নেশা

প্রকাশ | ১৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

মঈনুদ্দিন কাজল
তমা খুব খুশি পলাশকে পেয়ে। দেখতে ফর্সা সুদর্শন, পলাশ অত্যন্ত দায়িত্বশীল। সংসারে অভাববোধ করার আগেই প্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়ে যায় তমা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি করে পলাশ। শান্তস্বভাবের রুচিশীল পলাশ ঘরমুখো, সাংসারিক যা তমাকে করেছে সুখী। ছুটির দিনগুলোতে তমাকে নিয়ে দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাওয়া, ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া পলাশের পছন্দ। তমা-পলাশের রুচি ও স্বভাবে রয়েছে দারুণ মিল। অফিস থেকে যথাসময়ে নিয়মিত বাসায় ফেরে পলাশ। সুন্দরী লাবণ্যময়ী তমাকে বিয়ের পর থেকেই ভালোবেসেছে পলাশ। তমা সত্যি অনেক গুণী। সংসারের যাবতীয় কাজ অতি দ্রম্নত সেরে নিতে পারে সে। কাজের মেয়ের অপেক্ষায় না থেকে নিজের হাতেই সংসার সাজাতে গোছাতে পটীয়সী তমা। চটজলদি রান্না করা, নাশতা তৈরি করে হাসিখুশি থাকে। গায়ের রং যেমন ফর্সা তেমনি হালকা-পাতলা গড়নের সাজসজ্জায় পরিপাটি তমাকে পছন্দ পলাশের। সকাল ৯টা বেজে গেলেও পলাশ ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তমা স্নান সেরে নাশতা তৈরি করে দেখে, পশাল তখনো ঘুমিয়ে। পলাশ...পলাশ ওঠো ৯টা বেজে গেছে, আর কত ঘুমাবে। আজ ছুটির দিন একটু ঘুমিয়ে নিই। আর ঘুমোতে হবে না, নাশতা তৈরি। আজ খুব আসলে লাগছে। কেন? আমি খুব ক্লান্ত। দুষ্টুমি রাখো... বলেই তমা ভেজা চুলের পানি পলাশের চোখে-মুখে ছিটাতে থাকে। কী করছ তমা? ঠিক-ই করছি-উঠছ না কেন? এই তো উঠছি বলেই পলাশ তমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলে তমা এক ঝটকায় ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলে, দুষ্টুমি আর কত, নাশতার টেবিলে এসো। নাশতা খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পলাশ তমাকে বলে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। কেন? বাইরে বেড়াবো, খাবো। বাইরে আর কত? প্রতিটি ছুটির দিনেই তো বেড়ানো আর খাওয়া। ঘুরলে ও খেলে অসুবিধা কী? আমরাই তো ঘুরছি, খাচ্ছি। শুধু ঘুরলে আর খেলে কী চলবে? ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবেছ। কী ভাবনা? সামনে সংসারে খরচ বাড়বে। কেন? বোঝ না সংসারে খরচ কেন বাড়ে? বুঝলাম না। তমা পলাশের অনেকটা কাছাকাছি কানের সামনে মুখ নিয়ে বলে, নতুন অতিথি আসছে সংসারে। বল কী? এ তো খুশির সংবাদ। আর তুমি কিনা এ সুসংবাদটি আমাকে এমন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জানালে। পলাশ তমাকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ আনন্দ প্রকাশ করে বলে, এই খুশির সংবাদে আমার মন ভরে গেল তমা। শুধু মন ভরলে চলবে না, এখন থেকে একটু হিসেব করে চলতে হবে। তমা তুমি চিন্তা করো না। আমি প্রতি মাসে আমার বেতন থেকে পাঁচ হাজার টাকা ডিপিএস করে সঞ্চয় করছি, তা তিন