হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় স্বদেশচেতনা

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

সাগর জামান
হাসান হাফিজুর রহমান প্রবাদপ্রতিম কবি। কবিতা রচনার পাশাপাশি প্রবন্ধ, গল্প রচনা ও সম্পাদনায় তার পারঙ্গমতা সর্বজনবিদিত। সাহিত্যের সব শাখাতে তার সদম্ভ পদচারণা থাকলেও তিনি মূলত কবি। বাংলা কবিতায় তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কারণে পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে রয়েছে বিশাল তাৎপর্য। পঞ্চাশের দশকে স্বতন্ত্রধর্মী বক্তব্যের কবিতার মাধ্যমে তিনি তেজদীপ্ত মহিমায় সাহিত্যাঙ্গনে আবির্ভূত হন। ভাষা আন্দোলের সময় প্রথম নির্মিত শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হলে কবির হৃদয় রক্তাক্ত হয়। তখন হাসান হাফিজুর রহমান দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে সম্পাদনা করেন 'একুশে ফেব্রম্নয়ারি' শীর্ষক সংকলন। এই সংকলনটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত- যা তাকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি বাংলা কবিতায় ভিন্ন পথের সন্ধান দিয়েছেন। তার কবিতার প্রকাশভঙ্গি আকর্ষণীয় ও অনবদ্য। তার রচিত উলেস্নখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ :বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩), আর্ত শব্দাবলি (১৯৬৮), অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮), যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২), শোকার্ত তরবারী (১৯৮১), প্রতিবিম্ব (১৯৭৬), ভবিতব্যের বাণিজ্য তরী (১৯৮৩), হাসান হাফিজুর রহমান আজীবন স্বদেশের প্রেমে জড়িয়ে থেকেছেন। তিনি কবিতা চর্চায় স্বদেশ সমকাল লগ্ন থেকেছেন। তার কবিতায় স্বদেশ ও সমাজ বন্দনা লক্ষ্য করা যায়। তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করে কবিতা রচনায় নিমগ্ন থেকেছেন। রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও স্বদেশকে ঘিরে তার কবিতা আবর্তিত হয়েছে। তিনি স্বদেশ বন্দনা করেছেন, তার কবিতায় দেশপ্রেমকে নানাভাবে কবিতার বিষয় করেছেন। তার কবিতায় জাতীয় জাগরণের প্রসঙ্গ ওঠে এসেছে। স্বদেশপ্রিয়তা নিয়ে তিনি কবিতা চর্চায় নিবেদিত থেকেছেন। তিনি ছিলেন স্বদেশপ্রেমিক কবি। তার জীবনে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। জাতীয় জীবনের বহুমাত্রিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সঙ্গে তিনি নিজেকে যুক্ত রেখেছেন সব সময়। প্রিয় স্বদেশ ও স্বদেশের জন্য সংগ্রামী মানুষ তাকে নানাভাবে প্রাণিত করেছে। আন্দোলন সংগ্রাম রাজনৈতিক ঘটনাবলি তাকে উদ্বেলিত করেছে। তিনি তার কবিতায় জাতীয় জাগরণ উপস্থিত করেছেন। দেশকে ভালোবেসে কবিতা রচনায় তিনি মগ্ন থেকেছেন। তিনি স্বদেশপ্রেমের কবিতার রচয়িতা হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়। স্বদেশপ্রেমের হৃদয়স্পর্শী কবিতা হাসান হাফিজুর রহমানকে উদ্ভাসিত করে। তিনি কবিতার নিরীক্ষায় নিমগ্ন থেকেছেন। তিনি কবিতার মহৎশিল্পকে স্বদেশ আর গণমানুষের বাণীতে সংলগ্ন করেছেন। তার কবিতায় সংগ্রামরত মানুষ তাদের আত্মত্যাগের কথা ওঠে এসেছে। তিনি স্বদেশ ও সমকালের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কবিতা চর্চায় ব্রতী হয়েছেন। পাশাপাশি তার কবিতায় রোমান্টিক মানসপ্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বলা যায় হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন প্রেমিক ও দ্রোহী। দেশপ্রেম ও সমাজচৈতন্যের অন্বয় তার কবিতায় প্রযুক্ত হয়েছে। স্বদেশ ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি তার কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে। ভাষা আন্দোলন তার কবিচিত্তে আলোড়ন তোলে। ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতি দেওয়া ভাষাশহীদ বরকত, রফিককে তিনি ম্মরণ করে কবিতা রচনা করেছেন। 