হেরল্ড হার্ট ক্রেন জীবন ও কবিতা

১৯৭০ ও ১৯৮০ সালের দিকে পন্ডিতরা ক্রেইনের উৎকট তত্ত্ব সম্পর্কে পুনঃগবেষণা করে বলেছেন, ক্রেন একজন বহিরাগতের মতো উৎকট জীবনের সামাজিক ও ঐতিহাসিক অবস্থাকে অস্পষ্ট ও রূপকভাবে প্রকাশ করেছেন। টিম ডিনের মতে, গোপনীয়তাকে ক্লেদ দ্বারা উৎপাদন রীতির মাধ্যমে ক্রেনের রুদ্ধভাষা কামজ ও মনস্তাত্ত্বিক উভয় জীবনকে ধ্বংস করেছে। ডিন এবং অন্য সমালোচকরা দেখিয়েছেন, ক্রেনের উৎকটতাভাব তার কবিতার গন্তব্য পথে জটিলতা তৈরি করে রেখেছিল। ডিনের ভাষায়, 'ক্রেনের কবিতা নির্দেশ করে প্রত্যক্ষভাবে সম্ভাব্য ছন্দোময় রূপের পরিবর্তন করে সমজাতীয় যৌন আবেদন ও আত্মনিষ্ঠা বিনির্মাণকরণ'।

প্রকাশ | ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

মুহম্মদ সালাহউদ্দীন
আমেরিকার সাহিত্যে হার্ট ক্রেনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি ভবিষ্যদ্বাণীর কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাকে কয়েক দশক ধরে উচ্চ আধুনিকতাবাদের জটিল শৈলীধারার রোমান্টিক কবি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ক্রেনের আমেরিকান রোমান্টিসিজমের সংস্করণ প্রসারিত হয়েছিল ওয়াল্ট হুইটম্যান থেকে রালফ ওয়াল্ডো এমারসন পর্যন্ত। তার অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী কাজ 'দি ব্রিজ' এ তিনি লিখেছেন, 'আমেরিকানদের নিজের সম্পূর্ণতার অভিজ্ঞতার মধ্যে অভিব্যক্তির কোন ঘাটতি নেই। 'এসে অব ফোর ডিকেড' প্রবন্ধে এলেন টেইট লিখেছেন, 'ক্রেন ছিলেন এমনই এক কবি যাকে মনে হয় প্রত্যেক যুগের আধ্যাত্মিক চেতনার মুখপাত্র'। \হক্রেন ১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই ওহিও রাজ্যের গ্যারেটসভাইলে এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্লারেন্স এ ক্রেন ও মাতা গ্রেস এডনা হার্ট। তিনি জীবনের অনেকটা সময় ক্লিবল্যান্ডে তার নানির কাছে ছিলেন। তার নানির বড় একটা লাইব্রেরি ছিল। সেখানে ভিক্টোরিয়ান রবার্ট ব্রাউনিং, আমেরিকার রালফ ওয়ালডো, এমারসনদের মতো কবিদের সমন্বিত সাহিত্যকর্মের সংস্করণসহ তাদের সব ধরনের বই ছিল। ক্রেনের কবিতায় উভয় কবিরই বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। মাত্র সতের-আঠার বছর বয়সেই তিনি দার্শনিক পেস্নটো, ঔপন্যাসিক বালজাক, রোমান্টিক কবি শেলী প্রভৃতি লেখকদের লেখা ব্যাপকভাবে পড়াশোনা করেন। পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনি প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকতেন। ১৯১৬ সালে এন্ট্রাস পাস করে পড়ালেখা করার উদ্দেশ্যে তিনি নিউইয়র্ক শহরে যান। \হযদিও তার পড়াশোনা তেমন এগোয়নি। তিনি কলেজ পরিত্যাগ করে সাহিত্য চর্চাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে সাহিত্য জগতে নিমগ্ন হতে ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করেন। ক্লিবল্যান্ডে থাকাকালীন তার সঙ্গে একজন চিত্রশিল্পীর পরিচয় ছিল। পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্কে আসার ফলে তার সঙ্গে আরও অনেক শিল্পীর পরিচয় হয়। তিনি