দ্বিতীয় দশকের কবিতায় বাঁকবদল ও কাব্যনির্মিতি

প্রকাশ | ০৩ মে ২০১৯, ০০:০০

মাসুদ মুস্তাফিজ
শিল্পের শর্ত কীভাবে পূরণ করা যায়, কীভাবে পূরণ হয় তা শিল্পের অধিকার বা মীমাংসার পথ কোনোভাবেই নির্ধারিত নয়। আমরা জানি শিল্পের ক্ষেত্র কখনো ফুরাবার নয়, বরং হাজার বছরের পুরনো ফর্মে নিজেকে গহিনে মগ্ন করা, অন্যকিছু অন্যভাবে বলা তা যে রকমই হোক নিশ্চয়ই শিল্পের অভিনব প্রাণসঞ্চার করে এ কথা মেনেই নিতে হচ্ছে। কবিতার পন্ডিতমশাইরা আর অদীক্ষিত পাঠক বাংলাকবিতার মূলধারা(?)র স্মৃতি নিয়ে এগোলেও নিশ্চয়ই ত্রিপদীয় ভ্রমে আটকে আছে। কেননা কবিতার ছন্দ, ডিকশনের চর্চা ও ধারা কবিতার জন্য কতটা দরকার তা কোনোভাবেই সন্ধান মিলছে না। কেউ কাব্যে দর্শনকে অনিবার্য মনে করেন কিংবা দর্শন আগে না পরে এমন অনেক প্রশ্নেই আমাদের ভাবনার আর জ্ঞানের অথবা দার্শনিক শব্দদ্বয়ের সমার্থক নির্বুদ্ধিতায় হাবডুবু খাচ্ছি। এ প্রশ্ন বিশেষত বিগত শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমার মনে হয় এ প্রশ্নের জন্ম হলো কীভাবে। সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিয়ে মাত্র কয়েক শতাব্দীর আগ পর্যন্ত ইউরোপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বিষয় সমূহকে ঘধঃঁৎধষ চযরষড়ংড়ঢ়যু বলা হতো। দর্শনের এই বিশাল মহীরুহ তাহলে ক্রমে ক্রমে পতনের সম্মুখীন? পেস্নটোর দর্শন থেকে পৃথক করে অ্যারিস্টটলের মধ্যে বিষয়বিভাজন যেভাবে সুস্পষ্ট অর্থাৎ ঙৎমধহড়হ এ ওহফঁপঃরড়হ, উবফঁপধঃরড়হ ও ওহঃঁরঃরড়হ -এর ধারণা ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে তিনি অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞান, যুক্তিনির্ভর জ্ঞান আর আবেগ কিংবা বিশ্বাসনির্ভর ব্যাখ্যার অযোগ্য ব্যক্তিগত আবেগের পার্থক্য নির্ণয় করেছিলেন। আবছাভাবে হলেও 'প্রকৃতি বিজ্ঞান' আর 'যদি-তাহলে'-র সম্পর্কভিত্তিক 'অংক'-র বিচরণ ক্ষেত্র ও তার পরিধি অ্যারিস্টটলের মধ্যে যথেষ্ট মাত্রায় স্পষ্ট ছিল। আমরা দেখি প্রথম থেকেই দর্শন আলোচনার সিংহভাগ বিষয় ছিল অধিবিদ্যা সম্পর্কিত যার সঙ্গে আবশ্যিকভাবেই আত্মা, পরকাল ও ঈশ্বরের প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তাই এই বিতর্কে না গিয়ে আমরা আজকের যুগে এই শাস্ত্রের মধ্যে কি চাই বা কি খুঁজি সেটাই প্রশ্ন হওয়া উচিত। কবিতা কবির কাছে ভাবের এক নির্মোহ জায়গা, ভাব-কল্পনার জায়গা ও মনীষার আঁধার-মনন ও দর্শনের প্রতীতি। ভাবকে দর্শনের জায়গা থেকে আলাদা দেখতে চাই। হার-হাড্ডির মাংসের যে সম্পর্ক কবিতার সঙ্গে কল্পনাপ্রতিভা, চিন্তা ও ভাবদর্শনের সম্পর্ক সে রকম। আসলে কবিতার মূল উপাদান হলো ভাব ও শব্দ। আর এই কেন্দ্রীয়ভাব মূলত কল্পপ্রভাময় দার্শনিকতা ও প্রতিজ্ঞার নির্মিতি। তাই বলে কবিতা দর্শন নয়। কবির সাধনা কাব্যের জগৎনির্মাণের, জগতের সঙ্গে নতুনজগৎ তৈরির সম্পর্ক। সেই জগৎ ভাবের জগৎ, না দেখা ও কল্পনার জগৎ। কবি নিশ্চয় জানেন কবিতা