'আম্মা তার নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর? ঘূর্ণিঝড়ের মতো সেই নাম উন্মথিত মনের প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে জাগবে ডাকবে দু'টি ঠোঁটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতো গড়িয়ে এসে একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে সারা জীবনেও না তবে আর? কী করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতদিন? আবুল বরকত নেই, সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা বিশাল শরীর বালক মধুর স্টলে ছাদ ছুঁয়ে হাঁটত যে তাকে ডেক না, আর একবার ডাকলে তাকে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে সালাম রফিক উদ্দিন জব্বার কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম। এই এক সারি নাম বর্ষার ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে উচ্ছেদের জন্য তৈরি হওয়ার আগেই আমরা ওদের হারিয়েছি... কেননা প্রতিক্রিয়ায় গ্রাম জীবন ও মনুষ্যত্বকে সমীহ করে না ভেবে ওঠার আগেই আমরা ওদের হারিয়েছি। কেননা প্রতিক্রিয়ার কৌশল এক মৃতু্য দিয়ে হাজার মৃতু্যকে ডেকে আনে আর এখন আমরা হারিয়েছি এমন কয়জনকে ওরা কোনো দিন মন থেকে মুছবে না, কোনো দিন কাকেও শান্ত হতে দেবে না।' হাসান হাফিজুর রহমানের কাব্যগ্রন্থ 'আর্ত শব্দাবলি' ও 'অন্তিম শরের মতো' প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এই দুই কাব্যগ্রন্থে মুক্তি সংগ্রামে জাতির মানসপ্রবণতা মুখ্য প্রতিপাদ্য হয়েছে। ভাষা আন্দোলন পঞ্চাশ দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পাকিস্তানি শাসকদের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, গণঅভু্যত্থান ও মুক্তিসংগ্রামে জোটবদ্ধ জাতি ষাট দশকের সময়ের চিত্র তিনি কবিতায় তুলে ধরেন একটি জাতির সোচ্চার হওয়া ক্ষোভে বিক্ষোভে জ্বলে ওঠার উচ্চারণ হাসান হাফিজুর রহমান কবিতায় ধারণ করেছেন। বাঙালির দ্রোহকে তিনি কবিতায় প্রযুক্ত করেছেন। স্বদেশপ্রিয়তা তার কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। তিনি স্বদেশের মায়ায় জড়ানো কবি। তার যাপিত জীবনের আনন্দবেদনা স্বদেশ ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তিনি স্বদেশপ্রেমের কাছে নিজেকে সমর্পিত করেছেন। আমার হৃদপিন্ডের মতো/আমার অজানা সামুতন্ত্রীর মতো/সর্বক্ষণ সত্য আমার দেশ/আমার দেহের আনন্দ কান্নায় তোমাতেই আমি সমর্পিত।' হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা রচনায় আটচলিস্নশ থেকে আটষট্টি সাল পর্যন্ত স্বদেশ স্বজাতির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এ সময় তিনি স্বদেশচেতনায় উদ্দীপ্ত থেকেছেন। তিনি সংগ্রামরত বাঙালির বিজয়ের ব্যাপারে বরাবরই আশাবাদী থেকেছেন। বাংলার ভূমিতে মতলববাজ, স্বার্থবাদী সুবিধালোভী মানুষের দুরভিসন্ধি কপটতা তাকে পীড়িত করেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন বাঙালি বাধা অতিক্রম করতে পারঙ্গম। তিনি সামনে এগিয়ে যেতেন বিজয়ের স্বপ্নে। হতাশা ও দুঃখ তার এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় হতে পারেনি। তিনি যাত্রা করেছেন তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। তিনি উচ্চারণ করেছেন :'মহামারী বন্যার প্রতিটি ছোবলে/পলিমাটি জমে নিত্য প্রাণের অমোঘ আদলে।/খরতর করে কাম ছায়া গূঢ় ক্রোধকে আমার এই প্রতারক কাল চেনাবে বলে/আপসবিহীন দুই হাত শুধু অসহ্য ঘৃণার আগুন ঢালে।' শস্যশ্যামল স্বদেশের অপরূপ সৌন্দর্য হাসান হাফিজুর রহমানকে মুগ্ধতার জালে আটকে রেখেছে। স্বদেশের মানুষের সংগ্রামী জীবন তাদের কাতরতা আনন্দবেদনা তিনি কবিতায় বন্দি করেছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে হাসান হাফিজুর রহমান নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। মানবিক বিপর্যয় তাকে ব্যথিত ও দ্রোহী করেছে। দেশপ্রেমকে মুখ্য প্রতিপাদ্য করে তিনি কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে স্বদেশ, স্বদেশের মাটি ও মানুষকে কবিতাবদ্ধ করেছেন। শস্যশ্যামল, সুফলা স্বদেশের রূপচিত্র তার কবিতায় পরিস্ফুটিত হয়েছে। বন্যা ও খরাকবলিত মানুষের দুর্দশার চিত্রও তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। হাসান হাফিজুর রহমান স্বদেশের মাধুর্যে লীন হয়েছেন। স্বদেশের সৌন্দর্যে অবগাহিত হয়েছেন। তার কবিতা স্বদেশপ্রেমের অনুভূতিতে পূর্ণ। স্বদেশ তাকে নিয়তির মতো নিয়ন্ত্রণ করেছে সব সময়। হাসান হাফিজুর রহমান মাতৃভূমির কাছে নিজেকে সমর্পিত করেছেন। তিনি স্বদেশপ্রিয়তা থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই তিনি আটষট্টি, উনসত্তর ও সত্তরে স্বদেশের নিপীড়িত সন্তানদের সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়েছেন। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিল। দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হাসান হাফিজুর রহমানের দুই সহোদরকে হত্যা করে। তিনি শোকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। তিনি শোকার্ত হয়ে ক্রোধে জ্বলে ওঠেন : একজন নয়, তোমার দুই দু'টি সহোদরের রক্তে/ওরা মাটি ভিজিয়ে দিল/তবু তোমার শোক নেই কেন?/দুই নয় বরং বল দশ লক্ষ সহোদরের/শহীদের শোণিত চারপাশে ভাসে/আমি একা, কোটির বিলাপ করব কি করে? আমি পারি না কাঁদতে/শুধু শিল্পীভূত হই শেষ আঘাতের অমোঘতায়।' ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখন্ডের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর সন্তানহারা মায়ের কান্নাভেজা চোখ বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান মোছাতে চেয়েছেন। 'এবার মোছাব মুখ তোমার আপন পতাকায়/হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল/রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যামকান্ত ফুল/নিঃসঙ্গ হাওয়ায় আজ ওড়ে দুঃখ ভোলানিয়া গান গায়/মোছাব তোমার মুখ আজ গাঢ় পতাকায়।' মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রয়েছে নারীর অপরিসীম অবদান। তাদের আত্মত্যাগ চিরস্মরণীয়। তারা স্বামী-সন্তানকে হারানোর সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন। শুধু তাই নয় অনেকে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। প্রায় চার লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের দ্বারা। যারা লালসার শিকার হয়েছেন সেই সব বাঙালি নারীদের কথা হাসান হাফিজুর রহমান অসীম শ্রদ্ধায় কবিতায় তুলে ধরেছেন। 'তোমাদের ঠোঁটে দানবের থুথু/স্তনে নখের দাগ/সর্বাঙ্গে দাতালের ক্ষতচিহ্ন প্রাণান্ত গস্নানিকর/লুট হয়ে গেছে তোমাদের নারীত্বে মহার্ঘ মসজিদ/উচ্ছিষ্টের দগদগে লাঞ্ছনা/তোমরা পরিত্যক্ত পড়ে আছ/জীবনের বিকৃত অলিন্দে।' হাসান হাফিজুর রহমান কবিতায় ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে প্রাণস্পর্শী কথামালা দিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের বড় অবদানে মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে উপস্থাপন করেছেন, যা তার অনুরাগী পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা আমাদের চেতনাকে শাণিত করে। তিনি গতানুগতিক ধারার বাইরে থেকে কবিতা রচনা করেছেন। তার মেধা শ্রম ও আলাদা অনুভূতির প্রকাশে শিল্পিত হয়ে উঠেছে কবিতা। স্বদেশ তার কবিতায় বারবার এসেছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশপ্রেম তার কবিতার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। অধিকার হরণের বিরুদ্ধে হাসান হাফিজুর রহমান রুখে দাঁড়িয়েছেন। তার কবিতায় দেশমাতৃকার ভালোবাসা, দেশের মানুষের রাজনৈতিক আবেগ তাদের জীবনাচরণ মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। তিনি কবিতার ক্ষেত্রে একজন তুলনারহিত, অনতিক্রম্য কবি। তিনি পুরনো ধারাকে পরিহার করে কবিতাকে নতুন ধারার সৌন্দর্যালোকে আলোকিত করেছেন। তার কবিতা হয়ে উঠেছে দেশীয় সম্পদে সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয়। হাসান হাফিজুর রহমান সবসময় প্রাসঙ্গিক এবং স্মরণীয়।