তাদের কাছ থেকে চিত্র শিল্পের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তিনি সমসাময়িক আইরিশ কবি উইলিয়াম ইয়েটস ও জেমস জয়েস থেকে শুরু করে ফ্রান্সের প্রতীকবাদী কবি শার্ল বোদলেয়ার, আর্থার রিমবাউট প্রভৃতি লেখকদের ওপর ব্যাপক পড়াশোনা করেন। \হক্রেন আর্থিকভাবে পিতা-মাতার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। অন্যদিকে তিনি আধুনিকতাবাদী কবি জয়েস ও টি এস ইলিয়টসহ গতানুগতিক লেখক নাথানিয়েল হথ্রোন, ওয়াল্ট হুইটম্যান থেকে শুরু করে শিরউড এন্ডারসন ও আরও অনেক লেখকের বইয়ের ছোট ছোট রিভিও পত্রিকা বিক্রি করতেন। এসব লেখকদের লেখা বইয়ের রিভিউ পড়ে তিনি তাদের অনেকের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। ক্রেন রবার্ট ফ্রস্ট এর 'সেভেন আর্টস' নামক রিভিও পত্রিকাও বিক্রি করতেন। পত্রিকা বিক্রির সুবাদে তার কবিতার মধ্যে জেমস জয়েস, টি এস ইলিয়ট ও রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার ছাপ ছিল। ১৯১৭ সালের মধ্যে তিনি ছাপার যোগ্য লেখা লিখে ফেলেন। এ সময় 'পেগান' নামক স্থানীয় পত্রিকায় তার কিছু লেখা ছাপা হয়। তখন থেকেই গতানুগতিক এবং পরীক্ষণমূলক উভয় লেখার প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি ছন্দোবদ্ধ প্রকরণে সমসাময়িক চিত্রাবলী শ্রম্নতিকটূ ভাষায় ব্যক্ত করেন। অনেক সমালোচক তার জীবনের প্রথমদিকের কবিতার প্রশংসা করলেও তিনি সেগুলোকে উচুঁভাবে তুলে ধরেননি এবং তিনি সেগুলোকে আর পুনঃমুদ্রণ করেননি। \হক্রেন প্রথমদিকে নিউইয়র্ক সিটিকে প্রাণবন্ত ও অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেছেন। ১৯১৭ সালে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তার মা ও নানি ক্রেনের সঙ্গে থাকতেন। মানসিক অবসাদ ও বেদনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার মা সবসময় ক্রেনের সান্নিধ্য চেয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক দীনতার কারণে ক্রেন হতাশ হয়ে পড়েন। অন্যদিকে পিতার সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। পারিবারিক চাপের কারণে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শারীরিক অযোগ্যতার কারণে সেখানে তার চাকরি হয়নি। এরপর তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে ক্লিবল্যান্ড চলে যান। সেখানে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেন সমরাস্ত্র কারখানায় চাকরি করেন। যুদ্ধ শেষে ক্রেইন সেখানে 'ক্লিবল্যান্ড পেস্নইন ডিলার' নামে একটি পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেণ। ১৯১৯ সালে তার পিতার প্রভাবের কারণে ক্রেন জাহাজ কোম্পানির কেরাণী হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। সেখানে কয়েক মাস চাকরি করার পর তিনি ওহিও রাজ্যে তার পিতার কোম্পানিতে কাজ করতে চলে আসেন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে অবস্থান করার কারণে তাদের মধ্যে সমঝোতার সম্পর্ক ছিল না। বিশেষত তার পিতা মাতৃত্বের সম্পর্ক নিয়ে কটূক্তি করার কারণে