কবিতায় বর্ষা

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

শাহরিয়ার সোহেল
রূপবৈচিত্র্যে বর্ষা অতুলনীয়। বর্ষাকাল বাঙালি জাতির প্রাণের ঋতু। ভালোবাসার সিক্ত স্পর্শে আরও বেশি সজীব-প্রাণবন্ত। বর্ষা মানব মনে সঞ্চার করে অনন্ত বিরহ-বেদনা-সুখ। মনকে উদ্ভাসিত করে অনন্ত সৌন্দর্যলোকে। বর্ষার এক প্রান্তে সৃষ্টি-সৃজনের প্রাচুর্য আর অন্য প্রান্তে ধ্বংসের প্রলয় তান্ডব। এক চোখে অশ্রম্ন, অন্য চোখে হাসি। বর্ষা চির আদরের ঋতু, কখনো কখনো বেদনার। বাংলাসাহিত্যে বর্ষা বহুরূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এমন কোনো কবি পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার, যে জীবনে অন্তত দু'একটি কবিতা বর্ষা নিয়ে লেখেনি। বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পার হয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বহু কবি বর্ষা নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কবিতা লিখেছেন। বর্ষা আমাদের মনকে প্রয়োজনের জগৎ থেকে নিয়ে যায় অনন্ত অভিসারে অন্য কোনো খানে। আমাদের মন সেখানে যেয়ে হারিয়ে যায় অন্য ভুবনের মনোলোভা সিক্ত আশ্রয়ে। বর্ষার স্নিগ্ধ-সজল-লাবণ্যময় মায়াঞ্জনে কবিদের হৃদয় যুগে-যুগে হয়ে উঠেছে উদ্বেলিত-উচ্ছ্বসিত। চির সৌন্দর্যের অলকাপুরীতে কবি মন যাত্রা করে নিবিড় শান্তির সন্ধানে। সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ পথে শান্তির পশরা সাজায়। ভাবের প্রাচুর্যে-ঐশ্বর্যে-শ্যামলে-সবুজে ভরে ওঠে সাহিত্যের দশ-দিগন্ত। কবি জয়দেব মেঘমেদুর অম্বরের কথা বলেছেন। বৈষ্ণব কবিগণ বর্ষার গম্ভীর পরিবেশে রাধিকার বর্ষাভিসারের চিত্র অঙ্কন করেছেন। 'ঘনঘন ঝনঝন বজর নিপাত'-বর্ষণ মুখর অন্ধকারে 'এ ভরা বাদল মাহ ভাদর'- এর শূন্যতার ভেতর অনন্তের সন্ধান করেছেন। মঙ্গল কাব্যের কবিগণ এঁকেছেন বর্ষার দুঃখের ছবি। বর্ষায় কবি মন যাত্রা করে চির সৌন্দর্যের অমরাবতীতে। পরিচিত জগৎ-সংসারের বন্ধন তখন তুচ্ছ হয়ে যায়। মনে পড়ে প্রিয় বেদনার কথা। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে জন্যই হয়তো বলেছেন, 'এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরষায়।' কবির দৃষ্টিতে বর্ষা গভীর অর্থব্যঞ্জনায় বিধৃত। এ দিনে মন উদাস হয়। মন কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়! কবি আরও বলেছেন, 'আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ঝরঝর মুখর বাদল দিনে।' বিদ্রোহী ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষাকে চঞ্চলা মেয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কাশ ফুলের নরম ছোঁয়ায় সে সৌন্দর্য বিকশিত হয়। বর্ষায় কাননে কদম ফোটে। সে অপরূপ সৌন্দর্যের কথা কবি চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। বর্ষার রিমঝিম নৃত্য কবিকে সচকিত করে, আনন্দে উদ্বেলিত করে, উদ্ভাসিত করে মনের অবগুণ্ঠন। তিনি বলেছেন, 'ওগো ও কাজল মেয়ে উদাস আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে কাশফুলসম শুভ্র ধবল রাশরাশ যেত মেঘে তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে ওগো ও জলের দেশের কন্যা তবও বিদায় পথে কাননে কাননে কদম কেশর ঝরিছে প্রভাত হতে \হতোমার আদরে মুকুলিতা হয়ে উঠিল যে বলস্নরী তরুণ কণ্ঠে জড়াইয়া তারা কাঁদে দিবানিশি ভরি।' কবি সুফিয়া কামাল তার বহু কবিতায় প্রকৃতির বিদগ্ধ রূপ প্রকাশ করেছেন সযত্নে। প্রায় সব ক'টি ঋতু নিয়েই কবি কবিতা লিখেছেন। বর্ষা অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষিত-প্রত্যাশিত। গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমের পর বর্ষা আমাদের মনে ও শরীরে আনে পুলকিত শিহরণ। বর্ষার অনবদ্যতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 'আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি মায়ার কাজল চোখে মমতায় বর্মপুট ভরি।' কবি অমিয় চক্রবর্তী বর্ষাকে অস্তিত্বের অতলান্তে নিয়ে গেছেন। বৃষ্টি ঝরে মাঠে, ঘাটে, বন্দরে, মরুতে, বনতলে, গূঢ় প্রাণে, শিরায়-শিরায়, মনের মাটিতে। সর্বত্র বর্ষা যেন গ্রাস করে সকল অস্তিত্ব, আমাদের প্রাণের ফসল। বর্ষা নামে দিগন্তের দশ দিক জুড়ে। তিনি বলেছেন, 'অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে, বৃষ্টি ঝরে রুক্ষ মাঠে, দিগন্ত পিয়াসী মাঠে স্তব্ধ মাঠে, মরুময় দীর্ঘ তিয়াষার মাঠে, ঝরে বনতলে, ঘন শ্যাম রোমাঞ্চিত মাটির গভীর গূঢ় প্রাণে, শিরায়-শিরায় স্নানে, বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে।' কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বর্ষার আকাশকে প্রকাশ করেছেন চমৎকারভাবে। বর্ষায় আকাশের রঙ-রূপবৈচিত্র্যে ভরপুর থাকে। মাঝে মাঝে রঙধনু ওঠে। আকাশে যেন বিভিন্ন বর্ণের মেঘের খেলা চলে। বিভিন্ন সময় মেঘের বিভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়। এ যেন আনন্দের পশরা। আকাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধূসর কৃষ্ণ মেঘপুঞ্জের ঘনঘটা সকলকে মুগ্ধ করে, কাছে টানে অন্য এক অজানা আকর্ষণে। তিনি বলেছেন, 'শ্রান্ত বরষা, অবেলায় অবসরে প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া; স্বর্ণ সুযোগে লুকোচুরি খেলা করে গগনে গগনে পলাতক আলো-ছায়া।' কবি বুদ্ধদেব বসু বর্ষায় মেঘের কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছেন। কবির হৃদয়ে বর্ষার আবেদন গভীর। মেঘের বুকও কবির হৃদয়ের মতো দুরু-দুরু কেঁপে ওঠে। বর্ষার দিনে মনের গহিনে গুনগুনিয়ে ওঠে বিগত দিনের স্মৃতি। স্মৃতি রোমন্থন করাও বর্ষার দিনে একটি অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। দুঃখই যেন স্মৃতিপটে ভেসে আসে। কবি আবেগঘন কথা এভাবে ব্যক্ত করেছেন, 'নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে \হজোয়ার এলো জলে; আকাশ ভরা মেঘের ভারে বিদু্যতের ব্যথা গুমড়ে উঠে জানায় শুধু অবোধ আকুলতা।' বর্ষণমুখর দিন স্মৃতি-বিস্মৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ। দুঃখের স্মৃতিই ভেসে আসে মনে বারে বারে। শ্রাবণের আকাশে মেঘ মঞ্জরি জটলা পাকায়। ঘন ঘন বিদু্যৎ জ্বলে ওঠে। নির্দয় স্মৃতিগুলিও জেগে ওঠে করোটিতে। বর্ষায় যতদূর দৃষ্টি যায়, আকাশে বিস্তার করে থাকে পাংশুটে মেঘের জাল, প্রকৃতি নিথর নিস্তব্ধ। ঘরে বসে স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া যেন আর কিছুই করার থাকে না। কবি শামসুর রাহমান বলেছেন, 'শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায় \হমেঘ ময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদু্যৎ জ্বলে মিত্র কোথাও আশপাশে নেই শান্তি উধাও নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে।' \হরোমান্টিক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বৃষ্টির ভেতর রমনীয় আল্পনা এঁকেছেন। বৃষ্টিতে মানবীয় মুখ কেমন দেখায়, কেমন রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে, তা বর্ণনা করেছেন নিঁখুতভাবে। বৃষ্টি হয়ে ওঠে চাঞ্চল্যকর রোমান্টিক উপমা। কবি বৃষ্টি বিধৃত গোধূলী ও সন্ধ্যার বর্ণনা দিয়েছেন চমৎকারভাবে। 