বাংলা কবিতায় বৈশাখ

প্রকাশ | ১২ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

মতিয়ার রহমান
আবহমানকাল থেকে বাঙালির বার মাসে তের পার্বণের এই দেশে পহেলা বৈশাখ অন্যতম একটি উৎসব। বাঙালি জীবনের সর্বত্রই এর অবাধ বিচরণ। গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে পিচঢালা রাজপথ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। গ্রাম্যমেলার বাঁশের বাঁশির মেঠো সুর থেকে শহুরে জীবনের পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম- উপলক্ষ্য একটাই, পহেলা বৈশাখ। বাঙালির পোশাকে ও রঙে এবং ঢোলের বাজনায় সারা দেশ উৎসবের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। বাংলা নববর্ষকে বরণ বা উদযাপনের চিত্র এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলার শিল্প-সাহিত্যেও বৈশাখের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সাহিত্য সময়ের প্রতিচ্ছবি। আর সেই প্রতিচ্ছবিতে ফুটে ওঠে সমকালীন সময়ের চিত্র। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বৈশাখকে কেন্দ্র করে রচিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান দখল করে আছে। বলাইবাহুল্য, এর মধ্যে কবিতাই প্রধান। কারণ, যখন পহেলা বৈশাখ সেভাবে পালন করা শুরু হয়নি তারও আগে মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডিমঙ্গল কাব্যে চমৎকারভাবে বৈশাখ সম্পর্কে চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো কবি নেই যে, কি না বৈশাখ নিয়ে কিছু লেখেননি। বিশেষ করে বাংলা কবিতায় এই বৈশাখকে ঘিরে রয়েছে উৎসবমুখর বাঙালির প্রাণের প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশে বৈশাখী উৎসব মানেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চির পরিচিত গান- 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ তাপস নিশ্বাস বায়ে/ মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক/ এসো এসো.....' এই গানের মধ্য দিয়েই নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার অনুষ্ঠানগুলো শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ। তার জীবন ঘনিষ্ঠ এই গান মানুষের মনকে নাড়া দেয়। আলোড়িত করে, নতুন বছরকে বরণ করার উৎসাহ জোগায়। তার 'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের বলাকা কবিতাটিতে ঝড়ের মাঝে জীবনের যে স্পন্দন তিনি অনুভব করেছেন তা প্রকাশ করেছেন এভাবে.....'পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ....'। কবি রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের প্রকৃতির রঙে বৈরাগ্যের প্রতীক গেরুয়া রঙ দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে শুরু করলেও বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০খ্রি.) তার 'চন্ডিমঙ্গল' কাব্যে কালকেতু ও ফুলস্নরার দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখকে চমৎকারভাবে বৈশাখের প্রচন্ড দাবদাহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি লিখেছেন- 'বৈশাখে অনলমসম বসন্তের খরা/তরুতল নাহি মোর করিতে পসরা/ পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।/ শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন/নিযুক্ত করিল বিধি সবার কাপড়।/ অভাগী ফুলস্নরা পড়ে হরিণের দুড়্‌'। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বৈশাখকে বিচিত্র রূপে প্রকাশ করেছেন। কখনো শান্ত, কখনো উদাস, বাতাস বন্ধ। হঠাৎ প্রলয় বেগে ঝড়। নজরুল বৈশাখ নিয়ে নানান বৈচিত্রীয় চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন। একটি গানে নজরুল তার প্রেয়সীকে স্মরণ করতে গিয়ে অস্থির মনের বাণীতে লিখলেন- ' বৈশাখী ঝড়ের রাতে চমকিয়া উঠি জেগে/বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে./ ঝড় চলে যায় কেঁদে ঢালিয়া শ্রাবণ ধারা/ সে কি তুমি? সে কি তুমি?' এই বৈশাখী ঝড়কে কবি কাব্য করেছেন 'ভাঙ্গার গানে'। অপূর্ব এক পৌরুষদীপ্ত রূপ প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতায়- 'নাচে ঐ কাল-বোশেখী/কাটাবি কাল বসে কি?/দেরে দেখি/ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি।/ লাথি মার ভাঙরে তালা/ যত সব বন্দীশালায়/ আগুন জ্বালা/ আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি। 'আধুনিক বাংলা কবিতার রাজপুত্র কবি জীবনানন্দ দাশও তার কবিতায় বৈশাখের চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে-'বৈশাখের মাঠের ফাটলে/এখানে পৃথিবী অসমান।/আর কোনো প্রতিশ্রম্নতি নেই।