ক্রেন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, তিনি আর তার পিতাকে কোন কাজে সহযোগিতা করবেন না। পিতার কোম্পানি ছেড়ে যাওয়ার পর তিনি ক্লিবল্যান্ডে একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ শুরু করেন। ক্রেন এ ধরনের কাজ নিউইয়র্ক শহরেও পেয়েছিলেন। কিন্তু পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি ক্লিবল্যান্ড থেকে যান। ১৯২২ সালের মধ্যে তিনি অনেক লেখালেখি করেন। ওই কবিতাগুলোর বেশির ভাগই 'হোয়াইট বিল্ডিং' নামক সংকলনে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে 'চেপলিকুইস' কবিতাটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত কৌতুক ছবি 'দি কিডস' দেখে তিনি তা লিখেন। 'দি কিডসের' প্রধান চরিত্র ছিল কৌতুক প্রিয়, অকর্মা ও ভবঘুরে লোক। কবি নিজেকে ছবির প্রধান চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, প্রধান চরিত্রের অনুসৃতি অতি নগণ্য অনুভূত হলেও তা নিগূঢ়। ক্রেনের মতে, ছবিটির আশাবাদিতা ও চেতনা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কবির নিজের দুর্দশার সঙ্গে মিল রয়েছে। অন্যদিকে ভবঘুরে লোকটিকে আপাত দৃষ্টিতে উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও দুর্দশাগ্রস্ত মনে হলেও এখানে তার নিরীহতা নির্দেশ করে। তাই কবি লিখেছেন : পার্শ্বচিত্র করে যাব আমরা বোকা হাসি হেসে/ ছেলে খেলা করে ভাগ্যলিপি নিশ্চিত পিসে যাবে/কালশিটে বলি আস্তে করে বলে দেয়/ যা কিছু সরল তার অভিমুখ অনুজ্জ্বল/এবং কি বিস্ময়! ১৯২০ সালে 'ফর দি ম্যারেজ অব ফস্টাস এন্ড হেলেন' কবিতায় ক্রেন এক ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সমকালীন এক বিয়ের সময় ফস্ট রাস্তার একটা গাড়িতে উঠেছে এবং হেলেন একটা জাজ ক্লাবে এসেছে। এ কবিতায় কবি উত্থাপন করেছেন, ফস্ট কবির আদর্শ সুন্দরকে উপস্থাপিত করেছে যার জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। অন্যদিকে হেলেন সে সুন্দরকে মূর্তমান করেছে। কবিতার উপসংহারে হেলেনের সৌন্দর্যকে সে সময়ের জয়োৎসব হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশেষত, তখনকার বিশ্বযুদ্ধের হতাশাকে ছাড়িয়ে সে সময়কে ক্রেন ছন্দময় উদ্ভাবনের স্বীকৃতি দিতে বলেছেন। 'ফর দি ম্যারেজ অব ফস্টাস এন্ড হেলেন' কবিতাটি সে সময়ে ক্রেনের আবেগকে কমই প্রকাশ করেছিল। ওই কবিতাটি লেখার কিছুদিন পরই তিনি নিউইয়র্ক শহরে ফিরে আসেন ও একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরিতে যোগ দেন। তার কাছে মনে হয়েছে এ চাকরিটি বিরক্তিকর ও মর্যাদাহীন। এ হতাশাজনক পরিস্থিতিতে তিনি শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাটে বিভিন্ন ধরনের দাঙ্গা হাঙ্গামা এবং অনেক অনভিপ্রেত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এক সময় তার কল্পনা এবং মনোযোগ শক্তি দুর্বল হয়ে আসতে থাকে। তখন তিনি অনুভব করলেন যে, এ অস্থিরতা তাকে মানসিক বৈকল্যের দিকে নিয়ে যাবে। তাই তিনি ভয় পেয়ে পাশের উডস্টকে চলে যান। সেখানে তিনি তার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবসহ গ্রামীণ পরিবেশে কিছু দিন প্রশান্তিতে কাটান। \হক্রেন পুনর্জীবন লাভ করে আবার নিউইয়র্কে ফিরে আসেন। এর কিছু দিন পর ইমিল অফার নামে এক নাবিকের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে কখনও কখনও কামজ আবেগের তীব্রতা আবার কখনও কখনও প্রচন্ড অস্থির সম্পর্ক ছিল। তিনি এ সম্পর্ককে ভালোবাসার ছন্দময় প্রশস্তির অনুক্রম হিসেবে দেখেছেন। এ সময় তিনি 'ভয়েজেজ' নামে একটি কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। কুইন নামক একজন সমালোচক ক্রেনের এ কবিতাটিকে বর্ণনা করেছেন 'ভালোবাসার রূপান্তরিত শক্তির উদযাপন হিসেবে'। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, মানুষের প্রতি প্রেমিকের উৎসর্গ যেহেতু পরিবর্তনশীল সুতরাং অস্থির সময় পরিবর্তনের পরও তা প্রিয় হতে পারে সমুদ্রের রূপ ও গতিবিধির মতো'। এখানে সমুদ্রের পরিবর্তনশীল ঝঞ্ঝা, বিক্ষুব্ধতা ও শান্ততা ইত্যাদিকে ভালোবাসা হিসেবে উপস্থাপন করে আমাদের সবাইকে পরিত্রাণ করার সেবক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে : হে সময়, সম্ভ্রমের মাঝে রেখে দিও মুক্ত করে/ক্যারীব ঝঞ্ঝায় পাল তোলা জাহাজের ছন্দ/ ভরার্পণ করো না মৃন্ময়ীর কোন ধার/ ঝঞ্ঝার মাঝে সমাধির উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত/ বিস্তীর্ণ ফেনরাশি রেখে দিও স্বর্গপানে। ক্রেনের এ কবিতার উজ্জ্বল ভাব ও রহস্যময় উদ্দীপনার চিত্রানুপাতের কারণে এটিকে প্রায়শই তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে গণ্য করা হয়। সমালোচক আর ডবিস্নও বি লিউইসের মতে, 'এ কবিতাটি হলো ক্রেনের সেরা গীতধর্মী রচনা'। ১৯২৪ সালে তিনি 'ভয়েজেজ' কবিতা লেখা শেষ করেন। ইতোমধ্যে তিনি তার সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কবিতা 'দি ব্রিজ' প্রবর্তন করেছিলেন। ক্রেন দীর্ঘ কবিতাটিকে কিছুটা হলেও টি এস ইলিয়টের সেরা রচনা 'দি ওয়েস্ট ল্যান্ড' এর বিকল্প হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। পনের অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট ষাট পৃষ্টার বড় এ কবিতার মাধ্যমে ক্রেন- যাকে তিনি 'দি এক্সপেরিয়েন্স' বলে অভিহিত করে থাকেন তার একটা পরিদৃশ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ওই কবিতায় প্রতীক হিসেবে তিনি ব্রম্নকলিনের ব্রিজকে গ্রহণ করে বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন মানুষের-বিশেষ করে অনুসন্ধানী ক্রিস্টোফার কলম্বাস এবং পুরানখ্যাত রিপ ভেন উইংকেল থেকে শুরু করে সমসাময়িক নিউ ইংল্যান্ডের প্রাকৃতিক ভূচিত্র ও ইস্ট রিভারের সাবওয়ের চিত্রাবলি অস্পষ্টভাবে প্রচার করেছেন। 'দি ব্রিজ' কবিতাটিতে ক্রেন আমেরিকাকে বিনির্মাণকরণের ঐক্য হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। অধিকন্তু, তিনি উৎসাহের উৎস হিসেবে আমেরিকানদের আশাবাদ ও দেশপ্রেমের প্রতি একনিষ্ঠতা অসাধারণ বাস্তবরূপে রূপায়িত করার চেষ্টা করেছেন। ১৯২৬ সালে ক্রেইন যখন 'ব্রিজ' নিয়ে কাজ করছিলেন তখন তার কবিতা সংকলন 'হোয়াইট বিল্ডিং' প্রকাশিত হয়। এ কবিতা সংকলনটির মাধ্যমে তিনি আড়ম্বরপূর্ণ প্রকৃত শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তার রচনার ভাবমূর্ছনা ও চিত্রাবলি ফ্রান্স প্রতীকবাদী কবি বোদলেয়ার ও রিমবাউটকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি মাঝে মাঝে বোধ-এর পরিবর্তে শব্দকে ব্যবহার করেছেন। তাই একটা গুঞ্জন ছিল, ক্রেন ছিলেন সূক্ষ্মতা ও শৃঙ্খলাহীন একজন রূপকার। