অশরীরী ছায়া

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

জাহিদ হোসেন
কাইয়ুম বিএ পাস করে চাকরি খুঁজছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করে। ভাবে একটা চাকরি পেলে বাবা-মায়ের টানাটানির সংসারও চলবে, লেখাপড়াও চালানো যাবে। অনেক কসরত করে একটা বনবিভাগে সরকারি চাকরি মিলল। চাকরি হয়েছে শুনে বাবার বন্ধু তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেপে বসলেন। তাই কাইয়ুমের অমত সত্ত্বেও বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের কিছুদিন পর কাইয়ুম চাকরিতে যোগ দিল। চারদিকে ঘন বন তার ভিতর অফিস। ছাদ পেটানো দোতলা বিল্ডিং। ছাদটিও চারদিকে রেলিং ঘেরা। নিচে অফিস উপরে স্টাফদের থাকার ঘর। কিছুদূর হাঁটলেই সমুদ্র। জায়গাটায় প্রায় সময় থাকে করুণ নিস্তব্ধতায় ঠাসা। আর কিছু সময় বনজ পাখিদের দখলে। একটু দূরে ঘন জঙ্গলে বিভিন্ন প্রকার জীবজন্তর ডাকাডাকি। এ এক আলাদা জগৎ, আলাদা পরিবেশ। এখানে কবিতা লেখা যায়, তপস্যা করা যায় কিন্তু দিন কাটতে চায় না। তার ওপর বাড়িতে নতুন বউয়ের কথা মনে হতেই মনটা উদাস হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে সঙ্গীদের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে কাইয়ুম। ফজরে ওঠা, জামাতে নামাজ পড়া পরে বনের পাশ ঘেঁষে সমুদ্র কিনার ধরে হেঁটে বেড়ানো। এক দৃষ্টিতেই যেন সুদূর আফ্রিকা মহাদেশ চোখে পড়ে। সে একদিন সাগর কিনার ধরে হাঁটছিল। সূর্যটা লাল আভা ছড়িয়ে ডুবুডুবু করছে। এ সময় সে একটা আলাদা রকম শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ঠিক কীসের শব্দ তা আন্দাজ করতে না পারলেও তার কানে নূপুরের শব্দের মতো শোনাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে পিছনে পিছনে কোনো মেয়ে নূপুর পায়ে হেঁটে আসছে। পিছন ফিরে তাকালো সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। নূপুরের শব্দটাও থেমে গেল। মনের ভুল মনে করে হাঁটতে লাগল। আবার ওই নূপুরের শব্দে পেছনে কে যেন হেঁটে আসছে। এবার খুব দ্রম্নত পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল আলতা-হলুদ সুন্দরী এক মেয়ে অশরীরী ছায়া হয়ে নিমিষেই কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। খুব দ্রম্নত পা চালিয়ে অফিসে ফিরে এলো। আর ভাবতে লাগল কে এই অনিন্দ সুন্দরী মেয়ে। চরাঞ্চলের বাড়িগুলো বেশ দূরে দূরে। বর্ষার সময় পানি থৈ থৈ করে। তাছাড়া ছোট ছোট পাড়াগুলো একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব নেহাত কম নয়। তবে কোত্থেকে এলো এই সুন্দরী যুবতী। যাই হোক আস্তে আস্তে কাইয়ুম বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগলো। বনরক্ষীরা যে দিকে যেতে বাধা দেয় কাইয়ুম সেদিকেই চলতে পছন্দ করে। একদিন বনের ভিতরে চলে যায় সে। হাঁটতে হাঁটতে একটা টিলার কাছাকাছি হতেই দেখলো টিলার উপরে একটি সুন্দর পাহাড়ি ফুল। ফুলটি নেয়ার ইচ্ছে হতেই দেখলো একটা গোখরো সাপ ওঠানামা করছে। তা দেখে সে অফিসে ফিরে এলো। পরদিন একজন সঙ্গীকে নিয়ে টিলার কাছাকাছি হতেই দেখলো দু'তিনটি সাপ ওঠানামা করছে কিন্তু ফুলটি সেখানেই আছে। তারপর দিন বনরক্ষী জনাছয়েক লাঠিসোঁটা নিয়ে টিলার কাছাকাছি হতেই দেখলো অনেক গোখরো সাপ ওঠানামা করছে। তারা ফিরে এসে ফরেস্ট অফিসারকে জানালো। অফিসার সব শুনে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য মন্ত্রীর কাছে হেলিকপ্টার-গানশিপসহ কিছু সেনা সদস্যকে পাঠানোর অনুরোধ জানালো। পরদিন হেলিকপ্টার-গানশিপ নিয়ে টিলার উপরে এসে দেখলো অসংখ্য গোখরো সাপ আর ফুলটির কাছে অসংখ্য কলি বাতাসে দোল খাচ্ছে। অফিসার বলল, এরা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না বরং এরা আমাদের সমুদ্র আর বনের পাহারাদার। অতঃপর রাজধানীতে ফিরে গেল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল কাইয়ুমের। সে প্রতিরাতে স্বপ্নে সাপের মুখোমুখি হতে লাগলো। মাঝে মাঝে সে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে ওঠে। অবস্থা এমন হলো যে কিছু দিনের মাথায় কাইয়ুমের চেহারা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল। ব্যাপারটি যেহেতু অফিসের সবার জানা তাই ফরেস্ট অফিসার মানবিক কারণে এক মাসের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। স্টেশনে যখন নামলো তখন রাত দশটা। মেঘলা আকাশে তারাদের সাক্ষাৎ নেই, সেই সঙ্গে রিকশাও। বাড়ি মাইল পাঁচেক দূরে তাই হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নতুন বউয়ের কথা মনে হতেই পা দ্রম্নত চলতে শুরু করে তার। জোরে হাঁটলে ঘণ্টাখানেক লাগবে হয়তো। গ্রামের এই রাস্তাটি প্রায় জনশূন্য। খানিক দূরে গরুর খামার। সেটা পেরুলেই কুমারের বাড়ি। বাইরেই কুমারের তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, চারি সব থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে। রাস্তার পাশে একটি টং পাতানো কিন্তু লোকজন নেই। সে হেঁটেই যাচ্ছে। সামনে একটি পুরনো বটগাছ। ছোট থেকেই দেখে আসছে সে। শুনেছিল অমাবস্যা রাতে নাকি জিন-পরীরা সেখানে আসে, খেলা করে, আলো জ্বালায় এবং ভোরের আগে চলে যায়। এসব মনে হতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল কিন্তু বাড়িতে সুন্দরী নতুন বউয়ের কথা মনে হতেই আবারও দ্রম্নত পা চালাতে থাকল। বটগাছটার কাছে এসে দেখলো জিন-পরী তো দূরের কথা দু'একটা বাদুড় ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। হঠাৎ সে নূপুরের শব্দ শুনতে পেল যা সে সমুদ্র তীরে শুনেছিল। গা ছমছম করে উঠল। আলস্নাহ-রসুলের নাম নিয়ে কিছুদূর যেতেই দেখে রাস্তার পাশের জমিতে একটা তারার মতো আলো ঝলমল করছে। আর একটু এগোতেই দেখে একটা সাপ আলোটার চারদিকে ঘুরছে। আবার সে আলোয় যতটুকু দেখা যায় ততদূরে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো কাইয়ুম। তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। কুমারের বাড়িতে ফিরে গেল এবং একটা ছোট ও একটা বড় চারি নিয়ে এগিয়ে এলো। বেশ কিছুক্ষণ সাপটার গতিবিধি লক্ষ্য করে একটু দূরে যেতেই জলজল করা সাপের মণিটির ওপর খুব দ্রম্নত প্রথমে ছোট চারি ও পরে বড় চারিটি দিয়ে ঢেকে দিয়ে আবার কুমারের বাড়ির এখানে পাতানো টঙে এসে বসল। কুুমারের বাড়ির সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সে শুধু লক্ষ্য করছে সাপটা এদিকে আসে কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাতাশের চাঁদ উঠল। তখন কাইয়ুম একটা লাঠি হাতে নিয়ে এক পা দু'পা করে এগিয়ে দেখলো সাপটা চারির পাশে পড়ে আছে। নড়ছে না। তবুও কাইয়ুম সজোরে সাপের মাথায় আঘাত করতে থাকল। সাপ আগেই মরে গেছে। চারি সরিয়ে সাপের মণিটি রুমাল দিয়ে তুলে নিল। রাত প্রায় শেষের দিকে। দ্রম্নত পা চালিয়ে বাড়িতে এসে বউকে ডাকল। বউ ওঠার আগে কে যেন খাটের নিচে লুকিয়ে গেল। দরজা খুলতেই কাইয়ুম মাঝের দরজা দিয়ে ভিতরের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল আর বলল কেউ যেন তাকে ডাকাডাকি না করে। এদিকে একটা ছায়ামূর্তি খাটের নিচে থেকে বের হয়ে আমবাগানে অদৃশ্য হয়ে গেল। কাইয়ুম বাক্স খুলে রুমালে জড়ানো মণিটি বাক্সের মধ্যে ঢুকায়ে একটু জিরিয়ে নিল। তারপর বাক্স খুলতেই দেখে গোটা বাক্স টাকায় ভর্তি। বন্ধ করল আবার খুলল। কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান হলো। কাইয়ুম ঘুমিয়ে পড়লে তার বউ ঘরে ঢুকে বাক্সটা নেড়ে-চেড়ে দেখল। কাইয়ুম জেগে উঠতেই সে বাইরে চলে গেল। কাইয়ুম বাক্স খুলেই মাথায় হাত দিল। বাক্সে টাকা-পয়সা, মণি কিছুই নাই। তার মাথা খারাপের মতো অবস্থায় বিছানার ওপর বসে থাকল। সারাদিন কেটে গেল। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই। রাত নেমে এলো। কাইয়ুম পাগলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল সেখানে যেখানে সাপটা মেরেছিল। রাত গভীর থেকে গভীর হলো। পাগলের মতো চোখ ঘোরাচ্ছে কাইয়ুম। কোথাও টাকা-পয়সা বা মণির দেখা নেই। হঠাৎ আবার সেই নূপুরের শব্দ শুনতে পেল। সেই পরিচিত শব্দ। সে অন্ধকারে সেই অনিন্দ্য সুন্দর আলতা-হলুদ সুন্দরীকে দেখতে পেল। আলতা-হলুদ সুন্দরীর সারা গায়ে সোনা-দানা, মণি-মানিক্য ঝলমল করছে আর তার দিকে এগিয়ে আসছে।