বছর হতে চলল। তাই নাকি? হঁ্যা, তাই। আমি জানি এবং বিশ্বাস করি তুমি অনেক দায়িত্বশীল। তবুও বললাম এখন থেকে আমাদের সাশ্রয়ী হয়ে চলা দরকার। ঠিক বলেছ। অনাগত অতিথির জন্য এখন থেকে আমাদের ভাবতে হবে। ঠিক আছে আজ বাইরে যাব না, বাসায় তোমার হাতের রান্না খাব। পলাশ ও তমার সংসারকে আলোকিত করে একটি পুত্রসন্তান আসে। সেই আনন্দ ও উলস্নাসে ওরা ভীষণ পুলকিত। খুশির হাওয়া বইছে ওদের হৃদয় আঙিনায়। পুত্রসন্তান পেয়ে সুখের স্বর্গ নেমে আসে ওদের ঘরে। আনন্দে আত্মহারা পলাশ ছেলের সঙ্গে খেলা করতে, আদর করতে যেন ব্যাকুল। তাই কখন অফিস শেষ হবে সেই অপেক্ষায় প্রহর গোনে সারাক্ষণ। অফিস শেষে দ্রম্নত ছুটে আসে বাসায়। পলাশের ইচ্ছা হয় সারাক্ষণ স্নেহের পরশ বুলিয়ে নিবিড় মমতায় ছেলেকে আদর করে, যত্ন করে, খেলা করে হাসিখুশিতে ব্যস্ত থাকতে। তাই অফিসের কাজে ঠিকমতো মন বসে না পলাশের। ছেলের কী চাই, কী লাগবে এই নিয়ে তমাকে অস্থির করে রাখা। সন্তানের সেবাযত্নে সারারাত জেগে থাকা। পলাশের এই সব কান্ড-কারখানা তমার ভালোই লাগে। এভাবে কেটে যায় বেশকিছুটা সময়। বড় হতে থাকে পলাশ ও তমার একমাত্র সন্তান শুভ্র। সময়ের পরিক্রমায় হঠাৎ পলাশ বদলে যেতে থাকে। প্রায়ই রাত করে বাসায় ফেরা, বাইরে থেকে খেয়ে আসা, চিন্তামগ্ন থাকা, তমাকে ভাবিয়ে তোলে। হঠাৎ করে পলাশের এমন বদলে যাওয়ায় তমাকে করে তোলে অস্থির, চিন্তামগ্ন। সকালে নাশতার টেবিলে তমা পলাশকে প্রশ্ন করে, কী হয়েছে তোমার? কই না তো, কিছুই হয়নি। কিছু একটা তো হয়েছে। চুপ করে আছো কেন? কথা বলো। কী বলব? বলো তোমার কী হয়েছে? কোনো সমস্যা? বললাম তো কিছুই হয়নি আমার। বললেই হলো? তাহলে তুমি দিন দিন বদলে যাচ্ছো কেন? কোথায় বদলালাম। আমি তো আগের মতোই আছি। আগের মতোই আছো তাই না, তাহলে প্রতিদিন অফিস থেকে অতো রাত করে আস কেন? অফিসে ভীষণ কাজ। মানলাম অফিসে কাজ। বাসায় এসে খাও না কেন? আমার হাতের রান্না কী আর ভালো লাগে না? অফিসেই খেয়ে নিই। অফিসে কেন খাবে? তোমার কী ঘর নেই, স্ত্রী-সন্তান নেই। কী বলছ এসব। ঠিকই বলছি। আমাকে তো দূরের কথা, তুমি আজকাল তোমার আদরের সন্তানকে তেমন সময় দিচ্ছ না, ভুলে যাচ্ছো। কী, মিথ্যে বললাম। তমা তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। ভুল বুঝি নাই পলাশ। তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো, তুমি আর আগের মতো নেই। তুমি বাইরে থেকে খেয়ে আস। আমরা কী খাচ্ছি, আমাদের কী লাগবে, সেদিকে তোমার কোনো খেয়াল নেই। সকালে নাশতা খেয়ে বেরিয়ে যাও, ফিরে আস অনেক রাতে। কেন সেদিনই তো বাজার করলাম। তুমি ভুলে গেছ পলাশ। বাজার করেছ দশ দিন হয়েছে। আমি অভাবে আছি হাতে টাকা নেই। কেন? অভাবে কেন? হঠাৎ অভাবের কারণ কী? খরচ বেড়ে গেছে। তার মানে? অফিস থেকে যে বেতন দেয় তাতে চলে না। তুমি মিথ্যে বলছ। এতদিন চলত কীভাবে? ধার দেনা করে চালিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি না। আমাদের খরচ এমন কিছু বেড়ে