বিস্ময়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে এক উদ্দীপক অনুভূতি। এই আনন্দ বিস্ময় হতে পারে অন্যদিকে ঘোরের স্বপ্নের এবং কল্পনার। কবিতা কোনো ব্যাখ্যার বিষয় নয়। তা একান্তই পাঠকের এবং পাঠকেরই মানদন্ডেই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক কবিতার ওপর যদি আমরা একটু গভীর পর্যবেক্ষণ চালাই তাহলে আমরা দেখবো, কবিতা অচলায়তন ভেঙে বেরুতে পারছে না এমনকি না পারার অক্ষমতা নিয়েও কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনা চোখে পড়ে না বরং দেখা যায় স্বস্তির ভাব ছেড়ে অনেকেই বলেন 'অনেক কিছুই করা হয়েছে এখন কিছুই আর করার নেই।' তাহলে কি সাম্প্রতিকচিন্তা ও তৎপরতার আলোকে কবিতা প্রশ্নবিদ্ধ। গভীর মনোনিবেশ প্রয়োজন, দরকার বিশ্লেষণ আর ব্যাপক পর্যবেক্ষণ। বলা যায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পর কেবল জীবনানন্দ যিনি এখন পর্যন্ত দখল করে আছেন বাংলাকবিতার অনেকটা জায়গা, সেটি বিশেষ করে তা কবিতার সাম্প্রতিকতা ও সমসাময়িকতার কারণে- আধুনিকতা, এমনকি উত্তর আধুনিকতার কারণেও। তার ভাষা, প্রকাশশৈলী, অভিজ্ঞতার বয়ান ইত্যাদি এখনো ব্যাপকভাবে অধিকাংশ পাঠককে আলোকিত করে- বোধ ও উপলব্ধির জাগরণ ঘটায়, সমৃদ্ধ করে ভাব ও দর্শন। তাই তিনি এখনো সাম্প্রতিক ও দূরগামী। এখানে ভাষার শক্তিই কবিতার শক্তি। এখানেই কবিতার ভবিষ্যৎ রেখা, এখানে সময়কে অতিক্রম করে যাওয়া। বলা যায় কবি নিজেকে অতিক্রম করেন। আর এখানেই কবির মুক্তি। এ সময়ের কবিতায় শব্দসমবায়ের বিচারে এবং নির্বিচারে দেশি, বিদেশি কিছু সৃজনশীল শব্দের মিথস্ক্রিয়ায় ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে এমন ধারণা অনেকেই করেন। শব্দকে অতিগীতল স্বভাবে পরিণত করে কিংবা অতিগদ্যধর্মিতা থেকে মুক্তি দিয়ে ঝরঝরে প্রাঞ্জল করে উপস্থাপন করার যে শৈলী কবি আত্মস্থ করেছেন তাতে কবিতা কি গদ্যের, কি পদ্যের নাকি সব ভেদাভেদ রেখা মুছে অন্যকিছু? আর এই বৈশিষ্ট্য কবিতার কোনো পক্ষকে সমর্থন করে কিংবা কোনো পক্ষের মাঙ্গলিক বার্তা বয়ে আনতে পারে সেটাই বিবেচনার বিষয়। আধুনিক বাংলা কবিতা ভাবাবেগের স্থান মর্যাদাপূর্ণ ও ভাবালুতা রোমান্টিক উদ্বেলিত করলেও কবির রুচিকে ধারণ করার মতো যৌক্তিক প্রপঞ্চ হয়ে উঠেছে কি? কেন না আধুনিক মানুষের জীবন এবং জীবনের গতিপথ পুরোটা যান্ত্রিক ও গতিমন্থর। এই যন্ত্রশাসিত গতির যুগের সময়ের সংক্ষিপ্ততম অবসরে মানুষের কাছে কাব্য নিশ্চয় অনেক বিস্ময়ের এবং আশ্বাসের। আর এ কারণেই বারবার আধুনিক কবিরা সংবেদ জাগাতে ব্যর্থ হয়ে ভাবালুতা উপেক্ষিত বিষয়ে বিবেচিত এবং বিশুদ্ধ ভাবাবেগ ও চিন্তার সাদরে গৃহীত হচ্ছে। সেই হিসেবে সম্প্রতি কবিগণ কবিতাকে অভিজ্ঞতার স্মারকে উপস্থাপন করে নিরঙ্কুশ বস্তুসত্যের কাছাকাছি আনার চেষ্টা করেছেন। কবির কল্পনার বস্তুগত সত্যের সমীপ্যে গ্রহণ করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে পারেন। আলোচ্য গদ্যের বিষয়বস্তুতে কবিতাও তেমনি কেবল অনুভবের স্ট্রেংথ ঢেলে