলে কী করে? বাসন্তির সঙ্গে তোমার সম্পকর্ কী? মেয়েটি এবার যেন আবার কিছুটা আনমনা হলো। সন্ধ্যার অঁাধারেও স্পষ্ট দেখতে পেলেন ভবতোষ বাবু, মেয়েটির সুন্দর মুখের ওপর ঝলমল করছে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া কয়েক ফেঁাটা জল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখে মেয়েটি। খুব চাপা স্বরে মেয়েটি যা বলল, তা পুরোপুরি ভবতোষ বাবুর কানে পেঁৗছালো না। আধাআধি শুনেই তার দু’চোখ বন্ধ হলো। টলতে টলতে বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়লেন ভবতোষ বাবু। এ সময়ে তার পা’ জোড়া এলোমেলো হলো কিনা, কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ল কিনা, তার চেহারাটি একেবারেই বিষণœ হয়ে গেল কিনা, তা দেখার মতো সেখানে কেউ ছিল না। নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ। মনে হলো কোথাও কোনো শব্দ নেই, আলো নেই, বাতাস নেই। মেয়েটি আবার বলল, বাসন্তি আমার মা!