বই আলোচনা

ভাঙনের শব্দ

প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

অরূপ পালিত
আলোকিত নারী 'তেমনি এক সফল সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম। তার সৃষ্টি ও কর্ম মানুষকে কল্যাণের পথে, সুন্দরের পথে পরিচালিত করে। তার আলোয় সমাজ হয়ে ওঠে আলোকিত। তারা কখনো নিজের জন্য জন্মান না, তারা যুগে যুগে মানুষের প্রয়োজনে জন্মান।  তিনি একজন বহুমাত্রিক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। পরিশ্রমী গবেষক, দক্ষ শিক্ষাবিদ এবং জ্ঞানী বক্তা। বেতার-টিভির ও জনপ্রিয় উপস্থাপক হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত মুখ। মায়া মুখের ওপর সংগঠক হিসেবে তিনি অনন্য।  সাহিত্যের অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন সন্মান। 'ফয়েজ নুরনাহার সাহিত্য পুরস্কার' (প্রবন্ধ-গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য) ১৯ ফেব্রম্নয়ারি ২০২২, এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্তৃক একুশে পদক-২০২৩ (প্রবন্ধও গবেষণায়)।  আমার মনে হয়, যে বইয়ের আলোচনা আগে বই নিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। আমি এই পর্যন্ত বেশ কিছু বই আলোচনা করেছি। বইয়ের গল্পের মধ্যে ডুবে গেছি শুধু। কিন্তু সমাজের জন্য কিছু কী রেখে যাচ্ছি? কারণ আমাকে তো কেউ লিখতে বলেনি। আমি যখন লিখছি তখন নিশ্চয় সমাজের জন্য দায়বদ্বতা নিয়ে লিখি। আমি আমার নিজের কথাই বলছি এবং একই কারণে প্রতিনিয়ত আমি লিখছি। কিন্তু কয়টা লেখা পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পারছি তা আমি নিজেও জানি না। আসলে কোনো কিছু না পড়ে লেখা যায় না।  অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলমের বই নিয়ে লিখতে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়েছে আমার। মনে হচ্ছে আমি শব্দের ভান্ডারে ডুবে যাচ্ছি। আমি এমন একটি বই পেয়েছিলাম আদিবাসী গবেষক হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা। বইটা হাতে পেয়ে উনার কাছে শব্দের জন্য আশ্রয় চেয়েছি। তিনি আমাকে পড়তে বলেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, শঙ্খ ঘোষ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেনকে এবং ভাষার জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে। ড. আনোয়ারা আলমের বই পড়ে আমার শেখার এবং জানার জন্য আরো কৌতুহল বেড়ে যায়। আমি তাকে পেয়েছি সব্যসাচী লেখক কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের মতো। আমি যদি তাকে বা তার গল্পকে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে তেমন  ভুল হবে কী। কারণ সৈয়দ শামসুল হকের গল্পসমগ্র আমি পড়েছি। যেমন হিজল কাঠের নাও/তৃষ্ণা/ প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান। এই লেখাগুলো পড়লে জানার