ভাষার মফস্বলে নাগরিক দহন-প্রেম-কামের কুলকুচি করলেই স্থিতির অক্ষাংশে ত্বরিত হতে পারে না, পারেওনি কোনোকালে। চিৎকার করে চাঁদকে ডাকলেই চাঁদ হাতের মুঠোয় চলে আসার দিবাস্বপ্ন যারা দেখেন তারাও অনুভূত মাদকতা পেশ করেন যদিও এতে পাড়াপ্রতিবেশী বিরক্ত হয়, আদৌ কি এই অনুভূতি আর নিমগ্রতা কিংবা মাদকতা কবিতা অথবা কবিতাসুলভ মানসবৃত্তির শামিল? সুধীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন- একটা লোকোত্তর পটভূমি না জুটলে, কবি তো কবি, খুব স্থূল অনুভূতির মানুষও বাঁচে না। অতঃপর সমীক্ষাপ্রবণ কবিমনের জ্ঞাতার্থে আবশ্যক সংবাদ হলো অনুভূতির কবিতার প্রেক্ষাপট হতে না, কখনো দ্বিধাহীন হতে পারে না বিধায় অনুভূতির বিস্তারে কবির সার্থক প্রকাশ ঘটতে পারে না। অবশ্য লোকোত্তর পটভূমি ব্যাপারটার সুরাহা হওয়া বাঞ্ছনীয়। আলবেয়ার কামুর এক বক্তব্যে এর কিছুটা হদিস মিললেও মিলতে পারে, আবার এলেইন বলেন, প্রার্থনা হলো যখন রাত্রি নেমে আসে চিন্তার ওপরে- যখন অন্ধকার বিশীর্ণতায় বস্তুর আকারে চিন্তকে গ্রাস করে এরকম রাত্রি নিশ্চই নয়; সেই রাত্রির নিজস্ব আলোকোজ্জ্বল বিভা রইবে, সেই রাত্রির অতিকায় ডানা থাকবে, চঞ্চলতা, ক্ষীপ্রতা, তীক্ষ্নতা, থাকবে যাতে ভর করবে প্রার্থীর মন, যাতে নিঃসন্দেহে আলিঙ্গন করবে তার বাহু, অতিলৌকিক তন্দ্রার মতো যা আঘাতের প্রতিকার, পীড়নের উপশম। সেই পরাজাগতিক রাত্রির অনুরাগে বিষ যাকে ছোঁবে তার নির্বিকারে জুটে যাবে লোকোত্তর পটভূমি। আমরা আলোচনার প্রেক্ষিতে বলতে পারি সমকালিন বাংলা কবিতা অর্থাৎ এই দশকের কবিতায় যতই অনাচার থাকুক ততধিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখা যায় দর্শনের পাশাপাশি আখ্যানের বিষয়টিও এখনকার কবিতার স্ট্রাকচারে মুদ্রিত হচ্ছে জোরেশোরে। বরং পরাবাস্তবতার গভীর নিনাদ যদিও উহ্যপ্রায় তবুও বিচ্ছিন্ন প্রকারে সুর রিয়ালিস্ট মানসিকতা ফুটে উঠছে অনেকের কবিতাধারায়। চমৎকার কিছু চিত্রকল্প অনুভূতির প্রগাঢ়তাকে যেমন উসকে দিচ্ছে তেমনি উঠে আসছে নির্জনতার সুধা, লৌকিক মূল্যবোধের পাশাপাশি সুশ্রী বক্তব্যও দেখা যাচ্ছে কবিতায় যা পূর্ববর্তীদের থেকে আলাদা সমকালিন কবিদের। দশক বিভাজন কবিতার আলোচনার বিষয় হতে পারে না। তবে দশক কবির বয়স ও অভিজ্ঞতা এবং দায়িত্ব অনুভব প্রকাশের মাধ্যম হতে পারে। তাই আমরা 'শিল্পরীতির ঋষি' বলে কোনো দশককে ভিত্তি করে কবিদের চিহ্নিত করতে পারি না। দেখতে পারি নির্মাণের অনুস্মরণ অনুকরণ আর উত্তরণের ক্রমাগত ধারা কতটা অংশ অনিবার্য করে আড়াল করেছে। আর এ কারণেই সময়ের প্রয়োজন। যাকে আমরা এখানে শূন্য- এবং প্রথম দ্বিতীয়দশক বলে বিবেচনা করেছি। বাংলাকবিতা আলোচনা কোনোভাবে খন্ডিত ভূগোলের ওপর দাঁড়িয়ে পূর্ণাঙ্গ হয় না আসলে বাংলা ভাষাভাষী সীমানার যে বিস্তৃতি তা পূর্বে অভিজ্ঞতা থেকে অভীক্ষা করা খুবই কঠিন। আমরা জানি সব মানুষেরই প্রাথমিক ভাবনা 'মানুষ চিন্তা' যাকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। সাম্প্রতিকালে অনেক