লোক নাট্যদলের আমরা তিনজন

প্রকাশ | ২১ জুন ২০১৯, ০০:০০

অপূর্ব কুমার কুন্ডু
বাগান যখন আগুনে পোড়ে তখন লোকে তাকে বলে দাবানল। লোকাচারে যজ্ঞানুষ্ঠানে কাঠ-কয়লা-ঘি যখন আগুনে পোড়ে লোকে তখন তাকে বলে হোমাগ্নি। আর সৃজনশীল মানুষের অন্তরাত্মা যখন স্মৃতির আগুনে পোড়ে লোকে তখন তাকে বলে কবি আর প্রজ্বলিত আভার ন্যায় কবির রচনা কাব্য তথা কবিতা। কবি বুদ্ধদেব বসুর গল্পকে আশ্রয় করে তেমনই এক মঞ্চকাব্য নির্মাণ করলেন কবির গুণী অনুরাগী এবং যোগ্য উত্তরাধিকারী অভিনেতা-নির্দেশক-সংগঠক লিয়াকত আলী লাকী। ১৯২৭ এবং ২৮ সালে ঢাকা শহরের পুরনো পল্টনের আলোকে কবি বুদ্ধদেব বসু রচিত এক কাল্পনিক কবি বিকাশের প্রেম-প্রহসন-প্রতীক্ষা আর বর্তমানের বাস্তবতা নিয়ে গল্প অবলম্বনে মঞ্চনাটক 'আমরা তিনজন'। কর্মমুখর এবং বলিষ্ঠ নাট্যদল লোক নাট্যদল প্রযোজিত, বুদ্ধদেব বসুর গল্প আশ্রিত, দিক খুঁজে দিক চিনিয়ে দেয়ার নির্দেশক লোক নাট্যদলের প্রাণপুরুষ লিয়াকত আলী লাকী রূপান্তরিত অভিনীত ও নির্দেশিত নাটক 'আমরা তিনজন' মঞ্চস্থ হলো ১৪ জুন বাংলাদেশ শিল্পকালা একাডেমির মূল হলে। মূলকথা বিকাশ আজ তার পড়ন্ত বেলায় হুইল চেয়ারে বসে স্মৃতির ডানায় ভর করে ফিরে গেছে ১৯২৭-২৮ এর পুরানা পল্টনে। বিকাশের অন্তরাত্মার বন্ধু অসিত এবং হিতাংশু। তিন বন্ধু তিনজনকে ভালোবাসে আবার তিনবন্ধু মিলে হিতাংশুদের ভাড়াটিয়া দে বাবুর কন্যা অন্তরার প্রেমে পড়ে এবং ভালোবেসে। নাম দেয় মোনালিসা। মোনালিসা বন্ধুত্রয়ের কাছে মোনালিসার মতো রহস্যময়ই থেকে যায়। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, আচার-আচরণে মার্জিত, ব্যক্তিত্বনির্ভর অন্তরাকে বন্ধুত্রয় অনেক কায়ক্লিস্টে যখন কিছুটা কাছে পায় তখন মোনালিসা টাইফয়েডে আক্রান্ত মোনালিসার মা-বাবার পাশাপাশি বন্ধুত্রয় বিনিদ্র রজনী মাসাধিক কাল সেবা-শুশ্রূষা করে অন্তরাকে সারিয়ে তুললে সুস্ত মোনালিসা বায়ু পরিবর্তনে রাঁচি যায়। তিন বন্ধু অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে একের পর এক চিঠি পাঠায় কিন্তু কোনো প্রতি উত্তর নেই। রাঁচি থেকে ফিরতি মোনালিসাকে ট্রেনে আনতে গিয়ে তিনবন্ধু ধন্য হয় কিন্তু ফিরতি ঘোড়ার গাড়িতে হিরেন বাবুকে বিয়ে করে মোনালিসা শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। ভঙ্গুর হৃদয় নিয়ে বন্ধুত্রয় যখন দিশাহারা তখন সন্তান সম্ভাবা মোনালিসা বাপের বাড়ি ফেরে এবং সার্বিক সেবা শুশ্রূষার মধ্য দিয়ে বন্ধুত্রয় আবার খানিকটা মোনালিসার সান্নিধ্য পায়। কিন্তু সন্তান প্রসবকালে ডাক্তার-বন্ধুত্রয় সবার চেষ্টাকে অগ্রায্য করে মোনালিসা মারা যায়। বিবাগী বন্ধুত্রয় মোনালিসাকে হারানোর বেদনায় অসহায় থেকে আরও অসহায় হয়ে যায়। অসিত অসুখে মারা যায়, হিতাংশু জার্মান পৌঁছে ঘর সাজায় আর বিকাশ, বিবাগী কবিমন নিয়ে আজও মোনালিসার স্মৃতি হাতড়ে শরীরী-অশরীরী মোনালিসাকে মনোঃচক্ষে দেখার আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনে যায়। প্রহর গোনা না বরং প্রহসনমূলক অভিনয় আঙ্গিক অর্থাৎ আমি বিকাশ, আমি এখন পুরানা পল্টনে, কথা বলছি মোনালিসার সাথে' এভাবে নাটকটি উপস্থাপিত না হয়ে সংলাপ-অভিনয়-দৃশ্যকল্পে নির্মাণের মধ্যদিয়ে অনেকটা শ্রম্নতি নাটককে মঞ্চনাটকের গভীরতা দিতে পারায় নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকী বরাবরের মতোই নিজেকে অতিক্রম