/কেবল খড়ের স্তূপ পড়ে আছে দুই-তিন মাইল/তবু তা সোনার মতো নয়;/ কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে/করুন, নিরীহ, নিরাশ্রয়।' কবি জীবনানন্দ দাশ তার আর একটি কবিতায় লিখেছেন-'এসো এসো ওগো নবীন,/চলে গেছে জীর্ণ মলিন- আজকে তুমি মৃতু্যবিহীন/মুক্ত সীমারেখা।' কবি শামসুর রাহমান বৈশাখকে দেখেছেন অভাব, যন্ত্রণা ও কষ্টের প্রতীক হিসেবে। তিনি লিখেছেন, 'আমার মাকে আমি কোনোদিন গান গাইতে শুনিনি' কথাটি আমার জীবনেও প্রায় সত্য, ব্যতিক্রম কেবল চৈত্রসংক্রান্তির দিন। শিশুকাল থেকে দেখেছি চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাড়ির উঠোন- আঙ্গিনা ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে মা গাইছেন- 'তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক/ এসো এসো।। এসো হে বৈশাখ এসো এসো/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/অশ্রম্নবাষ্প সুদূরে মিলাক।। মুছে যাক গস্নানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শূচি হোক ধরা।।' তিনি আর একখানে লিখেছেন- 'রাত্রি ফুরালে জ্বলে ওঠে দিন/ বাঘের থাবায় মরছে হরিণ/কাল বোশেখের তান্ডবে কাঁপে পড়ো পড়ো চাল/ শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল ইচ্ছে তার ইচ্ছে।' কবি আল মাহমুদের 'বোশেখ' কবিতায় দেখতে পাই,'সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি/তিষ্ঠ হাওয়া, তিষ্ঠ মহা প্রতাপশালী,/ গরীব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কী লাভ?/ কী সুখ বলো গুড়িয়ে দিয়ে চাষীর ভিটে?/ বেগুন পাতার বাসা ছিঁড়ে টুনটুনিদের/উল্টে ফেলে দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি/ হে দেবতা, বলো তোমার কী আনন্দ,/কী মজা পাও বাবুই পাখির ঘর উড়িয়ে?' কবি সৈয়দ শামসুল হকের 'বৈশাখের পঙ্‌ক্তিমালা' কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখেছেন- 'বহুদিন থেকে আমি লিখছি কবিতা;/হঠাৎ দেখতে পাই কালবৈশাখের ঝড় ফেটে পড়ে তীব্র আর্তনাদে,/ বাতাসের হাহাকারে, নৌকোয় নৌকোয় দোলে'। কবি মহাদেব সাহার 'বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ' কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে বৈশাখের সুর-'মা আমাকে বলেছিল- যেখানেই থাকিস তুই/বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে।/ পয়লা বোশেখ বড়ো ভালো দিন/এ দিন ঘরের ছেলে বাইরে থাকতে নেই কভু,/বছরের এই এশটি দিনে/ আমি সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে দিই/ ফুলজল, কে বলবে কী করে কার বছর কাটবে/ বন্যা, ঝড় কিংবা অগ্নিকান্ড কত কি ঘটতে পারে, তোর তো কথাই নেই।' সমকালীন কয়েকজন প্রতিনিধিত্বশীল কবির কবিতায় বৈশাখের পঙ্‌ক্তিমালা উলেস্নখ করতে পারি। তাদের মধ্যে শিহাব সরকারের 'আজ বর্ষবরণের যত উৎসব' কবিতায় তিনি লিখেছেন- 'আজ ধ্রম্নবতারা অস্ত গেল না/মঞ্চে ফুটে আছেন শুধু আপনি, রবিঠাকুর/ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়, ঘর থেকে মুখর প্রাঙ্গণে/আজ সারাদিন বর্ষবরণের যত উৎসব হবে/তার সব কটিতে প্রধান নক্ষত্রপুরুষ আপনি রবিঠাকুর।' 'বৈশাখ, আমার অপরাজিত পূর্বপুরুষের মতো/তুমিও আমাকে শেখাও তোমার বজ্রের ভাষা/ তোমার হিংস্র রৌদ্রের বর্ণমালা/ \হতোমার কালবৈশাখীর ঝড়ের ডানার আদর। ( বৈশাখ-আবিদ আজাদ) আজকের বাঙালির জীবনে যে সাংস্কৃতিক চেতনায় পহেলা বৈশাখের উৎসব উৎযাপিত হয়, তা প্রবর্তনের কৃতিত্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনিই প্রথম শান্তিনিকেতনে বৈশাখ বরণের উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি বাংলা নববর্ষকে সম্ভাষণ জানিয়ে রচনা করেন অনেক কালজয়ী গান ও কবিতা। মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই 'বৈশাখী পূর্ণিমা', নির্মলেন্দু গুণের 'চৈত্রের ভালোবাসা' নামের একটি কাব্যগ্রন্থ। বৈশাখ প্রেমের মাস না হলেও বৈশাখ পুরাতন স্মৃতি-জরা-গস্নানি মুছে ফেলে নতুনকে আহ্বান জানায়; প্রেরণা ও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। বৈশাখী ঝড়ো হাওয়া গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছে অনেক সময় আতঙ্ক রূপে দেখা দেয়। বৈশাখী উৎসবের আনন্দকে কখনো কখনো কাল বৈশাখী এই জনপদের জনজীবনকে তছনছ করে দেয়। এখানে যেমন বৈশাখী উৎসবের আমেজ আছে, তেমনি ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো ও সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও আছে। তবে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি দ্রম্নতই পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেয়া অপসংস্কৃতিতে বিধ্বস্ত বাঙালি সংস্কৃতি আজ বিপর্যস্ত। তাকে ঘুরে দাঁড়াতে বিস্তর বেগ পেতে হচ্ছে। তাই আমাদের সর্বস্তরের মানুষের জীবন ও মননে একটা বিশাল কালবৈশাখী ঝড়ের বড়ই প্রয়োজন। যে ঝড়ে সব অপসংস্কৃতিকে ধ্বংস করে সাহিত্যের উর্বর এই পবিত্র জমিনে বাংলা কবিতায় ফলবে বোশেখের পঙ্‌ক্তিমালা।