যায়নি যে তোমাকে ধার-দেনা করে চলতে হবে। তুমি মিথ্যে বলছ। তমার এই কথার কোনো উত্তর নেই পলাশের কাছে। সে চুপ হয়ে যায়। পলাশ নাশতার টেবিল থেকে দ্রম্নত উঠে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। অফিসে গিয়ে কাজে মন বসে না পলাশের। অফিস রুমেই পায়চারী করতে থাকে। তমার কথাগুলো ওকে ভাবিয়ে তুলেছে। তমা কী তাহলে সবকিছু জেনে ফেলেছে। তমা যেভাবে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করেছে তাতে মনে হয় ও সবকিছু জানে। পলাশ ভাবে, তবে কী সে ধরা পড়ে গেছে। বন্ধুদের কাছ থেকে পলাশ অনেক টাকা ধার নিয়েছে। এরই মধ্যে সঞ্চয় করা ডিপিএসের সব টাকা শেষ করেছে। হাতশূন্য পলাশের টাকার নতুন কোনো উৎস নেই। বরং পাওনাদারদের চাপ ওকে দিশাহারা করে তুলেছে। পলাশ ভাবে তবে কি সবকিছু তমাকে খুলে বলা দরকার কিন্তু পরক্ষণে চিন্তা করে তমাকে কী করে এ কথা বলবে সে। তমা কী ভাববে। এ লজ্জার কথা তো বলার নয়, বলা যায় না। অফিস শেষ করে পলাশ প্রতিদিনের মতো বন্ধু শিমুলের বাড়ির ছয় তলার চিলেকোঠায় উপস্থিত হয়। বন্ধুরা তাকে বলে, টাকা এনেছিস? না। তাহলে তোকে খেলায় নেয়া হবে না। কেন? শিমুল বলে, ধার নিয়ে আর কত খেলবি? আজকের মতো দে, আমি তোদের ঋণ পরিশোধ করে দেবো। আজ আমি ঠিকই জিতব। তুই জিতবি মনে হয় না। কেন? প্রতিদিনই তো হারতে থাকিস। হারতে হারতে একদিন জিতবই। মনে হয় না বন্ধু তুই জিতবি, শিমুল বলল। পলাশ বলল, আমাকে জিততেই হবে। ঠিক আছে তোর মনে যখন এতই জোর তবে খেলতে বস, শিমুল বলল- ওরা চার বন্ধু প্রতিদিনের মতো নেশায় মগ্ন হয়ে তাস খেলছে। রাত বাড়তে থাকে। তাসের খেলায় পলাশ ভুলে যায় স্ত্রী ও সন্তানের কথা। খেলতেই থাকে। খেলা চলছে। তিন তাসের খেলা। তাস যেন ওর সবকিছু। তাস সঙ্গী, তাসই জীবন। সময় যায় খেলা চলে। তাসের খেলা চলছে। রাত হয় গভীর। খেলা চলছে। আজ পলাশ ভুলে যায় বাড়ি ফেরার কথা। খেলা চলছে। গভীর রাত অব্দি পলাশ বাসায় না ফেরায় তমা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। পলাশের মোবাইল বন্ধ পায়। পলাশের সন্ধানে মন উচাটন হয়ে পড়ে তমার। পলাশের খোঁজ নিতে তমা অফিসের অনেকের কাছেই ফোন করে। অনুসন্ধানে এক সময় জানতে পারে পলাশের অবস্থান, শিমুলের বাড়ির ঠিকানা। তমা গিয়ে উপস্থিত হয় শিমুলের বাড়ির ছয় তলার চিলেকোঠায়। তমাকে দেখে চমকে উঠে পলাশ বলে, তমা তুমি এখানে? হঁ্যা আমি এখানে, অবাক হচ্ছো তাই না। এটাই তোমার অফিসের কাজের চাপ। তুমি ভেবেছো আমি জানতে পারব না তোমার এই ঠিকানা। বাহ্‌ পলাশ বাহ তুমি এখান থেকে চলে যাও পিস্নজ। চলে যাবো তোমার জীবন থেকে চলে যেতেই এসেছি। তোমার সাথে আর নয়। এই রইল তোমার সন্তান। আমি চললাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে পলাশ। কী করবে ভেবে পায় না সে। তাসের নেশায় ছন্দপতন ঘটে। সন্তান শুভ্রকে কোলে নিয়ে তমাকে ডাকতে থাকে, দাঁড়াও তমা...তুমি একা যেও না...আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও।