জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতি

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

মুস্তাক মুহাম্মদ
ধর্ম সার্বজনীন। শাশ্বত কল্যাণের জন্য ধর্ম। প্রত্যেক ধর্মের মূলে রয়েছে মানব কল্যাণ। মানবজীবন পরিচালনা করার জন্য ধর্ম। ধর্ম কোনো পরকালীন বিষয় নয়। ধর্ম ইহাকালীন। পরকালের হিসাব হবে ইহকালের ধর্ম পালনের ফলস্বরূপ। সুতরাং পৃথিবীতেই ধর্ম মানতে হবে। আর মানুষ যদি সঠিকভাবে ধর্ম পালন করে তাহলে কল্যাণকর সুন্দর হবে আমাদের এই বসুন্ধরা। ধর্ম হলো মানুষের সংবিধান। এই বিধান মেনে চললে শান্তি। শান্তি- কল্যাণের জন্য ধর্ম। আদিমকাল থেকে মানুষ কোনো না কোনো ধর্ম মেনে এসেছে। মেনে এসেছে কোনো মহাশক্তিশালী সত্তা। যিনি আমাদের সৃষ্টি করে পরিচালিত করে। বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপান্ডবের অন্যতম জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯- ১৯৫৪) কবিতায় ধর্ম এসেছে বারবার। ধর্মের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটেছে প্রকৃতির। জীবনানন্দের কবিতায় বাংলার প্রকৃতি প্রথিত আছে গভীরে। ধর্মের বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার এসেছে বাংলার প্রকৃতি। বাংলার প্রকৃতির উলেস্নখে ধর্মের অবস্থান সুদৃঢ়- মনোরম করেছেন রূপসী বাংলার তিমির হননের কবি জীবনানন্দ দাশ। হিন্দু ধর্মের অনুসারী মানুষ পুনর্জনমে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে মানুষ মরে গেলে আবার পৃথিবীতে অন্য কোনো প্রাণী হয়ে ফিরে আসবে। যদি মহাশক্তিশালী সত্তা কবিকে আবার পৃথিবীতে পাঠান তাহলে তাকে যেন এই বাংলায়- শঙ্খ-চিল-শালিখ করে পাঠান; এই প্রার্থনা করেছেন রূপসী বাংলার আধুনিক কবিতার কবি জীবনানন্দ দাশ। দেশপ্রেমিক কবি দেশকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। কবি জানেন পৃথিবীর উন্নত শক্তিশালী দেশ কারা। কোন্‌ দেশ পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে রাজত্ব করছে। কোন দেশের সম্পদ বেশি। সেই ঐশ্বর্যবান দেশ কবিকে টানেনি। তিনি সব কিছু ছেড়ে এই বাংলার সহজ-সরল মানুষ ও নির্মল সবুজ পরিবেশে ফিরে আসার আশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি সেই কথা 'রূপসী বাংলা' কাব্যের 'আবার আসিব ফিরে' কবিতায় খাঁটি দেশ প্রেমিক সৈনিকের মতো দৃঢ় কণ্ঠে ব্যক্ত করেছেন এভাবে- 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খ শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাকা হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠালছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হবো- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়, / সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে:' ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। ভারতবর্ষে এত ধর্মের মানুষ বসবাস করে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ধর্মের এত সমাহার পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষ পরস্পর মিলেমিশে বাস করে। দেখলে মনে হবে একই মায়ের সন্তান। