কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশ | ০৩ মে ২০১৯, ০০:০০

অলোক আচার্য
ইট বিছানো রাস্তা ছেড়ে সবাই ধানক্ষেতে নেমে গেল। নিঃশব্দে। নিজেদের পায়ের শব্দও শুনতে দিতে চায় না ওরা। দেশে বর্ষা শুরু হয়েছে। বৃষ্টি নামলে আর ছাড়ার খবর নেই। সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। এখনও হচ্ছে। তবে গুঁড়ি গুঁড়ি। গা সয়ে যায়। ধানক্ষেতের আইল ধরে সবাই হাঁটতে থাকে। কাঁদায় পা বসে যায়। পা টেনে নিতে কষ্ট হয়। তারপর একহাঁটু কাঁদা নিয়ে ওরা বিশাল মাঠটার এক পাশে এসে দাঁড়ায়। এখন বৃষ্টি কমে বেশ হাওয়া দিচ্ছে। সবাই চাঁদর জড়িয়ে নেয়। পাঁচ জনের এই দলটা মুক্তিযোদ্ধা। মাঠটার একপাশে দাঁড়িয়ে চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে নেয় সবাই। অবশ্য দেখার কিছুই নেই। ঘন অন্ধকারে ঢাকা। মনে হয় পৃথিবীটাকে কেউ কালো রং করে দিয়েছে। চারদিকে কিছু এলোমেলো আওয়াজ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। তাও সবাই সতর্ক থাকে। সামান্য ভুল করলে চলবে না। এই দলের নেতা রঞ্জু। অন্ধকারে দেখা যায় না। কিন্তু রঞ্জুর চেহারা বেশ সুন্দর। এক সময় সিনেমায় নামার চেষ্টাও করেছিল। তারপরই দেশে গোলমাল লেগে গেল। রঞ্জুও সব ছেড়েছুড়ে মুক্তিযোদ্ধার দলে নাম লেখালো। আগে দেশ পরে নায়ক হওয়া। এটা রঞ্জুর নিজের গ্রাম। অন্ধকার হলেও সমস্যা নেই। পথঘাট সব চেনা। ছবির মতো চোখের সামনে ভাসে সব। এই বিশাল মাঠটার ঠিক উল্টো দিকে দৈত্যের মতো এক তেঁতুল গাছ। সেই তেঁতুল কেউ পাড়ে না। তেঁতুল গাছে নাকি ভূত থাকে। সন্ধ্যার পর কেউ এই মাঠ দিয়ে চলাফেরা করে না। কত আজব আজব গল্প আছে এই বিশাল মাঠটা ঘিরে। রঞ্জু জানে এসব গল্প। তবু রঞ্জুও কখনো রাত বিরাতে এ মাঠে আসেনি। অথচ আজ সে রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। একজন চাঁদরের নিচ থেকে হাত বের করে সিগারেট ধরায়। আনিস কোনদিন সিগারেট খায়নি। রঞ্জুদের সঙ্গে থাকতে থাকতে অভ্যাস করে ফেলেছে। 'অই আনিস একখান বিড়ি দে;' হাশেম হাত এগিয়ে দেয়। একে একে বাকি দু'জনও নেয়। তারপর সবাই আনিসের বিড়ি থেকে আগুন ধরায়। বিড়ি ধরিয়ে নিঃশব্দে ধোঁয়া টানতে থাকে সবাই। বিড়ির আগুনে সবার মুখ কেমন অচেনা মনে হয়। বিড়ি খেতে খেতে রঞ্জুর নিজের গ্রামের কত কথা মনে পড়ে যায়। আহা! ডনজের গ্রামে পা দিয়েই রঞ্জুর ভেতর এক অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ছুটে বাড়ির দিকে চলে যাই। কিন্তু রঞ্জু এখন কোনো সাধারণ কেউ না। আর দেশের অবস্থাও ছুটে যাওয়ার মতো না। গ্রামে মিলিটারি নেই। তবে রাজাকার আছে। সিরাজ চেয়ারম্যান। বিশাল দেহী মানুষ। রঞ্জুদের বাড়ি এখান থেকে মাইল দুয়েক হবে। এই মাঠটার পাশ দিয়ে একটি খাল চলে গেছে। এই খাল ধরে এগিয়ে গেলেই রঞ্জুদের বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে। বাড়ির সামনে বিরাট জলপাই গাছ। বাড়িতে মা আছে। রঞ্জুর বোনও