স্বর্গের ফোন নাম্বার

প্রকাশ | ১৪ জুন ২০১৯, ০০:০০

ওমর খালেদ রুমি
সাবের আলীর সম্ভবত মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে তার বাসার সর্বত্র একটা ফোন নাম্বার খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার চোখে ছানি-পড়া অশীতিপর বৃদ্ধা স্ত্রী সাবেরা বেগম ভাঙা ক্যানক্যানে গলায় যখন তাকে জিজ্ঞেস করল, কি খুঁজছ? তার বিরক্তি যেন চরমে উঠল। জগতের যে আওয়াজ তার কাছে সবচেয়ে অসহনীয় ও বিরক্তিকর তা তারই স্ত্রী সাবেরা বেগমের আওয়াজ। পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী কণ্ঠের অধিকারী মানুষটির গানও সাবের সাহেব ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতে রাজি কিন্তু তিনি তার স্ত্রীর কণ্ঠটি একদম সহ্য করতে পারেন না। এই কণ্ঠের হাত থেকে বাঁচার জন্য পারলে তিনি অনেক আগে আত্মহত্যা করতেন। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ এবং কাপুরুষোচিত হওয়ায় তিনি সে সিদ্ধান্ত ত্যাগ করেন। আর এই কারণে বিগত তেষট্টি বছর তিনি এই বিরক্তিকর কণ্ঠটি সহ্য করে বেঁচে আছেন। তাদের যখন বিয়ে হয় তখন তার স্ত্রীর বয়স আঠার বছর। বর্তমানে সাবেরা বেগম একাশিতে পা রেখেছেন। সাবের আলী সাবেরা বেগমকে পছন্দ করেছিলেন স্রেফ নামের মিল থাকার কারণে। কিন্তু নামের মিলটুকু ছাড়া এক জীবনে অন্য কোনো মিল তিনি খুঁজে পাননি। পাওয়ার কথাও নয়। সাবের আলী বনেদি বংশের লোক। উদার নৈতিক মানুষ। বাপ-দাদাদের হালকা একটু জমিদারি ভাব ছিল। তিনি দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছিলেন। এক সময় স্বপ্ন ছিল ঝানু অর্থনীতিবিদ হবেন। কিন্তু যে কোনো কারণে হোক তার সে আশা পূরণ হয়নি। তবে একেবারে ব্যর্থ হননি তিনি। সরকারের বড় আমলা হতে পেরেছিলেন। তার দাপটও ছিল বেশ। বহু বছর আগে রিটায়ার্ড করেছেন। এখন বারান্দায় বসে বসে ঝিমোন। সাবের আলী ভালো গাইতে পারতেন। ছোট-খাটো কিছু গানের প্রোগামে গানও করেছেন। তাতে হাততালিও বেশ জুটেছিল। এসব যৌবনের কথা। যৌবনে মানুষ অনেক কিছু করতে সাহস পায়। যৌবন বলে কথা। সাবের আলী বরাবর স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। কি শীত, কি গ্রীষ্ম-বলতে গেলে বারো মাসই সকালে উঠে হাঁটতে বের হন। রিটায়ারমেন্টের পর তার কেন জানি কিছুই ভালো না লাগতে শুরু করে। তিনি নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যান। বারান্দায় পেতে রাখা ইজি চেয়ারে বসে শুধু ঝিমোন। আর এভাবেই তার মধ্যে আস্তে আস্তে এক ধরনের অস্থিরতা ধরা পড়তে থাকে। যা স্বাভাবিকতার সঙ্গে ঠিক যায় না। তিনি নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। ত্রিশ বছর একটা বারান্দায় বসে একা একা ঝিমোনো একেবারে সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনি তা করতে পেরে মনে মনে এক ধরনের আত্মপ্রাসাদ লাভ করতে থাকেন। এটাই তার অস্বাভাবিকতার প্রথম প্রকাশ। তার এই অস্বাভাবিকতা প্রথম ধরা পড়ে তাদের কাজের মেয়ে ফরিদার চোখে। ফরিদা কিছু একটা আঁচ করতে পেরে দৌড়ে ছুটে যায় সাবেরা বেগমের কাছে। দারুণ একটা সংশয় আর চাপা একটা উত্তেজনায় তার চকচকে চোখ আর ফ্যাশফেশে কণ্ঠে সে সাবেরা বেগমকে বলতে থাকে, খালু মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ফরিদার এই কথায় সাবেরা বেগমকে নিস্পৃহ থাকতে দেখা যায়। সে আলগোছে জবাব দেয়, বয়স হলে মানুষ অনেক কিছু করে। তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই তোর কাজে যা। কাজে ঠিকই যায় ফরিদা। কিন্তু কেন জানি কাজে তার মন বসে না। সারাক্ষণ শুধু ঘুরে-ফিরে একই ভাবনা, খালু কি পাগল হয়ে গেল। সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারান্দায় উঁকি মারে। সাবের সাহেবের অবস্থা তার কাছে অপরিবর্তিত মনে হয়। ফরিদার মন সংশয়ে ভরে যায়। ফরিদার সংশয়ের পিছনে যৌক্তিক কারণও আছে। খালুকে নিয়ে সে ততটা চিন্তিত নয় যতটা চিন্তিত তার বিয়ে নিয়ে। খালু বুড়ো