করে পুনঃনতুন। বুদ্ধদেব বসুর 'তপস্বী ও তরঙ্গিনী' একসময় তিনি করছেন, এখন করলেন আমরা তিনজন। যান্ত্রিক এই দেহ সর্বস্ব ভালোবাসা চাপিয়ে দেয়া ও বিপণনের কালে আত্মিক ভালোবাসা অর্থাৎ আমি একই রকম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছি এবং দেব আমার প্রেমিক অথবা প্রেমিকাকে এই মনোভাবের এবং দর্শনের নাটক মঞ্চায়ন বেদনার মধ্যদিয়ে আনন্দে অবগাহন। বিকাশ, মোনালিসাকে ভালোবেসেছে সত্যি বলেই সেসময় যেমন বন্ধুদের নিয়ে দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে পিছপা হয়নি আজও তেমনি মোনালিসার অবর্তমানে মোনালিসাকে বিকাশ ভোলেনি। আর সে কারণে বিকাশরূপী অভিনেতা লিয়াকত আলী লাকী সরাসরি স্বকণ্ঠে গেয়ে চলেন, 'যেতে যেতে একলা পথে নিভেছে মোর বাতি/ঝড় এলো এলো রে ঝড় ঝড়কে দিয়ে ফাঁকি' আর নাটকের শেষক্ষণে হুইল চেয়ার চালিয়ে চালিয়ে গেয়ে চলেন, 'তোমায় নতুন করে পাব বলে/হারাই ক্ষণে ক্ষণে ও আমার ভালোবাসার ধন'। নাসিরুল হক খোকনের আলোয় ল্যাম্পপোস্টের বাতি একাধারে যেমন বিশের দশককে মনে করিয়ে দেয় তেমনি বন্ধ-খোলার মধ্যদিয়ে দিন-রাতের ব্যবধান বুঝিয়ে গল্পের বুনন বুঝতে সুবিধা করে দেয়। সুজন মাহাবুবের সেটে গৃহের অভ্যন্তর এবং বহিঃরঙ্গের উপস্থিতি স্পষ্ট। অঙ্কিত বিপুলের প্রপস প্রতিটি প্রয়োজনীয়। ইমামুর বংশীদের আবহ এতটাই তীক্ষ্ন যেন বুড়িগঙ্গার ঢেউ, স্টিমারের বাঁশি, ট্রেনের চলার শব্দ, ঘোড়ার গাড়ির ছুটে চলা, সাইকেল চলার নষ্টালজিক সুর প্রভৃতি জীবন্ত ও আকর্ষণীয়। মেহেজাবীন মুমুর পোশাক একখন্ড অতীতকে, বর্তমানে অতীতের মতো করেই তুলে ধরে। কবি বুদ্ধদেব বসুর লেখার সঙ্গে রবিঠাকুরের গানকে মিলিয়ে দিয়ে সংগীত পরিকল্পক লিয়াকত আলী লাকী অনবদ্য। অনবদ্য তার নিদের্শনায় বন্ধুদের পথচলা, মোনালিসার ব্যক্তিত্ব, অসুস্থ সময়, ট্রেনে উচ্ছ্বাস, ঘোড়ায় দিগন্ত পার, মোনালিসার বিবাগী মন, চাপা কান্না, সংবাদ প্রদানের টানাপড়েন, ডাক্তারের আগমন, আন্তিম শয্যা, বিকাশের বিবাগী পথচলা প্রভৃতি দৃশ্যকল্প চাক্ষুষ দেখার মতো জীবন্ত, অনুভূতি সম্প্রসারিত এবং অব্যক্ত কথা রং তুলির ক্যানভাসে ব্যক্ত। ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে হিতাংশু চরিত্রে আজিজুর রহমান সুজন তিনবন্ধুর পথচলায় হাল ধরে, অসিত চরিত্রে ফজলুল হক যোগ্য সঙ্গ দেয় আর মাস্‌উদ সুমন পাওয়া আর হওয়ার মধ্যবর্তী দোটানায়। পরিণত বিকাশ চরিত্রে লিয়াকত আলী লাকীর মিনিট পাঁচেক অভিনয় নিমগ্নতায় ডুব দিতে পারলে যুবক মাসউদ সুমন জেনে যাবেন তার কী করণীয়। হিরেন বাবু রূপ জিয়া উদ্দিন শিপন মোনালিসার স্বামী হিসেবে উপযুক্ত, অঙ্কিত বিপুল ডাক্তার হিসেবে আকর্ষণীয়, গাড়োয়ান হিসেবে আলী আজম নাটকীয়, ভৃত্যরূপ শিশির অধিনস্ত, দে সাহেব চরিত্রে স্বদেশ রঞ্জন, দাশগুপ্ত বলিষ্ঠ এবং আকর্ষণীয় সুমি চরিত্রে সোনিয়া নির্লিপ্ত, আর তরু-অন্তরা তথা মোনালিসা চরিত্রে অনন্যা নিশি রজনী অবসানে রবির কিরণের মতো স্নিগ্ধ-তেজের সমন্বয়ে বর্ণিল আভায় উদ্ভাসিত। সোনাই মাধবের মতো ঝড়ো গতির প্রযোজনার পর আমরা তিনজন এর মতো এক পশলা বৃষ্টির মতো প্রযোজনা মঞ্চায়ন নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকীর পক্ষেই সম্ভব কেননা মোনালিসার রহস্য সবার পক্ষে উন্মোচন করা সম্ভব নয়। জীবনের সমান্তরাল সাহিত্যের মতোই জীবনের কঠিন সত্যের চিত্রায়ন লোক নাট্যদলের নাটক আমরা তিনজন।