কবির চিন্তাভাবনায় আর বক্তব্যে এমন মনে যেন কবিতার সর্বশেষ উৎকর্ষসাধিত হয়ে গেছে আর কিছু করার নেই। কবিতা একটি মৌলিক বিষয়ের উৎকর্ষ সাধন কোনোকালেই নির্দিষ্ট নয়। এটা নির্ভর করে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। শিক্ষা সাংস্কৃতিক রুচি, বয়স ও তার জেনেটিক ফ্যাক্টরের ওপর। কবি নিজেই একটি স্বয়ম্ভুসৃষ্টিকর্ম আর তাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হয় সময় আবির্ভাব হয়ে। কবির চাওয়া না চাওয়ার ওপর তা নির্ভর করে না। তবে তা ক্ষমতার ওপর নির্ভর করা যেতে পারে তাই কবির রচনা কবির যেরকম নিজের তেমনি পাঠকেরও নিজের বলে ভাবতে হবে। কবিতায় শিরোনাম জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত, কখনো ঝট করে আবার কখনো আরোপিত হয়- আরও ভীশন অদ্ভুত কোনো কোনো একটি পঙ্‌ক্তি পথের মাঝখান থেকে পাওয়া আর না পাওয়ার বেলায় চুরি করা সেই লাইন লিখে রাখতে না পারলেও অন্তত মনে রাখতে কত চেষ্টা, আর তারচেয়েও জোর করে সেটা কোথাও ফিট করতে হয়। কবি এবং কবিতার বিভাজন রেখায় যে বিবেচনা আমরা করেছি তা হয়তো পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা অনেক কবির লেখার সঙ্গে পরিচয় এবং যোগাযোগ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে যাদের লেখা গ্রন্থের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল শুধু তাদেরই স্মৃতির দৃষ্টিগোচরে আলোচনা করা সম্ভব হয়েছে। হয়তো অনেক কবি রয়ে গেলেন। অনেক কবিতাই অদেখা- তারাও তো সময়ের সারথী, ভবিষ্যৎ কাব্যের উত্তরসূরি আর কাব্যের অমোঘধারা নির্মাণকৌশলী। আমাদের আলোচ্য কবিতা সম্পর্কে তাই যথাযথ মন্তব্য অনিবার্য নয়। আজকের কবিতাকে অনেকখানি শ্রেণিকরণ করা হয়েছে- নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমানের কবিতা পড়লে আল মাহমুদ পড়া যাবে না এমন ভীমরতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমরা। হয়তো এটা আদর্শের প্রশ্ন- তাহলে আদর্শিক পার্থক্য আমাদের কাবের আঙিনা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? কিন্তু সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের কখনই দূরত্ব তৈরি হয় না। যতই সিলগালা আর ছাপ মেরে দিই না কেন এই মানসিকতা বর্জন করা প্রকৃত শিল্পীর কাজ হতে পারে না। বিভিন্ন কবি ও কবিতাতান্ত্রিক প্রসঙ্গ বিতর্কের অবতারণা করলেও বিতর্কগত অবসানের ইঙ্গিত রেখে গেছেন। এই তিন দশকের ক্ষেত্র আছে। বৈচিত্র্যহীনতা দশকের বৈশিষ্ট্য নয় কিংবা স্বতন্ত্র কাব্যচর্চা ইতিহাসে বিশেষ কোনো দশক আলোচনা হতে পারে না। আমরা পরিপ্রেক্ষিত কিছু বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতায় আর বিশিষ্টতায় তিন দশকের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছি। দৃষ্টিকোণবিচারে পূর্বোক্ত দশক থেকে তারা ভিন্ন নির্মাণশৈলীতে কী প্রতিফলন ঘটিয়েছে তা উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করা হয়েছে সংযমী আর উত্তাপহীন সময়ের