কবি আহসান হাবীব আপন আলোয় উজ্জ্বল

স্বনির্মিত আলোক ভুবনের তিনি ছিলেন একক সম্রাট। প্রচুর লেখক, কবির পথ নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি তার ঋদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি ও মননের গভীর উৎকর্ষতায়।

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

বাবুল আনোয়ার
ত্রিশ-উত্তর বাংলা কবিতার এক উজ্জ্বল নাম আহসান হাবীব। চলিস্নশ দশকের শুরুতে বাংলা কবিতার যে উলেস্নখযোগ্য রূপান্তর ঘটে, সে ক্ষেত্রে যারা অগ্রসর ভূমিকা পালন করেন, আহসান হাবীব তাদের মধ্যে শীর্ষতম। ত্রিশ-উত্তর কবিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারাকে সমুন্নত রেখে আহসান হাবীব তার কবিতার নিজস্ব ভুবন নির্মাণে সফল হয়েছেন। নিজস্ব বলয়ে তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী, সৃষ্টির জন্য ব্যাকুল নিভৃতচারী একজন। নিজ স্বভাবের মতোই চুপচাপ। কবিতার ক্ষেত্রে তার নিভৃত সাধনা তাকে অভিষিক্ত করেছে সফল কবির মহিমায়। কবিতার শব্দ প্রয়োগ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ, বাক্য গঠনে তিনি যেমন ছিলেন পরিশীলিত, তেমনি সচেতনও। সমকালীন সমাজ ও জীবনের বিরুদ্ধবোধ তাকে আহত করেছে, পীড়িত করেছে, তার শুভবোধকে করেছে বিপন্ন একজন সচেতন কবি হিসেবে। আর এসবের প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতা, লেখার শৈল্পিক বিন্যাসে। তিনি এ ব্যাপারে ছিলেন অনেকটা আপসহীন, কবিতার সার্বভৌমত্বে তার আস্থা ছিল প্রবল। তার কবিতায় চলিস্নশের কাব্যচেতনার সুর নানাভাবে ধ্বনিত হলেও দেশকালের চেতনা তার কবি মানসকে সমানভাবে পস্নাবিত করেছিল। আর তার প্রকাশ ঘটে তার কবিতায়। তার কবিতায় মানবিকতার ও রোমান্টিকতার সমন্বয় ঘটে এক আশ্চর্য কুশলতায়। এটি আহসান হাবীবের কবিতার এক অনন্য বৈশিষ্ট। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক, গবেষক আহমদ রফিক বলেন, 'রোমান্টিকতা ও সমাজচেতনার সংমিশ্রণ সত্যই যদি দেশকালকে ইতিবাচক ফলপ্রসূ চরিত্রে ধারণ করতে পারে এবং সচেতন রোমান্টিকতা নামক একটি স্বাতন্ত্র্য কাব্য চরিত্রের জন্ম দিতে পারে, তাহলে আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই রাত্রিশেষ প্রথম হয়েও সেই অর্থে সবিশেষ। শুধু বইটির নামেই সমাজসচেতনতার প্রকাশ নয়, স্বদেশের কাছে ঋত স্বীকার করে তবেই রাত্রি শেষ হওয়ার স্বাপ্নিকতায় কবিতাগুলোর যাত্রা প্রহর থেকে সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণের গুণ অর্জন করেছে। যুগ চেতনার সুস্পষ্ট আভাস এদের অঙ্গে, এদের চরিত্রে। (আহসান হাবীব স্মারক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা -১১৫) আহসান হাবীব কবি হিসেবে যেমন মহৎ, তেমনি সম্পাদক হিসেবেও অনন্য উচ্চতায় নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার ব্যক্তিগত জীবনের অরূপ শুদ্ধাচার। তিনি সেই সব বিরল কবিদের একজন যিনি যাপিতজীবনে সব মিথ্যাচার, কপটতা থেকে নিজকে সরিয়ে রেখেছিলেন। প্রচার, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, অর্থ কোনো কিছুই তাকে মোহগ্রস্ত করতে পারেনি। কবি হিসেবে নিজের লালিত নৈতিকতা, সৌন্দর্যবোধ, স্বনির্মিত আলোক ভুবনের তিনি ছিলেন একক সম্রাট। প্রচুর লেখক, কবির পথ নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি তার ঋদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি ও মননের গভীর উৎকর্ষতায়। এ প্রসঙ্গে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন 'যে লেখকের মধ্যে তিনি শৈল্পিক গুণাবলির পরিচয় পেয়েছেন তার লেখা প্রকাশ করেছেন নির্দ্বিধায়, আনন্দ চিত্তে, আর যাকে মনে হয়েছে নির্গুণ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন অকুণ্ঠ নিস্ঠৃহতায়।' (আহসান হাবীব স্মারক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা -৫২) কবি আহসান হাবীবের সৃষ্টিশীলতার ভান্ডার খুব বেশি না হলেও কম নয়। ২৫টির মতো গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, শিশুতোষ রচনা, অনুবাদ রয়েছে। রাত্রিশেষ, ছায়া হরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, দু'হাতে দুই আদিম পাথর, প্রেমের কবিতা, বিদীর্ণ দর্পণে মুখ তার কবিতার বই। অন্যান্যের মধ্যে, অরণ্য নীলিমা, রানীখালের সাঁকো, বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, ছুটির দিন দুপুরে, খসড়া ইত্যাদি। পেশা হিসেবে মূলত সাংবাদিকতাই ছিল প্রধান। বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি, একুশের পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। কবি আহসান হাবীব আমাদের মধ্যে নেই। ১৯৮৬ সালের ১০ জুলাই তিনি পাড়ি জমিয়েছেন মহাকালের পথে। বড় বেশি আপন ছিলেন তিনি বাংলা কবিতার, এ দেশের কবি, সাহিত্যিকদের কাছে ছিলেন আলোর অগ্রজ নির্দেশক। তার কবিতার ভাষায় বারবার মনে সেই সব অমিয় শব্দমালা- আমি কোন আগন্তুক নই আমি ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে এখানে থাকি আর এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা সারা দেশে। (আমি কোন আগন্তুক নই) মাথাভর্তি সেই ধবধবে চুলের শান্ত মুখাবয়বের কবি আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না। কিন্তু তার সৃষ্টির মধ্যদিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অমর হয়ে আছেন, থাকবেন চিরকাল।