ছিল। বোনের কথা মনে পড়তে আবার সিরাজ চেয়ারম্যানের কথা মনে পড়ে যায়। যুদ্ধ শুরুর পর রঞ্জুরা কয়েক বন্ধু মিলে পালিয়ে যায়। সেই রাগে সিরাজ চেয়ারম্যান গ্রামের অনেকের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। হিন্দুদের সব মালামাল লটু করে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে যোগ দেয় গ্রামের অনেক মানুষ। গ্রামের অনেক মেয়ের সঙ্গে রঞ্জুর বোনকেও তুলে নিয়ে যায় কুত্তাটা। সিরাজ চেয়ারম্যান মিলিটারির সঙ্গে যোগাযোগ করে। হিন্দুদের কথা বলে গ্রামে নিয়ে আসে তাদের। সুন্দর সাজানো গোছানো গ্রামটা একদিনেই পুড়িয়ে দেয়। গ্রাম হয়ে যায় ভূতের গ্রাম। এখন যারা গ্রামে আছে তারা বেশিরভাগই সিরাজ চেয়ারম্যানের লোক। মিলিটারির কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে গ্রাম পাহারা দেয়। ওরা ঠিক জানে যে কোনদিন মুক্তিযোদ্ধারা আসবে। আজ তার সব শোধের পালা। শালা কুত্তা। থু করে একদলা থু থু ফেলে রঞ্জু। 'কহন যাবি'? আনিস প্রশ্ন করে। \হ'রাতটা আর ইট্টু আওগাক। রাত আওগাইলে সবাই ঘুম দিব। হেই সময় যদি যাই তাইলে রিক্স কম। তোরা কি কস'? 'তুই হইলি আমাগো লিডার। তুই যহন কবি তহনই আমরা রেডি। তা ছাড়া তোর গ্রাম এইডা। সব খোঁজ খবর তুই-ই ভালো জানিস'। 'হ। ঠিক কথা'। \হফের বিড়ি বের করে আনিস। আবার সবাই বিড়ি ধরায়। সারা মাঠ কাঁদা। ফলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ওদের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওরা নিচুস্বরে গল্প করে যায়। দেশের গল্প স্বাধীনতার গল্প। সিরাজ চেয়ারম্যানকে খতম করার পর রঞ্জু মা'র সঙ্গে দেখা করতে যাবে সেই গল্প। মা নিশ্চয়ই রঞ্জুকে দেখে আনন্দে কেঁদেটেদে একাকার হবে। রঞ্জুর চোখের কোণে জল জমা হয়। ভাগ্যিস কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। এখন আবেগের সময় না। আসার আগে কমান্ডার বারবার বলে দিয়েছে কোনো ভুল করা চলবে না। সামান্য ভুলে পাঁচ জনের জীবনই বিপদে পড়তে পারে। তাই ওদের না দেখিয়েই চোখের জল মুছে নেয় রঞ্জু। তারপর আনিস পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে আনে। এই গ্রামের ম্যাপ। সিরাজ চেয়ারম্যানের বাড়ির খুঁটিনাটি আঁকা আছে এতে। কয়েকদিন আগে ওদের দলের একজন জোগাড় করেছে। সবাই ম্যাপটার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কেউ একজন পকেট থেকে লাইট বের করে জ্বালায়। সবাই যখন ম্যাপ দেখায় ব্যস্ত তখন হঠাৎ রঞ্জু ম্যাপটা ছো মেরে নিয়ে নেয়। তারপর টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। রঞ্জুর এমন কান্ডে অবাক হয়ে যায় সবাই। 'কি করলি ব্যাটা? ছিড়লি ক্যান'? 'ম্যাপের দরকার নেই। আমার লগে ল? সবকয়টা বাইর কর'। এ কথা বলেই রঞ্জু চাঁদরের নিচ থেকে রাইফেল বের করে আনে। সঙ্গে সঙ্গে বাকি চারজনও বের করে। তারপর রঞ্জু সামনে এগুতে থাকে। খালের পার দিয়ে পাঁচ জন মুক্তিযোদ্ধার দলটি হেঁটে যায়।