মেজাজে। হয়তো এটা সময়ের দাবি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ দশকের কবিতা জীবনশূন্য আর বিভাজন দৈন্যতার বিকৃতিতে কবির মানসিকতায় প্রকাশ পেয়েছে। আবার দেখা যায় কারও কারও কাব্যদর্শন উপলব্ধির চেয়ে পারস্পরিক জ্ঞান প্রকাশের প্রবণতাই অনেক বেশি। এ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণঅভিক্ষা আর বিনির্মাণের পথ পাঠককে অনুসন্ধ্যানী করে তুলবে। আমরা তিনদশকের রূপরেখায় অনেক প্রতিশ্রম্নতিশীল আর সম্ভাবনাময় কবির সাক্ষাৎ পেয়েছি। যাদের হাতে আগামী কবিতার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণতা পাবে। এমন আশা করা যেতেই পারে। তবে এ প্রজন্মের কবিতা শূন্য থেকে প্রথম-দ্বিতীয় দশক নিঃসন্দেহে উত্থান আর বিবেচনার দশক বলা যায়। দেখা যায় পূর্বোক্ত দশকের ধারাবাহিকতা থেকে ভিন্নতা পেয়েছে বটে কিন্তু কাব্যের ভাবদর্শন, উৎস, কাব্যনির্মিতির প্রকাশ ঘটেছে প্রায় একই কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু প্রকাশভঙ্গির শৈলী আলাদা প্রকরণে ও উপস্থাপনার স্টাইল পাল্টিয়ে আলাদা হয়েছে এ সময়ে কাব্যান্দোলন আর কোনো আন্দোলনের রূপ নেয়নি। বরং কাব্যধারা আর জীবনাচরণগত বিশ্বাস, বোধ, সমকালিন নির্দিষ্টতা আর পরিবর্তিত জীবনসংগ্রাম এ সময়ের কবিতা মৌল অনুষঙ্গ। তাই এক বিশেষ চেতনাবোধে এই কবিতার পাঠ পাঠককে ভিন্ন মাত্রা দিতে পারে। কিন্তু নিটোল গদ্যছন্দের আর অন্ত্যমিলের ঝোঁক না থাকলে যারা ব্রতী হয়েছে কাব্যরচনা প্রবণতা শনাক্ত করা দুস্করও বটে। শব্দের সারল্যে স্বতন্ত্রতা দান করলে প্রকরণগতভাবে তার বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হতে পারে। প্রখর বাস্তবতায় এর স্বর প্রক্ষিপ্ত করলে কখনো নিম্নমুখী কখনো ঊর্ধ্বমুখী সূচকে দাঁড়ায়। তবে শিল্পের নান্দনিকতার ঝংকার এদের কবিতা জ্বলজ্বলে। সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রটির বিভাজন আর বিভক্তির, যোগাযোগ, সখ্য, সৌহার্দ্যের চর্চিত সমান্তরাল আলোচনা মূল কেন্দ্রবিন্দু। কবি সময়ের প্রতিনিধি। কবির অন্তর চেতনালোক আর লক্ষণ বরাবরই নতুন স্বপ্ন দেখে। তা চিন্তার আঙ্গিক ও প্রকরণে, প্রগাঢ় ও মননে রুচি অভ্যেসের রীতিতে ও বিশ্বাসে আধুনিকতায় এরা আজীবন অনুকরণীয়। এজন্যই এলিয়ট বলেছেন 'পাঠককেই হতে হবে সমালোচক আর তাকেই কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হবে কবি ও কবিতাকে নির্মোহভাবে। এবং আজকের দিনে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা-স্বীকৃতি পেতে হলে কবির থাকতে হবে মেধা ও মনন, পরিচিত হতে হবে আর জানতে হবে আপন কৃষ্টি-কালচার-সভ্যতা-ঐতিহ্য এটি কবিদের অবশ্য পালনীয়।' শিল্পকলার তুমুল আর সূক্ষ্ণতম দ্বন্দ্বমুখর প্রপঞ্চের নামই কবিতা। কবিতা কখনো বিশেষ প্রকরণে আত্মপ্রকাশ করে না। সমকালে যে কবি স্বীকৃত মহাকালে সেই কবি আবিষ্কারের নেশায় মাতাল হতে পারে না। তাই কবিতা সবসময় এবং শেষপর্যন্ত ব্যাখ্যাতীত প্রপঞ্চ হিসেবেই বিবেচিত এবং চিহ্নিত।