জন্য হৃদয়ের আকুলতা বেড়ে যায়। তেমনি ড. আনোয়ারা আলমের 'ভাঙনের শব্দ' পড়ে আমার আরো আকুলতা বেড়েছে জানার আগ্রহে। প্রিয় কথাসহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের 'গল্পসমগ্র' ৬৩টি গল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আর ড. আনোয়ারা আলম যাত্রা শুরু  করেছেন ছোট্ট বহর নিয়ে সঙ্গে নিয়েছেন ১৬টি সন্তানকে। বইটি নামকরণের এনেছেন ভিন্নতার মাত্রা 'ভাঙনের শব্দ'। বইয়ের এইটা প্রথম গল্প 'ভাঙনের শব্দ'। গল্পটা তিনি দারুণভাবে শুরু করেছেন সাহসিকতা নিয়ে। গল্পের শুরুতে প্রতিনিয়ত আমরা যে হয়রানি শিকার কাস্টমসকে দিয়ে। একজন  মানুষ তিক্ততা না পেলে সহজে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান না। জনগণের সেই তিক্ততার থেকে কাস্টমস চাইলে কী বের হতে পারবে? পাকা হাত বলে কথা, গল্পকার বুঝিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসা জন্য মানুষ কতই না ত্যাগ স্বীকার করে। ভাঙনের শব্দে  মূল চরিত্রটি হচ্ছে মিলি। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। মিলি গাড়িতে বসেই দুটি হাত মামুনের সামনে এনে বলে- 'দ্যাখ তো' কিছু বুঝতে পারছ কিনা!' 'দ্যাখছি! দু'হাতের দশটি আঙুলের নখগুলো বেশ লম্বা। আর রংয়ের কারুকাজে সাজানো, ব্যাপার কি বলো তো? নখ কাটার সময় নেই-নাকি এটিও ফ্যাশন' এই গল্পে গল্পকারের লেখনীতে দেখলাম একজন নারীকে সাহসী চরিত্রে বসিয়েছেন। মিলির দুই বছরের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে, নিজেকে সামলাতে শিখেছে। বেশ পরিবর্তন। মেদহীন ছিপ-ছিপে-শরীরটা বেশ লাগছে। এর মাঝে মিলির প্রবাস জীবনের গল্প। 'এক বছর হলো বিউটি পার্লারের কাজ করছি- অবশ্য এক মাস ট্রেনিং নিতে হয়েছে।' মিলির মুখে হাসি- 'কি মজা- তাই না মামুন! দেশে যখন ছিলাম বিউটি পার্লারে যাদের সেবা নিতাম সেই সেবাতে এখন আমি।' মিলি হঠাৎ চুপ হয়ে যায়- কিছুক্ষণ পরে গভীর দীর্ঘশ্বাসে- 'মামুন'! প্রায় রাত এগারাটায় বাড়িতে ঢুকে দুজন। মিলি এখন অন্যরূপে- যেন উচ্ছ্বল এক বালিকা। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের খুপরি বন্দিজীবনের বাইরে এ যেন খোলা হাওয়া। হঁ্যা- এ বাড়িটা মামুন ও মিলির নয়। মিলির বাবার বাড়ি। এক সময়ের তুখোড়  ছাত্রনেতা মামুন স্বৈরাচারী এরশাদের কারণে আন্ডার গ্রাউন্ডে যাওয়া মানুষটিকে মিলির জেদ এবং ভালোবাসার কাছে হার মেনে নেওয়া। গল্পকার এই দুইজনের মাঝে নিয়ে এসেছেন রূপার মতো ইন্টারেস্টিং চরিত্র। স্বামী-সন্তান থাকার পরও কেন পর পুরুষের সঙ্গে রসায়ন। রূপার উদাসীন বেদনার পলকে ছুঁয়ে গেল মিলির মনে। নির্ঘুম সারারাত মনে পড়ছে- মলে মিলির সঙ্গে কাজ করা এক স্প্যানিশ তরুণকে। সম্ভবত মিলিকে তার মনেও ধরেছিল। মিলি সযতনে এবং সাবধানে সম্পর্কটা বন্ধুত্বে রেখেছিল। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে একসঙ্গে আড্ডা দিত দুজনে। ও বেশ বিস্ময়ে একটা কথা প্রায়ই বলতো- 'মিলি! তুমি তো সন্ন্যাসিনী সেজে বেশ সুন্দরভাবে সময়কে হারিয়ে দিচ্ছো বা নষ্ট করছ। তোমার স্বামীও কী তাই! 'মিলি বুঝেনি যুবকের কথা। 'ওহ ডিয়ার খুলে বলি! পুরুষ মানুষ- এতটা সময় সেক্স ছাড়া দিন কাটাচ্ছেন তিনি?  হৃদয়ের অনুভূতির কাছে শরীরের চাহিদা একবারে গৌণ- যুগ যুগ কাটাতে পারি। আমরা গর্ব করি এটিকে- তোমাদের ভোগবাদী সমাজ এটি বুঝবে না।  আমি গল্পটা সবাইকে পড়ার জন্য অনুরোধ করছি এই কারণে অনেক কিছু শেখার আছে এই গল্পে মাধ্যমে। মামুনের চরিত্রটি শেষ মুহূর্তে কীভাবে নিল মিলি। কিছু কথা পাঠকের জন্য রেখে দিলাম। আফসোস থেকে গেল আমারও নিজের ভেতর। অনেক কষ্ট জমা পড়েছে ধুলোবালি মাখা তিক্ততার শহরে। আমি পাঠক হয়ে বলব, প্রেমহীন শূন্যতায় ভরে উঠবে যে জীবন- প্রেমহীন দাম্পত্য জীবন যে ভারী যন্ত্রণার। কিছু কথায় গল্পকারকে আমার মনে হয়েছে বেশ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় গল্পে মধ্যে আমি তা পেয়েছি। এখানে অনেক চমৎকার  গল্প আছে, একজন রানুর গল্প/অপেক্ষা/ক্যাকটাস/কাঠগড়ায় মা/ট্রেনের শব্দে/আমি এক সময়ে দ্বিতীয় হয়েছিলাম/অনিশ্চিত যাত্রা/স্মৃতির বেদনা/আনন্দ আর বেদনা/ দুর্ঘটনা/মালতী/মানিব্যাগের ভেতরে একটা চিঠি/এই তো জীবন/চোরাবালি। অপেক্ষা- তার এই গল্পের মধ্যে আমি তার স্বরূপে আবির্ভূত হতে দেখেছি। যেমন সেলিনা হোসেনের বিশাল গল্প ভান্ডারে সমৃদ্ধ গল্পসমগ্রতে ৮৬টি সন্তানের মাকে দেখতে পেয়েছি। তেমনি চমৎকার গল্প পেয়েছি ড. আনোয়ারা আলমের কাছে। যেমন দুর্ঘটনা/মালতী/মানিব্যাগের ভেতরে একটা চিঠি/এই তো জীবন/চোরাবালি। এইখানে আমি ড. আনোয়ারা আলমকে সেলিনা হোসেনের ছায়ায় দেখতে পেয়েছি। সেলিনা হোসেনের প্রতিবাদ নারীত্বের রহস্যময় জীবন 'গায়ত্রী সন্ধ্যা' উপন্যাসে সেলিনা হোসেনকে যেমন পেয়েছি। আনোয়ারা আলম আপাকে তেমনি একজন সাত্ত্বিক গল্পকার হিসেবে পেয়েছি। এখানে চমৎকার অনেক গল্প আছে। একজন রানুর গল্পে আমাকে দাম্পত্য জীবন সমাজ-সংস্কৃতি মানবতা মূল্যবোধ সবমিলিয়ে ভাবিয়ে তুলছে। ভালোবাসায় ভিজে গেছি রসায়নে। আমি পাঠক হিসেবে অন্য পাঠকের মন্তব্যর জন্য ছেড়ে দিলাম। গল্পকার বইটি উৎসর্গ করেছেন শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফীকে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে গ্রন্থটি বিশেষ অবদান রাখবে বলে আমার সুদৃঢ প্রতীতি। অনুপম সুকুমার বৃত্তি আর মানবতার স্নিগ্ধছোঁয়ায় ঋদ্ধ কবি আর তারই হৃদয়ের নির্যাস গল্পগুলো আলোকছটায় উদ্ভাসিত হোক এই তমসা ঢাকা যুদ্ধ-যন্ত্রণায় কাতর বসুধা। জয় হোক গল্প এবং গল্পকারের। গল্পের মতো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকুক জীবনের পরতে পরতে। বইটির প্রকাশক 'গল্পকার'। সুন্দর প্রচ্ছদটিও করেছেন গল্পকার। বইটির মূল্য ২০০ টাকা।