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মেবাউট উইলস তার নিউ রিবাউট প্রবন্ধে লিখেছেন, 'ক্রেন মাঝে মাঝে আমাদের নাড়া দিতে সক্ষম হলেও তার অনুভূতির প্রকাশ ছিল অদ্ভুত ধরনের অস্পষ্ট'। 'দি সোরস্‌ অব লাইট' এ গ্রন্থিত প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, 'বড় মাপের কোনো শিল্প শৈলীকে যদি কোনো অভিধায় সংযুক্তি না করা হয়ে থাকে তাহলে মৌলিক রচনাকে আচ্ছন্ন করে থাকা ক্রেনের রচনা শৈলীকে উচ্চমাত্রার রচনা হিসেবে দেখতে হবে'। কবিতা সম্পাদক হেরিয়েট মনরো দাবি করেছেন, 'তার কবিতা অযৌক্তিক রীতি ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ওগুলি অনুমান থেকে এসেছে'। তিনি ঘোষণা করেছেন, 'পূর্ণ যৌক্তিকীকরণ ব্যাখ্যার কারণে আবেগময় গতি বিভ্রান্ত হতে পারে না। কবিতার ক্ষেত্রে উপমার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের চেয়ে অন্য কোনো অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে থাকে। অথবা যেখানে মৌখিক অনুরক্তি বা ধারণার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে সেটি বিজ্ঞানসম্মত ও অবাধ রীতিভুক্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ হতে পারে না'। প্রেমিকা ইমিল অফারের সঙ্গে যখন ক্রেনের সম্পর্ক নিরানন্দ হয়ে আসতে শুরু করে তখনই তার 'দি বিল্ডিং' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ক্রেন পুনরায় বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন। নিজেকে প্রবোধ দেয়ার জন্য তিনি মদ্যপানে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ক্রেইনের সঙ্গে তার মায়ের প্রায়ই দ্বন্দ্ব লেগে থাকত। তিনি তখন খুব সম্ভবত তার পিতার সান্নিধ্য পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তার পিতার মৃতু্যতে তিনি আরও গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। এরপর ক্রেইন তার মাকে ত্যাগ করে ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। তিনি প্যারিসে আমেরিকাত্যাগী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। তাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিলেন কবি ও প্রকাশক হেরি ক্রসবি। ক্রেন ইউরোপ থাকাকালে সামান্য কিছু লেখালেখি করেন। ইউরোপে কিছুদিন অবস্থান করার পর তিনি আবার আমেরিকায় ফিরে এসে আত্মবিধ্বংসী কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অন্যদিকে তার 'দি ব্রিজ' গ্রন্থটি সমালোচকগণের কাছে হতাশাজনকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। যদিও কিছু কিছু সমালোচক তার সামর্থ্যকে স্বীকার করে নিলেও সাফল্যের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এতে