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। সবাই মিলে বিভিন্ন উৎসব পালন করে যেমন বাংলার নববর্ষ। এত পারস্পরিক সৌহার্দ্য পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যার সময় মুসলিমের মসজিদ থেকে সুমধুর কণ্ঠে আজানও হয় অন্যদিকে একই সময় পূজার ঘণ্টার ধ্বনিও ভেসে আসে। কোথাও কোনো বিরোধ নেই। যে যার মতো ধর্ম পালন করে। সকাল-সন্ধ্যায় মুসলিম কোরআন পড়ে; পূজারী মন্ত্র পড়ে। মসজিদ-মন্দির যেন মিশে গেছে। মনে হয় একই ঘর। এমন পুণ্যভূমি আমাদের এই ভারতবর্ষ। জীবনানন্দ দাশের 'ঝরা পালক' কাব্যগ্রন্থের 'হিন্দু-মুসলমান' শিরোনামের কবিতায় সেই চিত্র আমরা দেখতে পাই- 'মহমৈত্রীয় বরদ- তীর্থে- পুণ্য ভারতপুরে / পূজার ঘণ্টা মিশিছে হরষে নামাজের সুরে-সুরে! / আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,/ মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগনে গগনে বাজে;/ জপে ঈদগাতে তসবি ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে,/ সন্ধ্যা উষর বেদবাণী যায় মিশে কোরআনের স্বরে;/ সন্ন্যাসী আর পীর/ মিলে গেছে হেথা- মিশে গেছে হেথা মসজিদ, মন্দির!' জগতে মহাপুরুষরা সমাজ সংস্কার করে। তারা প্রচলিত কুপ্রথা ভেঙে গড়ে নতুন সমাজ। তাদের হাতে নব রূপ পায় সমাজ। তাদের আলোয় আলোকিত হয় চারিচর। তারা মানবকল্যাণে অকাতরে কাজ করে যায়। তাদের সংগ্রাম সাধনায় নবরূপে জাগে সমাজ। তাদের হাতে নবরূপে সৃজিত হয় সমাজ। তারা এই জন্য দেবতা। মানুষের কল্যাণে কাজ করে তারা অর্জন করে এই দেবত্ব। তেমন একজন মহামানব স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি গেরুয়া পোশাক পড়ে উইরোপীয় দেশ পর্যন্ত জয় করেছেন। দেশপ্রেমিকের কখনো মৃতু্য হয় না। তার আদর্শ যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করে মানুষকে। তার রক্তে লেখা হয় নতুন ইতিহাস। জীবনানন্দ দাশের 'ঝরা পালক' কাব্যর 'বিবেকানন্দ' কবিতাটি সেই সাক্ষ্য বহন করে। তিনি লিখেছেন- 'চক্র গদার সাথে/ এনেছিলে তুমি শঙ্খ পদ্ম, হে ঋষি, তোমার হাতে;/ এনেছিলে তুমি ঝড় বিদু্যৎ, পেয়েছিলে তুমি সাম,/ এনেছিলে তুমি রণ বিপস্নব-শান্তি-কুসুমদাম;/ মাভৈঃ শঙ্খে জাগিছে তোমার নরনারায়ণ- নাম! / # / জয় তরুণের জয়! আত্মাহুতির রক্ত কখনো আঁধারে হয় না লয়!/ তাপসের হাড় বজ্রের মতো বেজে ওঠে বারবার!/ নাহি রে মরণ বিনাশ, শ্মশানে নাহি তার সংহার,/ দেশে দেশে তার বীণা বাজে- বাজে কালে কালে ঝঙ্কার!' জীবনানন্দের কবিতায় সনাতনী ধর্মীয় বিশ্বাসের সুর বারবার স্পষ্টত হয়েছে। কবিতার উপমা অলঙ্কারে সনাতনী মূল্যেবোধ- ঘটনা- বাংলার প্রকৃতি উপজীব্য। এই সনাতনী বিশ্বাসের সঙ্গে বাংলার প্রকৃতি মিশ্রণে জীবনানন্দের সমকক্ষ বাংলা সাহিত্যে বিরল। বাংলার প্রকৃতি মিশেছে তার ধর্মীয় বিশ্বাসে। এসেছে সনাতনী ধর্মের পেঁচা পাখি যা বিদ্যার দেবী লক্ষ্ণীর বাহন, এসেছে চাঁদ সওদাগর, বেহুলার ঘুঙুরের ঝংকার ধ্বনি। সনাতনী বিশ্বাস এবং বাংলার প্রকৃতি মিশ্রণের অপূর্ব সমন্বয় জীবনানন্দ দাশের কবিতা। 'রূপসী বাংলা' কাব্য গ্রন্থের 'শ্মশানের দেশে তুমি' কবিতায় পঙ্খি তার সাক্ষ্য বহন করে। 'শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ- বহুকাল গেয়ে গেছ গান/ সোনালি চিলের মতো উড়ে আকাশের রৌদ্র আর মেঘে-/ লক্ষীর বাহন যেই স্নিগ্ধ পাখি আশ্বিনের জোসনা আবেগে/ গান গায়- শুনিয়াছি রাখি পূর্ণিমার রাতে তোমার আহ্বান।' গ্রিক পুরানে আগুন-বাতাস-জল-মাটির দেবতা আছে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক ছিলেন। যে কারণে ইংরেজদের ধ্যান-ধারণা বিশ্বাস এসেছে তার কবিতায়। আদিম এই সব দেবতাদের অস্তিত্ব এখন আর নেই। এখন নতুন নতুন দেবতাদের আবির্ভাব হয়েছে। তারপরেও কবি স্মরণ করেছে সেই সব দেবতাদের। বহু ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে প্রকৃতির মিশ্রণের দারুণ সংমিশ্রণ কবির কবিতা। তিনি লিখেছেন- 'আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে/ তোমাকে দিল রূপ-/ কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিল তারা;/ তোমার সংস্পর্শের মানুষের রক্তে দিল মাছির মতো কামনা।' (আদিম দেবতারা: মহাপৃথিবী) মানুষ সত্য- মানুষই ধর্ম। মানুষ না থাকলে ধর্মের প্রয়োজন ছিল না। মানুষ আছে তাই ধর্ম আছে। মানুষের প্রয়োজনে ধর্মের প্রয়োজন। 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'- মানুষই ধর্ম। যুগে যুগে মহামানবরা এই মানুষের কল্যাণের জন্য কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেছে। পৃথিবী যত ধর্ম আছে সব ধর্মের একই কথা- মানুষের কল্যাণ। সব ধর্মের মানুষই পূজনীয়। যত ধর্মীয় গ্রন্থ আছে সেখানে মানুষের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে মানবকল্যাণের কথা। জীবনানন্দের কবিতায় ধর্মের কথা এসেছে বারবার। বাংলার প্রকৃতির সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের অপূর্ব সম্মিলন তার কবিতা। তবে তার কবিতায় হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে এসেছে মুসলিম, খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মের কথা। কিন্তু জীবনানন্দের বিশ্বাস ছিল মানব ধর্মে। মানুষ একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। একাত্মবাদে বিশ্বাসী কবি। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে সব প্রাণীর প্রতি তার দরদ রয়েছে। কবি সবার বেদনা ভাগ করে নিতে চেয়েছে। যথার্থ মানব দরদি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতার পরতে পরতে সেই বিশ্বাসের অনুরণন শুনতে পাই। তিনি তা ব্যক্ত করেছেন এভাবে- 'নিখিল আমার ভাই,/ -কীটের বুকেতে যেই ব্যথা জাগে সে বেদনা পাই;/ যে প্রাণ গুমরি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি,/ কোন ফণী যেমন আকাশ বাতাসে তোলে বিষ গরজানি!/ কী যেন যাতনা মাটির বুকেতে অনিবার ওঠে রণি,/ আমার শস্য-স্বর্ণপসরা নিমেষে হয় যে ছাই!/ - সবার বুকের বেদনা আমার, নিখিল আমার ভাই।' (নিখিল আমার ভাই: ঝরা পালক) জীবনানন্দ দাশ যথার্থ মানব দরদি কবি। প্রত্যেক ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি প্রকাশ করেছেন মানবের প্রতি প্রেম। যা প্রত্যেক ধর্মের মূল কথা। বাংলার প্রকৃতি তার কবিতায় বহুরূপে বহুবার (অগণিত) এসেছে। তিনি বাংলাকে ভালোবাসতেন; ভালোবাসতেন সৃষ্টিকর্তার সব মাখলুকাতকে। তবে তিনি মানুষকে পূজা করতেন। মানুষকে ভালোবাসতেন। তার এই ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। যে যে ধর্মে বিশ্বাসী হই না কোনো মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারলে মানবজনম সার্থক হবে। মানুষই বরণীয়- মানুষই পূজ্য।