'বাইরে বৃষ্টি, বিষম বৃষ্টি, আজ তুমি ঐ রূপালি শরীরে বৃষ্টি দেখবে প্রান্তরময়, আকাশ মুচড়ে বৃষ্টির ধারা... আমি দূরে এক বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছি, একলা রয়েছি ভিজেছে আমার সর্ব শরীর, লোহার শরীর, ভিজুক আজকে বাজ বিদু্যৎ একলা দাঁড়িয়ে কিছুই মানি না, সকাল বিকেল খরচোখে আমি চেয়ে আছি ঐ জানলার দিকে, কাচের এ পাশে যতই বাতাস আঘাত করুক, তবুও তোমার রূপালি চক্ষু- আজ আমি একা বৃষ্টিতে ভিজে, রূপালি মানবী, দেখবো তোমার বৃষ্টি না ভেজা একা বসে থাকা।' বৃষ্টির সময় যাত্রীদের খুব ক্লান্তিকর ও বিরক্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। যারা মোটর যানে চড়ে বসে তাদের বিশেষ সমস্যা না হলেও নামার সময় বা যানে ওঠার সময় বেশ বিরক্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হয় যাত্রীরা। তবু বৃষ্টিতে যাত্রা নান্দনিক- আনন্দের ফলগুধারা। চারিদিকে জল আর জল, যেন হিংস্র থাবায় সব কিছু এলোমেলো করে দেয়। কবি শহীদ কাদরীর ভাষায়, 'বৃষ্টি পড়ে মোটরের বনেটে টেরচা \হভেতরে নিস্তব্ধ যাত্রী, মাথা নিচু ত্রাস আর উৎকণ্ঠায় হঠাৎ চমকে দ্যাখে জল-অবিরল জল, জল, জল তীব্র, হিংস্র, খল।' কবি মহাদেব সাহা তার প্রিয়তমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে নিষেধ করেছেন। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে প্রিয়তমার অসুখ হতে পারে, ঠান্ডা লাগতে পারে, জ্বর আসতে পারে। এসব কবির ভালো লাগবে না। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে প্রিয়তমার শরীরের আদলের পরিবর্তন হবে, কবির এ সব সহ্য হয় না। রোমান্টিক বৃষ্টি কখনো কখনো করুণ কাতরও হয়ে ওঠে। বৃষ্টিতে গলে যাবে মাধবী। তাই কবির এত উৎকণ্ঠা, 'ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্স্নান হয়ে যাবে তোমার শরীর এ বৃষ্টিতে ঝরে যদি কারো হৃদয়ের আকুল কান্না, শোকের তুষার গলে গলে যাবে এই বৃষ্টির হিমে তোমার কোমল দেহের আদল মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে যেও না মাধবী তুষারপাতে বাইরে যেও না।' বাংলার কবিগণ প্রত্যেকে বৃষ্টি নিয়ে একাধিক কবিতা লিখেছেন। বৃষ্টিকে কেউ রোমান্টিক, কেউ যন্ত্রণাদায়ক, কেউ উৎপীড়ক, কেউ অত্যন্ত আদরণীয় বলে মনে করেন। সব কিছুর পরও বৃষ্টি অত্যন্ত নান্দনিক ও রোমাঞ্চকর, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কবিগণ বৃষ্টিকে নিয়ে যত কবিতা লিখেছেন, অন্য কোনো ঋতু নিয়ে এত বেশি কবিতা লেখেননি। বৃষ্টিতে প্রাণের গহিনে আনন্দের উৎসারণ ঘটে, দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে অন্য এক অনুভূতি। বৃষ্টির ছোঁয়া হৃদয়কে করে প্রশমিত। স্বর্গীয় এক সুধাধারা নেমে আসে অন্তরে। কবি বৃষ্টির ফোঁটায় নিজেকে স্নাত করে স্বর্গীয় সে অমিয়ধারা পান করেন; এবং সকলের মাঝে সে সত্যকে প্রকটিত করে তোলেন। অন্যের সাথে সুখ ও দুঃখের সংযোজন ঘটান অতি আদরের সঙ্গে। কবির চিন্তা হয়ে ওঠে সর্বজনীন। শ্রাবণের জোসনা রাতে যদি বৃষ্টি ঝরে ঝর ঝর করে, ঈষৎ পূর্ণিমার আলোয় তা বড়ই মনোমুগ্ধকর। অমাবস্যায় বৃষ্টির রূপ বেশ ভয়াল- সর্বগ্রাসী। বৃষ্টিতে জানালায় চোখ রেখে কেটে যায় দীর্ঘক্ষণ। স্মৃতি-বিস্মৃতির বেড়াজালে উপমা-চিত্রকল্পে ভরপুর হয়ে ওঠে বৃষ্টির স্নিগ্ধতা-কোমলতা। বৃষ্টির সুধা চোখ-মুখ ভেদ করে ঢুকে যায় অন্তরের গহিনতম প্রকোষ্ঠে। কবিগণ সেই গহিন জলের স্রোত উপমা-চিত্রকল্পের মাধ্যমে একান্ত নিবিড়ভাবে উপহার দেন সমগ্র পৃথিবীকে।