করে তার আত্মবিশ্বাসে প্রচন্ডভাবে ঝাঁকুনি লাগে। সমালোচকগণ তার গ্রন্থটিকে ব্যর্থতা হিসেবে নির্দ্বিধায় গণ্য করলেও ক্রেইনকে তারা সৃজনশীল প্রতিশ্রম্নতির জন্য শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। উইলিয়াম রোজ বেনেট তার 'সাটারডে রিভিউ অব লিটারেচার' প্রবন্ধে বলেছেন, 'কোন কবিতাটি শ্রেষ্ঠ হতে পারে তা সৃষ্টি করতে ক্রেন ব্যর্থ হয়েছেন'। তারপরও 'দি ব্রিজ'কে গণ্য করা হয় চিত্তাকর্ষক গ্রন্থ হিসেবে। তিনি ঘোষণা করেছেন, 'দি ব্রিজ' গ্রন্থটি লেখকের শক্তিশালী কার্যশীলতা নির্দেশ করে ও তার পরবর্তী রচনা আরও বেশি উলেস্নযোগ্য হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। \হএলেন টেইট 'এ চেজ অব ফোর ডিকেইডস' নামে তার বিখ্যাত প্রবন্ধে লিখেছেন, ক্রেইনের শিল্পার্জন প্রশংসার দাবির ক্ষেত্রে অনিবাযভার্বে ব্যর্থ'। টেইট আরও উলেস্নখ করেছেন, 'তিনি আবেগ প্রবণতার চূড়ান্ত সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে পূর্বের রোমান্টিকদের মতো তার কবিতায় নিজের রোমান্টিকতাকে অভিভূতকারী হিসেবে আরোপ করেছেন। তিনি নিজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ইচ্ছা ও শিল্পকে যেমনিভাবে প্রতিফলিত করেছিলেন তেমনিভাবে ধাবিত হয়েছিলেন ধ্বংসের দিকে। টেইট তৃপ্ত হয়ে বলেছেন, 'ক্রেইন প্রমাণ করেছেন, সেটির সমাধান সম্ভব নয়'। সমালোচক আর পি বস্নাকমুর ক্রেইনের ব্যর্থতা এবং অসম্পূর্ণতার কারণে তাকে 'নিষ্প্রতিভ' হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ১৯৭০ ও ১৯৮০ সালের দিকে পন্ডিতরা ক্রেইনের উৎকট তত্ত্ব সম্পর্কে পুনঃগবেষণা করে বলেছেন, ক্রেন একজন বহিরাগতের মতো উৎকট জীবনের সামাজিক ও ঐতিহাসিক অবস্থাকে অস্পষ্ট ও রূপকভাবে প্রকাশ করেছেন। টিম ডিনের মতে, গোপনীয়তাকে ক্লেদ দ্বারা উৎপাদন রীতির মাধ্যমে ক্রেনের রুদ্ধভাষা কামজ ও মনস্তাত্ত্বিক উভয় জীবনকে ধ্বংস করেছে। ডিন এবং অন্যান্য সমালোচকরা দেখিয়েছেন, ক্রেনের উৎকটতাভাব তার কবিতার গন্তব্য পথে জটিলতা তৈরি করে রেখেছিল। ডিনের ভাষায, 'ক্রেনের কবিতা নির্দেশ করে প্রত্যক্ষভাবে সম্ভাব্য ছন্দোময় রূপের পরিবর্তন করে সমজাতীয় যৌন আবেদন ও আত্মনিষ্ঠা বিনির্মাণকরণ'। তিনি আমেরিকার কাব্য সম্বন্ধীয় ভাবপ্রবণতা ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির ওপর পড়াশোনা করার লক্ষ্যে একটা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছিলেন। তার আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছিল। তিনি তখন মেস্কিকোতে ছিলেন। সেখানে তিনি সম্ভবত বিখ্যাত সাহিত্যিক ক্রাডলির স্ত্রী পেগী বারিডের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। ক্রেন সেখানে কদাচিৎ লেখালেখি করতেন। এক সময় তিনি অনুভব করলেন, তার লেখনি মেধাশক্তি উলেস্নখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৩২ সালের ২৭ এপ্রিল ক্রেইন প্রেমিকা বারিডের সঙ্গে নৌ ভ্রমণের সময় গ্রাসকারী সব হতাশা থেকে মুক্তি লাভের আশায় মেস্কিকো উপসাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র তেত্রিশ বছর।