মানুষ। তার বয়স হয়েছে। পাগলতো হতেই পারে। কিন্তু খালু পাগল হলে তার বিয়ে দেবে কে। আর এক মাস পরে তার বিয়ে। পাত্র তার ঠিক করাই আছে। পাশের বাড়ির ড্রাইভার কাদের। কাদের ছেলে ভালো। ভীষণ হাসি-খুশি। তবে সামান্য তেল চুরি আর ফাও ট্রিপের অভ্যাস আছে। এসব ড্রাইভারের থাকে। বিয়ের ব্যাপারে তার তেমন কোনো চাহিদা নেই। শুধু তার বাবা-মায়ের ইচ্ছা মেয়েকে যেন একটু সাজিয়ে-গুঁজিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে দেয়। তার খালু তাকে কথা দিয়েছিল, সে সবকিছুই ঠিকঠাক মতো করে দেবে। আর সেই খালুই যদি এখন এভাবে পাগল হয়ে যায় তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার চেয়েও মারাত্মক ঘটনা ঘটবে। কাদেরের বাবা-মা হয়তো অপেক্ষা করতে চাইবে না। এই সুযোগে তাকে অন্য কোথায় বিয়ে দিয়ে দেবে। এমনিতেই ফরিদাকে তাদের পছন্দ নয়। তার উপরে এমন একটা মোক্ষম সুযোগ পেলে সে অজুহাতে তারা কাদের অন্যত্র বিয়ে দিতে পারে। ফরিদার বুক ভেঙে কান্না আসে। সে কান্না তার বুকের পাটাতন ভেঙে দুকূল ছাপিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তার কি অবস্থা হবে। এই তার কপালে ছিল। যে বাড়িতে সে তার শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের প্রথম ভাগ কাটিয়েছে, যাদের সহযোগিতায় স্বপ্ন দেখেছে সংসার পাতানোর, যাদের জন্য তার শরীরের সব শক্তি ক্ষয় করেছে, যাদের ঘিরে তার সব চিন্তা-ভাবনা, সেই বাড়ির মানুষটি যদি পাগল হয়ে যায় তাহলে তার কি গতি হবে। ফরিদার কয়েক দিন আগেই এরকম সন্দেহ হয়েছিল। কারণ তার খালু ইদানীং তার সঙ্গেও কথা-বার্তা কমিয়ে দিয়েছিল। সে হঠাৎ করে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। তার কান্না শোনার মতো এখানে অবশ্য কেউ নেই। সাবের সাহেব ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। ফরিদা তবু ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ফরিদাকে অবাক করে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তার খালু মিষ্টি করে হাসে। ফরিদাও ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে মিষ্টি করে হাসে। খালু তাকে আরও অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, স্বর্গের ফোন নাম্বার কত বলতে পারিস। ফরিদা ভীষণ অবাক হয়ে যায়। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। আস্তে আস্তে সরে আসে। সে নিশ্চিত হয়ে যায় খালু তাহলে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। সাবের সাহেবের অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। তার স্ত্রী সাবেরার এসবে মন নেই। সে সারাক্ষণ অন্ধকার ঘরটায় পড়ে থাকে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে আসে না। তার প্রয়োজনও তেমন কিছু নেই। ফরিদা আর তেমন কোনো আশার আলো দেখতে পায় না। একদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ করে সে খেয়াল করে, সাবের সাহেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন। হাতের কাজ ফেলে ফরিদাও তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। সাবের সাহেব যেন তার উপস্থিতি টের না পায় তার জন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সে আগাতে থাকে। ফরিদাকে অবাক করে দিয়ে সাবের সাহেব মোড়ের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট এবং একটা দিয়াশলাই কেনেন। ফরিদা ভালো করে জানে যে তার খালুর ধূমপানের কোনো নেশা নেই। এমনকি শখ করেও কোনোদিন সিগারেট টানতে দেখেনি। খালুর কান্ড দেখে ফরিদার চোখ কাপালে উঠে যায়। তার ভীষণ ইচ্ছা করে দৌড়ে গিয়ে খালুকে সে নিরস্ত করে। কিন্তু পরক্ষণেই খালু টের পেলে বিরক্ত হবে ভেবে নিজেকে নিরস্ত করে। ফরিদা তার খালুর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। কিছু দূর গিয়ে সাবের সাহেব একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকানে ঢুকে পড়েন। ফরিদা একটু দূর থেকে লক্ষ্য করেন তিনি কি করছেন। সাবের সাহেব দোকানদারের কাছে স্বর্গের ফোন নাম্বার চেয়ে দোকানদার ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সে একটু হেসে বলে, কিছু মনে না করলে, স্যার, আপনি কি আমার সঙ্গে তামাশা করছেন। - তামাসা করব কেন? সাবের সাহেবের স্পষ্ট জবাব। - স্যার, স্বর্গের কোনো ফোন নাম্বার নেই। আপানি ভুল করছেন। - আছে। আমার কাছেই ছিল। কখন যেন হারিয়ে ফেলেছি। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার কাছে থাকলে দাও। না থাকলে না দাও। কিন্তু ফাজলামো করবে না। নাম্বারটা আমার খুব দরকার। - সরি স্যার। এই নাম্বারটা আমার কাছে নেই। - ঠিক আছে। সরাসরি না বলেছো। ভদ্রলোকের মতো কাজ করেছ। তোমাকে ধন্যবাদ। ঘোরপ্যাচ আমি একদম পছন্দ করি না। সাবের সাহেব টলতে টলতে দোকান থেকে বাইরে বের হয়ে আসেন। হঠাৎ করে বৃষ্টি নামে। ফরিদা এগিয়ে এসে হাত ধরে। প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তারপর মুষলধারে পড়তে শুরু করেছে। তারা বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। সে রাতে ফরিদার আর ঘুম হয় না। শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে স্বর্গের নাম্বারটা কোথায় পাওয়া যাবে। অবশেষে ভোর রাতে তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে তার বুদ্ধির কথা আর কাউকে বলে না। তখন তার চোখে রাজ্যের ঘুম। পরদিন দোকানে গিয়ে একটা নতুন মোবাইল কিনে নিয়ে আসে ফরিদা। খালুর হাতে সেই নাম্বারটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, খালু, স্বর্গের ফোন নাম্বার পাওয়া গিয়েছে। আপনি ফোন করেন। কথা বলতে পারবেন। সাবের সাহেব তার মোবাইলটা হাতে তুলে নেন। নাম্বার টিপতে টিপতে ফরিদা তার শোবার ঘরে চলে আসে ফরিদার নতুন মোবাইলটা বেজে ওঠে। সাবের সাহেব অতি উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, হ্যালো, এটা কি স্বর্গের ফোন নাম্বার? ওদিক থেকে ফরিদার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, হঁ্যা, এটা স্বর্গের ফোন নাম্বার। আপনাকে স্বাগতম। বলুন কি বলবেন। সাবের সাহেব আরও উৎসুক কণ্ঠে বলেন, আমার জন্য একটা ভালো সিটের ব্যবস্থা করা যাবে? - হঁ্যা, যাবে। ফরিদা উত্তর দেয়। - আর শুনুন, একটা কথা। আমার স্ত্রী যদি কোনো সিটের কথা বলে তাকে বলে দেবেন স্বর্গে আর কোনো সিট খালি নেই। শেষ সিটটা আমি বুকিং দিয়েছি। - জি স্যার। ওনার বুকিং নেয়া হবে না। আমরা মার্ক করে রাখছি। - ওকে। ধন্যবাদ। - আপনাকেও ধন্যবাদ বুকিং দেয়ার জন্য। তবে স্বর্গের তরফ থেকে আপনার প্রতি একটা অনুরোধ আছে। - কি অনুরোধ? - ফরিদা নামের যে মেয়েটি আপনাদের কাছে থাকে তার সিটটা ক্যান্সেল করে আপনাকে দেয়া হলো। এর জন্য ওর বিয়ের খরচ বাবদ এক লাখ টাকা দিয়ে দেবেন। আমরা ওটাকে আপনার সিটের মূল্য বাবদ ধরে নেব। আপনার কি আপত্তি আছে? - না। কোনো আপত্তি নেই। আমি ওকে চেক লিখে দেবো। - চেক নয়। নগদ টাকা দেবেন। বেচারির চেক ভাঙাতে সমস্যা হবে। - আচ্ছা ঠিক আছে। আলমারিতে নগদ টাকা আছে। ওখান থেকে দিয়ে দেবো। এবার তাহলে রাখি। - হঁ্যা, রাখুন। আর শুনুন, স্বর্গের নাম্বারে দ্বিতীয় বার ফোন করলে শাস্তিস্বরূপ বুকিং ক্যান্সেল হয়ে যায়। - ঠিক আছে। আর করব না। - এবার তাহলে নাম্বারটা ছিঁড়ে ফেলুন। ফরিদা কাগজ ছেঁড়ার শব্দ শুনতে পায়। তারপর আস্তে করে ফোনটা রেখে দেয়। কাদের আর ফরিদা পাশাপাশি শুয়ে আছে। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ফরিদার হঠাৎ করে সে রাতের কথা মনে পড়ে যায়। যে রাতে তার খালু রাস্তায় বের হয়ে গিয়েছিল। ফরিদা গিয়েছিল তার পিছু পিছু। ফেরার সময় বৃষ্টি নেমেছিল। প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি। তারপর মুষলধারে। ঠিক আজকের রাতের মতোই। সে রাতের মাত্র এক সপ্তাহ পরে তার খালু মারা যায়। খালাম্মা মারা যান ঠিক তার এক সপ্তাহ পরে। নামের পাশাপাশি তাদের মৃতু্যর মধ্যেও অপূর্ব একটা মিল ছিল।