দলছুট

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আকলিমা সোমা
আমাদের গল্পের চরিত্র সার্জিল। বয়স ২৬। সকাল সকাল সু্যট-কোট পরে দৌড়াচ্ছে। পেছনে ফেলে যাচ্ছে চেনা পথ-ঘাট, লালকালিতে লেখা রাজপথের স্স্নোগান। উদ্দেশ্য বাস স্ট্যান্ড, দৌড়াচ্ছে কারণ পথে একটাও রিকশা নেই। আজ কী স্ট্রাইক? আমরা আপাতত জানি না। আমাদের গল্পে সার্জিল দৌড়াচ্ছে। মহাসড়ক ধরে সাঁইসাঁই চলে যাচ্ছে বাস-ট্র্যাক। বাস ছুটছে, সার্জিল ছুটছে। চলন্ত বাসের হাতল ধরে ঝুলে পড়ে, পা দুটো কোনো রকম জায়গা করে নিয়েছে আরও অনেকগুলো পায়ের ভিড়ে, কিন্তু দাঁড়াতে আর পারছে কই? পায়ের নিচের অবস্থানটা শক্ত করতেই সার্জিল ছুটছে। ছুটছে বগলে ফাইল নিয়ে। গল্পের দ্বিতীয় দৃশ্যে আমরা দেখি সার্জিল বসে, মুখোমুখি আরও তিনটে মুখ। কী ভীষণ গম্ভীর আর কাঠিন্যের ছাপ সেসব মুখে। তারা জানে সার্জিলের চাকরিটা হবে না এবং এমন কিছু প্রশ্ন করতে হবে যেন সে নিজেকে অযোগ্য মনে করে। সার্জিল জানে তার চাকরিটা হবে না কারণ চাকরিটা অন্য একজনের হয়ে আছে, টিকে থাকার লড়াইয়ে সার্জিল আবার ছিটকে পড়বে। আমরা দেখব সার্জিলের পরাজিত মুখে ক্লান্তির ছাপ, সার্টিফিকেটের ফাইল হাতে সার্জিল রাস্তায় নেমে টাইয়ের বাঁধন আলগা করে। সভ্যতার নাগপাশ আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে তার গলায়, হাঁসফাস লাগে তাই ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সার্জিল ফুটপাত ধরে হাঁটছে উদ্দেশ্যহীন, যেখানে জীবনের নানান পসরা সাজিয়ে খদ্দেরের অপেক্ষায় আছে সমাজের নিচুতলার মানুষ। হঠাৎ পুলিশের গাড়ির হুঁইসেল শুনে তাদের ব্যস্ততা বাড়ে। পণ্যের বোঝা মাথায় তারা এদিক-ওদিক ছুটে ফুটপাত খালি করে দিতে, হোঁটচ খেয়ে পড়ে যায় ছোটছেলে, মাথা থেকে ছিটকে পড়ে কাপড়ের ঝুড়ি, ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। শশব্যস্ত ছোটছেলে কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড় কুড়োতে থাকে দ্রম্নত। চারপাশে গোল হয়ে মানুষ দেখে তার ভয়ে তটস্থ ছোটমুখ। সার্জিল দেখে, তার বিরস লাগে সবকিছু। সে এগিয়ে যায়। গল্পের তৃতীয় দৃশ্যে আমরা প্রবেশ করি। অপরাহ্নের নরম আলোয় আমরা দেখি একটি মুখ, কচি লাউডগার মতো স্নিগ্ধ। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে নীরবতা ভাঙার। নির্বিকার ভঙ্গিতে সার্জিল শূন্য করছে চায়ের কাপ। গুমোট পরিবেশ, পেছনে লালকালিতে লেখা "রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ" দোকানি নিজে লিখে দিয়েছে। তারা কী এখানে রাজনৈতিক আলাপ করছে? খানিকক্ষণ উশখুশ করে নীরবতা ভাঙে মেয়েটিই। - কী করবে তাহলে? - বারবার এক কথা বলতে ভালো লাগে না। - তুমি সিরিয়াস? গ্রামে গিয়ে চাষবাস করবে? - আমি ফাইজলামি করার মতো অবস্থায় নেই আর এমন কিছু অবাস্তব তো বলছি না। - একজন চাষার সঙ্গে নিশ্চয়ই বাবা আমাকে বিয়ে দিবে না। - তোমাকে তোমার বাবা বিয়ে দেওয়ার কে? তুমি কার সঙ্গে জীবন কাটাবে সেটা একান্তই তোমার সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। বিয়ে তো তোমার বাবা করবে না। - জেদ কর না লক্ষ্ণীটি। পিস্নজ, আরেকটা বার চেষ্টা কর। আমি মানত করেছি তোমার চাকরি হলে দরগায় দুটো ছাগল দিব। - ঘুষ দিচ্ছ? ঘুষ দিতে পারলে তো চাকরিই হতো। আবারও অসহ্য নীরবতা নেমে আসে। আবারও নীরবতা ভাঙে মেয়েটি। - আমি আসি। - তুমি আসবে? গল্পের শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই মহাসড়কের পাশে ফুটপাতে সার্জিলের পাশে এসে দাঁড়ায় বোরকাবৃতা মেয়ে, তারা সিএনজিতে ওঠে। তারা ছুটছে। পেছনে ফেলে পরিচিত পথঘাট। নগর শেষে গ্রামের কাছে এসে গাড়ি থামে। তারা ছুটছে রোদ ঝলমলে ধানখেত ধরে। পেছনে গাড়িতে পড়ে আছে তাদের বোরকা, সু্যট-কোট, জুতোজোড়া। মধ্য দুপুরের ভীষণ রোদে, তারা ছুটছে নগ্ন পায়ে আলপথ ধরে।